মসজিদে মহিলাদের যেতে বাধা কোথায়? (১ম পর্ব)

মহাল আল্লাহপাক ইরশাদ করেন-‘মুমিন হয়ে পুরুষ ও নারীর মধ্যে যে কেহ সৎকর্ম করবে তাকে আমি নিশ্চয়ই আনন্দময় জীবন দান করব এবং তাদেরকে তাদের কর্মের শ্রেষ্ঠ পুরষ্কার দান করব।’ (সূরা নাহল : আয়াত-৯৭)। পুরুষ ও নারী যে কেহ নেক আমল করবে তার সেই নেক আমলের যথাযথ প্রতিদান পাবে-এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে এই নেক আমল বা ইবাদত যেমন ইচ্ছা করলে চলবে না, এই ইবাদত মনগড়া নিয়মে করলে কখনও এর প্রতিদান পাওয়া যাবে না। সকল প্রকার ইবাদত ও নেক আমলের পূর্ণ সওয়াব পেতে হলে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দেয়া নিয়ম অনুসারে সেই ইবাদত করতে হবে। আল্লাহপাক মানব জাতিকে পুরুষ ও নারী-এ দু’শ্রেণিতে বিভক্ত করে সৃষ্টি করেছেন। মানুষ হিসেবে উভয়ে সমান হলেও শারীরিক গঠন, আকৃতি-প্রকৃতি, আকর্ষণ-বিকর্ষণ, কথাবার্তা, চাল-চলন, রুচি, চাহিদা আবেগ-অনুভুতির ক্ষেত্রে উভয়ের মধ্যে বিরাট পার্থক্য বিদ্যমান। বাহ্যিক এ পার্থক্যগুলো ইবাদতের ক্ষেত্রেও বিদ্যমান। অর্থাৎ পুরুষ ও নারীর ইবাদতের নিয়ম-কানুন সমান নয়। আর পুরুষ ও নারীর ইবাদতের নিয়ম-নীতির এই বিরাট পার্থক্যের বিষয়টি কোরআন-হাদিস দ্বারাই সুষ্পষ্ট প্রমাণিত। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়-হজ্ব ফরজ হওয়ার জন্য মহিলার সাথে মাহরাম পুরুষ থাকা শর্ত, যা পুরুষের বেলায় শর্ত নয়। ইহরাম অবস্থায় মহিলার মাথা ঢাকা ফরজ, পুরুষ যা ঢাকতেই পারবে না। তাওয়াফের সময় পুরুষের জন্য রমল আছে অথচ মহিলাদের জন্য রমল নেই। তালবীয়া পুরুষরা উচ্চস্বরে পাঠ করবে কিন্তু সেই তালবীয়া মহিলারা পাঠ করবে নিুস্বরে। নামাজের জন্য আযান-ইকামত দিবে পুরুষরা পক্ষান্তরে মহিলারা আযান ও ইকামত দিতে পারবে না। ইমামতি করবে পুরুষরা, মহিলারা কখনও ইমামতি করতে পারবে না। নামাজের আহকাম ও আরকান পালনের বেলায়ও নারী-পুরুষের মধ্যে বিরাট পার্থক্য বিদ্যমান। যেমন-তাকবীরে তাহরীমার সময় পুরুষের হাত উঠবে কান পর্যন্ত পক্ষান্তরে মহিলারা হাত উঠাবে বুক পর্যন্ত। তাকবীরে তাহরীমার পর নামাজে পুরুষরা হাত বাঁধবেন নাভীর নীচে পক্ষান্তরে মহিলারা হাত বাধবেন বুকের উপরে। নামাজে পুরুষরা দাঁড়াবেন দু’পায়ের মাঝখানে ফাক রেখে পক্ষান্তরে মহিলারা দাঁড়াবেন দু’পা মিলিয়ে। পুরুষরা ফজর, মাগরীব ও ইশার নামাজে কেরাত পড়বে উচ্চ স্বরে পক্ষান্তরে মহিলারা সর্বাবস্থায় কেরাত পড়বে চুপে চুপে নিঃশব্দে। রুকু করার সময় সিজদা করার সময় পুরুষরা উভয় হাত কব্জি হতে কনুই পর্যন্ত জমিন থেকে উপরে রাখবে পক্ষান্তরে মহিলারা তা জমিনে বিছিয়ে রাখবে। নামাজের বৈঠকে পুরুষরা বসবে বাম পায়ের উপর পক্ষান্তরে মহিলারা নিতম্বের উপর বসবে।
পুরুষ ও নারীরা ইবাদতের নিয়মের মধ্যে বিরাট পার্থক্য থাকলেও সওয়াবের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকবে না। অর্থাৎ পুরুষরা নামাজে উচ্চস্বরে কেরাত পাঠ করে যে সওয়াব পাবেন মহিলারা নামাজে চুপে চুপে কেরাত পড়ে সেই একই রকম সওয়াব পাবেন। আলোচ্য নিবন্ধের মূল বিষয়টি হচ্ছে-‘মহিলারা মসজিদে গিয়ে পুরুষের সাথে জামাআতের সাথে নামাজ আদায় করতে পারবেন কিনা?’ অথবা ‘মহিলাদের মসজিদে যেতে বাধা কোথায়?’ এ সম্পর্কে উলামায়ে কেরামের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। একদল আলেমের মতে-মহিলাদের মসজিদে যেতে কোনো বাধা নেই-তারাও মসজিদে গিয়ে জামাতের সাথে সালাত আদায় করতে পারবে। অপর একদল আলেমের মতে-মহিলাদের যাবার কোনো প্রয়োজন নেই। তাদের নিজ নিজ ঘরেই নামাজ পড়া উত্তম। মসজিদে নামাজ পড়ে তারা যে সওয়ার পাবার কথা নিজ নিজ ঘরে নামাজ আদায় করে তারা সেই সওয়াব পেয়ে যাবেন। মসজিদের জামাআতে শরীক হওয়া তাদের জন্য শর্ত নহে। উলামায়ে কেরামের এই মতভেদের কারণ হল-উভয় পক্ষের সমর্থনেই হাদিস রয়েছে। এখন আমরা এই হাদিসগুলোর চুলচেরা বিশ্লেষণ করি। হাদিসগুলোর চুলচেরা বিশ্লেষণ করার পর ‘মহিলারা মসজিদে নামাজের জামাআতে শরীক হতে পারবেন কিনা? বা মহিলাদের জন্য মসজিদে নামাজ পড়া উত্তম? না, নিজ নিজ ঘরে নামাজ পড়া উত্তম? তা পরিষ্কারভাবে জানতে পারব।
যারা বলেন-‘মহিলাদের মসজিদে যেতে কোনো বাধা নেই’ তাদের দলীল হচ্ছে-
১. হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণিত হাদিসে রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন- ‘মহিলাগণ মসজিদে যেতে চাইলে তোমরা তাদেরকে বাধা দিওনা’ (মুসলিম)। ২. হজরত ইবনে ওমর (রা.) বর্ণিত হাদিসে রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন-‘তোমরা মহিলাদেরকে মসজিদে যেতে বাধা দিওনা’ (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা)। ৩. হজরত আয়শা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন-‘একবার এশার নামাজের জন্য ঘর থেকে বের হতে নবী (সা.) এর কিছুটা দেরি হয়ে যায়। হজরত ওমর এ সময় আওয়াজ দিতে থাকলেন-‘নারী ও বাচ্চারা ঘুমিয়ে যাচ্ছে।’ অতঃপর নবী (সা.) মসজিদের উদ্দেশ্যে বের হলেন’ (বুখারী)। ৪. হজরত আয়শা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন-রাসূল (সা.) যখন ফজরের নামাজ পড়াতেন তখন মহিলারা নামাজ শেষে নিজেদের চাদরের মধ্যে ঢেকে ঘরে ফিরতেন এবং অন্ধকারের জন্য তাদেরকে চেনা যেতনা (বুখারী ও মুসলিম)। ৫. হজরত আনাস (রা.) বর্ণিত হাদিসে রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন-‘আমি নামাজ শুরু করে লম্বা তেলাওয়াত করার নিয়ত করি কিন্তু বাচ্চাদের কান্না ও মায়েদের পেরেশানি হবে বিবেচনা করে আমি তেলাওয়াত সংক্ষিপ্ত করে ফেলি’ (বুখারি ও মুসলিম)। ৬. হজরত ইবনে মাসউদ (রা.)-এর স্ত্রী হজরত জয়নব (রা.) বর্ণিত হাদিসে নবী (সা.) ইরশাদ করেন-‘যখন কোনো মহিলা মসজিদে উপস্থিত হবে সে যেন সুগন্ধি স্পর্শ না করে’ (মুসলিম)। ৭. হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণিত হাদিসে রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন-‘যদি কোনো মহিলা সুগন্ধি ব্যবহার করে তবে সে এশার নামাজে আমাদের সাথে শরীক হবে না’ (মুসলিম)। ৮. হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণিত হাদিসে রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন-‘তোমরা মহিলাদেরকে মসজিদে যেতে বাধা দিওনা। মেকাপ ও সুগন্ধি ব্যবহাকারী ছাড়া’ (আবু দাউদ)। ৯. একখানা হাদিসে আছে-একবার এক মহিলা হজরত আবু হুরায়রা (রা.)-এর পাশ দিয়ে যাচ্ছেন। তার দেহ থেকে সুগন্ধি ছড়াচ্ছিল। তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন-হে আল্লাহর বান্দি! তুমি কোথায় যাচ্ছ? সে সুগন্ধি দিয়ে কি তুমি মসজিদে যাচ্ছ?’ সে বলল-‘হ্যাঁ’। তিনি বললেন-‘ঘরে ফিরে গোসল করে এসো। আমি নবী (সা.) কে বলতে শুনেছি-যে মহিলা দেহে সুগন্ধি ব্যবহার করে মসজিদে নামাজে যায়, আল্লাহপাক ততক্ষণ পর্যন্ত তার নামাজ কবুল করেন না যতক্ষণ পর্যন্ত না সে ঘরে ফিরে গোসল করে ফিরে আসবে’ (আবু দাউদ, নাসায়ী, ইবনে মাজাহ)। উক্ত হাদিসগুলো দ্বারা এটাই প্রমাণ হল-নবী (সা.)-এর সময়ে মহিলারা মসজিদে যেতেন, জামাআতের সাথে নামাজ আদায় করতেন। যদিও মহিলাদের মসজিদে গমনের ব্যাপারে উক্ত হাদিসগুলোতে নানা ধরনের শর্তারোপ করা হয়েছে।
যারা বলেন-‘মহিলাদের নামাজের জন্য মসজিদে গমন করার প্রয়োজন নেই, মসজিদে নামাজ পড়ে যে সওয়াব পাবার কথা, তারা ঘরে নামাজ পড়লে সেই সওয়াব পেয়ে যাবেন, মহিলাদের জন্য মসজিদ অপেক্ষা ঘরে নামাজ পড়াই অতি উত্তম’ তাদের দলীল সমূহ হচ্ছে-
১. হজরত উম্মে সালমা (রা.) বর্ণিত হাদিসে রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন-‘মহিলাদের জন্য উত্তম মসজিদে হলো তাদের অন্দরমহলের গোপন স্থান’ (সহীহ ইবনে খুজাইমাহ)। ২. হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বর্ণিত হাদিসে রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন-‘মহিলাদের ভিতর ঘরের সর্বাধিক সংকীর্ণ ও অন্ধকারাচ্ছন্ন স্থানের নামাজ তার ভিতর ঘরের নামাজ অপেক্ষা উত্তম এবং তার ভিতর ঘরের নামাজ তার বাহির ঘরের নামাজ অপেক্ষা উত্তম’ (সহীহ ইবনে খুজাইমা)। ৩. হজরত আবু হুমাইদ আস সাইদী (রা.)-এর স্ত্রী উম্মে হুমায়েদ (রা.) বর্ণিত হাদিসে তিনি বলেন-তিনি একবার নবী (সা.) কে জিজ্ঞেস করলেন-হে আল্লাহ রাসূল! আমি আপনার সাথে মসজিদে নামাজ পড়তে বড়ই ভালোবাসি। তখন রাসূল (সা.) বললেন-‘আমি বুঝতে পারছি যে, তুমি আমার সাথে নামাজ পড়তে ভালোবাস। কিন্তু তোমার অন্দরমহলের নামাজ তোমার বাহির ঘরের নামাজ অপেক্ষা উত্তম। বাহির ঘরের নামাজ আঙ্গিনায় আদায়কৃত নামাজ অপেক্ষা উত্তম। আবার আঙ্গিনায় নামাজ মহল্লার মসজিদে আদায়কৃত নামাজ অপেক্ষা উত্তম। আর তোমার মহল্লার মসজিদের নামাজ আমার এ মসজিদে আদায়কৃত নামাজ অপেক্ষা উত্তম’ (সহীহ ইবনে খুজাইমা)। ৪. হজরত ইবনে মাসউদ (রা.) বর্ণিত হাদিসে রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন-‘আল্লাহর দরবারে মহিলার সর্বাধিক প্রিয় নামাজ তাই যা তার ঘরের সর্বাধিক অন্ধকারাচ্ছন্ন স্থানে আদায় করা হয়’ (সহীহ ইবনে খুজাইমা)। ৫. একবার এক মহিলা হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) এর কাছে মহিলাদের জন্য মসজিদে জুমআর নামাজ পড়ার ব্যাপারে জানতে চাইল। জবাবে হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) বললেন-‘তোমার অন্দরমহলের নামাজ তোমার বাহির ঘরের নামাজ অপেক্ষা উত্তম। বাহির ঘরের নামাজ আঙ্গিনায় আদায়কৃত নামাজ অপেক্ষা উত্তম। আর আঙ্গিনার নামাজ মহল্লার মসজিদে আদায়কৃত নামাজ অপেক্ষা উত্তম’ (মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবাহ)। ৬. বিশিষ্ট তাবেয়ী হজরত সাঈদ ইবনে ইয়াস (রা.) বলেন-‘আমি ইবনে মাসউদ (রা.) কে দেখেছি যে, তিনি মহিলাদেরকে এই বলে মসজিদ থেকে বের করে দিচ্ছেন যে, তোমরা বের হও কেননা এটা (মসজিদে নামাজ) তোমাদের জন্য নয়’ (রায়হাকী)। উক্ত হাদিসগুলো দ্বারা দিবালোকের ন্যায় প্রমাণিত-মহিলাদের নামাজের জন্য মসজিদে যাওয়ার প্রয়োজন নেই, মহিলাদের জন্য ঘরে নামাজ আদায় করাই অতি উত্তম। ৭. হজরত উমরা বিনতে আব্দুর রহমান (রা.) বর্ণিত হাদিসে তিনি বলেন, আমি হজরত আয়শা (রা.) কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন-আজকে মহিলারা যা শুরু করেছে তা যদি রাসূল (সা.) দেখতেন তবে তাদেরকে মসজিদে যেতে এমনভাবে নিষেধ করতেন যেমন বনি ইসরাঈলের মহিলাদেরকে নিষেধ করা হয়েছিল তখন উমরা (রা.) তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন-বনি ইসরাঈলের মহিলাদেরকে মসজিদে যেতে কি নিষেধ করা হয়েছিল? হজরত আয়শা (রা.) উত্তরে বললেন-‘হ্যাঁ’ (বুখারী-মুসলিম)। মহিলারা নবী (সা.) এর পর মসজিদে এসে শরীয়ত বিরোধী তাণ্ডব সৃষ্টি করেছিল বলেই হজরত আয়শা (রা.) একথা বলতে বাধ্য হয়েছিলেন-‘যদি নবী (সা.) মহিলাদের এ অবস্থা দেখতেন তাহলে তাদেরকে চিরতরে মসজিদে যেতে নিষেধ করতেন।’ ৮. হজরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, যেসব পুরুষ মসজিদে জামাআতে শরিক হয় না তাদের বিরুদ্ধে নবী (সা.) কঠোর হুশিয়ারী উচ্চারণ করে বলেছেন-‘যদি ঘরসমূহে মহিলারা এবং শিশুরা না থাকত তাহলে আমি ইশার নামাজের জামাআত কায়েম করতাম এবং যুবকদেরকে আদেশ করতাম যেন তারা (যারা জামাআতে শরীক হয়নি তাদের) ঘরসমূহে যা কিছু আছে সবকিছু আগুনে জ্বালিয়ে দেয়’ (আহমদ)। উক্ত হাদিসে নবী (সা.) পুরুষদেরকে জামাআতে শরীক না হওয়ার কারণে ধিক্কার দিয়েছেন। এর দ্বারা দিবালোকের ন্যায় প্রমাণ হল-মসজিদে নামাজের জামাআতে শরীক হওয়া কেবলমাত্র পুরুষদের দায়িত্ব।
(২য় পর্ব)

Comments

comments

About

Check Also

রাসুলুল্লার হিজরাত : প্রাসঙ্গিক ভাবনা

পৃথিবীতে তখন ঘোর অমানিশার রাজ। চারিদিকে বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্যের দৃঢ় ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। যে ভিন্নতার জন্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *