ঘোড়ার ডিম

এক গাঁয়ে ছিল এক তাঁতী। তাঁতীর ছিল একটি মাত্র ছেলে। ছেলেটি পাশের গ্রামের পাঠশালায় লেখাপড়া করে। প্রতিদিন পায়ে হেঁটে পাঠশালায় যাতায়াত করে। সেই গ্রামের রাজারও ছিল একটি ছেলে। রাজার ছেলেও প্রতিদিন পাঠশালায় যায়। কিন্তু সে যায় ঘোড়ায় চড়ে। রাজার ছেলে পাঠশালায় যেতে আসতে পথিমধ্যে তাঁতীর ছেলেকে বলল, আরেও ও তাঁতীর ছেলে, তোদের বুঝি ঘোড়া নেই? থাকবেই বা কেমন করে, ভাতই ঠিকমতো জোটে না! এমনিভাবে রাজার ছেলে প্রতিদিন লজ্জা দেয়। এসব কথাবার্তা শুনে তাঁতীর ছেলের ভীষণ রাগ হয়। আবার নিজেদের ঘোড়া নেই বলেও লজ্জা করে। কয়েকদিন পর তাঁতীর ছেলে তাঁতীকে বলল-বাবা, কেন? ছেলে বলল, ঘোড়া কিনে না দিলে আমি পড়ব না। তাঁতী তো অবাক। ছেলে বলছে কি! ভাতই জোটে না, আবার ঘোড়া! তাঁতী অনেকের মুখেই ঘোড়ার ডিম শব্দটি শুনেছে। কিন্তু আদৌ যে ঘোড়ার ডিম হয় না, তা সে জানে না। তাই ঘোড়া জন্ম দিতে হলে ডিম লাগবে মনে করে পরদিন তাঁতী দুই টাকা নিয়ে হাটে চলল ঘোড়ার ডিম কিনতে। হাটে গিয়ে তাঁতী চিৎকার করে বলতে লাগল, কারো কাছে ঘোড়ার ডিম আছে। তাঁতীর মুখে এমন কথা শুনে হাটের লোকজন থ মেরে গেল। লোকজন বলতে লাগল, লোকটা পাগল নাকি? হাটের শেষ প্রান্তে এক ডিম ব্যবসায়ী ডিম বিক্রি করছিল। লোকটি ছিল অতিশয় চালাক ও ধূর্ত প্রকৃতির। সে তাঁতীকে বলল হ্যাঁ, আমার কাছে ঘোড়ার ডিম আছে।
এ কথা শুনে তাঁতী বলল, তাহলে আমাকে একখানা দাও ভাই, ব্যবসায়ী বলল, সেই ডিম তো এখানে নেই, আমার বাড়িতে আছে। ডিম নিতে হলে, আমরা বাড়িতে গিয়ে একরাত থেকে ডিম নিতে হবে। তাঁতী এতে রাজী হয়ে গেল।
সন্ধার দিকে তাঁতী ডিমওয়ালার সাথে তার বাড়িতে গেল। বাড়িতে গিয়েই ডিমওয়ালা চলে গেল মাঠে। মাঠ থেকে নিয়ে এলো একটি বড় ধরণের মিষ্টি কুমড়া। তারপর তাতে চুন মেখে দিল। চুন মাখানোর পর কুমড়াটিকে ঠিক ডিমের মতোই মনেই হচ্ছিল। সেই কুমড়াটিকে ব্যবসায়ী তার খোড়ার ঘরে রেখে এল। সকাল বেলা তাঁতীর ঘুম ভাঙল। তাঁতী বলল, ‘দাও ভাই, এবার ডিমটা নিয়ে বাড়ি যাই।’ ব্যবসায়ী বলল, ‘ওই ঘোড়ার ঘরটাতে আছে, নিয়ে এসো।’ তাঁতী ঘোড়ার আস্তাবলে গিয়ে মিষ্টি কুমড়াটিকেই ঘোড়ার ডিম ভেবেই নিয়ে আসল। তারপর টাকা পরিশোধ করে বাড়ির দিকে চলল।
মাঝপথে এসে তাঁতী একটি পুকুর দেখল। তাঁতী ভাবল, পুকুরটাতে নেমে একটু হাত মুখ ধুয়ে নিই। হাত মুখ ধোয়ার সময় তাঁতী দেখল পুকুরে প্রচুর মাছ। তাঁতী ভাবল কিছু মাছ ধরলে মন্দ হয় না। এই ভেবে তাঁতী ডিসরুপী কুমড়াটিকে পাড়ের উপর রেখে মাছ ধরতে পুকুরে নামল।
তাঁতী কুমড়াটির পিছন ফিরে মাছ ধরছিল। এমন সময় একটা শিয়াল এসে কুমড়াটিকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিল। কুমড়াটি যেখানে পড়ল, সেই জায়গাটি ছিল একটা শক্ত মাটির ডিবি। কুমড়া সেখানে পড়া মাত্রই ফেটে গেল। কুমড়াটি মাটিতে পড়ার সময় একটু শব্দ হল। হঠাৎ শব্দ শুনে তাঁতী পিছন ফিরে তাকাল। তাকিয়েই দেখে, সেখানেই কোন ডিম নেই। তাঁতী সেখানে শিয়ালটিকে দেখে মনে করল হয়তো ডিমটা ফুটে বাচ্চা বেরিয়ে পড়ছে আর ওটিই বুঝি ঘোড়ার বাচ্চা। এই মনে করে তাঁতী শিয়ালটিকে ধরার জন্য গেল।
আর ওদিকে শিয়ালটি তাঁতীকে এগুতে দেখেই দিলো এক ছুট। এক ছুটেই শিয়ালটি বনের ভিতর চলে গেলো। এ দৃশ্য দেখে তো তাঁতী অবাক। সে মনে করল এ নিশ্চয়ই তেজোদীপ্ত ঘোড়া। নতুবা ডিম থেকে ফুটতে না ফুটতেই এত জোড়ে দৌড়াবে কেন! এই ভেবে তাঁতী শিয়ালটিকে ধরার জন্য তার পিছনে ছুটতে লাগল। কিন্তু বনের ভিতর গিয়ে সে আর শিয়ালটিকে খুঁজে পেল না।
শিয়ালটি ধরতে না পেরে তাঁতী মনে মনে বলল, আহা রে! এত টাকা দিয়ে ডিমটা কিনলাম, আর ডিম থেকে বাচ্চা ফুটেই বেরিয়ে গেল। যাই ব্যবসায়ীর বাড়ি আরো একটা ডিম কিনে নিয়ে আসি। এই ভেবে তাঁতী ব্যবসায়ীর বাড়ির দিকে চলল। ব্যবসায়ীর বাড়ি গিয়ে তাঁতী সমস্ত কথা খুলে বলল। ঘটনা শুনে ব্যবসায়ী তো হতবাক! মনে মনে বলল, এ আবার কেমন কথা! আমি দিলাম কুমড়া আর তার থেকে কিনা বাচ্চা ফুটে বেরিয়ে গেল!
সকালে ডিম নেয়ার আসায় রাতে তাঁতী ব্যবসায়ীর বারান্দায় ঘুমিয়ে রইল। মাঝরাতে ব্যবসায়ীর এক ঘোড়া তাঁতীর সামনে ঘোরাফেরা করছিল। এমন সময় তাঁতীর ঘুম ভেঙে গেল। তাঁতী ভাবল, এটা বোধ হয় আমার সেই ঘোড়া। এই ভেবেই তাঁতী এক লাফে গিয়ে ঘোড়ার পিঠে চড়ে বসল। বলল, এবার আর পালাতে পারবে না। তার আগেই তোমাকে ধরে ফেলেছি। অতঃপর তাঁতি ঘোড়া ছুটিয়ে বাড়ির দিকে চলল এবং ভোরবেলায় বাড়িতে গিয়ে পৌঁছল।
এ ঘটনা প্রত্যক্ষ করে তাঁতী দৃঢ়ভাবে বিশ্বাসী যে, ঘোড়ার ডিম হয়। যেহেতু তাঁতী তার চাক্ষুস প্রমাণ পেয়েছে। এরপর থেকে সেই ঘোড়ায় চড়ে তাঁতীর ছেলে পাঠশালায় যেতে লাগল। তখন থেকে রাজার ছেলে তাকে নিয়ে টিটকারী করার মওকা পেল না।

Comments

comments

About

Check Also

বিদায়বেলা

জামুরাইল হাই স্কুলের বাংলা শিক্ষক ইমরান হোসেন। প্রতিদিন সকাল ৯ টায় স্কুলে আসেন। যথারীতি তিনি …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *