আল্লামা ফুলতলী ছাহেব ক্বিবলা (রহ.)’র আধ্যাত্মিক জীবন

ইমাম মালিক (রহ.) বলেন,-যে ব্যক্তি ইলমে ফিকহ অর্জন করল কিন্তু ইলমে তাসাওউফ অর্জন করল না সে ব্যক্তি ফাসিক। আর যে ব্যক্তি ইলমে তাসাওউফের দাবি করে অথচ ইলমে ফিকহ শিক্ষা করল না সে ব্যক্তি যিন্দিক। আর যে ব্যক্তি ইলমে ফিকহ ও ইলমে তাসাওউফ উভয় দিক অর্জন করল সে মুহাক্কিক অর্থাৎ মু’মিন কামিল। কামিল মর্দে মুজাহিদ ছিলেন আমাদের আত্মার আত্মীয় মুরশিদে বরহক শামছুল উলামা রঈসুল কুররা ওয়াল মুফাস্সিরীন উস্তাজুল মুহাদ্দিসীন হাল যমানার শ্রেষ্ঠ ওলী ও মহান বুযুর্গ আল্লামা ছাহেব কিবলা ফুলতলী রাহিমাহুল্লাহু আলাইহি। মাত্র ১৮ বছর বয়সে স্বীয় মুরশিদ কর্তৃক খিলাফতপ্রাপ্ত এ মহান ওলীর আধ্যাত্মিক জীবন নিয়ে কিছু কথা নিম্নে উপস্থাপন করা হলো।
আল্লামা ফুলতলী (রহ.) ছিলেন হাল যমানার ভারতীয় উপমহাদেশের আধ্যাত্মিক রাহবার। বংশীয় চাচাতো ভাই মাওলানা ফাতির আলী (রহ.)’র তত্ত্বাবধানে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনান্তে ভারতের হাইলাকান্দি রাঙ্গাউটি মাদরাসায় পরবর্তীতে যথাক্রমে বদরপুর সিনিয়র মাদরাসা, মাদরাসা-ই আলিয়া রামপুর ও মাতলাউল উলুম রামপুর থেকে হাদিস বিভাগে সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী এ মহান ওলীর আধ্যাত্মিক জীবনের সূচনা হয়েছিল ছাত্র যমানা থেকেই।
বদরপুর সিনিয়র মাদরাসায় অধ্যয়নকালীন সুলতানুল আওলিয়া হজরত মাওলানা শাহ আবু ইউসুফ মুহাম্মদ ইয়াকুব বদরপুরী (১৮৫৭-১৯৫৮) (রহ.)’র দস্ত মোবারকে বায়আত গ্রহণ করে চিশতিয়া, কাদিরিয়া, নকশবন্দিয়া, মুজাদ্দিদিয়া এবং মুহাম্মদিয়া তরীকার সনদ হাসিল করেন। পরবর্তীতে স্বীয় মুরশিদ হজরত বদরপুরী (রহ.)’র অনুমতিক্রমে ভারতের মশহুর ওলী ও মুহাদ্দিস হজরত মাওলানা গোলাম মুহিউদ্দীন (রহ.)’র কাছ থেকে চিশতিয়া নিজামিয়া তরীকার সনদ প্রাপ্ত হন।
আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলা (রহ.)’র বায়আত গ্রহণ ও ইলমে তরীকত হাসিল করার এক চমৎকার বর্ণনা স্বীয় আদরের নাতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক তরুণ বুজুর্গ ড. মাওলানা আহমদ হাসান চৌধুরী শাহান সাহেব কর্তৃক সম্পাদিত ‘আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) স্মারক’ গ্রন্থে পাওয়া যায় এভাবে-কৈশোরেই এক শোকাবহ দিনে হজরত বদরপুরী (রহ.)’র সাথে হজরত ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (রহ.)’র পরিচয় হয়। হজরত ফুলতলী ছাহেব কিবলার পিতা হজরত মাওলানা মুফতী মো. আব্দুল মজিদ চৌধুরী (রহ.)’র ইন্তিকালের আগের দিন হজরত বদরপুরী (রহ.) জকিগঞ্জের আটগ্রামে যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে তিনি হজরত মুফতি আব্দুল মজিদ সাহেবকে দেখতে যান। তিনি (হজরত ফুলতলী ছাহেবের আব্বা) ছিলেন অত্যন্ত অসুস্থ্য, শয্যাশায়ী। বদরপুরী (রহ.) নির্ধারিত সফর বাতিল করে পাশ্ববর্তী একটি গ্রামে অবস্থান করেন। ঐ দিন রাতেই মাওলানা আব্দুল মজিদ চৌধুরী (রহ.) ইন্তিকাল করেন। পরদিন তাঁর জানাযায় হজরত বদরপুরী (রহ.) ইমামতি করেন। জানাযার পর যখন তাঁকে দাফনের কাজ চলছিল, কিশোর ফুলতলী ছাহেব কবরের একপাশে বিষন্ন মনে বসে নিরবে চোখের পানি ফেলছেন, এমনি মুহূর্তে তিনি তাঁর পিটে যাঁর দয়াদ্র হাতের পরশ অনুভব করলেন তিনি হলেন হজরত বদরপুরী (রহ.)। মাধ্যমিক শিক্ষার জন্য ফুলতলী ছাহেব হাইলাকান্দি মাদরাসায় ভর্তি হলেন। কিছুকাল পর একদিন বদরপুর অতিক্রম করার সময় বদরপুরী ছাহেবের সাথে দেখা হলো তাঁর। খোঁজ খবর নিয়ে বদরপুর আলিয়া মাদরাসায় গিয়ে উচ্চ মাধ্যমিক জামাতে ভর্তি হতে বললেন বদরপুরী ছাহেব। তাঁর কথামতো ফুলতলী ছাহেব বদরপুর সিনিয়র মাদরাসায় ভর্তি হলেন। পীর-ওলীগণের মাজার জিয়ারত তাঁর খুব ভালো লাগতো। আধ্যাত্মিকতা এবং বদরপুরী ছাহেব কিবলার প্রতি তাঁর মনে ছিল তীব্র আকর্ষণ। কিসের যেন এক টান সর্বদা অনুভব করতেন মনে। কিন্তু ঠিক নিশ্চিত হতে পারছিলেন না, কোথায় কার নিকট বায়আত হবেন। অনেকটা সিদ্ধান্তহীনতার মধ্যেই এক রাতে স্বপ্নে দেখলেন, বদরপুরী ছাহেব কিবলা নিজ বাড়ির আঙ্গিনায় বরই (কুল) গাছের নিচে দাঁড়িয়ে হাতছানি দিয়ে ডাকছেন। স্বপ্ন দেখে জেগে উঠলেন তিনি। রাত তখন দু’টা। ঘুমের ঘোরে আচ্ছন্ন তরুণ ফুলতলী ছাহেব স্বপ্নের কোনো ব্যাখ্যা বুঝতে পারলেন না। ওযু করে দু’রাকাত নামাজ পড়ে আবার শুয়ে পড়লেন। কিছুক্ষণের মধ্যে আবার সেই একই স্বপ্ন-একই ইশারা। এবারও জেগে উঠলেন তিনি। স্বপ্নের গভীর তাৎপর্য বুঝতে বাকি রইল না। ওযু করে লজিং থেকে বেরিয়ে পড়লেন পাশ্ববর্তী গ্রাম বুন্দাশীলের উদ্দেশ্যে-বদরপুরী (রহ.)’র বাড়ি যেখানে। গভীর রাতে ছাহেব বাড়িতে পৌঁছে দেখেন, স্বপ্নে যে গাছের নিচে দাঁড়িয়ে বদরপুরী ছাহেব তাঁকে ডাকতে দেখেছেন, ঠিক সেই গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। আলো আঁধারের মাঝে মানুষের অস্তিত্ব অনুমান করে বদরপুরী ছাহেব কিবলা (রহ.) তাঁর নাম ধরে বললেন, আব্দুল লতিফ এসেছো? তিনি (ফুলতলী ছাহেব কিবলা) সালাম দিলেন। বদরপুরী ছাহেব ওযু আছে কিনা জানতে চাইলে ফুলতলী ছাহেব বললেন, আছে। আর কোনো কথা না বলে ভেতর বাড়ির নিজের কামরায় নিয়ে হাত ধরে বায়আত করালেন, তা’লীম-তাওয়াজ্জুসহ সবক বাতলে দিলেন। (সূত্র : শাহ ইয়াকুব বদরপুরী (রহ.), লেখক; হজরত মাওলানা মুহাম্মদ হুসামুদ্দীন চৌধুরী ফুলতলী)।

সারাবিশ্বে তিনটি ইলম’র সনদ বা সিলসিলা প্রচলিত আছে। যা ইসলামি শরিয়তের অবিচ্ছেদ্দ্য অংশ। ইলমে ক্বিরাত, ইলমে হাদিস ও ইলমে তাসাওউফ। যাকে ইলমে তরীকতও বলা হয়। উপরিউক্ত তিন প্রকার ইলমের সনদ আল্লামা ফুলতলী ছাহেবের আছে।
হজরত ফুলতলী ছাহেব কিবলা (রহ.) কুতবুল আওলিয়া হজরত বদরপুরী (রহ.)’র নিকট থেকে চিশতিয়া, কাদিরিয়া নকশবন্দিয়া, মুজাদ্দিদিয়া ও মুহাম্মদিয়া তরীকার সিলসিলা নিম্নরূপ :
০১। শামছুল উলামা হজরত আল্লামা আব্দুল লতিফ ফুলতলী (রহ.), ০২। কুতবুল আওলিয়া হজরত মাওলানা আবু ইউসুফ শাহ মোহাম্মদ ইয়াকুব বদরপুরী (রহ.), ০৩। শামছুল আরিফিন হজরত শাহ হাফিজ আহমদ সিদ্দিকী জৌনপুরী (রহ.), ০৪। তাঁর পিতা ও মুরশিদ হজরত মাওলানা কারামত আলী সিদ্দিকী জৌনপুরী, ০৫। ইমামুত তরীকত, আমীরুল মু’মিনীন হজরত সায়্যিদ আহমদ শহিদ বেরলভী (রহ.), ০৬। হজরত মাওলানা শাহ আব্দুল আযিয দেহলভী (রহ.), ০৭। তাঁর পিতা ও মুরশিদ হজরত মাওলানা শাহ ওয়ালী উল্লাহ দেহলভী (রহ.), ০৮। তাঁর মুরশিদ হজরত মাওলানা শাহ আব্দুর রহীম দেহলভী (রহ.)। আর শাহ আব্দুর রহীম দেহলভী (রহ.)’র সিলসিলা সারা দুনিয়া ব্যাপি মশহুর।
এছাড়া পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, হজরত বদরপুরী (রহ.)’র অনুমতিক্রমে আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলা (রহ.) চিশতিয়া নিযামিয়া তরীকায় বায়আত হন হজরত মাওলানা গোলাম মুহিউদ্দীন (রহ.)’র কাছে। তাঁর চিশতিয়া নিযামিয়া তরীকার সিলসিলা নিম্নরূপ:
০১। শামছুল উলামা হজরত আল্লামা আব্দুল লতিফ ফুলতলী (রহ.), ০২। শামছুল মাশায়িখ হজরত মাওলানা গোলাম মুহিউদ্দীন রামপুরী (রহ.), ০৩। হজরত মাওলানা সায়্যিদ মুহাম্মদ মুশতাক শাহ (রহ.), ০৪। হজরত মাওলানা সায়্যিদ জামাল শাহ (রহ.), ০৫। হজরত মাওলানা মুহাম্মদ নাসির উদ্দিন শাহকালী (রহ.), ০৬। হজরত মাওলানা কুতুব উদ্দীন (রহ.), ০৭। হজরত মাওলানা ফখরুদ্দীন দেহলভী (রহ.), ০৮। হজরত মাওলানা নিয়াজউদ্দীন আওরঙ্গবাদী (রহ.), ০৯। হজরত শায়খ কালীমুল্লাহ জাহানবাদী (রহ.), ১০। হজরত শায়খ ইয়াহইয়া আল-মাদানী (রহ.), ১১। হজরত শায়খ মুহাম্মদ (রহ.), ১২। হজরত শায়খ হাসান মুহাম্মদ (রহ.), ১৩। হজরত শায়খ জামাল উদ্দীন (রহ.), ১৪। হজরত শায়খ মাহমুদ রাজান (রহ.), ১৫। হজরত শায়খ আলাম (রহ.), ১৬। হজরত শায়খ সিরাজুদ্দীন (রহ.), ১৭। হজরত শায়খ কামালুদ্দীন (রহ.), ১৮। হজরত নাসির উদ্দীন মাহমুদ চেরাগে দিল্লী (রহ.), ১৯। হজরত শায়খ নিযামুদ্দীন মুহাম্মদ ইবনে হজরত সায়্যিদ আহমদ বাদায়ুনী (রহ.), ২০। হজরত ফরিদ উদ্দীন মাসউদ গনজেশকর (রহ.), ২১। হজরত খাজা কুতুবুদ্দীন বখতিয়ার কাকী (রহ.), ২২। ইমামুত তরীকত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী আজমিরী (রহ.), ২৩। হজরত শায়খ উসমান হারুনী (রহ.), ২৪। হজরত শায়খ আলহাজ শরীফ যানদানী (রহ.), ২৫। হজরত শায়খ মওদুদ চিশতী (রহ.), ২৬। হজরত শায়খ ইউসুফ চিশতী (রহ.), ২৭। হজরত শায়খ মুহাম্মদ চিশতী (রহ.), ২৮। হজরত শায়খ আহমদ চিশতী (রহ.), ২৯। হজরত শায়খ আবু ইসহাক শামী চিশতী (রহ.), ৩০। হজরত শায়খ যমশাদ উলু দিলওয়ারী (রহ.), ৩১। হজরত আবু হুরায়রা আল বুসুরী (রহ.), ৩২। হজরত হুযায়ফাহ আল মারআশী (রহ.), ৩৩। সুলতানুত তারিকীন হজরত ইবরাহীম ইবনে আদহাম আল বলখী (রহ.), ৩৪। হজরত শায়খ ফুদায়েল ইবনে আয়াদ্ব (রহ.), ৩৫। হজরত শায়খ আব্দুল ওয়াহিদ ইবনে যায়েদ (রহ.), ৩৬। খায়রুত তাবিঈন হজরত হাসান আল বসরী (রহ.), ৩৭। কুদওয়াতুল আতকিয়া ইমামুল আউলিয়া আমীরুল মু’মিনীন সায়্যিদুনা হজরত আলী (রাদ্বি), ৩৮। সায়্যিদুল আম্বিয়াওয়াল মুরসালীন মাহবুবু রাব্বিল আলামীন সায়্যিদুনা হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
ইসলামে আধ্যাত্মিকতার গুরুত্ব খুবই বেশি। হজরত আদম (আ.) থেকে শুরু করে শেষ নবি হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত সকল নবি ও রাসুলগণের জীবনের পরতে পরতে ছিল আধ্যাত্মিকতায় ভরপুর।
মানুষের আধ্যাত্মিক জীবন আল্লাহর খাস মেহেরবাণীর জ্বলন্ত নমুনা। নবি-রাসুল, ওলী-আব্দালগণকে আল্লাহ পাক তাঁদের জীবনের বিশেষ বিশেষ মুহূর্তে এ নিয়ামত দ্বারা ধন্য করেছেন। আধ্যাত্মিকতা আত্মিক উন্নতি সাধনে সয়াহক শক্তি। এ শক্তি দ্বারা খোদা প্রদত্ত ক্ষমতা বলে শত শত মাইল দূর থেকে যুদ্ধের সেনাপতিকে সঠিক দিক নির্দেশনা দেওয়া, জীবিত থাকাবস্থায় যুদ্ধের ময়দান থেকেও বেহেশতের সুঘ্রাণ লাভ করা, যুদ্ধের ময়দানে অতি ভারি দূর্গের কপাটকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা, চল্লিশ বছর এশার ওযু দ্বারা ফজর নামাজ আদায় করা, জ্বলন্ত আগুন থেকে নিরাপদে বের হওয়া, (হজরত আবু মুসা খাওলানী), রওদ্বায়ে আতহার থেকে আযান-একামতের আওয়াজ শুনা, মায়ের উদরে থেকেও পবিত্র কুরআন মুখস্থ করা, আনা সাগরের পানি একটি লুটায় জমা করা, জায়নামাজ বিছিয়ে সঙ্গীদেরসহ নদী পাড়ি দেওয়া, ভারতবর্ষে অবস্থান করে প্রতিদিন প্রিয় নবির দীদার লাভে ধন্য হওয়া, অন্যায় কাজের বিচার করণার্থে বাঘের কান ধরে চপেটাঘাত করা এবং গাড়ি থেকে নেমে বাঘের পিটে হাত বুলিয়ে রাস্তা ক্লিয়ার করা সম্ভব হয়েছে অনায়াসে। হজরত ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (রহ.)’র আধ্যাত্মিক জীবন ছিল এক উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা স্বরূপ। নিম্নের কয়েকটি ঘটনা দ্বারা তাঁর আধ্যাত্মিক জীবনের কিছু পরিচয় পাওয়া যায়।
০১. ডা. নজরুল ইসলাম সাহেব বলেন, মুক্তিযুদ্ধের পরে আল্লামা ফুলতলী (রহ.) যখন কারাগার থেকে বেরিয়ে আসলেন তখন সিলেটের দায়িত্বে ছিলেন একজন ক্যাপ্টেন (যার নাম স্মরণ নেই)। ক্যাপ্টেন সাহেব আমাকে বললেন, ছাহেব কিবলার সাথে দেখা করব। আপনি আমাকে ছাহেব কিবলার সাথে দেখা করার সুযোগ করে দেন। আমি বলে দিলাম, আগামী বৃহস্পতিবার সুবহানীঘাটে ছাহেব আসবেন, সেখানে গিয়ে দেখা করা যাবে। ঠিক ঐ দিন ক্যাপ্টেন সাহেবকে নিয়ে ছাহেবের নিকট গেলাম। ক্যাপ্টেন সাহেব সেখানে গিয়ে হজরত ছাহেব কিবলাকে বললেন-ছাহেব, আমার গত মাসের সরকারি কাজকর্মের সমস্ত ফাইল হারিয়ে গেছে, পাওয়া না গেলে আমার চাকরি যাবে। সাথে সাথে আমার জরিমানাসহ জেল হবে। আমি আর কোনো উপায় না পেয়ে আপনার আশ্রয় নিয়েছি। আপনি দুআ করলে আমি ফাইলটি পেতে পারি। ডা. নজরুল সাহেব বলেন, আমি অবাক হলাম ফুলতলী ছাহেব ক্যাপ্টেন সাহেবকে বললেন-আপনাদের কথা সরকার শুনে, আর আমাদের কথা আল্লাহ শুনেন। চিন্তা করবেন না, আপনার ফাইল ইনশাআল্লাহ পেয়ে যাবেন। তবে আমার বাড়ির রাস্তা দিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না। বিরাট বিরাট গর্ত। সিলেটের ডিসি, এসপি দেরকে বলেও কাজ হলো না। ক্যাপ্টেন সাহেব লজ্জিত হয়ে বলেন-ছাহেব, আমি করে দিব। সামনের সপ্তাহে বাড়িতে যাওয়ার সময় আর গর্ত পাবেন না। ঠিক কথামতো ছাহেবের রাস্তার কাজ হলো। (এদিকে) ক্যাপ্টেন সাহেবের ফাইলটি ১/২ দিনের মাথায় পেয়ে গেলেন। (ডা. নজরুল সাহেব বলেন) এতো সরাসরি ছাহেবের মুখ থেকে আমি আর কখনও এরকম কথা শুনি নাই যে, আপনাদের কথা সরকার শুনে, আর আমাদের কথা আল্লাহ শুনেন। (সূত্র : কারামত-২)
০২. ক্বারী গিয়াস উদ্দিন সাহেব বলছেন, হজ্জের সময় মিনার ময়দানে পরপর ৩ বছর তাঁবুতে আগুন লেগে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠে। ছাহেব কিবলাহ তাঁবুর নিকটে আসার সাথে সাথে আগুন নিভে যায়। (সূত্র : কারামত-১)
০৩. হজরত ফুলতলী ছাহেব কিবলা (রহ.)’র গাড়িচালক বিলাল বর্ণনা করেন, ১৯৯৫ সালে ফুলতলী ছাহেবকে নিয়ে রাত্রিবেলা মৌলভীবাজার হতে শ্রীমঙ্গলে একটি মাহফিলে যাওয়ার পথে হঠাৎ চা বাগান থেকে একটি বাঘ এসে রাস্তায় শুয়ে পথ আগলে রাখল। গাড়ি চালক গাড়ির হর্ণ বাজানোর পরও বাঘ রাস্তা থেকে সরল না। তখন ছাহেব কিবলাহ নিজে গাড়ি থেকে নেমে বাঘের পিটে হাত দিয়ে কি যেন পড়লেন। সঙ্গে সঙ্গে বাঘটি রাস্তা থেকে সরে গেল। পরে আমরা শ্রীমঙ্গল চলে গেলাম। (সূত্র : কারামত-১)
০৪. ক্বারী গিয়াস উদ্দিন সাহেব বলেন, অনুমান ১৯৭৩ সালে আল্লামা হরমুজ উল্লাহ সায়দা সাহেব রাত ১০ টার সময় কুলাউড়া জলসায় বয়ান আরম্ভ করেন। ১১.৩০ টার সময় ভীষণ বৃষ্টি আসে। জলসার সবাই বলছেন, ছাব দুআ করলে হয়ত আল্লাহ তায়ালা বৃষ্টি সরিয়ে নেবেন। সায়দা সাহেব বললেন, ফুলতলী ছাহেবকে আনুন। তিনি আসলে বৃষ্টি বন্ধ হয়ে যাবে। ফুলতলী ছাহেব বাড়ি হতে স্টেইজে এসে হাত তুলে খোদার কাছে বললেন, ‘আল্লাহ আমার বাচ্চাদেরকে নিয়ে কোথায় যাব। দয়ার নজর কর।’ এ দুআর শেষে সমস্ত রাত নিরাপদে জলসায় বয়ান হয়। সকালবেলা দেখা যায়, রাস্তা-ঘাটে ও পার্শ্ববর্তী জমিনে বৃষ্টির পানি ভর্তি কিন্তু মাহফিলে কোনো বৃষ্টি নেই। (সূত্র: কারামত-১)
আল্লামা ফুলতলী ছাহেবের আধ্যাত্মিক জীবনে এরূপ অসংখ্য ঘটনা বিদ্যমান আছে। গুণীজনের দৃষ্টিতে আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলার আধ্যাত্মিক জীবনের কিছু উপস্থাপনা নিম্নরূপ :
কায়রো আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর শেখ ড. আবু লাইলা বলেন, ‘তিনি (ফুলতলী সাহেব) এশিয়ার সূর্য।’ প্রফেসর ড. এম. শমশের আলী বলেন, ‘তিনি ছিলেন এক পবিত্র আলোকবর্তিকা।’ জাতীয় মসজিদ বায়তুল মুকররম-এর খতিব প্রফেসর মাওলানা সালাহউদ্দিন সাহেব বলেন, ‘তিনি ছিলেন, ‘শরীয়াত তরীকত ও মা’রিফতের আফতাব।’ মাসিক মদীনার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক মরহুম মাওলানা মুহিউদ্দীন সাহেব বলেন, ‘আল্লামা ফুলতলী ছাহেব ছিলেন, অতুলনীয় গুণসম্পন্ন মহান বুযুর্গ।’ অধ্যাপক আ ন ম আব্দুল মান্নান খান বলেন, ‘তিনি ছিলেন অনন্য আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব।’ অধ্যাপক হাসান আব্দুল কাইয়ুম বলেন, ‘তিনি ছিলেন, তাসাওউফ আকাশের উজ্জ্বল নক্ষত্র।’ হজরত মাওলানা আব্দুল কুদ্দুছ আমরোটী বলেন, ‘তিনি ছিলেন একজন সাহেবে কাশফ ওলী আল্লাহ।’ আব্দুল আউয়াল ঠাকুর বলেন, ‘ফুলতলী সাহেব ছিলেন, যামানার আধ্যাত্মিক পদপ্রদর্শক।’ মাওলানা শরীফ উদ্দিন বলেন, ‘তিনি ছিলেন, এজন সাহিবে কারামত ওলী আল্লাহ।’ অলিউল্লাহ নোমান বলেন, তিনি ছিলেন জ্ঞানসাধক ও আধ্যাত্মিক জগতের সম্রাট।’ অধ্যাপক ড. এ আর এম আলী হায়দার বলেন, ‘তিনি সূফী ও আলিমকুল শিরোমণি মহামনীষী।’
আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ’র আধ্যাত্মিকতা এতোই প্রখর ছিল যার বদৌলতে জেলখানায়, মদিনা শরিফে অসুস্থ অবস্থায়, মুনতাখাতুস সিয়র গ্রন্থ লেখার সময় এবং জালিমদের জুলুমের সময় হাবীবে খোদা রাহমাতুল্লিল আলামিন হজরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দীদার নসীব হয়েছে বলে মজবুত প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর বর্ণাঢ্য জীবনের পরতে পরতে।

Comments

comments

About

Check Also

নালায়ে কলন্দর : পূত হৃদয়ের নান্দনিক ছন্দবদ্ধ অভিব্যক্তি

মাহবুবুর রহীম আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) রচিত উর্দুভাষার কাব্যগ্রন্থ ‘নালায়ে কলন্দর’। ‘কলন্দর’ হচ্ছে কাব্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *