গৃহকর্মীর নিয়োগ ও আমাদের দায়িত্ব

গৃহকর্মী নিয়ে বাস্তবতার কিছু কথা আজ বলবো। কখনো কখনো ওরা আমাদের বোকা বানায়, আবার অনেক সময়েই ভদ্র লোকদের নিপীড়ন নির্যাতনের শিকার হয়ে পঙ্গু এমনকি মৃত্যুর পথে ঠেলে দেয় ওদের। এর আগে গৃহকর্মীর সুরক্ষা নিয়ে, ওদের অধিকার নিয়ে অনেক লিখেছি। সৃষ্টিকর্তা মানুষের অবস্থার ভিন্নতা রেখেছেন। উচ্চবিত্তরা অর্থের বিনিময়ে নিুবিত্তদের কাজে নেয়, ওরা টাকার বিনিময়ে শ্রম দিয়ে থাকেন। কিন্তু কথা হলো যার কাজ আমার পছন্দ হবে না তাকে আমি রাখবই না, তাকে দিয়ে কাজ করাবো আবার অত্যাচারও করবো। এ কি করে সম্ভব! বিভিন্ন গবেষণায় বলা হয়েছে, গৃহকর্মীর মৃত্যুর জন্যে অনেক ক্ষেত্রেই গৃহের মালিকরা দায়ী, বেশির ভাগ গৃহকর্মীকে ইজ্জত হারাতে হয় ভদ্রলোকদের কাছে। জানি না এসব বন্ধ কবে হবে, আদৌ কি বন্ধ হবে?
এই বছর রমজান ঈদের আগে পরে গৃহকর্মীর উপর নির্যাতন নিপীড়নের অনেক ঘটনা ঘটেছে। এটা নতুন নয়, প্রতিনিয়তই হচ্ছে। বিচারব্যবস্থা থাকলেও তা ধীর গতিতে চলে বলে বারবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। তবে তিন বছর আগের এক গৃহকর্মীর নির্যাতনের বিচার এই বছর হওয়ার পর অনেকেই বিচার ব্যবস্থাকে স্বাগত জানিয়েছে।
গত ১৪ অক্টোবর সকালে অভ্রকে নিয়ে প্রাইভেটে যাই। হেঁটে যাওয়া-আসা করলে সকালের হাঁটা হয়ে যাবে বলেই মা মেয়ে হেঁটেই যাই। ওকে পৌছে দিয়েই ফিরে আসি। বাসার অনেকটা কাছাকাছি এসে তিন রাস্তার মোড়ে দেখি অনেকে দাঁড়িয়ে আছে। ওদের সামনে মধ্যবয়সী এক মহিলা সেলোয়ার কামিজ পরা, সাথে ৪ সাড়ে ৪ বছরের একটা ছেলে বাচ্চা দেখেই মনে হয় বাচ্চাটা মহিলার বাচ্চাই। এখানে যারা দাঁড়ানো তাদের মাঝে বুয়া ৪/৫ জন। রিকশাওয়ালা ৩/৪ জন। দারোয়ান আছে ৩ জন। সাধারণ পাবলিক ৫ জন। রিকশাওয়ালা ছাড়া বাকিরা এই এলাকায় কাজ করে। পথচারীরা যাওয়ার পথেই দাঁড়ায়। আমিও পথচারীর একজন। উল্লেখ্য আমি একটু ব্যতিক্রম কাজ করি, মানে লেখালেখি করি এটা এলাকার কেউ কেউ জানে। আমি এসে দাঁড়াতেই সবাই আমায় বলতে লাগলো, মূল কথা হলো-এই মহিলার বাড়ি বগুড়ায়, চার মাস আগে এলাকার এক মহিলা ওনাকে এনে ঢাকায় কাজ দেয় এক বাসায়। এরপর থেকে সেই মহিলার আর কোন খোঁজ নেই। এই চার মাসে ওকে কোন টাকা পয়সা দেয়নি। এই চার মাসে মহিলা একদিনের জন্যেও বাসা থেকে বের হয়নি। মহিলার ছোট একটা মোবাইল ছিলো, দুই মাস আগে গৃহকর্ত্রী শিউলি সেই মোবাইল নিয়ে যায়। এরপর এই দুই মাস মহিলা গ্রামের কারো সাথে যোগাযোগ করতে পারেনি। মহিলা শুধু শিউলি নামটাই বলতে পেরেছে। গৃহকর্ত্রী নিজের মোবাইল দিয়েও কথা বলতে দেয়নি। মহিলাকে বাসায় অনেক মারধর করতো। গৃহকর্তা উনার পারসোনাল কাজ করতে বলতো, হাত পা টিপা, কোমর টিপা…। মহিলা করতে চাইতো না বলেই আরো মারতো। অবশেষে আজ সকালবেলা সুযোগ পেয়ে মহিলা ছেলেকে নিয়ে বের হয়ে চলে আসে। যে দিকে পথ দেখেছে সে দিকেই হাঁটতে থাকে। ধরা পড়ার ভয়ে দ্রুত পালিয়ে আসে। সে এখন বগুড়া চলে যেতে চায়। তার কথা কেউ যদি তাকে বগুড়ার বাসে তুলে দেয়, বগুড়ার গাবতলি নামলে সে বাড়ি চিনে যেতে পারবে। কিন্তু এই কাজ কে করবে? কে টাকা দিবে?
সবার মুখে কথাগুলো শুনে মহিলাকে জিজ্ঞেস করি। মহিলা তাই বলে। বললাম চলো কোন রাস্তা দিয়ে এসেছো দেখিয়ে দেখিয়ে নিয়ে যাও আমাদের, টাকা তো তুমি পাবেই সাথে সেই বাড়ির গৃহকর্তা ও গৃহকত্রীকেও ধরতে পারবো। মহিলা জানায় সে চিনতে পারে না, শুধু বলে বড় রাস্তা পার হয়ে এসেছে। ধরে নিতে হয় সে হিসাবে মহিলা মনিপুরী পাড়া, রাজা বাজার বা ইন্দিরা রোডের কোন বসা থেকে এসেছে।
উপস্থিত এক দারোয়ান বলে-পাশের এক বাসায় লোক খুঁজছে, ওরা মাসে ৪/৫ হাজার টাকা দিয়েও রাখবে। কিন্তু সাথে যে ছেলে আছে, তার উপর কেউ জানে না চিনে না একে।
অন্যদিকে মহিলাও বলে সে গ্রামেই চলে যেতে চায়। সে এখানে আর থাকবে না। পরিস্থিতি এড়িয়ে বাসায় চলে আসতে পারছি না। কিন্তু কি করবো। মহিলাকে থানায় দিয়ে আসবো? মহিলার সাথে কোন কাপড়ের ব্যাগ বা অন্য কিছুই নেই।
যে বাসায় লোক রাখতে চায় সে বাসার ভদ্র লোক তখনিই এই পথে যাচ্ছিলেন। উনি শুনলেন। সেই একই কথা, বাচ্চা সহ রাখবেন না, আর মহিলার কোন পরিচয় ও জানা নেই, গ্রামের ঠিকানা ও জানে না। কিভাবে রাখবে। মহিলার ছবি থানায় জমা দিয়ে রাখার কথা বলেছি আমি। জানি এটা সম্ভব নয়।

সব ভাবনা চিন্তার শেষ, সব দারোয়ান বুয়া আমাকেই দেখিয়ে দিয়ে বলে-এই খালা যখন এসেছে, একটা কিছু হবেই।
একজন একজন করে লোক কমতে শুরু করলো। বললাম-
ঠিক আছে, ভাড়ার টাকা আমি দিবো, কিন্তু ওকে বাসে তুলে দিবে কে?
রিকশাওয়ালাদের দিয়ে পাঠাতে পারি কিন্তু কোন বিশ্বাসে। যদি রিকশাওয়ালা টাকা নিয়ে পালিয়ে যায়। অথবা গাড়িতে তুলে দিয়েছে বলে না দিয়েই পালায়। খুঁজতে খুঁজতে বেছে নিলাম আমাদের দারোয়ানকে। মহিলাকে সাথে করে বাসার নিচে নিয়ে আসি। মহিলার ছবি তুলি। আশেপাশের ২/৩ জনকে বিষয়টা জানাই। এক বুয়া বাচ্চাটাকে একটা চিপসের প্যাকেট কিনে দেয়। দারোয়ানের সাথে যে কথা হয় আমার-
আপনি ওকে টিকিট কেটে বাসে তুলে দিবেন। টিকিটের আসল কপি আমার জন্যে নিয়ে আসবেন। বাসের চালক ও হেলপারের মোবাইল নাম্বার নিয়ে আসবেন। বাসে তুলে দেয়ার সময় মহিলার হাতে ৫০ (পঞ্চাশ) টাকা দিবেন। একটা ব্যাগে এক লিটার পানি, দুটো রুটি, ভাজি, একটা আপেল দিয়ে বলি-রাস্তায় খেয়ে নিতে। সেভাবেই দারোয়ান মহিলাকে আর ওর বাচ্চাকে নিয়ে চলে যায় গাবতলি।
ঘণ্টা ৩ পরে দারোয়ান আসে, বলে-বাস থেকে নেমে কাউন্টারের কিছু আগে মহিলাকে দাঁড় করিয়ে আমি টিকেট কাটতে যাই। বলেছি এখানে দাঁড়িয়ে থাকো, আমি টিকেট নিয়ে আসি। টিকেট কেটে এসে দেখি মহিলা নেই, বাচ্চাও নেই। চারপাশ অনেক খোঁজাখুঁজি করি। মহিলাকে কোথাও পাইনি। কিছুক্ষণ পর বাস ছেড়ে দেয়।
দারোয়ান এসে আমায় টিকেট দেয়। সব শুনে আমি হতবাক, এই ঘটনার কোন মীমাংসা খুঁজে পাইনি। মনের মাঝে অনেক প্রশ্ন, মহিলার হাতে কোন টাকাই কিন্তু দেয়া হয়নি। যদি টাকা দেয়া হতো ভাবতাম হয়তো এটাই ওর কাজ। কেউ হয়তো প্রশ্ন তুলতে পারেন, কেনো মহিলাকে থানায় নিয়ে যাই নি? কেনো পুলিশের হাতে দিই নি?
তাহলে আসি পরের ঘটনায়-
কিছুদিন আগের কথা, আমার বন্ধু মহলের একজন হালিমা জানায়-এক সকালে ইলার আম্মু কল করে জানায় একটা বাসায় গৃহকর্মীকে চুরির অপরাধে মারধর করে ঘরে আটকে রাখে। যে করেই হোক মেয়েটাকে বের করে বাড়ি পাঠাতে হবে। ইলার আম্মুকে বলে মিরার আম্মু, মিরার আম্মুকে বলে এশার আম্মু। যাক খবরটা শুনের পর ইলার আম্মুকে বলি ঘটনা আদৌ সত্যি কিনা তা জানতে ওই বাড়ির ঠিকানা আর গৃহকর্ত্রীর নাম্বার চাই। ওরা তা সংগ্রহ করে দেয়। গৃহকর্ত্রী বিলকিসের নাম্বার আর বাড়ির ঠিকানা পেয়ে হালিমা কল করে। ঠিকানা ঠিক আছে তা আগে শিউর হয়। মহিলার নাম ও ঠিকই। বিষয়টা জিজ্ঞেস করায় উনি বলেন-
মারধর কোথায় করা হয়েছে, ওকে শুধু জিজ্ঞাসা করা হয়েছে।
তার মানে গলার চেইন চুরি হয়েছে, এটাও সত্য, জিজ্ঞাস করেছেন এটাও সত্য।
তিনি স্বীকার করলেন। মোবাইলে থানার নাম্বার ছিলো আগে, এখন নেই। পুলিশের হেড অফিসে কল করে ওই এলাকার থানার নাম্বার নিই। সে নাম্বারে কল করি। হেড অফিস থেকে ভুলে পাশের থানার নাম্বার দেয়া হয়। যাই হোক, সে থানা থেকে প্রয়োজনীয় থানার নাম্বার নিই। কল করি। থানায় অবস্থানরত অফিসারকে সব খুলে বলি। বিলকিসের নাম্বার আর ঠিকানা দিই। ঘটনা সত্য তা আমি যে জেনেছি, তাও জানাই। অফিসার আমার পরিচয় জানতে চায়, আমি পরিচয় দিই নি। উনি আরো বলেন আজ উনারা ব্যস্ত, উনাদের অতিথি আসছেন। আমি আপনাদেরকে জানালাম আপনারা কি করছেন, তা দেখার জন্যে আমার লোক থানায় উপস্থিত আছেন।
এই বলেই রেখে দিই। খবরাখবর চলছে। সেই খবর আমার কানে আসছে। ৩০ মিনিট পর আবার থানায় কল করি, ওরা দেখছে বিষয়টা তা জানায়। বলি দেরি হলে সাংবাদিকদের জানিয়ে দিবো। থানা থেকে কল করে বিলকিসের বাসায়। বিলকিস বলে, এক মহিলা কল করেছে ওকে। থানার লোক ও বলে এক মহিলা কল করেছে। বিলকিসের বাড়িতেই ভাড়া থাকে থানার এক কর্মচারী। উনাকে দিয়েই এই বিষয় আর বাড়তে দেয়নি। গৃহকর্মীর বেতন দিয়ে ওকে বের করে দেয়া হয়। খবরটা আমার কাছে আসে। আর থানা থেকেও বলে। এই ঘটনার কয়েকদিন পর জানা যায় সোনার চেইন চুরি করেছে ঘরের অন্য সদস্য।
সে ঘটনার সব জানা ছিল বলে থানায় জানানো গিয়েছে। কিন্তু এখানে কেউ কাউকে চিনেনা। মহিলা নিজের ঠিকানাও বলতে পারছে না। নারীদের পদে পদে বিপদ, থানায় বিচার চাইতে গিয়ে কি ধরনের সমস্যায় আমাদেরকে পড়তে হয় তার নজির অনেক আছে। সেসব ভেবেই মহিলাকে গ্রামে পাঠিয়ে দিতে চেয়েছি। কিন্তু সে আর পারলাম কই?
উল্লেখ্য, প্রায় ৮/১০ বছর আগে আমার বাসায় একটা মহিলাকে নিয়ে আসি। সে মাত্র সাত দিন ছিল আমার বাসায়। তিনদিনের দিন সাহেব অফিস থেকে কল করে বলে, তার পকেটে পাঁচশত টাকার একটা নোট ছিলো, এখন সেটা নেই। মানে রাতে কেউ এটা সরিয়েছে। বাসায় আমি সাহেব ছোট্ট অভ্র আর সেই বুয়া। কথাটা শুনেই আমি বুয়াকে জিজ্ঞেস করি, সে অস্বীকার করে। আমি তাকে যুক্তি দিয়ে বলি, তাহলে টাকা যাবে কই। টাকা না হারালে তো আর বলতো না। বাসায় অন্য কেউ থাকলে না হয় তাকেই ধরতাম। অত:পর বুয়া স্বীকার করলো সে টাকা নিয়েছে, এবং টাকাটা ফেরত দিয়েছে বুয়া বুঝতে পারে এখানে সে কোন ফায়দা করতে পারবে না। দুদিনের মাথায় সে এতই অসুস্থতার ভান করলো বাধ্য হয়ে আমার বাবাকে সাথে দিয়ে ওকে গ্রামে পাঠাই। যে বুয়া ঘরে হাঁটতেই পারে না, সে বাইরে যাবার পর আমার বাবারও আগেই হেঁটে যায়। বুঝতে পারি সে চুরি করতে না পেরে এখান থেকে সরে যাওয়ার জন্যেই অসুস্থতার ভান করেছে।
মনে পড়ে ২০/২২ বছর আগের কথা। তখন মোহাম্মদপুরে ছিলাম। এমন এক বুয়াকে ধরি আমরা, যার কাজ হলো ছোট বাচ্চা নিয়ে বাসায় বাসায় কাজের খোঁজে যায়। মহিলা গৃহকর্ত্রীর সাথে কথা বলে আর এই সুযোগে বাচ্চাটা ভেতরে গিয়ে ছোটখাটো দামী জিনিস চুরি করে নিয়ে আসে। সেদিন বাচ্চাটা আমার রিলেটিভের বাসা থেকে ঘড়ি নিয়ে পালাচ্ছিলো। ভাগ্যিাস ধরা পড়ে, এরপর জেরা করার পর আসল তথ্য বেরিয়ে আসে।
তাই আমরা যারা গৃহকর্মী ঘরে রাখবো তাদের আসল পরিচয় জেনে শুনেই রাখবো। আর অত্যাচার নিপীড়ন করে নয়। যার কাজ পছন্দ হবে না, তাকে জোর করে কেনো রাখবো। আর তাকে যদি আমার প্রয়োজনই হয় তাহলে কেনো অত্যাচার করবো। এমন পরিবেশ করতে হবে যেনো ওরা নিজেকে আমাদের পরিবারের একজন ভাবে। আর আমরাও তেমনি ভাবতে পারি।

Comments

comments

About

Check Also

রাসুলুল্লার হিজরাত : প্রাসঙ্গিক ভাবনা

পৃথিবীতে তখন ঘোর অমানিশার রাজ। চারিদিকে বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্যের দৃঢ় ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। যে ভিন্নতার জন্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *