আশাপুর গ্রাম

আশাপুর গ্রামটি ছিল ছবির মতোই সুন্দর। সেগ্রামের মানুষের মনে ছিল অনেক আশা। তারা উন্নত একটি গ্রাম হিসেবে দেখতে চেয়েছিল তাদের গ্রামটিকে। সারা বছর গুটি গুটি পায়ে গ্রামটি যেই উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যেত এমনই এক মুহূর্তে শুরু হয়ে যেত ঝড়-বৃষ্টি-বাদল আর পরিশেষে বন্যা। সেই গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গিয়েছিল অবোধ নামের একটি নদী। অবোধ নদীটি সারা বছর যেমন তেমন বর্ষার মৌসুমে এসে এতটাই উতলা হত যে তখন জোয়ারের পানিতে বন্যা তৈরি করে আশাপুর গ্রামের দরিদ্র ঘর বাড়ি সমেত সকল আশাগুলোকে ধুয়ে মুছে নিয়ে যেত। কেউ যে নদীতে বাঁধ দিয়ে ঝড়ের মৌসুমে গ্রামের নিরাপত্তার কথা ভাবেনি তা নয়। তবে যাদের সাধ আছে সাধ্য নেই-এমন গোছের ব্যক্তিরাই অনেক চেষ্টা করেছিল বাঁধ দেবার জন্য। তবে শেষ মেষ আর নুন আনতে পান্তা ফুরায় এমন হত দরিদ্র পরিবারগুলোর পক্ষে অবোধ নদী বাঁধ দেওয়া সম্ভব হয় নি। সে গ্রামে যে কেউই স্বচ্ছলতা সম্পন্ন ছিল না এমন নয়। কিছু কিছু পাকা উঁচু দালান বাড়ি রয়েছে বটে যেগুলো বর্ষার মৌসুমে তালা বদ্ধ থাকে। কারণ গ্রামটি বন্যার উৎপাতে তাদের কাছে বসবাসের অনুপযোগী বলে মনে হত। আবার যাদের ততটা সামর্থ্য নেই তবে উন্নত জীবনের চিন্তা রয়েছে তারা পাড়ি জমাত কাছের বা দূরের অন্য কোন গ্রামে যেখানে বন্যার উৎপাত হয়না। সরকারের নজর যে সেই গ্রামের দিকে একেবারেই পড়ে নি এমন কথা বলা যাবে না। সরকার গ্রামটি উন্নয়নের জন্য কয়েক দফা বড় অংকের টাকাও পাঠিয়েছে। তবে সমস্যা হল শহরের অলি গলি পেরিয়ে গ্রামের পথ ধরতে টাকা অনেকটাই ফাঁকা হয়ে যেত। আর লাভবান হত চ্যালা প্যালারা। অবোধ নদী তেমন অবোধই থেকে যেত; থেকে যেত অপ্রতিরোধ্য। তাই আশাপুর গ্রামকে ব্যঙ্গ করে অনেকে ডাকত কান্নাপুর গ্রাম।
সেই গ্রামেরই ছেলে জাহিদ। আসল নাম জাহিদুল ইসলাম। লেখাপড়া ভালোভাবেই শেষ করেছে সে। মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নেওয়া জাহিদ স্বপ্ন দেখে উন্নত জীবন যাপনের। তাই সেও পাড়ি জমায় ভিন্ন এক গ্রামে। সেখানে কিছু দিন থাকে। তার গ্রামটি পছন্দ হলেও ভাবে পাশের আরেকটি গ্রামে জীবনযাত্রা মান আরও উন্নত। তাই সেখান থেকে আবার অন্য গ্রামের পথ ধরে। এবার কিছু দিন ঐ গ্রামে থাকার পর একটা সময় নিজের বিবেক তাড়া দিতে থাকে। সে ভাবে এসব গ্রামের পাশ দিয়েও তো নদী বয়ে যায়। তবে এরা নদীতে এমন শক্ত বাঁধ দিয়েছে যে বন্যার পানি তাদের কোনও ক্ষতি করতে পারে না। আর আমরা ভীরুর মতো গ্রামকে দোষ দেই যে, আমাদের গ্রামের লোক ভালো না, নদী ভালো না,চ্যালা প্যালা ভালো না, হয়ত সরকারই ভালো না ইত্যাদি। আসলে আমরা নিজেরাই ভালো না। আমিও ভালো না। নয়তো নিজের স্বার্থে গ্রামকে ছেড়ে অন্যের গ্রামে ভিক্ষুকের মতো বসবাসকারী হতাম না।
আশাপুর গ্রাম
জাহিদ নিজের সাথে যুদ্ধ করে পরিশেষে নিজ গ্রামে ফিরে আসে বিবেকের তাড়নায়। সে তার ইনকামের টাকা দিয়ে এবং সবার কাছ থেকে চাঁদা উঠিয়ে এমন এক কাজে হাত দেয় যা গ্রামবাসীদের কাছে ছিল দীর্ঘ আকাক্সক্ষার বস্তু। অবোধ নদীতে বাঁধ দেওয়া সহজ কথা নয়। তবে জাহিদ থেমে যাবার পাত্র নয়। অনেকে আবার তাকে গ্রামে ফিরতে নিষেধ করেছিল গ্রামের দুরবস্থার জন্য। অনেকে আবার বলেছিল সরকারই করতে পারেনি বা করেনি যে কাজ তা তুমি কি করে করতে পারবে। জাহিদ কোন বাঁধাতে ফিরে যাবার পাত্র নয়। যে কাজে সে কল্যাণ দেখতে পায় তাতে সে দৃঢ়তার সাথে এগিয়ে যায়। তার কথা হল পরের জিনিস সুন্দর হয়েছে তাই আমি পরেরটা লোভ করতে চাই না। আমার নিজের জিনিস সুন্দর করতে বিশ্বাস করি।
দীর্ঘদিন ধরে প্রচেষ্টার ফলে সবাই মিলে সম্পন্ন করে অবোধ নদী বাঁধ। এরপর ধীরে ধীরে এগুতে থাকে গ্রামোন্নয়ন। কান্নাপুর থেকে আশাপুর গ্রামের নামটিও পুনরুদ্ধার হয়। এককালে যারা আশাপুর গ্রাম ছেড়ে অন্যগ্রামে পাড়ি জমিয়েছিল তারা আবার নিজেদের গ্রামে ফিরে আসতে শুরু করে। জাহিদের হাত ধরে শুরু হওয়া উন্নয়নের জোয়ার আশেপাশের অনেক গ্রামকেও আলোড়িত করে। কিছু কাল পরে অনেক গ্রামের আদর্শ হিসেবে চিহ্নিত হতে থাকে আশাপুর গ্রামটি।

Comments

comments

About

Check Also

বিদায়বেলা

জামুরাইল হাই স্কুলের বাংলা শিক্ষক ইমরান হোসেন। প্রতিদিন সকাল ৯ টায় স্কুলে আসেন। যথারীতি তিনি …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *