নতুন স্কুল

বছরের শুরুতে নতুন স্কুলে ভর্তি হযে়ছে রাসেল। স্কুলের সবাই অপরিচিত। তবুও ক্লাস রুম, খেলার মাঠ আর স্কুলের চারপাশে লাগানো নিমগাছগুলো ভালোই লাগছে ওর কাছে। পুরনো স্কুলে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পডে়ছে। সমাপনী পরীক্ষায় ভালো রেজাল্টও করেছে ও। পুরনো বন্ধুদের হারিযে় রাসেলের যতটা কষ্ট আছে তার চেযে় বড় কষ্ট ওই স্কুলের খেলার মাঠকে নিযে়। চারদিকে ইটের দেয়ালের ভেতর মাঠে খেলা করতে কতই না আনন্দ ছিল! ফুটবল আর ক্রিকেট কী। বল মাঠের বাইরে যেতে পারত না। কতই আনন্দ হতো পুরনো স্কুলেই থাকলে। মনে মনে ভাবে রাসেল। দুরন্ত রাসেল বইযে়র পাঠে যতটা পারদর্শী তেমনি খেলার মাঠেও সমান পারদর্শী । বাবা মাযে়র একমাত্র সন্তান হিসেবে আদর হয়তো বা একটু বেশিই পাচ্ছে। তাতে কী। স্কুলের প্রতিটি ক্লাসে প্রথম সারির ছাত্র হিসেবে রযে়ছে বেশ সুনাম। আর সমাপনী পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করে সাফল্যের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রেখেছে। নতুন স্কুলের সাথে সাথে অনেক কিছুই নতুন পেযে়ছে। নতুন বই, নতুন পোষাক নতুন কিছু খেলনার জিনিস। সমাপনী পরীক্ষার পূর্বে বাবার কাছে বায়না ধরেছিল ভালো রেজাল্ট করতে পারলে একটি কম্পিউটার কিনে দিতে হবে। বাবা তামীম রায়হান হুবহু কথাটি না রাখলেও অষ্টম শ্রেণির জুনিয়র পরীক্ষা পর্যন্ত সময় নিলেন। সাথে এও বলেছেন এতো ছোট বয়সে কম্পিউটার কিনে দিলে পড়ালেখার ক্ষতি হবে। মাযে়র সম্মতি ছিল এবারই যেন কিনে দেয়ার। রাসেল প্রথমে অভিমান করে থাকলেও বাবার যুক্তির কাছে হার মানতে বাধ্য হয়। আর বাধ্য হবেই না কেন? বাবা কী তার ছেলের অকল্যাণ চাইতে পারেন। পৃথিবীর সব বাবার মতো রাসেলের বাবাও তার সন্তানের মঙ্গল চান। রাসেলকে ওর বাবা অনেক আদর করেন। রাতে ঘুমানোর পূর্বে অনেক গল্প বলেন, বড় মানুষ হওয়ার স্বপ্ন দেখান। রাসেল ওর বাবার কাছে জানতে চায়—
‘আব্বু তুমি ভালো রেজাল্ট করতে পারলে তোমাকে দাদা কিছু কিনে দেয়ার কথা বলেননি?’
ছেলের মুখে এমন প্রশ্ন শুনে তামীম রায়হান সেই শৈশবের কাছে ফিরে যান। তার বাবার অনেক স্মৃতি মনে পডে় যায়। রাসেল এখন যেমন সুযোগ সুবিধা পাচ্ছে তামীম রায়হান এমনটি পাননি। তারপরও তার বাবা ভালো রেজাল্ট করতে পারলে মোটর সাইকেল কিনে দেয়ার আশ্বাস দিযে়ছিলেন। ভালো রেজাল্ট করেছিলেন প্রতিটি ক্লাসে কিন্তু শেষ পর্যন্ত মোটর সাইকেল পাননি। রাসেল বাবার মুখে এসব কথা শোনার পর ওর খারাপ লাগে। রাসেল বলে—
‘বাবা আমি চাকরি করে তোমাকে মোটর সাইকেল কিনে দিব।’
তামীম রায়হানের নিজের অজান্তেই চোখের কোণে পানি জমতে থাকে। রাসেল বাবার দিকে তাকিযে় থাকে। বাবাকে এখন কী বলবে ভেবে পায় না। এ মুহূর্তে রাসেল যেন ওর বাবার কষ্টটা বুঝতে পেরেছে। মাঝে মাঝে বাবা আর ছেলে গল্প করে। তামীম রায়হানও তার ছেলেকে নিযে় ভাবেন। তার ছেলেকে মাঠে খেলতে দিতে চান। শহরের ভেতর সব স্কুলের খেলার মাঠ নেই। নতুন স্কুলেও যেটুকু আছে তাতে স্বল্প পরিসরে খেলাধুলা করা যায়। মন্দ কী? তামীম রায়হান ছেলের স্কুল নিযে় এসব যখন ভাবেন তখন বেশ ভালোই লাগে। নিজের স্কুল আর কলেজ জীবন কেটেছে গ্রাম আর মফস্বলে। চাকরি জীবন কাটছে শহরে । রাসেলের জন্মও এই শহরে। তাই গ্রামের সব সুযোগ সুবিধা কখনোই ও পায়নি।
জানুয়ারি মাস স্কুলের ভর্তি কার্যক্রমই চলে থাকে। পুরো মাস জুডে় আসতে থাকে নতুন শিক্ষার্থী। রাসেল যে স্কুলে ভর্তি হযে়ছে এ স্কুলও অনেক পুরনো প্রতিষ্ঠান। লেখাপড়ার মান অনেক ভালো। প্রতিবছর সীমিত আসনে ভর্তির সুযোগে রাসেল এখানে ভর্তি হতে পেরেছে। জানুয়ারির শেষের দিকে নিয়মিত ক্লাস। ষষ্ঠ শ্রেণির গণিত শিক্ষক মোতালেব খন্দকারের ক্লাসে সবাই কম বেশি একটু ভযে় ভযে় থাকে। অল্প কযে়ক দিনের ভেতরই রাসেলের সাথে এ স্কুলের অনেকের সাথে পরিচয় হয়। ষষ্ট শ্রেণির সবার সাথে কম বেশি সখ্যতা আছে রাসেলের। সবুজ, মেহেদি, সুমন আর সাখাওয়াতদের নাম উল্লেখ করার মতো। ক্লাসে কযে়কজন দুষ্টু ছেলের সাথেও সখ্যতা রাসেলের। গণিত স্যার একটু কড়া থাকায় এই ক্লাসেই সবাই অন্য ক্লাসের তুলনায় ভীত সন্ত্রস্ত্র থাকে। সপ্তাহের পাঁচদিনই গণিত ক্লাস থাকে। তাই এ ক্লাসের পড়া ফাঁকি দেয়ার কারো সুযোগ থাকে না। ক্লাসের লাস্ট বেঞ্চের বসা নিযে় কযে়কদিনই ঝগড়া হয় রাতুল, পলাশ আর মামুনের ভেতর। পলাশ একটু বড় হওয়ার ওর সাথে কেউ বিবাদে অগ্রসর হয় না। বলা যায় পলাশ এ ক্লাসে অঘোষিত ক্লাস ক্যাপ্টেন। প্রথম ক্লাস থেকেই শফিউল ক্লাস ক্যাপ্টেনের দাযি়ত্ব পালন করছে। প্রতিদিনকার মতো গণিত ক্লাসে পলাশের বাড়াবাডি়।
‘রাতুল তুই আমার বেঞ্চে বসতে পারবি না।’
‘কেন পলাশ? আমি এ ক্লাসের ছাত্র। যেখানে ইচ্ছা সেখাইে বসবো।’ রাতুল জানে পলাশের সাথে কোনভাবেই জিততে পারবে না তবুও বৃথা চেষ্টা। পলাশের সাথে এসে সুর মেলায় ওরই ঘনিষ্ট মামুন।
‘হুম আমি আর পলাশই এ বেঞ্চে বসবো।’ মামুন একটু চিৎকার দিযে় বলে।
উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়, হাতাহাতি আর উচ্চ শব্দের ভেতরই ঘণ্টা বেজে ওঠে।
‘এই পলাশ মোতালেব স্যার আসছে।’
পলাশ চুপ হযে় বসে থাকে ওর প্রিয় বেঞ্চে। ক্লাসে ঢুকেই স্যার জানতে চাইলেন একটু পূর্বে কী ঘটেছে। কারণ স্যার নিজের কানে শোরগোল শুনতে পেযে়ছেন। ক্লাসে পিনপতন নিরবতা। গণিত স্যার হেড স্যারের রুম থেকেই লাল দাগ কাটা একটা বেতের লাঠি নিযে় এসেছিলেন বিধায় কারো মুখে কোনো শব্দ নেই। ক্লাস ক্যাপ্টেনকে দাঁড় করিযে় জানতে চাইলেন।
‘স্যার …।’ শব্দটি উচ্চারণ করেই থেমে যায় শফিউল।
‘কী হযে়ছে খুলে বল। আজ কিন্তু কারোই রক্ষা নেই।’
কযে়কমিনিট পরে ক্লাস ক্যাপ্টেন শফিউল খুলে বলে। পলাশকে সামনে নিযে় আসা হয়। পলাশ দাঁডি়যে় থাকে। মোতালেব স্যারকে স্বাভাবিক অবস্থায়ই সবাই ভয় পায়। আর এখনতো রাগে অগ্নিশর্মা। চোখের দিকে তাকানো যায় না। পলাশ মৃদু স্বরে বলে—
‘স্যার আর কখনো এমনটি করবো না। আমাকে ক্ষমা করুন।’
মোতালেব স্যার বেতটি হাত থেকে টেবিলের উপর রাখলেন। পলাশের মাথায় হাত রেখে বললেনÑ ‘তোমরা আমার ছেলের মতো। তোমাদেরকে শাস্তি দিলে আমিও কষ্ট অনুভব করি। লেখাপড়ার জন্য স্কুলে আসো লেখাপড়াই করবে। দুষ্টুমি করো না। তোমাদের ভেতরই লুকিযে় আছে আগামী দিনের সম্ভাবনা।’
স্যার যখন কথাগুলো বলছিলেন অন্য কারো চোখে পানি না জমলেও পলাশের চোখের কোণে জমল নোনা জল। মোতালেব স্যার পলাশকে মারলেন না। না মেরেই মনে
হয় বড় শাস্তি দিলেন। স্যারের এমন আচরণে কমবেশি সবাই অবাক হয়। কারণ স্যার যে মারবেন তা সবাই-ই ধরে নিযে়ছিল। স্যার শুরু করলেন পাটি গণিতে হিসেব নিকেশ। পলাশও মনে মনে ভালো হওয়ার জন্য শপথ নিল। কযে়কদিনের ভেতরই পলাশের পরিবর্তন সবার চোখে পড়ল। যে ছেলেটি কদিন আগেও ক্লাসের পড়া শিখত না সে কিনা সবার মতো পড়া পারে, বাসার কাজ ঠিকঠাক করে নিযে় আসে। সামনের বেঞ্চে বসার চেষ্টা করে। কখনো রাসেলের পাশেই বসে। রাসেলের সাথেও বাড়তে থাকে ঘনিষ্টতা। স্কুল শেষে রাসেলের সাথে গল্প করে পলাশ। লেখাপড়ার গল্প। ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থীরাই এখন পড়ালেখার প্রতি খুব যতœশীল। নিয়মিত পড়া শিখে আসছে সবাই। এ স্কুলে রাসেলের বন্ধু সংখ্যা বেডে়ছে। নতুন স্কুলকে অনেক আপন করে নিযে়ছে। স্কুলের সব শিক্ষকই সবাইকে অনেক আদর করেন। ভালো রেজাল্ট করার জন্য নানা পরামর্শ দেন। একজন ভালো মানুষ হওয়ার স্বপ্ন দেখান। রাসেল যখন নতুন স্কুলের নানান বিষযে় ভাবে তখন অনেক আনন্দ পায়। বলা যায় পুরনো স্কুলের কথা এখন ওর মনেই পডে় না। এমন একটি প্রতিষ্ঠানে ভর্তি না হলে অনেক কিছুই শিখত না। অনেক ভালো বন্ধুও পেত না ও। রাসেল অবসরে নতুন স্কুল আর ওর বন্ধুদের নিযে় ভাবে। মনে মনে বাবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানায় এ স্কুলে ভর্তি করে দেয়ার জন্য। ওর বলতে ইচ্ছে হয় ‘বাবা তুমি সত্যিই অনেক ভালো একজন মানুষ।’

Comments

comments

About

Check Also

বিদায়বেলা

জামুরাইল হাই স্কুলের বাংলা শিক্ষক ইমরান হোসেন। প্রতিদিন সকাল ৯ টায় স্কুলে আসেন। যথারীতি তিনি …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *