১ম পর্ব
রাদিয়া কানে হেডফোন দিয়ে রবীন্দ্র সংগীত শুনছিলো আমারো পরানো যাহা চায়। ওদিকে কিচেন থেকে মুনিরা আহমেদ ওকে এই নিয়ে আটবার ডেকেছেন কিন্তু রাদিয়ার কোন খবর নাই। মুনিরা এবার রান্না ছেড়ে রাদিয়ার রুমের দিকে গেলো। মেয়েটা করছেটা কি এতবার ডাকছি?
মেয়ের রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে উঁকি দিতেই দেখলো মেয়েতো তার আপন মনে কানে হেডফোন দিয়ে শুয়ে শুয়ে গান শুনছে। বাব্বাহ এইনা হলো আমার মেয়ে! পড়তে বসেই ফোন নিয়ে আছে। আর ডাকলেই বলবে মা আমিতো পড়ছি।
মুনিরা মেয়ের কান থেকে আস্তে করে হেডফোনটা খুলে নিলো। রাদিয়া তা টের পেয়ে লাফ দিয়ে উঠে মা তুমি?
-হুম আমি। তাহলে পড়তে বসেই এসব হচ্ছে?
-মা আসলে ভালো লাগছিলোনা তো তাই..
-ভালো লাগছেনা বলে গান শুনবি? কোন বইয়ে আছে গান শুনলে মন ভালো হয়? এসব গান টান না শুনে একটু ভালো ভালো বই পড়তেও তো পারিস?
-মা সারাক্ষণ এককথা বলবে না তো ভালো লাগে না এমনি নিজের পড়া নিয়ে বাঁচিনা অন্য বই কখন পড়বো?
-আপনার ভালো লাগবে কেনো? ভালো কথা কি কারো ভালো লাগে। জানি না কার পাল্লায় পড়ে এতো বিগড়ে গেছিস! নামায কালাম তো সব ছেড়েই দিছিস। আর বই নিয়ে থাকলে এক কথা ছিলো
কে বলবে কদিন পরে তোর এডমিশন টেস্ট?
-মা আমি তো এতক্ষণ পড়ছিলাম, মাত্রই মোবাইল হাতে নিলাম।
-একটা থাপ্পড় দিবো মিথ্যা বলছিস কত সুন্দর করে মাত্রই ফোন হাতে নিলাম।
- মা যাও তো এখন বিরক্ত করো না!
-আমার তো খেয়েদেয়ে কাজ নাই তোকে বিরক্ত করবো। বড়দের সাথে কথা বলাও ভুলে গেছিস নাকি!
আমি তোকে কয়বার ডেকেছি সে খেয়াল আছে তোর?
-কখন? কি জন্য ডাকছো?
-সারাক্ষণ কানে হেডফোন থাকলে শুনবি কি করে? একটু পরে আফিয়া আর জামাই আসবে সেকথা ভুলে গেছিস নাকি?
-ভুলবো কেন আমি তো জানি।
-জেনে ও বসে আছিস?
-তো কি করবো?
-ঘরটা একটু ভালো করে গুছিয়ে নিতেও তো পারিস, আমি রান্না সামলে এদিকে করতে পারি? ঘরে এতো বড় একটা মেয়ে থাকতে এখনো আমাকে সব করতে হয়
-আমি পারবো না আমার পড়া আছে তুমি সামিহাকে বলো।
-কিযে পড়ছিস তাতো দেখতেই পাচ্ছি। সামিহার কাল পরীক্ষা আছে। একটু গুছিয়ে রাখ না। দুদিন পর শশুড়বাড়ি যাবি তখনো এমন থাকবি নাকি? একটু কাজ টাজ শিখ না হলে আমাকেই কথা শুনতে হবে।
নামায কালাম পর্দা করা তো ছেড়েই দিয়েছিস কলেজে উঠে জানিনা আল্লাহর কাছে কি জবাব দিবি এসবের জন্য।
রাদিয়া আপন ফোনে ফোন টিপছে।
মুনিরা মেয়ের হাত থেকে ফোন নিয়ে কি করছিস সারাদিন মোবাইল নিয়ে? কি আছে এটাতে?
-উফ মা তুমি না! অসহ্য! এই বলে রাদিয়া বিছানা ছেড়ে উঠলো।
রাদিয়া রুম ছেড়ে বেরুতেই সামিহা ডেকে বললো, ছোটো আপু একটু এদিকে আসবি?
-কেনো? কি হয়েছে?
-এই ম্যাথটা মাথায় ডুকছে না একটু বুঝিয়ে দিবি?
-কেনো আমি কেনো? তোর টিচার তোকে ভালো করে বুঝাইনি? আমি পারবো না।
-এমন করছিস কেনো? দে না আপু একটু বুঝিয়ে। কাল আমার পরীক্ষা যে।
-হুম এই ঘরে আমি সবার কথার চাকর। তারপরও শুনতে হবে আমি নাকি কিছুই করি না সারাদিন নাকি শুয়ে বসে থাকি।
রাদিয়া সামিহাকে অংকটা বুঝিয়ে দিয়ে ঘরটা গুছালো। আজ পাঁচ বছর পর এ বাড়ির বড় মেয়ে আর জামাই আসছে। তাই মুনিরা একটু ব্যস্ত।
এই ফাঁকে পরিচয় করাচ্ছি এরা হচ্ছে জনাব জাওয়াদ আহমেদের পরিবার। জাওয়াদ আহমেদ দেশের বাহিরে থাকেন। জাওয়াদ আহমেদ আর মুনিরা আহমেদের তিন মেয়ে।
বড় মেয়ে আফিয়া বিনতে জাওয়াদ আর ওর হাজবেন্ড ইশতিয়াক মাহমুদ শাফী কানাডায় ছিলো গত পাঁচবছর যাবৎ। কিছুদিন আগেই দেশে ফিরেছে শশুরবাড়িতে কয়দিন থাকার পর আজই বাবার বাসায় আসছে। ওরা ওখান থেকে একেবারে ফিরে এসেছে। শাফী এখানেই বিজনেস করবে তাই।
আর সবচেয়ে বড় কারণ বিয়ের সাতবছর পর এই প্রথম আফিয়া অন্তসত্ত্বা হলো। অনেক চেষ্টার পর আল্লাহ ওদের এতবড় সৌভাগ্যের অধিকারী করেছেন। তাই ওদের দুজনের ইচ্ছা ওদের প্রথম সন্তান নিজের দেশেই নিজের আপনজনদের কাছেই জন্ম নেয়ার সৌভাগ্য পাবে। আর এসময়টা মেয়েদের পরিবারের সাহচর্যের অনেক দরকার।
ভীষণ অমায়িক, শান্তশিষ্ট আর যথেষ্ট ইসলামিক মন মাইন্ডের মেয়ে আফিয়া। বিদেশে থাকাকালে ও যথেষ্ট পর্দা মেইনটেইন করে চলাফেরা করেছে আর বিশেষ করে এগুলো সম্ভব হয়েছে ওর হাজবেন্ড শাফীর কারণে। স্বামি হিসাবে হোক বা একজন পুরুষ হিসাবে শাফী ইসলামের যথেষ্ট অনুরাগী। ওর এক কথা সবকিছুর আগে ইসলামকে মনেপ্রাণে গ্রহণ করতে হবে। তাই একটা সুখী দম্পতী হিসাবে এই সাতবছর কাটাতে পেরেছে ওরা। আজকালকার আধুনিক নারী পুরুষদের অবাদ মেলামেশা অতিরিক্ত আধুনিকতার জন্য যেখানে অনেক সম্পর্ক একবছর ও কাটে না সেখানে ওরা অনায়াসে এতগুলো বছর কাটিয়েছে। আর বিশেষ একটা সম্পর্কের মূল ভিত্তি হলো একজনের প্রতি আরেকজনের সন্মান আর বিশ্বাসের ভিত্তিটা মজবুত হওয়া যা ওদের অনেক বেশি আছে।
মেঝো মেয়ে রাদিয়া বিনতে জাওয়াদ। ইন্টার পরীক্ষা দিয়ে এবার এডমিশন টেস্টের জন্য পড়াশুনা করছে। মেধাবী হাসিখুশি আর আর প্রাণবন্ত এক তরুণী তবে রাগী আর কিছুটা অলস প্রকৃতির। আগে নিয়মিত নামাজ পড়লেও আর পর্দা মেনে চললেও কলেজে উঠেই নামাজ আর পর্দা করা বলতে গেলে ছেড়েই দিয়েছে। মন চাইলে নামাজ পড়বে না হলে না। বলেনা সঙ্গ দোষে স্বভাব নষ্ট রাদিয়ার ও সে অবস্থা। জোর করে কিছু বলতে পারে না আজকালকার মেয়েরা হয়েছে জেদি। এদের কখনো জোর করে কিছু বলা যায় না আর এ বয়সে গায়ে হাত তুলাও যায় না কখন কি করে বসে জেদের বসে বলা তো যায় না।
আর ছোট মেয়ে সামিহা বিনতে জাওয়াদ। এবার জে এস সি দিবে। শান্তশিষ্ট নরম স্বভাবের মেয়ে। মায়ের বাধ্য সন্তান বলতে গেলে।
মুনিরা কিচেনে বসে ভাবছেন আমার বড় মেয়ে আর ছোট মেয়েটা হয়েছে একরকম আর মেঝোটা পুরো বিপরীত মনে মনে আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করেন আল্লাহ যেনো ওকে হেদায়েতের আলো দেখান। আর উনি চাইছেন এবার আফিয়া যখন আসছে রাদিয়ার বিয়ের একটা বন্দোবস্ত করে ফেলবেন। দিন দিন যা বিগড়ে যাচ্ছে বলা যায়না আরো কি কি হতে পারে। পড়াশুনা বিয়ের পরেও করা যাবে। কিন্তু কে বুঝাবে ওকে ওর এককথা ও পড়াশোনা শেষ না করে বিয়ে করবে না। অবশ্য বড়বোন আফিয়াকে এখনো যথেষ্ট মান্য করে। তাই ও বুঝালে হয়তো বুঝতে পারবে মনের মধ্যে এই একটা শেষ আশা নিয়ে মুনিরা আছেন।
কলিংবেলের শব্দে রাদিয়া দৌড়ে গেলো। নিজের সবচেয়ে প্রিয় মানুষটা এসেছে অনেকদিন পরে। দরজা খুলতেই সালাম দিয়ে বোনকে জড়িয়ে ধরলো। শাফী রাদিয়াকে দেখে দরজা থেকে একটু সরে গেলো। অন্যসব দুলাভাইদের মতো শালীদের সাথে অতিরিক্ত আধিক্ষ্যেতা করার মতো মন ওর নাই। আফিয়ার যখন বিয়ে হয় সামিহা তখন অনেক ছোট ছিলো। সেই হিসাবে সামিহার সাথে একটু আধটু কথা হতো কিন্তু রাদিয়ার সাথে আজ অবদি সরাসরি ওর কখনো দেখা হয়নি মানে ও নিজেই আফিয়াকে বলে দিয়েছে যাতে রাদিয়া কখনো ওর সামনে না আসে। অবশ্য প্রথম প্রথম রাদিয়া চাইতো দুলাভাইয়ের সাথে একটু খোশগল্প করবে তাই সামনে এসে সালাম দিতো কথা বলতে চাইতো কিন্ত যখন শুনেছে শাফী নিষেধ করেছে তারপর থেকে আর কখনো শাফীর মুখোমুখি হয়নি। তবে মাঝে মাঝে রাদিয়ার অনেক রাগ হতো এতো কিসের অহংকার উনার? হুজুর টাইপ ছেলেগুলো এজন্য রাদিয়ার চোখের বিষ।
শাফীকে সরে দাঁড়াতে দেখে আফিয়া রাদিয়াকে বললো, রাদি চল ভিতরে গিয়ে কথা বলি তোর ভাইয়া বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে। রাদিয়া বুঝতে পেরে বললো, ও সরি!
ওরা চলে যেতেই শাফী ভিতরে প্রবেশ করে।
মুনিরা এসে জামাইয়ের সাথে কুশলাদি বিনময় করলেন। রাদিয়া আফিয়াকে পেয়ে কথার ঝুড়ি খুলে বসেছে। বসার ঘর থেকে শাফী ওদের কথা বলা শুনছে আবার কতক্ষণ পর পর রাদিয়ার অট্টহাসির শব্দ আসছে। শাফী ভালো করে জানে আফিয়া এতো জোরে কথা বলেনা আর ওর হাসির শব্দ ও বাইরে আসবেনা। রাদিয়াটা আসলে কি? এত জোরে কেউ হাসে নাকি? ওর মধ্যে কি কমনসেন্স বলে ব্যাপারটা নেই? ঘরে একজন পরপুরুষ আছে সেকথা ও কি ভুলে গেছে? যত্তসব!
খাওয়াদাওয়া সেরে আফিয়া রুমে আসতেই শাফী বলে উঠলো, কি ব্যাপার ম্যাডাম আপনি তো মনে হয় আজ বেশ মুডে আছেন?
-কেন একথা কেন বলছেন?
-না মা আর বোনদের পেয়ে তো আমাকে ভুলেই গেছেন। বাড়িতে তো আমি ও আছি সেকথা কি ভুলেই গেছেন। কতক্ষণ হলো আসলাম খাবার টেবিল ছাড়া আপনাকে দেখতে পাইনি ব্যাপার কি?
-সরি আসলে,
-কোন সরি হবেনা আজ ভীষণ রেগে আছি কথাও বলবো না।
-প্লিজ রাগ করবেন না।
-শাফী অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। আফিয়া অনেক বুঝানোর চেষ্টা করেও রাগ ভাঙাতে না পেরে কিছুক্ষণ পর আহ, বলে ব্যাথা পাওয়ার মতো শব্দ করে উঠে মেঝেতে বসে পড়লো। শাফী কি হয়েছে বলে আতঙ্কিত হয়ে খাট থেকে নেমে গিয়ে আফিয়াকে ধরলো। শাফীর চিন্তিত মুখ দেখে আফিয়া হা হা করে হেসে উঠলো।
-কি আমার সাথে নাকি কথা বলবেন না এখন,
-শাফী কান্না আর রাগ মিশ্রিত কন্ঠে বললো,তার মানে তুমি ইচ্ছে করে এমন করেছো?
-জী সাহেব। এছাড়া আপনার রাগ ভাঙানোর কোন উপায় ছিল না।
-তুমি সব সময় আমার দুর্বল জায়গাটিতে আঘাত করো। তুমি জানো এখন তোমাকে নিয়ে আমার সারাক্ষণ টেনশন হয় আর তুমি সেই ব্যাপারটা নিয়ে আমার সাথে মজা করো।
-আরে আবারো রাগ করছেন? আমি তো একটু দুষ্টুমি করছিলাম।
-প্লিজ
-আফিয়া অবস্থা বুঝে আস্তে করে শাফীর গালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো।
আর সাথে সাথে শাফী দুই ঠৌঁট চওড়া করে হেসে দিলো।
-তোমার সাথে রাগ ও করা যায়না। এমনিতে বলেও কখনো আদায় করতে পারি না কিন্তু যখনি একটু রাগ দেখায় তখনি ঠিক লজ্জাবতী তার সব লাজ লজ্জা ভুলে তোমার ভাষায় এই কঠিন দূর্বোধ্য কাজটা করে আমার এত কষ্ট করে আনা রাগে পানি ঢেলে দাও।
-আমি জানি কি করলে আপনার রাগ কাটে।
-হুম তাইতো। নিজের দুর্বলতাগুলো তোমাকে বলেই বিপদে পড়েছি।
আফিয়া আবারো সেই নজরকাড়া হাসিটা দেয়।
-শাফী বললো, এমন করে হেসো না গো নিজেকে কন্ট্রোল করা দায় হয়ে পড়ে।
-ঢং দেখে বাঁচিনা এ বলে আফিয়া ওয়াশরুমের দিকে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো।
-ওয়াশরুমে যাবে? চলো আমি তোমাকে নিয়ে যায় এ বলে শাফী হাত বাড়ায়।
-আচ্ছা আপনি কি বলেন তো? আমি এতোটা অচল হয়ে যায়নি এখনো।
-তারপর ও
-আপনি চুপ করবেন বলে আফিয়া হাটা ধরে। আফিয়া জানে শাফীর ভয়ের কারণটা। এই মানুষটা একটা সন্তানের জন্যই দিনরাত আল্লাহর কাছে কেঁদেছে কিন্তু কখনো আল্লাহর উপর থেকে বিশ্বাস হারায়নি। মানুষ কত কথা বলেছে আফিয়াকে। শাফীকে অনেকে বলেছে ও যেন আরেকটা বিয়ে করে আর নয়তো একটা বাচ্চা দত্তক নেয়। কিন্তু ও এসবের কিছুই করেনি। আফিয়াকে ছাড়া স্ত্রী হিসেবে অন্য কাউকে ও ভাবতে পারেনা অনেক বেশি ভালোবাসে তো তাই। আর বাচ্ছা দত্তক নিকে সে বাচ্চাকে নিজের পরিচয় দেয়া যায় না আর না বড় হলে ঐ বাচ্ছার সাথে মা বাবা কখনো দেখা দিতে পারবে।
আর আল কুরআনের সূরা আল আহযাবে স্পষ্টভাবে আছে, পালক পুত্রকে নিজের পরিচয় দেয়া পুরোপুরি হারাম এসব ভেবে শাফী এসব থেকে বিরত থেকেছে।
আফিয়ার থেকেও সন্তানের মুখ থেকে বাবা ডাক শুনার জন্য শাফীর আকাঙ্খা বেশি ছিলো তারপরও এসব করেনি। আল্লাহ ওর মনোবাসনা পূরণ করেছে এতোগুলো বছর পরে সেই জন্য ও এতো বেশি উচ্ছসিত।
কানাডায় থাকাকালে আফিয়াকে কোন কাজই করতে দিতোনা। নিজেই সব করতো। বাসার পাশের যে বাঙালি দম্পতী থাকতো সেই মহিলা শাফীকে এভাবে কাজ করতে দেখে নিজের স্বামির সাথে প্রায়ই ঝগড়া করতো আর আফিয়া তা শুনে হাসতো।
আফিয়া যতবার নামাজে দাঁড়ায় মহান প্রভুর দরবারে এরকম একজন মানুষকে জীবনসঙ্গী হিসাবে পাওয়ার জন্য কৃতজ্ঞতায় মাথা নত করে।
২য় পর্ব
পরদিন এগারোটার দিকে রাদিয়া নিতুর বিয়েতে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে। নিতু রাদিয়ার বেস্টফ্রেন্ড। সেই স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে কলেজ পর্যন্ত নিতুর সাথে ওর বন্ধুত্ব। রাদিয়া চুলগুলো কে উপরে তুলে ফুলিয়ে বাঁধার জন্য ঠিক করছিলো তখনি পিছন থেকে আফিয়া বলে উঠলো, কিরে রাদি কোথাও যাবি নাকি?
-হুম আপু নিতুর আজ বিয়ে তো তাই সেখানে যাবো। যাবো না ভেবেছি কিন্তু ও ফোন দিয়ে কান্নাকাটি করে অনেক রিকুয়েস্ট করছিলো তাই যাচ্ছি।
-হুম অবশ্যই যাবি। ফ্রেন্ডের বিয়ে যাবিনা কেনো? কিন্তু তুই কি এভাবেই যাবি?
-এভাবে মানে? কি বলছো?
-মানে এভাবে বোরখা ছাড়া চুল ছেড়েই কি যাবি?
-রাদিয়া আনন্দের সাথে বললো, হুম আপু।
-এই মেয়ে দিন দিন কি ছোট হয়ে যাচ্ছিস নাকি বড় হচ্ছিস? এভাবে বেপর্দা হয়ে বিয়ে বাড়িতে যাবি কত অপরিচিত পুরুষ মহিলা থাকবে ওখানে আর তুই এতো নির্লজ্জ হয়ে যাবি?
-উফ আপু! এটা এখনকার ফ্যাশন সবাই এভাবে যায়। আর বিয়ে বাড়িতে একটু সেজেগুজে না গেলে হয় নাকি?
-ফ্যাশন! কোনটাকে ফ্যাশন বলছিস নিজেকে পুরুষদের চোখে লোভনীয় করে তুলাটা তোদের ফ্যাশন। পশ্চিমা কালচার গুলো তো ভালোই ধারণ করেছিস। মহিলাদের যতগুলা চুল গায়রে মাহরাম পুরুষ দেখবে কাল কেয়ামতের ময়দানে ততগুলা সাপ তার চুলে জড়াবে ভুলে যাসনা।
-আপু তোমার এই ওল্ড কথাবার্তা গুলো ছাড়োতো। তুমি সেকেলে রয়ে গেছো আজো।
-আমি সেকেলে? ইংলিশে অনার্স মাস্টার্স কমপ্লিট করেও আমি কোন চাকরী না করেও দিব্যি ঘর সংসার সামলাচ্ছি। এতগুলো বছর বিজাতীদের মধ্যে থেকেও আমি তাদের কালচার নিজের মধ্যে ধারন করিনি সেই জন্য কি আমি সেকেলে? যদি তাই হয় তবে আমি সেকেলে। আমি ওখানে থাকাকালে মা যখন তোর কথা বলতো আমি ভাবতাম হয়তো এটা বয়সের দোষ বয়স বাড়ার সাথে সাথে ঠিক হয়ে যাবে।
কিন্তু তুই এখন যথেষ্ট এডাল্ট এভাবে বেপর্দা হয়ে চলাফেরা কি এখন ঠিক হচ্ছে?
-আপু আমি তো যথেষ্ট শালীন হয়ে চলাফেরা করছি।
-এই তোর শালীনতা? এই ওটা কি দিচ্ছিস গায়ে?
-আপু এটা বডি স্প্রে।
-সেটাতো আমিও দেখতে পাচ্ছি কিন্তু তুই এটা দিয়ে বাহিরে যাবি?
-হ্যা কেন কি সমস্যা আবার এটাতে?
-বল কি সমস্যা নেই। হাদীসে মেয়েদের সুগন্ধি জাতীয় জিনিস গুলো ব্যবহার করে বাহিরে বের হতে নিষেধ করেছে কেননা এতে করে পুরুষেরা নারীদের প্রতি বেশি আকৃষ্ট হয়। মেয়েরা ব্যবহার করবে এমন জিনিস যার রং আছে কিন্তু সুবাস নেই।
-আপু থামবি! সব কথায় তুই কেন জ্ঞান দিচ্ছিস?
-এটা আমার কথা নয় স্বয়ং রাসূল সা. বলে গেছেন।
-তোর কথা শেষ হলে আমি বেরুবো?
-এই দাঁড়া! বোরখা না পরে ঘরের বাহিরে এক পা ও দিবিনা।
-মুনিরা এসে দাঁড়াতেই রাদিয়া বললো, মা তুমি আপুকে বলবে?
-আমি কি বলবো? ও ভুল কিছু বললে আমি বলতাম কিন্তু এখন আমি কিছু বলবো না। আমার কথা তো শুনিসনা এখন কি করবি?
-আপু প্লিজ যেতে দে আমায়। দেখ সবাই সেজেগুজে আসবে আর আমি এভাবে বোরখা পরে গেলে সবাই আমাকে নিয়ে হাসি তামাশা করবে।
-সবার ভয়ে তুই এভাবে যাবি? যাকে ভয় পাওয়ার তাকে ভয় না পেয়ে ওদের ভয় পেয়ে নিজেকে ধ্বংস করবি? আজ যদি তুই ওদের বলা কথাকে উপেক্ষা করে তুই চলতে পারিস তাহলে কাল কেয়ামতের দিনে কিন্তু জয়ের হাসিটা তুই হাসবি এটা মনে রাখ।
-আপু…
-রাদি আমি কি কথাগুলো তোকে বুঝাতে পারছি না নাকি তুই বুঝতে চাইছিস না?
-আপু আমি বুঝতে পারছি। আমি কাল থেকে বোরখা পরে চলাফেরা করবো প্লিজ আজ যেতে দে আপু প্লিজ।
-রাদি তুইতো অনেক বড় বেয়াদব হয়ে গেছিস দেখছি। তুই আমার কথাও মান্য করবিনা?
একটা কথা ভালো করে শুন, যদি বোরখা পরে পর্দায় আবৃত হয়ে যেতে চাস তাহলে যাবি না হলে বাসায় বসে থাকবি। আজকের পর থেকে তোর এভাবে হুটহাট করে বেপর্দায় বাহিরে বের হওয়া যাবে না এটা আমার শেষ কথা।
রাদিয়া জানে আজ আর কোন রিকুয়েস্টে কাজ হবেন া। কিছুক্ষণ দম মেরে বসে থেকে অগত্যা আফিয়ার আনা নেভি ব্লু কালারের বোরখাটা পরে একেবারে চোখমুখ ডেকে ও বেরুলো।
রাদিয়া বেরিয়ে যেতেই আফিয়া ওর মাকে বললো, মা তুৃমি ওকে এভাবে চলার জন্য কিছু বলো না?
-মুনিরা রান্না করতে করতে বললো, তোর বোন এখন বড় হয়ে গেছে আমার কথা শুনার মত বয়স ওর আর এখন নেই। সে এখন নিজে নিজে সব সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
-তাই বলে এতোটা বেড়ে যাবে?
-তুই এসেছিস তুই ওকে বুঝিয়ে বিয়ের জন্য রাজি করা আমি আর পারছি না।
-বিয়ে? কি বলছো ও সবে মাত্র ইন্টার দিলো এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে? ওর পড়াশুনা এখনো অনেক বাকি।
-দেখ পড়াশুনা বিয়ের পর ও করা যায়। তুই তো বিয়ের পরে মাস্টার্স করেছিস তাহলে ও কেন পারবে না।
-মা আমি আর ও এক না।
(চলবে)