আফসোস

সজীবের বাবা অনেক অর্থ -সম্পদ আর জমিজমার মালিক। গ্রামে তার মতো স্বচ্ছল পরিবার হাতে গোণা কয়েকজন মাত্র। তার ইচ্ছে ছিল ছেলেকে শহরের বড় স্কুলে লেখাপড়া করাবে। তাই মেধাবী ছাত্র সজীবকে আবাসিক স্কুলে পাঠিয়ে দেয়। সেই ষষ্ঠ শ্রেণি হতেই শহরে থাকা সজীব গ্রামের চেয়ে ধীরে ধীরে শহরকে, শহরের আধুনিকতাকে পছন্দ করতে থাকে। লেখাপড়ায় ফলাফল তার বরাবরই ভালো। তবে ধর্মের অনুশাসন তার কাছে আধুনিকতার বিপরীত মনে হতে থাকে। মেয়েদের কেন মাথায় কাপড় রাখতে হবে ….এটা কোন কথা হল? আদিম কালের কালচার তার কাছে যেন। আবার স্ত্রীকে কেন স্বামীর সংসারে রান্নাবান্না সহ সেবা যতœ করতে হবে? স্বামীকেও একইভাবে স্ত্রীর সেবা করতে হবে। ধর্মের এবং সামাজিক অনুশাসনলো তার কাছে যেন বাড়াবাড়ি মনে হতে থাকে।
নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভালো ফলাফল নিয়ে এম এ পাস করে বাবার স্বপ্ন পূরণ করেছে সজীব। গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে এসেছে কিছুদিনের জন্য। এরই মধ্যে মা বাবা আর আত্মীয় স্বজনেরা মিলে তার জন্য মেয়ে দেখা শুরু করে দিয়েছে। এর আগে সজীবের কোন পছন্দ আছে কিনা তারা তা জানতে চেয়েছিল। তার সোজাসাপটা উত্তরঃ
“তোমাদের পছন্দই আমার পছন্দ ….তবে অনাধুনিক গেঁয়ো মেয়ে আমার জন্য পছন্দ করতে পারবে না
….মনের মতো জীবন সঙ্গী না পেলে সারাজীবন আমি বিয়েই করব না”
ছেলের একদিকে তাদের পছন্দমতো আবার অন্যদিকে আধুনিক মেয়ে এই দুমুখো কথায় বেশ চিন্তায় পড়ে গেলেন বাবা মা সহ আত্মীয় স্বজনেরা। একটি মেয়ে তাদের বেশ পছন্দের ছিল। একই গ্রামে বাড়ি। মেয়েটির নাম রুবিনা। দেখতে মোটামুটি সুন্দর। তার বাবা হান্নান মুন্সির সাথে সজীবের বাবা সাহেদ চৌধুরীর বেশ খাতির ছিল। তারা একই বিদ্যালয় হতে একই সাথে মেট্রিক পাস করেছিলেন। এখন রুবিনার বাবা স্থানীয় একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। আর সজীবের বাবা পৈতৃক ব্যবসাকে আরও বাড়িয়েছেন। বাজারে তার বেশ কয়েকটি দোকান আর বিঘার পর বিঘা জমাজমি মিলিয়ে রুবিনার বাবার চেয়ে ঢের ধনী বলা যেতে পারে। তবুও বন্ধুত্বপূর্ণ মধুর সম্পর্ক উভয়ের মাঝে ছিল বিধায় সেখানে অর্থ সম্পদ বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। রুবিনা ছাত্রী হিসেবে ভালো ছিল। তবে গ্রামের বিদ্যালয়ে লেখাপড়ার মান শহরের চেয়ে কিছুটা কম হওয়ায় তুলনামূলক তার শিক্ষার সার্টিফিকেট সবাই তত মূল্যায়ন কর তো না তবে রুবিনা চিন্তাশক্তিতে আর মনোবলের দিক থেকে যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল। ধার্মিক মেয়ে রুবিনা ইসলামের শিক্ষাকে মনেপ্রাণে ভালোবাসতো আর সেগুলো পালনেও যথেষ্ট চেষ্টা করত।
রুবিনা গ্রামের পথ দিয়ে যেতে যেতে মাঝেমধ্যে সজীবকে দেখেছিল। শার্টের সাথে রঙিন টাই আর কোট -প্যান্ট -শু পড়া সাহেব বাবু সজীবকে তার খুব ভালো লাগত। যেন তার স্বপ্নের রাজকুমার। ছোটবেলা থেকেই দূরে থেকে মাঝেমধ্যে দেখতে দেখতে মনের মাঝে অবচেতনভাবে সজীব স্থান করে নিয়েছিল। আজ সে বড় হয়েছে ….বিএ পাস করেছে …..তার বাবা সেদিন এসে বললেন যে সজীবের পরিবার আর সজীব তাকে দেখতে আসছে। আনন্দে রুবিনা যেন আত্মহারা। তবে কি তার স্বপ্ন পূরণের পথে?

সোমবার বিকাল বেলা সজীব তার বাবা মা আর ফুপি সহ এল রুবিনাদের বাড়িতে। রুবিনাকে তো তারা অনেক আগেও দেখেছে। তবে ছেলেকে পছন্দ করাতে তাদের এ আগমন। চা নাস্তা খাওয়ার পরে রুবিনাকে তার দাদী নিয়ে আসেন মেহমানদের সামনে। সবুজ জমীন আর কালো পাড়ের একটি শাড়ি পড়ে মাথায় ঘোমটা দিয়ে হাজির হতে দেখে সজীব প্রথমেই মুখটা কালো করে ফেলল। সাজগোজও করতে পারে না ….হাতে-গলায় কিছুই নেই….একটু লিপস্টিকও নিতে জানে না….একেই বলে খাস গেঁয়ো ….ইত্যাদি মনে মনে বিড়বিড় করতে লাগল….আবার কতবড় একটা ঘোমটাও টেনেছে ….। তার কোন প্রশ্ন করার মতো অভিরুচি হলো না। বুদ্ধিমতী মেয়ে রুবিনা কিছুটা আঁচ করতে পারল যে তাকে বোধহয় সজীবের পছন্দ হয়নি। সজীবের বাবা মা ছেলের ভাব বুঝতে পেরে পরে জানানোর কথা বলে কিছুদিন সময় চাইলেন। ঐদিকে রুবিনার জন্য ঘটকের আনাগোনা বেশ কিছু দিন ধরেই ছিল। কিন্তু এতদিন মেয়ের লেখাপড়ার কথা ভেবে তার বাবা রাজী হননি। আর তো মেয়েকে ঘরে বসিয়ে রাখা যায় না। এই পর্যন্ত লেখাপড়া করাতেই সমাজের নানান কথা শুনতে হয়েছে পরিবারটিকে। মেয়েকে আইবুড়ি, ঘরের থাম বানাবে নাকি ….এই ধরণের নানান প্রশ্নের একটাই উত্তর ছিল হান্নান মুন্সির তাহলো:
“শিক্ষিত নারী জাতির সম্পদ…আমি আমার মেয়েকে সম্পদ হিসেবে গড়ে তোলার আগেই বিয়ে দিতে পারি না….আর তাছাড়া সন্তান লালনপালনের মতো বিষয়গুলো একজন সুশিক্ষিত মাতাই পারে সঠিকভাবে করতে ….”
এভাবে বেশ কিছুদিন পার হয়ে গেল। সজীবদের পক্ষ থেকে উত্তর আসছে না। রুবিনার মা তার বাবাকে তাদের সাথে কথাবার্তা বলতে অনুরোধ করেন। তাই হান্নান মুন্সি সজীবের বাবাকে বলে:
“বন্ধু! কি ব্যাপার আর কোন উত্তর দিলে না যে? তোমার ছেলে আমার মেয়েকে পছন্দ করেছে তো? আসলে আমার রুবিনা মায়ের জন্য অন্যত্র পাত্র পক্ষ চাপ দিচ্ছে। তোমার ছেলের পছন্দ হলে আমি অন্য কোথাও আমার মেয়েকে বিয়ে দিব না।”
মন খারাপ করে সজীবের বাবা ছেলের অপছন্দের কথাটা খুলে বললেন বন্ধুর কাছে। ফিরে এলেন রুবিনার বাবা হান্নান মুন্সি। ঠিক করলেন সপ্তাহ খানিকের মধ্যেই মেয়েকে তিনি বিয়ে দিবেন তার দূর সম্পর্কের ভাইয়ের ছেলে তারা মিয়ার সাথে। তারা মিয়াও ব্যবসায়ী। বাজারে একটি দোকানের মালিক, সাধারণভাবে বিএ পাশ করেছে।
মনে মনে রুবিনা ভীষণ কষ্ট পেল।সজীবের প্রতি দুর্বলতাটা তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিল। তবু তার বলার কিছুই নেই। তাকে যদি কারো ভালো না লাগে আর সেই কারণ যদি হয় সে মডার্ন মেয়েদের মতো বেপর্দায় চলাফেরা করতে পারে না বা ধর্ম কর্মকে ভালোবাসে তাহলে তার আর কিই বা করার থাকতে পারে ? তবে তার মন অকারণে খারাপ হয়ে যাচ্ছিল বারবার….মন সবসময়ই কি বাঁধা মানে?মানে না তবে তার বুদ্ধিমত্তা তাকে সচল রেখেছিল ….তাকে ঢলে পড়তে দেয়নি পড়ন্ত সূর্যের মতো।
অন্যদিকে সজীবের জন্য তারা ঠিক করে সজীবের মায়ের ছোটবেলার বান্ধবীর মেয়ে মৈত্রীকে। মৈত্রীর মায়ের বিয়ের পরে তারা শহরে ছিল আর সেখানেই মৈত্রীর জন্ম, বেড়ে ওঠা আর লেখাপড়া করা। মৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া শেষ করেছে সবে মাত্র। এরইমধ্যে সজীবের মতো এত ভালো পাত্র পাওয়াতে তারা এককথায় রাজী হয়ে যায়। মেয়ে দেখার পর্বে সজীব প্রথমেই পছন্দ করে ফেলে মৈত্রীকে। তার চটপটে স্বভাব আর সাজসজ্জা সজীবের বেশ ভালো লাগে। রুবিনার বিয়ের মাস খানিকের মধ্যেই সজীব বিয়ে করে মৈত্রীকে। বাবার এতবড় ব্যবসা রেখে সজীব শহরে চাকরির খোঁজে যেতে চাইলেও মা আর তাকে যেতে দিতে রাজি হননি। একমাত্র ছেলেকে আর চোখের আড়ালে রাখতে তিনি নারাজ। আর তাছাড়া সজীবের বাবারও তো বয়স হয়েছে। হিসাব নিকাশ ঠিক মতো না রাখলে নিজেদের এত ব্যবসা-বাণিজ্য যে লাটে উঠবে সেটাই সজীবের মা তাকে ভালোভাবে বুঝালেন। তাই ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সজীবের আর শহরে চাকরি করতে যাওয়া হয়নি।
মৈত্রী আর সজীব প্রথমে বেশ আনন্দে দিন কাটাতে লাগল। কিন্তু কিছু দিন পরে মৈত্রীর কিছু স্বভাব আর সজীবের ভালো লাগছিল না। সজীবের মা বাবাও মনঃক্ষুন্ন হচ্ছিলেন। মৈত্রী বেশ বেলা করে ঘুম থেকে উঠে, চা নাস্তা বানিয়ে তাকে ডাক দিতে হয়, রান্নাঘরে তেমন একটা আসতেই চায় না, নামাজ পড়ে না, মাথায় তো বাদই বুকের ওড়নাও ঠিক মতো রাখে না, বাহারি রকম পোশাক-পরিচ্ছেদ আর সাজসজ্জা নিয়ে ব্যস্ত থাকে সারাদিন ….এমনই নানান ধরণের আচরণে সজীবের মা মনে মনে বেশ ক্ষুব্ধ। আদরের একমাত্র ছেলের বৌকে একটুখানি বুঝিয়ে বলাতেই কেঁদে কেটে অস্থির হয়ে সজীবের কাছে নালিশ করে। সজীবকে শহরে চাকরির খোঁজে যাওয়ার জন্য জেদ ধরে কাপড় চোপড় গুছিয়ে রওনা হতে থাকে। সজীব তখন কিছুটা বাধ্য হয়েই শহরে যেতে রাজি হয়। ভালো একটা চাকরিও পেয়ে যায় আর সেখানেই সুন্দর একটা বাসা ভাড়া করে বসবাস করতে থাকে। সময় পেলেই দৌড়ে আসে গ্রামের দিকে তার বাবা মায়ের সাথে খানিকটা সময় কাটাতে। মৈত্রী সাধারণত তখনও সজীবদের বাড়িতে ততটা আসতে চাইত না। সে তার বাবা বাড়ির লোকজনের সাথে সময় কাটাতেই পছন্দ করত। তাই ছুটির সময় মৈত্রী তার বাবা বাড়ি যেত আর সজীব অধিকাংশ সময় একাই আসত তাদের বাড়িতে। কারো ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা সজীব পছন্দ করত না। আর সজীব হস্তক্ষেপ করলেও মৈত্রী তা মেনে নেবার মতো মেয়ে ছিল না। তাই কিছুটা মন খারাপ করেই সজীব একা একা মা বাবার সাথে দেখা করতে আসত শহর থেকে।
এতদিনে রুবিনা আর তারা মিয়ার গোছানো একটি সংসার হয়েছে। তারা মিয়ার পরিবারে তার মা, স্ত্রী আর ছোট এক বোন নিয়ে সুন্দর সংসার। বাবা মারা গিয়েছেন সে যখন ক্লাস সেভেনে পড়ত। তখন থেকেই দোকানে ব্যবসা দেখাশোনার পাশাপাশি পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়ার যুদ্ধ করে তারা মিয়া। এখন সে বেশ সুখী রুবিনার মতো
একজন জীবন সঙ্গী পাওয়ায়। রুবিনা তার শিক্ষাকে সমাজে ছড়িয়ে দিতে স্থানীয় একটি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় নিয়োজিত হয়।
বিদ্যালয়ে যাবার পথে হঠাৎ হঠাৎই দেখা হয়ে যায় সজীবের সাথে। রুবিনা দেখতে না পেলেও সজীবের দৃষ্টি সাধারণত এড়ায় না। নীল শাড়ি আর সাদা বড় ওড়না জড়িয়ে থাকা রুবিনাকে এখন কিন্তু সজীবের কাছে আর অশিক্ষিত, গেঁয়ো, অনাধুনিক বা আনস্মার্ট কোনটাই মনে হয়না। বেশ মার্জিত আর রুচিশীল মনে হয়। রুবিনা দেখা হলে অন্যদিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয় আর সজীবের ভেতর থেকে কেন জানি হাহাকার করে ওঠে অজানা এক অনুভূতি। অজান্তেই দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এসে জানিয়ে দেয় তার শূন্যতাটা বিশাল আকাশটা। সারাজীবন তার ভুলের মাশুল দিয়েও শেষ করা যাবে না ….কখনও ফুরাবে না তার আফসোস, যেটা সে কাউকে কোনদিনই প্রকাশ করতে পারবে না হয়ত….মৈত্রীর সাথে বৈবাহিক বন্ধনে সে পার্থিব জীবনে বাঁধা থাকলেও রুবিনাকেই তার হৃদয়ের স্বত্বাধিকারিণী মনে হতে থাকে…. রুবিনার ধার্মিকতাকে আজ আর তার কাছে বাড়াবাড়ি মনে হয় না….মনে হতে থাকে এটাই যেন পবিত্র আর প্রকৃত নারীত্বের স্নিগ্ধতম বহিঃপ্রর্কাশ…

Comments

comments

About

Check Also

বিদায়বেলা

জামুরাইল হাই স্কুলের বাংলা শিক্ষক ইমরান হোসেন। প্রতিদিন সকাল ৯ টায় স্কুলে আসেন। যথারীতি তিনি …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *