গ্রাম্যবধূ শিরিন গ্রামের কৃষ্টি কালচার সম্পর্কে অধিক কিছু জানত না। তার বাবার বাড়ি বেশ কয়েক গ্রাম দূরে থাকলেও তারা ঢাকা শহরে থাকত ছোটবেলা থেকেই। তার বাবা সরকারি চাকরিজীবী ছিলেন। জন্মলগ্ন থেকে একস্থানে এক পরিবারের গণ্ডিতে জীবনের এতগুলো বছর কাটানোর পরে ভিন্ন স্থানে অপরিচিত বা অর্ধ পরিচিত লোকজন নিয়ে কাটিয়ে দেওয়া নারী জীবনের আকস্মিক পরিবর্তন, যা যুগ যুগান্তর ধরে চলে আসছে। শিরিনের বর সিলেটে চাকরি পাবার পর তাদের বিয়ে হয় পারিবারিক পছন্দ মতো। এরপর কিছু দিন নিজেকে গুছিয়ে শিরিনকে নিয়ে যেতে চায় তার কর্মস্থানের পাশে একটি বাসা ভাড়া করে। মাঝের এই তিনটি বছর শিরিন তার শ্বশুরবাড়ি ময়মনসিংহে কাটায়। সেই দিনগুলোতে নববধূ হিসেবে তার জীবনের একধরণের অর্জন ছিল যা শিরিন আজ অনুধাবন করতে পারে।
শহরে লেখাপড়া করলেই যে সব মেয়ে খারাপ বা উচ্ছৃঙ্খল হয় না তা বাবামায়ের পছন্দে বিয়ে করা ফুয়াদ অনেক সময়ই বুঝতে চাইত না। অহেতুক সন্দেহ করত শিরিনকে। তার ধারণা ছিল শিরিনের হয়তোবা অনেক বন্ধুবান্ধবদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। যেটা হতে পারে কারো কারো সাথে বন্ধুত্বের চেয়ে অধিক কিছু। এছাড়াও সে শিরিনকে নিয়ে সন্দেহ করত তার আত্মীয় ভাইদের ব্যাপারেও। তাই বিয়ের পর হতে তার বাবার বাড়ি যাবার কথা উঠলেই চটে যেত ফুয়াদ। সিলেট থেকে কর্মব্যস্ততা এবং দূরত্বের কারণে ফুয়াদ সবসময় বাড়ি আসতে পারত না। বেশ কয়েক মাস গেলে বাড়ি ফিরত সে। তবে ফোনে কথা হত পরিবারের সবার সাথে রোজ। সবদিক থেকে বেশ একটা মানসিক চাপে সময় কাটছিল শিরিনের। একবার তার বাবা তাকে নিয়ে যেতে এলেন। কিন্তু ফুয়াদের অনুমতি পাওয়া গেল না। তাই তার আর যাওয়া হল না। পথ যেতে যেতে চোখ মুছতে থাকলেন তার বাবা। তবুও জোর করে মেয়েকে নিয়ে যেতে চাননি। মেয়েও বাবাকে বলল:
“আব্বা! কিছুদিন পরে আবার আমাকে নিতে আসবেন। আমি তার কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে রাখব। ”
বাবার বাড়ি থাকাকালীন ফুয়াদ বেশি ফোন করত না। আর ফোন করলেও তার সন্দেহের উৎগীরণ করত। আদুরে কন্যা শিরিন গ্রামের বাড়িতে কাজকর্ম করতে পারত না তেমন। রান্নাবান্নায়ও তত দক্ষ ছিল না সে। তাই তার শাশুড়ি তেমন পছন্দ করতেন না তাকে প্রথম দিকে। অনেক সময় লোকজনকে বলতেন:
“আমার বিয়াইন মেয়েকে কেবল লেখাপড়াই শিখিয়েছে …কাজকর্ম, রান্নাবান্না কিছুই শিক্ষা দেয়নি। ”
শিরিন ছোটবেলা থেকে গালিগালাজ করাটা একেবারেই অপছন্দ করত। কিন্তু তার শ্বশুরালয়ে এসে অবাক হয়ে লক্ষ্য করে ঘরে ঘরে ঝগড়া বিদ্বেষ, মারামারি, গালিগালাজ করাটা যেন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। একদিন গালিগালাজ না হওয়াটাই যেন অস্বাভাবিক সেখানে। মাঝেমধ্যে শিরিন ঘরের কপাট লাগিয়ে কেঁদেছে ….এ কোন জগতে এসে পড়েছে সে….তার ভাগ্যটা কেন এমন হল….
তবে ভাগ্যকে মেনে নিয়েছে শিরিন….বুঝে নিয়েছে এটাই তার জীবনের পরীক্ষা। বাবামায়ের আদর যতেœ লালিত পালিত হয়ে জগতের অনেক জটিলতাই সে অনুধাবন করতে পারেনি এতদিন। আজ সে কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। তবে তাকে বিজয়ী হতেই হবে…কারণ নিশ্চয়ই আল্লাহ্ ধৈর্যশীলদের সহায় হন….এটাই তার বিশ্বাস।
শ্বশুরবাড়িতে শ্বশুর, শাশুড়ি, সে ছাড়াও থাকত তার বয়সে বড় এক ননদ, তার এক ছেলে আর এক মেয়ে আর ননদের স্বামী। ননদের স্বামী ঐ গ্রামেই একটি এনজিওতে চাকরি করতেন বলে তারা সেই বাড়িতেই থাকতেন। এ নিয়ে শিরিনের তেমন কোন মাথাব্যথা ছিল না বটে কিন্তু তার ননদ ফিরোজা সবসময়ই ভাবত শিরিন তাকে হিংসা করে। রান্নাবান্না ফিরোজাই সাধারণত করত …আর তার হাতের রান্নাও ছিল খুব সুস্বাদু ….যাকে বলে একেবারে খাঁটি দেশীয় রান্নার স্বাদ। ফিরোজার হাতে বড় মাছ রান্নার কথা তো বাদই দিলাম গুরা মাছ অর্থাৎ ছোট ছোট মাছ রান্নাও ছিল অসাধারণ। শিরিনের মায়ের রান্নাও ছিল চমৎকার তবে বিয়ের পূর্বে ততটা খেয়াল করে দেখা হয়নি তার। ফিরোজার রান্নার সময়ে শিরিন তাকে কাটাকাটি, বাটাবাটি আর ধোয়ার কাজ করে সহায়তা করত। আবার ঘর গুছানো সহ ঘরের অন্যান্য কাজ করত। তার শ্বশুর একদিন বললেন,
“আমাদের রান্না করে খাওয়াবে না বৌমা?”
শিরিন ও ফিরোজাকে বলল,
আজ আমি রান্না করি আপা ….আপনি আমাকে বলে বলে দিন কিভাবে করব।
ফিরোজা মুখ কালো করে ফেলে জবাব দিল,
‘রান্না যে করবে তার মতে মতে করাই ভালো’
কথাটি বলেই রান্নাঘর থেকে দূরে সরে গিয়ে ফিরোজা কচুর লতি কেটে একজনকে ধরে পাঠিয়ে দিয়ে ছেলেকে নিয়ে বাড়ির অন্য ভাবীদের সাথে খোশগল্পে মশগুল হল। তার শাশুড়ি মেয়ের উপরে অনেক নির্ভরশীল ছিলেন। রান্নার সময়ে তাকেও খুঁজে পাওয়া গেল না। খুব চিন্তায় পড়ে গেল শিরিন। একবার তার মা অসুস্থ হলে বাড়িতে বেড়াতে আসা ফুফাতো বোন আর সে কি কাণ্ডটাই না ঘটিয়েছিল ভাবলে আজও মনে মনে হেসে ফেলে সে। ইলিশ মাছ রান্না করার জন্য গরম মসলা বেটেছিল তারা। কেবল মেশানোটাই ছিল বাকি। এর আগেই তার মা রান্নাঘরে আসায় শেষ রক্ষাটা হল। এবার অবশ্য শিরিন তেমনটা করল না। তবে রান্না সম্পর্কে অপারদর্শী শিরিন মাছের তরকারিতে পানি রেখে দিল অনেক …আবার হলুদ, লবণ, ঝাল ইত্যাদিও পরিমাণে কম বেশি করল। শ্বশুর খেয়ে বললেন,
ফিরোজা যেভাবে রান্না করে সেভাবে করতে পার না? ওর কাছ থেকে শিখবা
শিখার আগ্রহ তার ছিল বটে তবে সুযোগ পেল কোথায়?
শিরিনের বিয়ের সময় ফিরোজার মেয়ে তানিশা প্রথম শ্রেণিতে পড়ত। লেখাপড়ায় তত ভালো ছিল না। তার মা বাবাও তার পড়াশোনার দিকে তত যতœশীল ছিলেন না। শিরিন তানিশাকে অত্যন্ত স্নেহ করত …ওকে লেখাপড়া করাত, খাইয়ে দিত, গোসল করাত, ঘুম পাড়াত। ধীরে ধীরে তানিশাও তার মামীর অত্যন্ত ভক্ত হয়ে গেল। এই অচেনা দ্বীপে তানিশাই হয়ে উঠল শিরিনের একাকীত্বের সঙ্গী…তার পরম আপনজন। আর তানিশাও তার খেলার সাথীদেরকে বলত ,
“আমার আম্মু দুটি….মামীমাও আমার একটি আম্মু। ”
শিরিন বাবাবাড়ি বেড়াতে গেলে তানিশা কেঁদে কেঁদে বুক ভাসাত। তাকে অনেক বুঝিয়ে শান্ত্বনা দিয়ে যেতে হত শিরিনের। ক্রমে ক্রমে লেখাপড়ায় ভালো করতে থাকে তানিশা। কিছুদিনের মাঝে বিদ্যালয়ে প্রথম কয়েকজনের মাঝে স্থান করে নেয় সে।
বাড়ির অন্য ভাবীদের সাথে শিরিনের সম্পর্ক অত্যন্ত মধুর ছিল বটে যদিও অন্য ঘরগুলোতে যাওয়া তার শ্বশুর-শাশুড়ি পছন্দ করতেন না তেমন। শিক্ষিত নারী হিসেবে সবাই তাকে বেশ সম্মান করত। শিরিন অবসরে তাদের পাশে গিয়ে বসত, গল্পগুজব করত, তাদের দুঃখ সুখের খবর নিত। নববধূর নবীনতা ভেঙে যখন বাড়ির বৌ হয়ে উঠল শিরিন তখন অনেক কিছুকেই সমাধান করার মতো মানসিক শক্তি অর্জন করে ফেলল। এমনকি বাড়ির ভাবীদের মাঝে ঝগড়া গ্যাঞ্জাম শুরু হলে সে এসে সমোঝোতা করতে চাইত। আর তার আগমনে অনেকেই তাদের নিত্যনৈমিত্তিক বুলি গালিগালাজ ভুলে লজ্জায় কিছুটা নীরব হয়ে যেত … পুরোপুরি না থামলেও অন্তত গতিটা ধীর হয়ে আসত। এরপর সুযোগ বুঝে তাদের সমস্যা সমাধানের প্রয়াস করত শিরিন তার সাধ্যমতো। বাড়ির ছেলেমেয়েরাও অনেক সময় শিরিনের কাছে পড়াশোনা করতে আসত। শিরিনও চেষ্টা করত তাদের সহযোগিতা করার জন্য।
তিন বছর শেষ হয়ে এল। ফুয়াদ শিরিনকে নিয়ে যেতে এসেছে তার কাছে সিলেটে। মোটামুটি সুন্দর একটি বাসাও ঠিক করেছে সে। তবে পুরো বাড়িতে যেন কালো আঁধার নেমে এসেছে। এই বছর তিনেকের মধ্যেই শিরিন অনেকের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছে। সবাই তাকে বাড়িতে থেকে যেতে অনুরোধ করছে। তারও সবার জন্য অনেক মায়া হচ্ছিল আর সবচেয়ে অধিক মায়া হচ্ছিল সেই বিচ্ছিন্ন দ্বীপের একান্ত সাথী তানিশার জন্য।
Check Also
বিদায়বেলা
জামুরাইল হাই স্কুলের বাংলা শিক্ষক ইমরান হোসেন। প্রতিদিন সকাল ৯ টায় স্কুলে আসেন। যথারীতি তিনি …