ধূম্রদের অভিযান

১ম পর্ব
সাজ্জাদের মাথায় ঝিম ঝিম করছে। সে কোথায় শুয়ে আছে কিছুই বুঝতে পারছে না। সমস্ত কক্ষজুড়ে হলুদ আলো। চারপাশ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। ক্ষিধায় তার পেট চুঁ চুঁ করছে। কতক্ষণ বা কতোদিন ধরে সে অজ্ঞান ছিল কিছুই স্মরণে আসছে না। সাজ্জাদ গুণাক্ষরেও জানতে পারেনি সে ধূম্রদের কব্জায় এখন। ধূম্রদের টর্চারিং সেল ইয়োলো রুমে সে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল আটদিন থেকে।
ধূম্ররা অতি সূক্ষ জীব। খালি চোখে এদের ধূয়ার মতো দেখায়। শ’খানেক ধূম্র একসাথে চললে খালি চোখেও তাদের দেখা যায় না। ধূম্ররা মূলত ড. আশরাফের বিশেষ প্রক্রিয়ায় উদ্ভাবিত এক ধরণের অণুজীব। যাদেরকে তিনি জগতের সব মানুষের অজ্ঞাতে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যবহার করছে। লাখ খানেক ধূম্র একসাথে না চললে এদেরকে খালি চোখে ধূয়ার মতো দেখাটাও দুষ্কর।
সাজ্জাদের মুখ দিয়ে অতি চিকন পাইপ সদৃশ একটা কিছু ঢুকছে। সে নিঃসাড় পড়ে আছে। হাত, পা, শরীর, মাথা কোনো অঙ্গই নাড়াতে পারছে না। কেবল চোখ দু’টি এদিক ওদিক ঘুরাতে সক্ষম হচ্ছে। পাইপের মতো জিনিষটি কেউ পেটে ঢুকাতে যেমন সে দেখেনি তেমনি একটু পর সেটা বের করতেও কাউকে দেখলো না। এমনিতে সেটা বের হয়ে অদৃশ্য হয়ে গেলো। এবার তার পেটের ক্ষুধা একেবারে উধাও হয়ে গেছে। পেটটি তৃপ্তিসহ খানাপিনার পর যেমন ভার ভার লাগে ঠিক সেভাবে লাগছে। তার স্মৃতি ধীরে ধীরে সচল হচ্ছে। মনে পড়ছে সর্বশেষ সে কোথায় ছিল।
অধ্যাপক ড. আবু সালেহ ‘জাতীয় ক্বলক্বলা পার্টি’র মহাসচিব। এ সংগঠনের সদস্য প্রায় নব্বই ভাগ তার ছাত্রছাত্রী। দীর্ঘ পনের বছর থেকে গোপনে চলছে ক্বলক্বলা পার্টির কার্যক্রম। এ সংগঠনের চেয়ারম্যান কে, তা আজও কোনো কর্মী জানে না। সারাদেশ মিলে কর্মী-সদস্যের সংখ্যা হবে প্রায় বারশ’র মতো। সংগঠনটির একমাত্র কার্যালয় অধ্যাপক ড. আবু সালেহের বাসার চতুর্থ তলার সমস্ত ফ্ল্যাট। এ কার্যালয়ে বিশ্বস্থ বিশ বা ত্রিশ জনের বেশি কর্মীর প্রবেশের অনুমতি মিলেনি। সাজ্জাদের সে ভাগ্য হয়েছিল। সাজ্জাদ দলের বিশ্বস্ত নেতা এখন।
ধূম্রদের অভিযান
সাজ্জাদ সবে মাত্র বের হয়েছে ড. আবু সালেহ’র বাসা থেকে। তার মনে রিক্সা না পেলে হেঁটে হেঁটেই বাসায় পৌঁছবে। বাসা তেমন দূর নয়। দশ বা পনের মিনিট হাঁটলেই হলো। কিন্তু একি? এতো ধূয়া কোথায় থেকে হঠাৎ এসে তাকে ঘিরে ফেলল। ধূয়ার কোনো গন্ধ সে পায়নি। কিছু পুড়ার ধূয়া বা টিয়ার গ্যাসও মনে হয়নি সেটা। কিছুক্ষণের মধ্যে সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে। তারপর এই হলুদ কক্ষে নিজেকে দেখতে পায়।
জঙ্গিদের হামলায় পৃথিবীর মানুষ আজ খুব অসহায়। অনিরাপদ হয়ে গেছে চলাফেরা-বসবাস। বিভিন্ন দেশের নিরাপত্তা বাহিনী জঙ্গিনেতা ও জঙ্গি সদস্যদের গ্রেফতার করতে করতে হয়রান। তবু জঙ্গি আক্রমণ ঠেকানো যাচ্ছে না। জঙ্গিবাদী বিষয়ে সবার মতো ড. আশরাফ বেশ শঙ্কিত। তিনি কয়েক বছর থেকে ভাবছিলেন, এমন কিছু আবিস্কার করতে যা দিয়ে জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের অন্যায় হত্যাকে নিরবে ঠেকাবেন। জঙ্গিদের গ্রেফতার করে স্বীয় উদ্ভাবিত পন্থায় সংশোধন করে দেবেন। তিনি বার বার দেখেছেন পশ্চিমা-মিডিয়াগুলোর নির্লজ্জ মিথ্যাচার। ইসলাম ধর্মকে কলুষিত করতে নানা অপবাদের পাশাপাশি কোনো ষঢ়যন্ত্রই বাদ রাখেনি। মিডিয়া এবং বিশ্ব-মোড়লখ্যাতরা ‘ইসলামী জঙ্গি’ বলে দেদারছে কটাক্ষ করলেও অন্যান্য ধর্মানুসারী জঙ্গিদের ‘অমুকীয় জঙ্গি’ কখনো বলে না। এটা তাকে খুব পীড়া দেয়। তিনি এর প্রতিবাদের চেয়ে প্রতিরোধের একটা উপায় খুঁজছিলেন। আজ অনেকটা সফল ড. আশরাফ। তার আবিস্কৃত ধূম্রদের অভিযানগুলো পুরোপুরি সফল হচ্ছে।
সাজ্জাদকে গ্রেফতার করা ধূম্রদের প্রথম সাফল্য। এটা সহজে সম্ভব হয়নি। ধূম্রদের বিশেষ টিম সাজাদের মস্তিষ্ককোষ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে প্রাথমিক সনাক্ত রিপোর্ট দিয়েছিল ড. আশরাফকে। তিনি পূর্বেই সাজ্জাদের ডিএনএ দিয়েছিলেন এই বিজ্ঞানী টিমের কাছে। ডিএনএ রিপোর্ট নিয়ে ম্যাপে চিহ্নিত নির্দিষ্ট এলাকায় অভিযান চালায় ধূম্রের এ্যাকশন টিম।
তারও পূর্বে সাজ্জাদের ডিএনএ উপাদান নিয়ে সমস্ত শহর তন্ন তন্ন করে খুঁজে প্রথমে সংগ্রহ করা হয়েছিল তার মস্তিষ্ককোষ। অতঃপর যখন ড. আশরাফ বিশ্লেষণ করে নিশ্চিত হলেন সাজ্জাদ অবশ্যই জঙ্গিবাদের সাথে জড়িত তখনই ফাইনাল সিদ্ধান্ত দেন আটক করার।
‘এরোমা’ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে তেমন বেগ পেতে হয়নি সাজ্জাদের। কিছু দিনের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আবু সালেহ’র নজরে পড়ে সে। অন্যান্য নতুনদের মতো তাকেও কৌশলে বশ করার নির্দেশ দেন তার সংগঠনের বিশেষ কর্মী বাহিনীকে। লেলিয়ে দেয়া কর্মী ক্লাসমেট বন্ধুদের প্ররোচনায় যাতায়াত শুরু হয় ড. আবু সালেহ’র বাসায়। প্রথম সাক্ষাতের দিন থেকে শুরু হয় ষড়যন্ত্র। সাজ্জাদকে চা ও পানীয়ের সাথে ‘ক্যাপ্টাগণ কিউ’ এবং ‘অ্যাম্ফাটামিন এক্স’ নামক উচ্চমাত্রার নেশাজাত বড়ি মিশিয়ে পান করানো হয়। সাজ্জাদ এর কিছুই বুঝতে পারল না।
নেশাজাত দ্রব্য দু’টি যে কারো উম্মত্ততা বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। আসক্ত ব্যক্তি মৃত্যুর পরোয়া না করে কাংঙ্খিত ব্যক্তিদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এগুলো এমনভাবে তৈরী যা গ্রহণে দেহমনে এক ধরণের সুখ সুখ ভাব ও উদ্দামতা সৃষ্টি হয়। শরীরে ব্যাপক শক্তি অনুভূত হয়। যদিও তা খাওয়া-দাওয়ার রুচি, ঘুমকে একেবারে নষ্ট করে দেয়।
‘ক্যাপ্টাগন কিউ’ এবং ‘অ্যাম্ফাটামিন এক্স’ এর প্রভাবে এক সপ্তাহে সাজ্জাদ পুরোপুরি নেশাগ্রন্থ হয়ে পড়ল। উত্তম সুযোগে ড. সালেহ ও তার অনুগতরা সাজ্জাদের ব্রেন ওয়াশ করে ফেলল। তাকে সম্পূর্ণ আজ্ঞাবহ করার পর ড. আবু সালেহ নিয়ে যান ৪র্থ তলার গোপনীয় স্থানে। সেখানে গোপন কোঠরে বিস্ফোরক দ্রব্য, ধারালো অস্ত্র, বোমা তৈরীর সরঞ্জাম, পিস্তল, কার্তুজ, গ্রেনেডসহ নানা ধরণের খুন ও নাশকতার সামগ্রী থরে থরে সাজানো রয়েছে। পরিপাটি সাজানো গোছানো অফিসরুমের চার দেয়াল উন্নত প্রযুক্তির গ্লাসে মোড়া। আট ফুট দৈর্ঘ্য ও পাঁচফুট প্রস্থের একেক টুকরো গ্লাসকে ভিন্ন ধাচের টাইলস বসানো মনে হবে। কিন্তু এগুলো বাস্তবে একেকটা অস্ত্রাগার। দেয়ালে এমনভাবে স্থাপিত যে, গ্লাসের গাঁয়ে বিশেষ স্থানে নিয়ম কোডে নির্দেশ দিলেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে খোলতে থাকে। ধীরে ধীরে আলমিরার মতো কুঠরী সামনে এসে দাঁড়াবে। একেক কুঠরীর অস্ত্রভাণ্ডারে দৃষ্টি পড়তেই চোখ কপালে উঠবে। আধুনিক ও মামুলি যুগের এসব অস্ত্রের দুর্ভেদ্য কুঠরী সনাক্ত করা অত্যাধুনিক মেটাল ডিরেক্টর পারে না। আর এটা টাইলসের মতো দেখতে কাঁচের টুকরোগুলোর বৈশিষ্ট্য মনিটরে চোখ রাখা ড. আশরাফের। সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে সাজ্জাদের গতিবিধি ও আচরণ পর্যবেক্ষণ করছিলেন তিনি। এবার সাজ্জাদের মস্তিষ্ক বা সাজ্জাদের মুখ দিয়ে অতীতের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডগুলো জানার জন্য ‘স্ক্যানার টু স্ক্যানার হ্যামলেট’ সেটআপ করার নির্দেশ দিলেন ড. আশরাফ। ধূম্রের টিম সাজ্জাদের মাথায় হালকা চাকতির মতো যন্ত্রটি সেটআপ করে দিলো। সাজ্জাদ অকপটে বলতে থাকল জঙ্গি জীবনের ঘৃণিত অপারেশনগুলো। ড. আশরাফ তার মুখে কথা শুনছেন আর মনিটরের স্ক্রলে সেই ঘটনাগুলোর সন-তারিখ ক্লিক করে ভিডিও ক্লিপগুলো ডাউনলোড করে সেভ করছেন।
অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ক্যামেরায় স্যাটেলাইট থেকে ধারণকৃত দৃশ্য হুবহু ভিডিও আকারে পেয়ে থাকেন ড. আশরাফ। তার আবিস্কৃত শক্তিশালী ‘স্ক্যানার টু স্ক্যানার মেইল’ নামক যন্ত্রটি অতীতের যে কোনো তারিখের ঘটনা যে কোনো আড়াল বা প্রতিবন্ধকতা মমের মতো গলিয়ে রক্ত-মাংসের সৃষ্ট জীবদের আচরণ ভিডিও দৃশ্যে তৈরী করে দেয়। এতে তার শুধু সাহায্য নিতে হয় ‘স্যাটেলাইট ক্যামেরা’র।
সাজ্জাদ অসংখ্য জঙ্গি হামলার নেতৃত্ব দিয়েছে। ভিডিও ক্লিপের দৃশ্যগুলো দেখে ড. আশরাফ চমকে উঠলেন। ঘন ঘন ধূম্রদের দিকে তাকিয়ে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলেন। কারণ আল্লাহর দয়ায় তিনি যদি ধূম্রদের আবিস্কার করতে সক্ষম না হতেন তবে আরও কত যে জঙ্গিহামলায় নেতৃত্ব দিতো সাজ্জাদ। শত সহস্র মানুষ প্রাণ হারাতো তার সন্ত্রাসী অভিযানে।

সাজ্জাদ বলছে-‘২১ আগস্ট ২১১০ সাল। দুপুর দুইটা। আক্রমণ স্থান জাতীয় মসজিদ প্রাঙ্গন।’ ড. আশরাফ সাথে সাথে কীবোর্ডে নির্দেশ দিলেন সেই সন, তারিখ ও স্থানের। সামনে এলো সেদিনের ভয়াবহ দৃশ্যটি। রক্তের স্রোত বয়ে চলেছে মসজিদের বারান্দা বেয়ে ড্রেনের দিকে। এখানে ওখানে গড়ে উঠেছে মুসল্লিদের লাশের স্তুপ। রক্তে ডুবা টুপির স্তপকে অসংখ্য কাটামাথার ছোট ছোট পাহাড় দেখাচ্ছে। শিউরে উঠলেন ড. আশরাফ। তিনি মনিটরের উপর চোখ ধরে রাখতে পারলেন না।
(চলবে)

Comments

comments

About

Check Also

মুবাহাসা (২য় পর্ব)

(পূর্ব প্রকাশের পর)মুসাল্লা উঠিয়ে নাওইমাম আযম আবু হানিফা র.-এর আদত মুবারক ছিল যখন তিনি শাগরিদকে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *