ভোগের উৎসব

আনন্দ বা উৎসব বেচাকেনা করা যায় না। ঈদ উৎসব, বিবাহ উৎসব, আরো কতই না উৎসব হয় সমাজে। এসব উৎসব দূর থেকে উপভোগও করা যায় না পুরোপুরি ভাবে। যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির রায় হচ্ছে। এক এক করে আরো রায় ঘোষণা হবে। ফাঁসি, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, খালাছ অথবা ভিন্ন ধরণের রায় হবে। অপরাধীর অপরাধ বিবেচনায় হবে সে সব রায়। অনেকের কাছে বহুপ্রতিক্ষিত ও কাঙ্খিত এ বিচার। অনেকের কাছে তা বিতর্কিত। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত যুবক মাসুদ কামাল ফাঁসির রায়কে ঘিরে মনে মনে একটি আনন্দ উৎসব পালনের পরিকল্পনা করে। একা একা সে অনেক ভেবেছে উৎসব নিয়ে, কিন্তু সংগতিপূর্ণভাবে উৎসব বাস্তবায়নের সুরাহা হচ্ছে না।
মাসুদ কামালের পুরো জীবনটা সাধারণের চেয়ে বড় বিচিত্র। এই বৈচিত্র্যময় জীবনে কোথাও নেই দাড়ি, কমা, স্থিতিশীলতা। স্রোতে ভাসা কচুরিপানার মত ছুটে চলা জীবন কোথায় যে গিয়ে ঠেকে এর কোন গন্তব্য নেই। মাঝে মাঝে তার মনে হয় ধূ ধূ বালুচরেই থমকে আছে সে। সময়ের জোয়ার-ভাটায় তীরে আছড়ে পড়ে আবার নিচে নেমে আসে। যেন সে পৃথিবীর বোটা থেকে অবাঞ্চিত ঝরা পাতা।
মসজিদের ইমামতি পেশাটা তখন বেশ সম্মানেরই ছিল। ক্ষেত্র বিশেষ ছাড়া এখনও আছে। মাসুদ কামাল যখন মায়ের কোলে তার পিতা মোঃ হাশমত মিয়া মসজিদের ইমামতি করেই পাঁচ পাঁচটি সন্তানকে লালন পালন করেছেন। সংসার চালিয়েছেন স্বচ্ছল মতো। বড় দুই ছেলেকে বিদেশ পাঠিয়ে নিশ্চিত ছিলেন তিনি। ভেবে ছিলেন এই বয়সে ইমাম হয়ে আর নামাজ পড়া যাবে না। মাঝে মাঝে হাত পা কাঁপে, বুক ধুক ধুক করে। ষাট বছর বয়স তো আর কম নয়।
মাসুদ কামাল যখন প্রাথমিক বিদ্যালয় উত্তীর্ণ হলো মো. হাশমত মিয়া তাকে নিকটস্থ মাদ্রাসায় ভর্তি করে দেন। বড় দুই ছেলে বিদেশ থেকে ঠিকই টাকা পাঠায়। বিরাট বাড়িতে দালান তুলেছেন, অনেক বিঘা জমি ক্রয় করেছেন। মোঃ হাশমত মিয়া তবুও ইমামতি পেশা ছাড়তে পারেননি। এলাকার পুরনো মুসল্লিরা তাকে ছাড়তে দেয়নি। তার টাকা পয়সার চাহিদা আর না থাকলেও মুসল্লিরা তাকে হাদিয়া স্বরূপ এখনো টাকা পয়সা দেন। তিনি নেন, কাউকে নিরাশ করেন না।
বাড়ি থেকে প্রায় ৯০ কি.মি. পশ্চিমে একটি মসজিদে ইমামতি করে জীবন কাটিয়ে দিলেন মো. হাশমত মিয়া। প্রতি মাসে ৩ দিন ছুটি নিয়ে বাড়িতে আসতেন। তাছাড়া কোনো বিপদ বা সমস্যা হলে যেমন- পরিবারের কেউ হঠাৎ অসুস্থ হলে তার কাছে খবর পাঠানো হতো। মোবাইলের যুগ ছিল না তখন। কারো মাধ্যমে সংবাদ পাঠানো বা চিঠি দিয়ে জানানো হত মো. হাশমত মিয়াকে। তিনি সাথে সাথে ছুটে আসতেন বাড়িতে।
একবার মাসুদ কামালের ভীষণ জ্বর হলো। দু’দিন পর দেখা দিল গুটি বসন্ত। তিনি সংবাদ পেয়েই ছুটে আসলেন। কচি ছেলে মাসুদ কামালকে কোলে নিয়ে দীর্ঘ ১০ কি.মি. পথ হেটে উপজেলা সদরে ডাক্তারের কাছে গেলেন। পথে অনেকবার বিশ্রাম নিতে হয়েছে তাকে। শ্বাস প্রশ্বাসে ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল তার। একতো বয়স্ক হাঁপানী রোগী, তার উপর একটি অসুস্থ শিশু কোলে। সেবার খুব ধকল গিয়েছিল মো. হাশমত মিয়ার উপর দিয়ে। সন্তানটি পুরোপুরি সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত মসজিদের কর্মস্থলে যাননি তিনি। পুত্রের অসুস্থতার চিন্তায় অস্থির ভাবে দিন কাটছিল। মাসুদ কামাল বড় হয়ে এসব স্মৃতি কথা জেনেছে। পিতামাতার স্নেহ মমতা, বদান্যতা সব তার জানা। তবুও সে তার পিতার প্রতি এত অসৌজন্য বিরূপ আচরণ করছে কেন, তার চরিত্রে এমন অভাবণীয় পঙ্কিলতার কালিমা লেপ্টে গেল কেন এই প্রশ্ন প্রতিবেশী এবং আত্মীয়স্বজনদের ঠিক একই ভাবাতো। তাদের ভাবনার জট খুললো তখন, যখন তারা জানলো যে, মাসুদ কামালের মাদ্রাসা জীবনের শেষের দু’টি বছর তাকে এহেন বৈকল্য চরিত্রের অধিকারী করে তুলেছে। ধীরে ধীরে তাকে নিয়ে গেছে ভয়ঙ্কর এক জগতে।
মনিরুজ্জামানকে একজন মুসলমান জেনেই বাংলা প্রভাষক পদে নিয়োগ দিয়েছিল মাদ্রাসা কমিটি। যখন তার কাছ থেকে কেবল সমাজতান্ত্রিকতা বা কমিউনিজমের প্রশংসা শুনা যেত তখন অনেকেই গুরুত্ব দেয়নি তার কথার। কেউ ভাবতো এটা তার ব্যাঙাত্মক ও তাচ্ছিল্লপূর্ণ বক্তব্য। কেউ ভাবতো এটা হতে পারে রাজনীতির প্রতি তার অনীহার দৃষ্টিভঙ্গিপূর্ণ কথা বা কমিউনিজমের একটি প্রীতি। কেউ কেউ ভাবতো মনিরুজ্জামান স্যার নিজের পাণ্ডিত্য জাহিরের জন্য স্বীয় বাচাল স্বভাবের বহিঃপ্রকাশ এটা। কিন্তু এই ভাবাভাবীর মাঝেই তারা আটকে থাকলেও ততক্ষণে গড়িয়ে গেছে অনেক জল। মাদ্রাসার কয়েক ছাত্রের মতি গতি পাল্টে স্বীয় মতাদর্শের জালে আকড়ে ফেলেন মনিরুজ্জামান।
তার কথায় ছিল কপট যুক্তি। থাকারই কথা। তিনি কমিউনিষ্ট দল থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন কয়েক বছর হয়। সুতরাং কৌশল ও দূরদর্শীপূর্ণ বক্তব্য ছিল তার। বাস্তব পরিস্থিতির সাথে ভালভাবে পরিচিত নয় কিশোররা। ছলনা, ত্র“টিপূর্ণ বক্তব্য দিয়ে তাদের জ্ঞানকে প্রতারিত যে করা হচ্ছে এ হীন শটতা বুঝার ব্যাপারে তারা ছিল পুরোপুরি অজ্ঞ। তারা স্বীয় বিদ্যালয়ের একজন বিজ্ঞ স্যারের মোহনীয় বক্তব্যে আকৃষ্ট হয়ে সম্মানার্থে স্বীকৃতি দিয়েছিল কেবল, গভীরে ঢুকে দেখার অবকাশ নেয়নি। দূর্বলতার এ সুযোগে মনিরুজ্জামান কয়েক ছাত্রের সমর্থন যোগাড় করে ফেলেছিলেন।
মাদ্রাসার অধ্যক্ষ বিষয়টি অবহিত হওয়ার পূর্বেই জেনে যান ছাত্রছাত্রীদের অভিভাবকগণ, তারা ক্ষোভে ফেটে পড়েন। মাদ্রাসায় এসে প্রতিবাদ জানান। বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন বাংলা প্রভাষক মনিরুজ্জামানের বিরুদ্ধে। একটি মাদ্রাসার ক্যানভাসে বিকৃত মানসিকতার হীন মতবাদ প্রচারের কারণে তার অপসারণ দাবী করেন। মাদ্রাসা অধ্যক্ষের গাফিলতির নিন্দাও করেন তারা। বাধ্য হয়ে কর্তৃপক্ষ মনিরুজ্জামানকে অব্যাহতি প্রদান করে।
স্বঘোষিত নাস্তিক মনিরুজ্জামান মাদ্রাসা থেকে বিদায় তখন। মুরতাদ হয়ে যাওয়া কিশোরগুলোর চোখ খুলে ধীরে ধীরে। তারা নিজেদের কৃতকর্মের জন্য লজ্জিত ও অনুতপ্ত হয়। খালিছ তওবা করে স্বীয় ধর্মে ফিরে আসে। ফেরানো যায়নি কেবল মাসুদ কামালকে। সে কারো কোনো যুক্তিই শুনতে নারাজ। মুখ ফুটিয়ে কাউকে কিছু বলতেও চায় না সে। মনে মনে ভাবে- সব ধর্ম ব্যবসায়ী। ধর্মকে ব্যবহার করে নিজেদের সম্পদের কুমির বানাচ্ছে তারা। নিজেরা যা ইচ্ছা করে। অপরকে হেনস্তা করতে ধর্মের লেবাসে ঢুকে ন্যায়ের বুলি আওড়ায়। আবার কোথাও ঠেকে গেলে তুলে ধরে ধর্মের খড়গ হস্ত।
মাসুদ কামালকে ধর্ম সম্পর্কে অপরিণামদর্শী যা শেখানো হয়েছে সেই সব বুলিই সে তোতা পাখির মত শুধু বলতে পারে। তার হৃদয় পটে ধর্ম বিরোধী যে চিত্র আঁকা হয়েছে সেই চিত্রের বৃত্ত মাঝেই সে বার বার ঘোরপাক খায়। কখনো সে এটাও ভাবে- এই অনৈতিকতা ও মানবতাবিরোধী কাজে ধর্মের দোষ কী। ধর্মকে যারা অপব্যবহার করে তারাইতো সব অপকর্মের হোতা। কিন্তু একথাটিও সে এখন আর মনে স্থান দিতে চায় না। যেখান থেকে বেরিয়ে এসেছে সেখানে ফিরে যাওয়াটা চরম লজ্জাজনক লাগে তার কাছে।
তার নাম ছিল কামাল আহমদ। নাস্তিক গ্র“পে ঢুকার পর তার নাম হয়ে যায় মাসুদ কামাল। পিতামাতার ধর্ম ও মতাদর্শ সম্পর্কে আপত্তিজনক কথা বলায় ত্যাজ্যপুত্র করা হয় মাসুদ কামালকে। কমিউনিজম আদর্শ থেকে ফিরে আসা তার কিশোর বন্ধুরা তাকে অনেক বুঝিয়েছিল। তবু ফেরানো যায়নি তাকে।
মো. হাশমত মিয়ার ইমামতি পেশার প্রতি গুরুতর অভিযোগ মাসুদ কামালের। সে তার মায়ের সাথে এ নিয়ে ঝগড়াও করতো মাঝেমধ্যে। মাসুদ কামালের মতে, ইমামতি পেশা ধর্ম ব্যবসায়ীদের একটি লজ্জাজনক প্রতারণা। ইমাম মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে খোঁজে খোঁজে উদরপূর্তি করেন। ফিরে আসার সময় ভিক্ষা চাওয়ার মতো করে চেয়ে নেন টাকা, চাল-ডাল যা পান। এটা একজন সুস্থ সবল মানুষের জন্য পরমুখাপেক্ষিতার দৃষ্টান্ত। ভিক্ষুকের পেশার মত অপমান জনক। মাসুদ কামালের মা ছেলের এসব বেফাহেশী কথার যথাযথ জবাব দেন ধৈর্য্যরে সাথে। তিনি ভাবেন, ছোট ছেলেটির মাথা বিগড়ে দিয়েছে মাদ্রাসার নাস্তিক বাংলা স্যার। সঠিকভাবে বুঝানো গেলে হয়তো ছেলেটি সরল পথ পাবে, স্বীয় ধর্মে ফিরে আসবে। তিনি অনেক যুক্তি তর্কে মাসুদ কামালের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দিয়ে বুঝিয়েছেন। তিনি এটাও বলেছেন, মসজিদের ইমামতি হচ্ছে ইসলাম ধর্মের সবচেয়ে সম্মানিত পেশা। এই পেশায় বেতন নেয়া হয় হাদিয়া স্বরূপ, মজুরির মতো করে নয়। যিনি ইমাম তিনিই হলেন সেই এলাকার নেতা। তাকে নেতা না মেনে বিরূপ ধারণা রেখে যদি তার পেছনে নামাজ আদায় করা হয় তবে সে নামাজ হবে না। আর নামাজই হচ্ছে আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পণ ও এবাদতের প্রধান রূপ। নামাজ ছাড়া কেউ প্রকৃত মুমিন হিসেবে নিজেকে দাবী করতে পারবে না। সুতরাং ইমামগণ সমাজে মহাসম্মানিত। তাদের এ পেশা অতি পবিত্র। কোনো ইমাম কারো বাড়িতে যেতে চান না, ভিক্ষুকের মত চেয়ে কিছু নেন না। তাদেরকে সম্মানের সাথে দাওয়াত দেয়া হয়, হাদিয়া দেয়া হয় শ্রদ্ধার সাথে।
মাসুদ কামাল নব্য মুরতাদ। নতুনত্বের ঝাঁজ এখনো তার মনে বহমান। তাই মায়ের কোনো যুক্তিই তাকে নাড়াতে পারে না। দিতে পারে না আলোর পরশ, জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তির দিশা। আনন্দ উৎসব নিয়ে ভাবনার মাঝে হঠাৎ মনিরুজ্জামানের কথা মনে পড়লো মাসুদ কামালের। স্যারের দেখানো আদর্শে এ পর্যন্ত তার পথ চলা, পার্টির কিছু দামী পদও বাগিয়ে দিয়েছিলেন তাকে। দেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর ও ব্যক্তির সাথে পরিচয়ও ঘটে স্যারের বদৌলতে। সাথে সাথে সেলফোনে যোগাযোগ করে তার সাথে দেখা করলো সে। মাসুদ কামালের পরিকল্পনা শুনে তার পিঠ চাপড়ে দিলেন মনিরুজ্জামান। অভিনব এবং গুরুত্বপূর্ণ এমন একটি চিন্তা তার মাথায়ও আসেনি কখনো। মনিরুজ্জামান… অনুষ্ঠান বাস্তবায়নের তৎপরতা শুরু করে দিলেন। সুযোগকে কাজে লাগাতে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। তার মতে এমন সুযোগ বাংলাদেশে খুব কমই এসেছে। জনসংখ্যার দিক দিয়ে বিশ্বের চতুর্থ মুসলিম রাষ্ট্র বাংলাদেশ। এ দেশের প্রায় ৯৫ শতাংশ মানুষ মুসলিম। এখানে কমিউনিজমের প্রচার ও প্রসার ঘটাতে কৌশলী হতে হবে। রাষ্ট্রের ক্ষমতাবান দলের ছত্রছায়ায় সব সময় থাকতে হবে। ক্ষমতাশীল দলকে যে কোন মূল্যে বাগে এনে ব্যবহার করে নিজেদের মনোবাসনা পূর্ণ করা ছাড়া কোনো গত্যন্তর নেই।
যেমন ভাবা তেমন কাজ। মনিরুজ্জামানের টোপ গিলে ফেললেন ক্ষমতাশীল দলের কয়েকজন ক্ষমতাবান ব্যক্তি। এরা পূর্বে কমিউনিস্ট দলে ছিল। ক্ষমতার লোভে, নির্বাচনে জিততে দল বদল করেছে কেবল, কমিউনিজম আদর্শ ছাড়েনি। মনিরুজ্জামানের বিশ্বাস এই বহুরূপীতার ভেতর এরা তাদেরই লোক। তাই তার এতো ঠুনকো যুক্তিও এই নেতাদের কাছে গ্রাহ্য হয় শুধু নাস্তিক্য মতবাদের তিলক ললাটে দৃশ্যমান থাকায়। নেতারা বলেছেন, কারো ফাঁসির রায় শুনে আনন্দ উল্লাস করে উৎসব করা অমানবিক এবং মর্মান্তিক। এটা পারে শুধু পিশাচ-পাষাণ্ডরা। তাছাড়া ফাঁসির রায় নিয়ে চলছে রাজনীতি, বিতর্ক। এহেন রায় হচ্ছে বিতর্কিত, প্রশ্নবিদ্ধ। তাই অনুষ্ঠানের ধরণ করতে হবে একটু এদিক ওদিক।
আনন্দ উৎসব প্রকাশের ধরণ পাল্টানো হলো। নতুন যুক্তিতে নতুন স্লোগান তোলা হলো। গণজাগরণ মঞ্চ তৈরি হলো। মঞ্চের কলকাঠি নাস্তিক মুরতাদদের হাতে থাকলেও প্রচারিত হলো এটা স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির মঞ্চ, নতুন প্রজন্মের তরুণ তরুণী যোদ্ধার মঞ্চ। ‘যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবী’ স্লোগানের নেপথ্যে নাস্তিক মুরতাদরা সংগঠিত হতে থাকলো। মিডিয়ার লাগামহীন প্রচারণায় এক ব্যতিক্রমধর্মী উৎসবে রূপ নিলো গণজাগরণ মঞ্চ। মনিরুজ্জামান বেজায় খুশি। সব ধরনের সুযোগ সুবিধা, নিরাপত্তা ক্ষমতাশীল দল থেকে পাওয়ায় তার খুশির অন্ত নেই। তিনি মিট মিট করে একাকি হাসেন। তার হাসার রহস্য দেখে, কতিপয় কুচক্রী বুদ্ধিজীবীর ষড়যন্ত্র এবং নির্বোধ রাজনীতিবিদদের বোকামি দেখে হেসে উঠে রাজধানীর পিচঢালা পথ, দালানকোটা, প্রকৃতিও।
মনিরুজ্জামান মনে মনে মাসুদ কামালের কৃতজ্ঞতা জানান। তাকে বড় একটি গিফট দেয়ার চিন্তা ভাবনাও করেন তিনি। মাসুদ কামাল মঞ্চে রাজত্ব কায়েম করে। সে বেশ তৃপ্ত। এই তৃপ্তির ঢেকুর ‘মঞ্চের মাইক যত না প্রকাশ পায় তার চেয়ে বেশী প্রকাশ পেতে থাকে নাস্তিক্যবাদের তোষণকারী অসংখ্য মিডিয়ায়। মাসুদ কামালও মিটমিট করে হাসে বোকার হদ্দদের তোষণ দেখে।
উৎসবে বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছাত্র ছাত্রী, বস্তির ভাড়াটে এবং গোপন অভিসারে থাকা যুবক যুবতী, পার্কে কিংবা আড়ালে লুকিয়ে চুটিয়ে প্রেমে মজে থাকা প্রেমিক প্রেমিকারা আসতে থাকে মৌমাছির মতো। তারা উৎসবের মধু সংগ্রহে মেতে উঠে প্রকাশ্য উল্লাসে। হাতে হাত, বাহুতে বাহু রেখে নারী পুরুষ ভেদাভেদ ভুলে একাকার হয়ে যায়। মন রাঙানোর রাখঢাক হীন এমন সুযোগ স্বাধীনতার দীর্ঘ বিয়াল্লিশ বছরেও তারা পায়নি। তাই এহেন যুগলরা আরো বেশী আনন্দিত। সবাই বড় কৃতজ্ঞ গণজাগরণ মঞ্চ তৈরীর উদ্যোক্তাদের প্রতি।
উদ্যোক্তারা নাস্তিক নাকি মুরতাদ, মুসলিম নাকি মুশরিক যেই হোক না কেন কিবা যায় আসে তাদের। উল্লাসে মেতে থাকা অংশগ্রহণকারীর এবং উৎসবের পৃষ্টপোষকরা ভুলে যায় যে, এটা একটা মুসলিম রাষ্ট্র। এ দেশের মুসলমানদের চোখে ধূলো দিয়ে বেশি দূর যাওয়া যায় না। এক সময় চক্রান্ত ফাস হয়ে যায়, চক্রান্তকারীদের সমুচিত জবাব দেওয়া হয়। যে যাই করুক সরকারও এই ষড়যন্ত্রের ফাঁদে এতো সহজে পড়ে যাবে এটা ভাবতেও মনিরুজ্জামানের পুলক অনুভূত হয়। তিনি মনে মনে এর পরিণতি সরকার কীভাবে সামলায় তা দেখার প্রতীক্ষা করতে থাকেন।
মঞ্চ তৈরীর অন্যতম উদ্যোক্তা মাসুদ কামাল এখন খুব ব্যস্ত। এতো ব্যস্ততার মাঝেও সাবেক প্রেমিকা জুলফির সাথে আলাপের ফাঁক সে বের করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের একাদশতম প্রেমিকা জুলফির কথা সে ভুলেই গিয়েছিল। জুলফি হিন্দু ধর্মাবলম্বী ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর সে নাস্তিক্য মতবাদ গ্রহণ করে। নাস্তিক বলয়ে আসার পর মাসুদ কামালের সাথে পরিচয়, সম্পর্ক এবং প্রেম হয়। জুলফির বর্তমান প্রেমিক একটি বেসরকারী টিভি চ্যানেলের সাংবাদিক। তার প্রস্তাবেই জুলফি গণজাগরণ মঞ্চে এসেছে। জুলফির বর্তমান প্রেমিক অনুষ্ঠানের সংবাদ সংগ্রহ ও লাইভ প্রচারে ব্যস্ত। সাবেক প্রেমিক মাসুদ কামালকে নিয়ে সে বেরিয়ে আসে হৈ হুল্লুড়, চিৎকার চেঁচামেচির ত্রিসীমা থেকে। শহরের বাইরে নির্জন স্থানে পাশাপাশি বসে কথা হয় অনেক সময় ধরে। কথা হয় মঞ্চের উৎসব নিয়ে। অনুষ্ঠান নিয়ে জুলফির কোনো আগ্রহ নেই। তবে বহু বছর পর এই উৎসবের কারণেই মাসুদ কামালের সাথে দেখা হয়েছে বলে মঞ্চের উদ্যোক্তাদের প্রতি সে কৃতজ্ঞতা জানায়। আরো অনেকেরই সাথে হয়তো দেখা হতে পারে।
বেলা গড়িয়ে যায়, গোধূলি বেলা ঘনায়। মাসুদ কামাল ও জুলফির কথা বলা আরো ঘনীভূত বাস্তব নির্ভর হয়। তারা কথা বলতে বলতে সিদ্ধান্তের একটি মোহনায় এসে মিলিত হয়। তাদের জীবনটা নিজেদের জন্য একটা বোঁঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে দু’জনই একমত হয়। এই বোঝা কখন কীভাবে নামবে এর কোনো পথই তাদের কাছে স্পষ্ট নয়। ভোগের মাঝে নেই স্বস্থি, পাওয়ার মাঝেও নেই শান্ত্বনা। মৃত্যুই যেন সব হতাশা অবসানের একমাত্র সমাধান। তাই যদি হয় তবে এতো কষ্ট স্বীকার করে এই জীবন যাপনের কী মর্মার্থ থাকতে পারে? জীবনে যত ইচ্ছা-অনিচ্ছায় অনৈতিক কাজ করো না কেন এর কোনো প্রতিফল পেতে হবে না, তা কী করে হয়? তাদের নাস্তিক্য অনুভবে হালকা ভাবান্তর উদয় হয়ে আবার হারিয়ে যায় ডুবন্ত সূর্যের সাথে।
মাসুদ কামালের মেসে রাতটা বেশ তৃপ্তিতে কাটে জুলফির। ইতোমধ্যে কোথায় যেন একটু ফাঁক, এক চিলতে ব্যথা তার মনকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। সকালে কিছু পূর্বে মাসুদ কামাল কথায় কথায় স্বাভাবিকভাবে তাকে বলেছিল জুলফির এক সময়ের বান্ধবী কণা গত দু’রাত এই মেসে তার বিছানায় ছিল। কণার সাথেও বহু বছর হয় দেখা সাক্ষাত যোগাযোগ ছিল না। মাসুদ কামালকে গণজাগরণ মঞ্চে দেখে কাছে এসে কথা বলেছিল কণা। তারপর দু’জন সোজাসোজি চলে আসে মেসে, এই নির্জন স্থানে। কণার কথাগুলো যখন জুলফি শুনছিল তখন থেকেই তার মনে চিন চিন ব্যথাটা জমতে শুরু করেছিল। তার চোখ দুটি ছল ছল করছিল। মাসুদ কামাল জুলফির এ ব্যাপারটি স্পষ্ট প্রত্যক্ষ করেছিল। তবে সেটা কণার জন্য জুলফির করুণা নাকি একটা প্রচ্ছন্ন হিংসার বহিঃপ্রকাশ তা সে বুঝতে পারেনি। কণাকে নিয়ে তার বান্ধবীরা বরাবর হিংসা করতো। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক তরুণ অধ্যাপকের রক্ষিতা ছিল কণা। সুন্দরী কণাকে নিয়ে অনেক মুখ রোচক কাহিনী বলে বেড়াত তার বান্ধবীরা।
এসবের ভেতর মাসুদ কামালের কথাও ভাবছিল জুলফি। স্বঘোষিত নাস্তিক রাকিবকে অজ্ঞাত খুনীরা নির্মমভাবে হত্যা করেছে। লাশ উদ্ধারের সময় তার মোটিতে লম্বা চুলের গোছা পাওয়া গিয়েছিল। নারীঘটিত কেলেঙ্কারীর বলি হয়েছিল ব্লগার রাকিব। মাসুদ কামালের সহকর্মী ছিল রাকিব। মাসুদ কামালের জীবনেও এমন ঘটনা অপেক্ষা করছে কিনা কে জানে। জুলফি এ আশঙ্কাটি একেবারে উড়িয়ে দেয় না। কারণ নাস্তিক ব্লগারের এ গ্র“পটি তরুণীদের নিয়েই ব্যস্ত থাকে বেশী। তাদের জীবনের পুরোটা জোড়েই তরুণীদের পটানোর বিশ্রী মতলব।
জুলফি যখন উল্টেপাল্টে এসব চিত্র দেখছিল তখন মাসুদ কামালের ভাবনার জগতে বিপরীত বায়ু প্রবাহিত হচ্ছিল। সে অতিষ্ট হয়ে উঠেছে এ জীবন নিয়ে। অসভ্য ভোগের পরিণতি কত যে মর্মান্তিক আর ধ্বংসাত্মক উপাদান দিয়ে গড়া তা সে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। অথচ তার পিতার জীবনেও তো রয়েছে ভোগ উপভোগ। সেটা কত নির্মল, পঙ্কিলতাহীন। সে জীবনে রয়েছে জবাবদিহিতা, পরকালে রয়েছে প্রাপ্তির প্রত্যাশা। তার পিতার জীবনে কখনো কোনো হতাশা আক্ষেপ সে দেখতে পায়নি। প্রকৃত মুসলমানের জীবন বুঝি এমনই হয়, প্রভুর কাছে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করে নির্ভাবনায় জীবন কেটে যায়।
মাসুদ কামালের রক্তে মুসলমানিত্ব গেঁথে আছে। তাছাড়া তার পিতামাতার রয়েছে নিরন্তর দোয়া। মাসুদ কামালের হেদায়াতের জন্য অজস্র অশ্র“ ঝরিয়েছেন তার মা এবং পিতা মো. হাশমত মিয়া। তাদের অকৃত্রিম রোদন হয়তো আল্লাহপাক গ্রহণ করেছেন।
গণজাগরণের মঞ্চে অধার্মিকরা যখন ধর্মের কথা বলে তখন মাসুদ কামালের পিলে চমকে উঠে। সে বুঝে এটা নেহায়েত উপহাস। একটি মহলকে অপদস্ত করতে যখন ধর্মীয় পোশাক টুপি পাঞ্জাবী নিয়ে তাচ্ছিল্য করা হয়, তখন পিতৃস্নেহের স্মৃতি তার চোখে ভেসে উঠে। বোবা কান্নায় বুক আনচান করে। যদিও সে এই উৎসবের অন্যতম উদ্যোক্তা কিন্তু সে এমন কিছু চায়নি। ধর্ম মানে না বলে কোনো ধর্মে আঘাত করা তার করতে নেই।
গত পরশু মঞ্চের বামপাশে খুঁটির সাথে বেঁধে রাখা হয়েছিল টুপি পাঞ্জাবী পরিহিত রাজাকারের একটি প্রতিকৃতি। লম্বা দাড়ি মুখে লাগিয়ে জীবন্ত প্রতিকৃতি সেজে দাঁড়িয়েছিল সুইপার বিমল। তাকে পাঁচ হাজার টাকা অগ্রিম দেওয়া হয়েছিল। তার শুশ্র“মণ্ডিত গালে, টুপি পরিহিত মাথায় হাইহিলের জুতো দিয়ে পিটুনির কষ্টটুকু তাকে হাসি মুখে সহ্য করতে হয়েছিল। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ও বস্তির সুন্দরী ললনা এবং জুলফি ও কণার মতো রক্ষিতারাই কেবল রাজাকার প্রতিকৃতিবেশী বিমলের মাথা ও মুখে জুতা মারার সুযোগ পেয়েছিল।
মাসুদ কামালের কাছে জুতো পেটানোর ব্যাপারটি খুব খারাপ লেগেছিল। সুইপার বিমলের স্থানে তার পিতা মো. হাশমত মিয়ার প্রতিকৃতিটাই বার বার চোখে ভেসে উঠেছিল। বৃদ্ধ মো. হাশমত মিয়ার মুখ ভর্তি লম্বা শুভ্র দাড়ি, মাথায় টুপি, গায়ে পাঞ্জাবী অবিকল খুঁটিতে বাঁধা বিমলের মতো। জুতোর পিটুনীগুলো মো. হাশমত মিয়াকে স্পর্শ করতে না পারলেও পিতার অবয়ব ভেবে মাসুদ কামালের কলিজায় পিন বিঁধার ন্যায় কষ্ট লাগছিল। নাস্তিকতার পঙ্কিলে যতোই ডুবে থাক না কেন এমনই আকৃতি ও পোশাকধারী একজন সহজ সরল পিতার যে সন্তান সে। হিন্দি চলচ্চিত্রে টুপি পরিহিত মুসলিম চরিত্রের কাউকে যখন ঘরদোর মুছার কাজে কিংবা মালিকের পায়ের কাছে বসে জুতা মুছে দিতে দেখতো তখন সে চরম অপমান বোধ করতো। তার কাছে স্পষ্ট হতো, মুসলমানদেরকে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে হেয় করা হচ্ছে। সবদিকে তার পিতৃধর্মের এই লোকদের আঘাত দেওয়া হচ্ছে। তখন অজানা এক মর্মপীড়া তাকে ক্ষতবিক্ষত করতো। মাসুদ কামাল বড় আশ্চর্য হয়ে দেখে নাস্তিক মুরতাদরাও অন্য ধর্মের তুলনায় ইসলাম ধর্মের বিরোধীতা ও সমালোচনা এতো বেশী করে যে, তাদের গোপন আক্রোশটি সহজে ফাঁস হয়ে যায়। তারা ইসলামী তথ্যকে গোয়েবলসীয় পন্থায় বিকৃত করে।
নাস্তিক মুরতাদদের কেবল ভোগ ছাড়া জীবনে পাওয়ার কিছুই নেই। মাসুদ কামালও নাস্তিক্য মতবাদ গ্রহণের পর ভোগের মাঝে কাটিয়েছে নিয়মিত। কখনো পরিমিত কখনো বা চাহিদা মতো। কিন্তু এই ভোগ তাকে কখনো স্বস্তি দিতে পারেনি। কি যে একটা অতৃপ্তি সর্বদা লেগেই থাকতো। জীবনটা রসকসহীন রুক্ষ আর যাযাবরের মতো লাগতো। মাঝে মাঝে জন্মগত ধর্মে ফিরে যাওয়ার একটা আকুলতা অনুভব করতো।
দিন যায় দিন আসে, কিন্তু যে সময় ঝরে যায় জীবন বৃক্ষ থেকে সেটা আর কখনো ফিরে আসে না। জীবন বৃক্ষ ক্ষয়ে ক্ষয়ে একদিন সময় শূন্য হয়ে আসবে। মাসুদ কামাল সেই সময়ের অপচয় আর হতে দিতে চায় না। সে নবারুণের একচিলতে নির্মল রোদের জন্য ভোগ উৎসবের নর্দমার স্তুপের কিনারে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে থাকে।

Comments

comments

About

Check Also

বিদায়বেলা

জামুরাইল হাই স্কুলের বাংলা শিক্ষক ইমরান হোসেন। প্রতিদিন সকাল ৯ টায় স্কুলে আসেন। যথারীতি তিনি …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *