মুসলিম জীবনে সুন্নাহর অনুসরণ

সুন্নাহ ইসলামী শরীআতের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। কুরআন কারীমের পরই শরীআতে সুন্নাহর অবস্থান। সুন্নাতের মৌলিক অর্থ, রাসূল সাল­াল­াহু আলাইহি ওয়াসাল­ামের জীবন আদর্শ। তবে শরীআতের বিভিন্ন পরিভাষা অনুযায়ী সুন্নাহর পরিচয় ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। আমরা এখানে সুন্নাহ বলতে রাসূল সাল­াল­াহু আলাইহি ওয়া সাল­ামের জীবনের সেই সকল বিষয়াবলীকে অন্তর্ভুক্ত করব যা ইসলামী শরীআতে ফরয বা ওয়াজিব নয়।
একজন মুমিন বান্দাহকে সুন্নাহর বাহিরে চলার কল্পনা করাও অসম্ভব। সাহাবায়ে কিরাম থেকে শুরু করে উম্মতের সকলেই সুন্নাহর প্রতি ছিলেন অত্যন্ত যতœবান। কারণ সুন্নাহর প্রতি যার যত বেশি ভালোবাসা ছিল তিনি ততো বেশি আল­াহওয়ালা ছিলেন। ইমাম হাসান বসরী (র.) বলেন, রাসূল সাল­াল­াহু আলাইহি ওয়াসাল­ামের প্রতি সাহাবীদের ভালোবাসার এক নমুনাই ছিল সুন্নতের অনুসরণ। হযরত যুননূন মিসরী (র.) বলেন, আল­াহর প্রতি বান্দাহর ভালোবাসার নিদর্শন হলো, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তার হাবীবের সুন্নতের অনুসরণ করা। আমাদের সালাফ যারা ছিলেন তারা সুন্নাহ অনুসরণে খুবই যতœবান ছিলেন। ইচ্ছাকৃতভাবে কোন সুন্নতও ছেড়ে দিতেন না। অনিচ্ছাকৃত কোন সুন্নাত ছুটে গেলে তাদের আক্ষেপ ছিল সীমাহীন। কারণ তাদের অন্তর ছিল নবী কারীম সাল­াল­াহু আলাইহি ওয়া সাল­ামের ভালোবাসায় পরিপূর্ণ। আর নবীর ভালোবাসার চাহিদাই ছিল তার সুন্নতের অনুসরণ করা। এমন তো হতেই পারে না যে, আমি যাকে ভালোবাসি তার আদর্শকে অনুসরণ করব না। ইমাম আহমদ (র.) প্রায় চলি­শ হাজার হাদীসের বিশাল সংকলন করেছেন ‘আল মুসনাদ’ কিতাবে। অবাক হওয়ার কথা যে, তিনি এ কিতাবের আমলযোগ্য সকল হাদীসের উপর আমল করেছেন। ইমাম আহমদ বলেন, আমি যত হাদীস জেনেছি তার উপর আমল করেছি। এমনকি যে দিন আমি হাদীস পড়েছি যে, রাসূল সাল­াল­াহু আলাইহি ওয়া সাল­াম শিঙ্গা লাগানোর পর আবু তায়্যিবাকে (সিঙ্গা লাগানোর কাজ করেন) দিনার দিয়েছেন সেদিন আমিও সিঙ্গা লাগিয়েছি এবং হাজ্জামকে দিনার দিয়েছি।
এ ছিল আমাদের সালাফের সুন্নাহ অনুসরণের নমুনা। তারা নবীজীর কোন সুন্নতকে বাদ দিতেন না। যথাসম্ভব আমল করার চেষ্টা করতেন। সুন্নাহর উপর আমল করলে এর সাওয়াব অর্জনের পাশাপাশি আরো অনেক ফযীলত লাভ করা যায়। যেমন-
১. সুন্নত আমলের দ্বারা আল­াহর ভালোবাসা অর্জনের স্তরে পৌঁছা যায়। কারণ কুরআন কারীমে ইরশাদ করা হয়েছে, আল­াহর ভালোবাসা লাভের জন্য নবীর অনুসরণ করতে হবে।
২. ফরয ইবাদাত যথাযথভাবে আদায় করা যায়। এমনকি হাদীস শরীফে এসেছে কিয়ামতের দিন যদি বান্দাহর ফরয আমলে কোন ত্রুটি থেকে থাকে তাহলে তার অন্যান্য ইবাদাত (সুন্নত, নফল) দ্বারা সে ত্রুটি পরিবর্তন করা হবে।
৩. দুআ কবুলের আশা রাখা যায়। কারণ বুখারী শরীফে এসেছে, একজন বান্দাহ ফরয ইবাদত করার পর যদি অন্যান্য ইবাদাত করে তাহলে সে আল­াহর এত বেশি নিকবর্তী হয়ে যায় যে, এই ব্যক্তি আল­াহর কাছে কোন কিছু চাইলে আল­াহ তাকে ফিরিয়ে দেন না।
আলোচ্য প্রবন্ধে আমরা দৈনিন্দিন জীবনে সহজে আমলযোগ্য কয়েকটি সুন্নাহর বিবরণ উলে­খ করছি।
ঘুম থেকে উঠার পর আমাদের জন্য কিছু সুন্নত কাজ থাকে, যা আমরা অতি সহজে আদায় করে নিতে পারি। যেমন-
১. ঘুম থেকে উঠার পর দুআ পাঠ করা সুন্নত। ‘আলহামদু লিল­াহিল­াযি আহ্য়ানা বা’দা মা আমাতানা ওয়া ইলাইহিন নুশূর’। রাসূল সাল­াল­াহু আলাইহি ওয়া সাল­াম ঘুম থেকে উঠে এ দুআ পাঠ করতেন। (বুখারী, হাদীস নম্বর-৬৩২৪)
২. ঘুম থেকে জাগ্রত হয়ে মিসওয়াক করা সুন্নত। সকল ওযুর আগে যেভাবে মিসওয়াক করা নবীর সুন্নত অনুরূপ ঘুম থেকে উঠার পরও মিসওয়াক করা সুন্নত। হাদীস শরীফে এসেছে, রাসূল সাল­াল­াহু আলাইহি ওয়া সাল­াম যখন তাহাজ্জুদের সময় ঘুম থেকে উঠতেন তখন তিনি মিসওয়াক করতেন। (মুসলিম, হাদীস নম্বর-২৫৫)
৩. ঘুম থেকে জাগ্রত হয়ে হাত দিয়ে মুখ মুছা। যাতে ঘুমের চিহ্ন দূর হয়ে যায়। এটাও সুন্নত। রাসূল সাল­াল­াহু আলাইহি ওয়া সাল­াম ঘুম থেকে উঠার পর হাত দিয়ে চোখ-মুখ মুছতেন।

Islamic calligraphy O Allah, bless and greet Muhammad


৪. ঘুম থেকে জাগ্রত হওয়ার পর তিনবার নাকে পানি দেওয়া সুন্নত। কারণ হাদীস শরীফে এসেছে, মানুষ ঘুমানোর পর শয়তান নাকের ভিতর বসে রাত কাটায়। (বুখারী, হাদীস নম্বর-৩২৯৫)
৫. ঘুম থেকে জাগ্রত হয়ে উভয় হাত কব্জি পর্যন্ত ধোয়া। কারণ হাদীস শরীফে এসেছে, রাসূল সাল­াল­াহু আলাইহি ওয়া সাল­াম ইরশাদ করেছেন, তোমাদের কেউ ঘুম থেকে জাগ্রত হলে যেন প্রথমে হাত তিনবার ধুয়ে নেয়। কারণ সে জানে না তার হাত কোথায় রাত্রিযাপন করেছ। (বুখারী)
দেখা যাচ্ছে ঘুম থেকে উঠার পর আমাদের জন্য পালনীয় অনেক সুন্নত রয়েছে। এ সুন্নতগুলো আমরা সহজেই করে নিতে পারি, যদি ঘুম থেকে উঠার পর আমরা ওযু করে নেই। ওযু করে নিলে এক সাথে এই সুন্নতগুলো পালন হয়ে যাবে।
সালামের ব্যাপক প্রচলন করা। সালাম দেওয়া রাসূল সাল­াল­াহু আলাইহি ওয়া সাল­ামের গুরুত্বপূর্ণ একটি সুন্নত। অনেক হাদীসে রাসূল সাল­াল­াহু আলাইহি ওয়া সাল­াম সালামের নির্দেশ দিয়েছেন। আমাদের মধ্যে সালাম প্রদানে উদাসীনতা দেখা যায়। সালাম দিতে আমরা কার্পন্য করি। অথচ সমাজ, পরিবারে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সালামের উলে­খযোগ্য অবদান রয়েছে। হাদীস শরীফে এসেছে, যে ব্যক্তি আগে সালাম দেয় তার অন্তর হিংসা থেকে মুক্ত।
মুসাফাহা করা সুন্নত। মুসাফাহার মাধ্যমে পরস্পরের সগীরা গুনাহগুলো আল­াহ তাআলা মাফ করে দেন। সালাম দেওয়ার পর দুই মুসলমানের দায়িত্ব হলো মুসাফাহা করা।
পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের সাথে গুরুত্বপূর্ণ সুন্নত রয়েছে। হযরত আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল­াহ সাল­াল­াহু আলাইহি ওয়াসাল­াম বলেন, যে ব্যক্তি দৈনিক ১২ রাকাত সুন্নত নিয়মিত আদায় করবে তার জন্য আল­াহ তাআলা জান্নাতে একটি ঘর নির্মাণ করবেন। ১২ রাকাত সুন্নত হলো যুহরের আগে চার রাকাত, পরে দু-রাকাত, মাগরিবের পরে দু-রাকাত, এশার পরে দু-রাকাত এবং ফজরের আগে দু-রাকাত। (তিরমিযী, হাদীস নম্বর- ৪১৪)
উলামায়ে কিরাম এ সুন্নত নামাযগুলোকে সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ বলে থাকেন। হুকুমের দিক থেকে এর অবস্থান ওয়াজিবের কাছাকাছি। তাই এ সুন্নতের জন্য আমাদের যতœবান হওয়া আবশ্যক। পাশাপাশি আরো যে সুন্নত নামায রয়েছে তার প্রতি আন্তরিক হওয়াও জরুরী।
আমরা যতক্ষণ জাগ্রত থাকি ততক্ষন ইবাদাতের সুযোগ পাই। কিন্তু ঘুমিয়ে যাওয়ার পর আর ইবাদাত করতে পারি না। কিন্তু যদি আমরা সুন্নত পদ্ধতিতে ঘুমাতে যাই তাহলে আমরা ঘুমে থাকলেও কিছু ফিরিশতা আমাদের জন্য দুআ করতে থাকবেন। (তিরমিযী, ৩৯৩৬)
ঘুমানোর সময় কিছু সুন্নত আমল হলো-ওযু করে ঘুমানো, বিছানা পরিষ্কার করা। পানির পাত্রের মুখ বন্ধ করা। দরজা, জানালা বন্ধ রাখা। সূরা ফালাক ও নাস পড়ে শরীর মূছা। ডান কাতে শুয়া। ডান হাত মাথার নিচে রাখা। ঘুমানোর দুআ পড়া। (বুখারী শরীফ :২৪৭ , ৬৩১১ , ৬৩১৩ , ৬৩১৫, ৭৪৮৮; মুসলিম শরীফ: ২৭১০; মুসনাদে আহমাদ: ১৮৫৮৫ )
একজন মুসলমানের জীবনে এমন কোন মুহুর্ত নাই যার আদর্শ প্রিয় নবীর সুন্নতের মধ্যে পাওয়া যাবে না। ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে প্রতিটি ক্ষেত্রে রাসূল সাল­াল­াহু আলাইহি ওয়া সাল­ামের অনুপম আদর্শ রয়েছে। আমাদের দায়িত্ব হলো প্রিয়নবীর সে আদর্শকে নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করা এবং অন্য মুসলমানকে তা শিখিয়ে দেওয়া। কারণ আপনি যদি কাউকে একটি ভালো জিনিস শিখাতে পারেন তাহলে তার আমলের একটি সাওয়াব আপনিও পাবেন। (মুসলিম, ২৬৭৪)
আমরা অনেক সুন্নতকে অবহেলা করে বা অনেকে না জানার কারণে আমল থেকে বাদ দিয়ে দিয়েছেন। এটি খুবই দুঃখজনক। মুসলমানমাত্র সকলের উচিত হারিয়ে যাওয়া সুন্নতকে জীবিত করা। রাসূল সাল­াল­াহু আলাইহি ওয়া সাল­াম ইরশাদ করেছেন, তাদের জন্য সুসংবাদ যারা আমার পর লোকদের দ্বারা নষ্ঠ হওয়া সুন্নতকে পুনরুজ্জীবিত করবে। (তিরমিযী, হাদীস নম্বর ২৬৩০)

Comments

comments

About

Check Also

রাসুলুল্লার হিজরাত : প্রাসঙ্গিক ভাবনা

পৃথিবীতে তখন ঘোর অমানিশার রাজ। চারিদিকে বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্যের দৃঢ় ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। যে ভিন্নতার জন্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *