শিশুদের প্রতি হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম

মানবজাতির জন্য সবচেয়ে কল্যাণমুখী জীবন ব্যবস্থার নাম ইসলাম। মহান আল্লাহর দেয়া এ জীবনব্যবস্থায় নারী পুরুষ শিশু বৃদ্ধ সর্বস্তরের সকল মানবের সম্যক অধিকার সংরক্ষিত হয়েছে। আজকে আমরা শিশুদের প্রতি ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আলোচনা করবো। ইসলামের নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কেমন ছিলেন শিশুদের প্রতি তা তুলে ধরার চেষ্টা করবো। শিশুদেরকে ভালোবাসা, সুন্দর নাম রাখা, উত্তমরূপে লালন পালন করা, আদব কায়দা শিক্ষা দেয়া, দীনি ইলম শেখানো, তাদের অবুঝ আবদার মেনে নিয়ে তাদের সাথে খেলাধুলা করা ইত্যাদি সর্বক্ষেত্রে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর অগণিত উপদেশ বিদ্যমান। আবার সেগুলো কাজে পরিণত তথা বাস্তবায়ন করে দেখানোর হাজারো দৃষ্টান্ত নবীজীর জীবনকর্মেই ফুটে উঠেছে। পৃথিবীবাসীর সামনে যা সূর্যের আলোর মতোই স্পষ্ট।
সুরা আলে ইমরান এর ১৪ নাম্বার আয়াতে মানুষের প্রিয় বস্তুর তালিকায় মহান আল্লাহ তায়ালা ৮ টি জিনিসের উল্লেখ করেছেন। তন্মধ্যে পরিবার ও সন্তানকে প্রথমে স্থান দিয়ে ঘোষণা করেন-
زُيِّنَ لِلنَّاسِ حُبُّ الشَّهَوَاتِ مِنَ النِّسَاءِ وَالْبَنِينَ
‘মানুষের কাছে লোভনীয় করে দেয়া হয়েছে তাদের পরিবার, সন্তান।’ সুতরাং শিশু সন্তানের প্রতি মানুষ স্বভাবতই দুর্বল। স্বয়ং প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার আদুরে নাতিনের ব্যাপারে বলেন-
إن الحسن و الحسين هما ريحانتاي من الدنيا
‘নিশ্চয়ই হাসান ও হুসাইন আমার নিকট দুনিয়ার সুগন্ধি।’ রিতমিযি শরীফ, হাদীস নাম¦ার ৩৭৭০। একদিন প্রিয় নবীজী মসজিদের মিম্বরে বক্তৃতা করছিলেন। এমন সময়ে হাসান ও হুসাইন দৌড়ে তার কাছে পৌঁছলে তিনি কথা বন্ধ করে মিম্বর থেকে নেমে তাদেরকে কোলে তুলে নেন। অতপর বলেন-
نظرت إلى هذين الصبيين يميشيان ويعثران فلم أصبر حتى قطعت حديثي ورفعتهما
আমি এই দুই শিশুকে হোচট খেয়ে খেয়ে আমার দিকে আসতে দেখলাম। এতে আমি আর ধৈর্য ধরতে পারলাম না। এমনকি আমার কথা বন্ধ করে তাদেরকে কোলে তুলে নিলাম। তিরমিযি শরীফ, হাদীস: ৩৭৭৪।
তিনি শিশুদেরকে আগে সালাম দিতেন, যে কথা উল্লেখ আছে সহীহ মুসলিম শরীফের ৫৭৯১ নাম্বার হাদীসে। তার কাছে কোন শিশু নিয়ে আসলে তিনি আদর করে কোলে তুলে নিতেন এবং মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করতেন। মেযনটা উল্লেখ আছে হযরত আয়েশা রা. বর্ণিত সুনানু আবি দাউদ এর ৫১০৮ নাম্বার হাদীসে। শিশুদের জন্য বরকত ও জ্ঞানার্জনের দোয় করতেন। যেমনটা শিশু ইবনে আব্বাস রা. কে। اللهم فقهه في الدين হে আল্লাহ, আপনি তাকে দীনের জ্ঞান দান করুন। এই দোয়ার বেদৌলতেই ইবনে আব্বাস রা. এমন জ্ঞানের অধিকারী হলেন যে, রইসুল মুফাসসিরীন বা মুফাসসিরদের সম্্রাট উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন। প্রিয় নবীজী ইরশাদ করেন-
ليس منا من لم يرحم صغيرنا ويوقر كبيرنا
‘যে ব্যক্তি ছোটদের ¯েœহ করে না এবং বড়দের সম্মান করে না সে আমাদের দলভুক্ত নয়। সুনানে তিরমিযি, হাদীস নাম্বার ১৯১৯। তিনি আরো বলেন- শশিুদরে প্রতি স্নহে ও আদর দখোয় না এমন ব্যক্তকিে ইসলাম থকেে বহষ্কিার করা উচতি। এজন্য ওলামায়ে ক্বরোম বলনে, ছোটদরে প্রতি দুর্ব্যবহার কবরিা গুনাহরে সমতুল্য।
সম্মানিত শ্রোতা, একটি শিশু যদি ইয়াতীম হয়, তার প্রতি নবীজীর দয়া আরো বেশি। নবীজী নিজেই ইয়াতীম হয়ে দুনিয়াতে এসেছিলেন এবং বেড়ে উঠেছিলেন। বুখারী শরীফের ৪৯৯৮ নাম্বার হাদীসে ইরশাদ হচ্ছে-
أنا وكافل اليتيم في الجنة هكذا وأشار بالسبابة والوسطى وفرج بينهما شيئا
আমি এবং এতমিরে প্রতপিালনকারী জান্নাতে এভাবে থাকব। একথা বলে তনিি র্তজনী ও মধ্যমা অঙ্গুলরি মধ্যে সামান্য ফাঁক রাখলনে। ইয়াতীম শিশুর প্রতি শুধু বাণী দিয়েই তিনি ক্ষান্ত ছিলেন না। একদা ঈদের দিনে একটি ইয়াতিম শিশুকে কাঁদতে দেখে তাকে আদর করে নিজের ঘরে নিয়ে গিয়েছিলেন এবং পুত্রের মত তাকে লালন পালন করে বড় করেছিলেন। তাঁর পালক পুত্র যায়েদকে সবাই যায়েদ ইবনে মুহাম্মাদ বলেই জানতো। সবচেয়ে আশ্চর্য বিষয় এই যে, কোন এক সময় এই যায়েদের পিতামাতা তাদের এই হারানো ছেলের খোঁজ পেয়ে তাকে নেয়ার জন্য নবীজীর দরবারে হাজির হয়েছিল। তখন নবীজী জিজ্ঞেস করলেন হে যায়েদ, এই মহিলা এবং এই পুরুষ লোকটিকে তুমি চিন? যায়েদ বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ এরা আমার মা এবং বাবা। তখন নবীজী বললেন- ঠিক আছে। আমি এতদিন তোমাকে লালন পালন করেছি এখন তুমি তোমার মাবাবার সাথে যেতে পারো। তখন যায়েদ বলে উঠেছিলেন- হে আল্লাহর রাসুল, আপনার আদর সোহাগের চাইতে কোনো মাবাবার আদর আমি চাইনা। তিনি মাবাবাকে ফিরিয়ে দিলেন। নবীজীর কাছেই থেকে গেলেন। পৃথিবীতে এমন একটি উদাহরণও কি কোন ধর্মগুরুর আছে? যেখানে একটি শিশু মাবাবাকে বাদ দিয়ে অন্যের আদরকে প্রাধান্য দিয়ে খুঁজে পাওয়ার পরও মাবাবার সাথে ঘরে ফিরে যেতে চায়নি? এটা কেবলই শিশুদের প্রতি অসীম ভালবাসার দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী নবীজী মুহাম্মদ স. এর বেলায়তেই প্রযোজ্য।
সৎ পিতা ও সৎ মায়ের আদরের কথা আমরা সবাই জানি। অথচ প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একাধিক শিশু সন্তানসহ উম্মে সালামা রা. কে বিয়ে করে এনেছিলেন। তার শিশু পুত্র আমর ইবনে আবি সালামা বর্ণনা করেন- খাবার সময় আমার হাত এলোপাথারিভাবে থালার মধ্যে বিক্ষিপ্ত হতো। নবীজী আমাকে বললেন-
ياغلام سم الله وكل بيمينك وكل مما يليك
হে বৎস, তুমি বিসমিল্লাহ বলো, এবং তোমার ডান হাতে খাও আর থালার নিকটবর্তী জায়গা থেকে খাবার গ্রহণ করো।’ এভাবে হাতে কলমে শিশুকে তিনি আদব শিক্ষা দিয়েছেন। ঘোষণা করেছেন-
لأن يؤدب الرجل ولده خير من أن يتصدق بصاع
‘শিশুকে আদব শিক্ষা দেয়ার বিনিময়ে এক সা’ পরিমাণ সদকা করার সাওয়াব হবে।’ সুনানে তিরমিযি, হাদীস নাম্বার ১৯৫১।


একদা আমীরে মুয়াবিয়া রা. এর গলায় রশি লাগিয়ে একটি শিশু তাকে ঘোড়ার মতো টেনে টেনে মাঠে খেলা করছিলো। তখন লোকেরা বলে উঠলো হায় হায়! স্বয়ং খলিফার এ অবস্থা। তখন তিনি হুংকার ছেড়ে বললেন- দূর হও, তোমরা কি বলছো আমি তো দেখেছি স্বয় বিশ্বনবী মুহাম্মাদ সা. এক ঘোড়া বানিয়ে হাসান ও হুসাইন পিঠে চড়ে খেলা করতেন। সে দৃশ্য দেখে এক লোক শিশু হাসানকে লক্ষ্য করে বলে উঠেছিলো-
نعم المركب ركبت يا غلام
হে শিশু তুমি কত মহান বাহনে আরোহণ করেছো, জানো? ইনি তো নবীকুলের শিরোমণি, দোজাহানের বাদশা। এ কথা শুনে স্বয়ং নবীজী বলে উঠলেন- ونعم الراكب هو আরোহীও তো কতইনা উত্তম। সুবহানাল্লাহ। নবীজী বললেন আরোহীও তো বেহেশতী যুবকদের সর্দার।
একদা প্রিয় নবী স. তাঁর নাতি হাসানকে চুমু খলেনে। সখোনে আকরা ইবনে হাবসি নামে এক সাহাবী বসা ছলিনে। তনিি বললনে, আমার দশটি সন্তান রয়ছে।ে আমি তাদরে কাউকে চুমু খাইন।ি নবীজী তার দকিে তাকযি়ে বললনে, যে দয়া করে না, তার প্রতওি দয়া করা হবে না। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৬৫১;
আরকে হাদীসে আম্মাজান আয়শো রা. বলনে, এক গ্রাম্যব্যক্তি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামরে কাছে আসল। নবীজী তাকে বললনে, তোমরা কি তোমাদরে শশিুদরেকে চুমু খাও? সে বলল, আমরা তাদরেকে চুমু দইে না। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললনে,
أو أملك لك أن نزع الله من قلبك الرحمة
আল্লাহ যদি তোমার অন্তর থেকে দয়া ছিনিয়ে নিয়ে থাকনে তাহলে আমার কী করার আছ?ে -সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৬৫২,
সুনানে নাসাঈ শরীফের হাদীস ১১৪২ হাদীসে এসেছে নবীজী সিজদাতে এত দেরী করলেন যে, নামাজ শেষে তাকে সাহাবায়ে কিরাম জিজ্ঞেস করলেন ইয়া রাসুলাল্লাহ, আমরা মনে করেছিলাম কোন একটা ঘটনা ঘটেছে অথবা অহী নাযিল হচ্ছে। নবীজী উত্তর করলেন এদুটির একটিও না বরং-
ولكن ابني ارتحلني فكرهت أن أعجله حتى يقضي حاجته
আমার এই নাতি পিঠে চড়ে বসেছে আর আমি তাড়াতাড়ি উঠতে চাইনি যাতে সে তার মনমতো খেলার প্রয়োজন সারতে পারে।
সম্মানিত শ্রোতা, হাদীসের কতিাবে এজাতীয় বহু ঘটনা বিদ্যমান রয়েছে। এ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে আমাদের উচিৎ প্রতিটি শিশুকে যে গুলো আমাদেরকে প্রতিটি শিশুকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে লালন পালন করতে উৎসাহিত করে। শিশুকে একটি একটি শিশু মা বাবার জন্য আল্লাহর উপহার। শুধু মা বাবার জন্য নয় একটি সমাজ ও দেশের জন্য আশীর্বাদ হতে পারে। অনুরূপ একটি শিশুই হতে পারে মহান আল্লাহ অলী। পৃথিবীর মানুষকে পথ দেখানোর পথপ্রদর্শক। সুতরাং পিতা যতই নীচু শ্রেণীর হোস তার সন্তানটি অবহেলার নয়। কবি নজরুলের ভাষায়
‘হয়তো উহারি ঔরষে ভাই উহারি কুটির বাসে
জন্মিছে কেহ জোড়া নাই যার জগতের ইতিহাসে।’
অনেক নবী ও জগৎজোড়া অলী একেবারে সাধারণ পিতার ঘরে জন্মগ্রহণ করেছেন। সুতরাং আমরা সবাই আগামী প্রজন্মকে সুন্দর করে সাজাতে শিশুদেরকে আদর করে বড় করবো- আল্লাহ আমাদের সবাইকে তাওফিক দান করুন। আমীন।

Comments

comments

About

Check Also

রাসুলুল্লার হিজরাত : প্রাসঙ্গিক ভাবনা

পৃথিবীতে তখন ঘোর অমানিশার রাজ। চারিদিকে বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্যের দৃঢ় ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। যে ভিন্নতার জন্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *