হালাল খাদ্য এবং উপার্জনের উপকারিতা

আল্লাহ রাব্বুল আলামিন যিনি সমগ্র বিশ্ব জাহানের মালিক, লালনকারী, পালনকর্তা, শাসনকর্তা, রিযিকদাতা; সকল বিধি বিধান তাঁরই নির্দেশ পালন ও বাস্তবায়নের জন্য। সাগরের প্রবাহমান স্রোত, মেঘমালার বিচরণ, চাঁদ-সুর্যের আগমন-নির্গমন, পাহাড়ের অবিচলতা, জমিনের উঁচু-নিচুতা, মৌসুমের বিবর্তন এই সবই মহান স্রষ্টা রাব্বে করিমের আদেশ পালনের বাস্তব নমুনা।
সৃষ্টির মধ্যে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মানুষকে আশরাফুল মাখলুকাত হিসাবে সৃষ্টি করেছেন তাঁর আদেশ নিষেধ বাস্তবায়নের জন্য। তাই মানুষের জন্য আছে পরীক্ষা ও জবাবদিহিতা। মানুষের জাগতিক জীবনে চাহিদার কোনো শেষ নেই। একমাত্র মানুষকেই আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ইচ্ছা শক্তি দান করেছেন, ইচ্ছা শক্তির মাধ্যমে মানুষ তার কর্ম সম্পাদন করে থাকে, নিষিদ্ধ বা হারাম থেকে বিরত থাকে এবং হালাল বা বৈধ পন্থার মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভে ধন্য হয়। প্রত্যেক মানুষ নিজের যোগ্যতানুযায়ী প্রয়োজনীয় অর্থ-সম্পদ উপার্জন করবে, কারণ এটা তার জন্য স্রষ্টা প্রদত্ত সৃষ্টিগত অধিকার। কিন্তু এসব উপার্জন অবশ্যই হালাল বা বৈধ পন্থায় হওয়া আবশ্যকীয়। ইসলামী শরিয়ত সমর্থন করে না, এমন কোনো পন্থায় সম্পদ উপার্জন করলে তা হবে হারাম বা অবৈধ। ইসলামী শরীআতে হালাল-হারামের বিষয়ে খুবই সাবধানতা ও সতর্কতা অবলম্বন করা হয়েছে, তাই হালাল এবং হারাম সম্পর্কে জ্ঞান থাকা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য ফরদ্ব (আবশ্যকীয়)।
হালাল এবং হারামের সংজ্ঞা:
(১): হালাল:- হাল’ বা হালাল শব্দের প্রকৃত অর্থ হলো গিঁট খোলা। যেসব বস্তুসামগ্রীকে মানুষের জন্য হালাল বা বৈধ করে দেয়া হয়েছে, তাতে যেন একটা গিঁট খুলে দেয়া হয়েছে এবং সেগুলোর ওপর থেকে বাধ্যবাধকতা সরিয়ে নেয়া হয়েছে। শরীআতের (ফিকহের) পরিভাষায় আল্লাহর কিতাব (কোরআন) এবং রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হাদীস যা হালাল করেছে তা-ই হালাল।
(২): হারাম:- হারাম শব্দের অর্থ বাঁধা দেওয়া, শরীআতের (ফিকহের) পরিভাষায় সেইসব জিনিসকে হারাম বলা হয়, যেগুলোতে লিপ্ত হওয়া থেকে শরীআতে নিষেধ করা হয়েছে। অর্থাৎ কর্ম হিসাবে যে আচরণ সরাসরি ও সর্বাবস্থায় শরীআতের দৃষ্টিতে নিন্দনীয় তা-ই হারাম।
হালাল গ্রহণ এবং হারাম বর্জনের ব্যপারে কোরআন ও হাদিস শরীফের উক্তি:
আল্লাহ্ তা’আলা সমগ্র মানুষের সৃষ্টিকর্তা। তিনি মানুষকে এতসব অমূল্য নিয়ামত দান করেছেন, যার কোন হিসাব-নিকাশ করা সম্ভবপর নয়। তাই স্বভাবতই তাঁর অধিকার রয়েছে মানুষের জন্যে কোন কিছুকে হারাম বা হালাল ঘোষণা করার। এ ব্যাপারে কারো কোন প্রশ্ন করার বা আপত্তি জানাবার কোন অধিকারণ থাকতে পারে না। তিনি রাব্ব- এ হিসেবেই তাঁর এ অধিকার। মানুষ তাঁরই বান্দা। এ বান্দাহ হিসেবেই মানুষ তাঁর এ অধিকার মেনে চলতে বাধ্য। কোরআনে পাকের মধ্যে আল্লাহ্ তা’আলা ইরশাদ করেন।
(১): হে মুমিনগণ, আহার কর আমি তোমাদেরকে যে হালাল রিযক দিয়েছি তা থেকে এবং আল্লাহর জন্য শোকর কর, যদি তোমরা তাঁরই ইবাদাত কর। নিশ্চয় তিনি তোমাদের উপর হারাম করেছেন মৃত জন্তু, রক্ত, শূকরের গোশ্ত এবং যা গায়রুল্লার নামে যবেহ করা হয়েছে। সুতরাং যে বাধ্য হবে, অবাধ্য বা সীমালঙ্ঘনকারী না হয়ে, তাহলে তার কোন পাপ নেই। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। (সুরা বাকারাহ ১৭২-৭৩)।
উপরোক্ত আয়াতে যেমন হালাল ও পবিত্র বস্তু খেতে এবং তা খেয়ে শুকরিয়া আদায় করতে অনুপ্রাণিত করা হয়েছে ঠিক তেমনি হারাম খাওয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন অন্যত্র ইরশাদ করেন:
(২): তোমরা চক্রবৃদ্ধি হারে সূদ খেয়োনা। (৩:১৩০)
(৩): তোমরা স্ত্রীদেরকে মহর হিসাবে যা দিয়েছ তা আতœসাৎ করা তোমাদের জন্য হালাল নয়। (২:২২৯)
(৪): তোমাদের জন্য মৃত প্রাণী হারাম করা হয়েছে। (৫:৩)
(৫): মানবমণ্ডলী! তোমরা খাও, পৃথিবীতে যা কিছু হালাল ও পবিত্র খাদ্য রয়েছে (হারাম ব্যতিত)। এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ কর না, নিঃসন্দেহে সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু। (সূরা বাকারা : ১৬৮)
এভাবে অসংখ্য আয়াতে কারিমায় আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মানুষকে হারাম কাজ থেকে বিরত থাকার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন এবং হালালের প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছেন। কোরআনে কারিমে যে সমস্ত কাজকে নিষেধ করা হয়েছে শরীআতের দৃষ্টিতে সেই সব কাজকে হারাম বা অবৈধ নির্ধারণ করা হয়েছে। তাই সেই সমস্থ হারাম কাজ থেকে বিরত থাকা প্রত্যেক মানুষ বিশেষ করে মুসলমানদের জন্য আবশ্যকীয়। ইসলামী শরীআতে যে সব কাজের ব্যপারে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এবং রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিষেধ করেছেন তা-ই হারাম। তবে কখনো কখনো বিভিন্ন কাজের আদেশ “ফরদ্ব” এবং নিষেধ “হারাম” প্রমাণ করে না বরং মাকরূহ প্রমাণ করে। এই ব্যতিক্রম স্থানগুলো মুফাসসির, মোহাদ্দিস এবং ফিকাহবিদগণ চিহ্নিত করে রেখেছেন।
হাদিস শরীফে রাসুল (সা.) উল্লেখ করেন,
(১): কোনো ব্যক্তি দূর-দূরান্তে সফর করেছে, তার মাথার চুল এলোমেলো, শরীরে ধুলা-বালি লেগে আছে। এমতাবস্থায় ওই ব্যক্তি উভয় হাত আসমানের দিকে তুলে কাতর স্বরে হে প্রভু বলে ডাকছে। অথচ তার খাদ্য হারাম, পানীয় হারাম, পরিধেয় বস্ত্র হারাম এবং সে হারামই খেয়ে থাকে। এই ব্যক্তির দোয়া কীভাবে কবুল হবে? (মুসলিম, তিরমিযি)
(২): হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী করিম (সা.) বলেছেন, মানুষের কাছে এমন এক সময় আসবে, যখন ব্যক্তি কোন উৎস থেকে সম্পদ আহরণ করেছে তা হালাল না হারাম সেদিকে কোনো ভ্রূক্ষেপ করবে না। (মিশকাত/বায়হাকি)।
(৩): যে শরীর হারাম খাদ্যের মাধ্যমে লালিত পালিত হয়েছে তা জান্নাতে প্রবেশ করবেনা। (মিশকাত)
(৪): হযরত রাফে ইবনে খাদীজা রাদিয়াল্লাহু আনহা হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে, সর্বোত্তম উপার্জন কোনটি? জবাবে তিনি বলেন: ব্যক্তির নিজস্ব শ্রমলব্দ উপার্জন ও সততার ভিত্তিতে ক্রয়-বিক্রয়। (ইমাম আহমাদ, মুসনাদ, খ.৪, পৃ. ১৪১)।
(৫): ফরদ্ব আদায়ের পর হালাল পন্থায় উপার্জনও ফরদ্ব। (সূনান আল-বায়হাকী, খ. ৬, পৃ. ১২৮)।
(৬): হালাল সুস্পষ্ট হারাম ও সুস্পষ্ট এবং এ দু’টির মধ্যখানে যে সব জিনিস সন্দেহযুক্ত অনেকেই তা জানেনা। (মিশকাত)।
(৭): যে ব্যক্তি হারাম মালের এক লোকমা তার পেটে ঢোকাবে, ৪০ দিন পর্যন্ত তার নামাজ-রোজা, ইবাদত-বন্দেগি কবুল হবে না। (তাবরানি শরিফ)।
বর্তমান যুগটি বস্তুবাদের যুগ, এ যুগে আধ্যাতিœকতা খুবই গৌন। সাধারন মানুষের বিশেষ করে মুসলমানদের ভিতর থেকে আকীদা-বিশ্বাস, তাক্বওয়া এবং সৎ চরিত্রের বিলুপ্তি হচ্ছে, তাই সময় দাবি হল, সমাজের সচেতন আলিম উলামারা বিশেষ করে তাকওয়া সম্পন্ন সূফিবাদি উলামাদের উচিত মানুষকে হালাল জীবিকা অর্জনের জন্য উদ্বুদ্ধ করে ইবাদতের প্রতি মনোযোগী করা।
সমাজ ও ব্যক্তি জীবনে হালাল এবং হারাম উপার্জনের প্রভাব:
ইসলাম এক মহাসৌন্দর্য মণ্ডিত জীবন বিধান। মানুষের জীবনে স্বাচ্ছন্দ বিধানের উদ্দেশ্যে, গোমরাহী, পথভ্রষ্টতা, হালাল-হারাম, জায়েজ ও নাজায়েজ নির্ণয়, সত্য ও ন্যায়ের পথ গ্রহণের লক্ষ্যে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তার শেষ আসমানি কিতাব পবিত্র কোরআনে বিভিন্ন মূলনীতি প্রণয়ের মাধ্যমে হালাল ও হারাম চিহ্নিত করেছেন। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বাস্তবায়নের মাধ্যমে মানুষকে বৈধ পন্থায় সত্য ও ন্যায়ের পথ গ্রহনে সাফল্যের সু-সংবাদ দিয়েছেন এবং এই পথ হতে বিচ্যুত হলে অর্থাৎ হারাম বা অবৈধ পন্থায় পরিচালিত হলে জাহান্নামের সতর্কবাণী শুনিয়েছেন।
হালাল উপার্জন এবং খাদ্য সমাজ ও ব্যক্তি জীবনে আল্লাহ প্রদত্ত এক মহান নেয়ামত। হালাল খাদ্য গ্রহণের মধ্যে ব্যক্তি জীবনে নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত, দান-খয়রাত, লেনদেনসহ যাবতীয় নেক আমল কবুল হওয়ার সমূহ আশা বিদ্যমান। হালালের মধ্যে বরকত আর রহমত থাকার দরুণ অন্তরে এক ধরণের নূর সৃষ্টি হয়, যা দ্বারা অন্যায় ও বদ চরিত্রের প্রতি ঘৃণা জন্মায় এবং সততা-সাধুতা ও উত্তম চরিত্রের প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি পায়; ইবাদত-বন্দেগির প্রতি অধিক মনোযোগ আসে, পাপের কাজে মনে ভয় আসে। আর এ কারণেই আল্লাহ তাঁর সব নবী-রাসুলের প্রতি ইরশাদ করেন, “হে আমার প্রিয় রাসুলগণ! তোমরা পবিত্র (হালাল) খাদ্য গ্রহণ করো এবং নেক আমল করতে থাকো”। (সুরা মুমিনুন, আয়াত ৫১)।
হালাল উপার্জন ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে যেমন বিরাট নেয়ামত ঠিক তেমনি হারাম উপার্জনের প্রভাব খুবই মারাত্মক। হারাম উপার্জনের ফলে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মানবজীবন থেকে সব ধরণের বরকত ছিনিয়ে নেন। রোগ-ব্যাধি ছড়িয়ে পড়ে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে। আর্থিক অনটন-সংকট দেশে-সমাজে শক্তভাবে শিকড় গেড়ে বসে। বেকারত্ব অভিশাপ আকারে প্রকাশিত হয়। জুলুম, অন্যায়, প্রতিহিংসা ও রেষারেষির সয়লাব ঘটে। যারা হারাম খাদ্য গ্রহণ করে, পরিবার-পরিজন, ছেলে-সন্তানদের হারাম অর্থে লালন করে, তারা মারাত্মক ক্ষতির মধ্যে নিমজ্জিত হয়। তাদের উদাহরণ সাগরের পানি পানকারীর মতো। যতই সে পান করে, ততই তার পিপাসায় আগুন ধরে। এরা অল্পে তুষ্ট হতে নারাজ, আবার অধিক পেয়েও থেকে যায় অসন্তুষ্ট। এরা হারামকে মনে করে সুস্বাদু-সুখাদ্য। বর্তমান যুগে তো হারাম খাওয়ার জন্য রীতিমতো প্রতিযোগিতা চলছে। কলাকৌশলে যে যত বেশি সম্পদ একত্রিত করতে পারে মানুষ তাকে তত বেশি চালাক ও বিচক্ষণ বলে। আর হালাল খেয়ে অল্পে তুষ্ট থাকা মানুষকে বর্তমান সমাজে বোকা বলে অভিহিত করা হয়। বড়ই আফসোসের বিষয় হচ্ছে বর্তমান যুগের স্ত্রীরাও তাদের পুরুষদের হারাম সম্পদ দু’হাতে লুটে নিতে উৎসাহ জোগায়। বর্তমান যুগে হারাম খেয়ে কেউ বমি করা তো দূরে থাক, সবাই বরং তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলে। আল্লাহ আমাদের সবাইকে হারাম উপার্জন থেকে দূরে থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন।
হালাল উপার্জনের দোয়া:
হালাল উপার্জনের জন্য আমরা যেন আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের দরবারে প্রতিদিন কায়মনো বাক্যে দোয়া করতে পারি তাই প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে একটি উত্তম দোয়া শিক্ষা দিয়েছেন।
হজরত উম্মে সালামা (রা.) বলেন, আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফজরের নামাজের সালাম ফেরানোর সঙ্গে সঙ্গেই নিয়মিত এ দোয়াটি পড়তেন।
উচ্চারণ : আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকা ই’লমান নাফিয়া’ ওয়া রিজকান তাইয়্যিবাহ ওয়া আমালান মুতাকাব্বিলা।
অর্থ : হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে এমন ইলম চাই যা আমার জন্য উপকারী। এমন রিজিক চাই যা আমার জন্য পবিত্র ও হালাল। এবং এমন আমলের তাওফীক চাচ্ছি যা তোমার দরবারে কবূল হবে। (ইবনে মাজাহ-৯২৫ নাসায়ি সুনানে কুবরা-৯৯৩০)।

Comments

comments

About

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *