ত্যাগের মহিমায় ভাস্বর ঐতিহাসিক মুহররাম

আরবি মাসের প্রথম মাস মুহাররম। মুহাররমের ১০ তারিখ ইয়াওমে আশুরা অর্থাৎ আশুরা দিবস। ইসলামের ইতিহাসে যুগে যুগে এই আশুরা দিবস অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সংঘটিত হবার দিন। অগণিত নবী-রাসুল ও আল্লা-প্রেমিকদের অজ¯্র ত্যাগের মহিমায় চির ভাস্বর পবিত্র আশুরা। আশুরা বেদনা ও শোকের দিন। মুক্তি ও বিজয়ের দিন। রহমাত ও বরকতের দিন। এমনকি কিয়ামত পর্যন্ত নিষ্ঠুর ও হৃদয় বিদারক দিনও পবিত্র আশুরা। সুতরাং আশুরার মত বৈচিত্রময় দিন পৃথিবীর ইতিহাসে আর দ্বিতীয়টি নেই।
বুখারী শরীফের ১৫৯২ নং হাদীসে উল্লেখ আছে- প্রথমে আশুরার রোজা ফরজ ছিল। পরে যখন রমজানের রোজা ফরজ করা হয়, তখন আশুরার রোজা নফল হয়ে থাকে। কিন্তু আশুরার গুরুত্ব কোন অংশেই কমে যায়নি। বুখারী শরীফের ২০০৪ নং হাদীসের ভাষ্যমতে হযরত মূসা আ. এ দিনে অত্যাচারী ফিরআউনের কবল থেকে মুক্তিলাভ করেছিলেন। যার শুকরিয়া স্বরূপ ইহুদীরা এর দিনে রোজা রাখতো। এ শুনে নবী স. ইহুদীদের বললেন ‘মূসা আ. এর প্রতি তোমাদের চেয়ে আমিই বেশি হকদার।’ অতঃপর তিনি রোজা রাখলেন সাহাবীদেরও রোজা রাখতে নির্দেশ দিলেন। পরে তিনি ঘোষণা দিলেন আগামীতে বেঁচে থাকলে আমরা আশুরার আগের দিন সহ দুটি রোজা রাখব। যাতে ইহুদীদের সাথে সাদৃশ্য হয়ে না যায়। সুতরাং মুসা আ. এর মত জালিমের কবল থেকে মুক্তির উপায় ও রহমাত রয়েছে আশুরা দিবসের মধ্যে।
তাফসীরে দুররে মানসুরে উল্লেখ আছে- আল্লাহ তায়ালা হযরত আদম ও হাওয়া আ. এর তওবা কবুল করে নিয়েছিলেন এই আশুরার দিনে। অনুরূপ আমাদের গুনাহের অনুশোচনা, অনুতাপ, কান্নাকাটি ও ইসতেগফার করে তাওবা কবুলের সাফল্য বহন করছে এই ইয়াওমে আশুরা। হযরত নূহ আ. ৮০ জন মুসলিম নিয়ে ভাসতে ভাসতে ১৫০ দিন পরে তার নৌকা জুদী পাহড়ের চূড়ায় যেদিন স্থির হয়েছিল, যেদিন তিনি মাটিতে পা রাখতে পেরেছিলেন- সেদিনটিও ছিল আশুরার দিন। এ দিবসেই হযরত ইবরাহীম আ. নমরুদের আগুনের কুণ্ডলী থেকে ৩ দিন বা ৪০ দিন পর সম্পূর্ণ অক্ষত অবস্থায় বেরিয়ে আসেন। সুতরাং তাগুতি কাফির শক্তি কখনই কোন মুমিনের সামান্যতম ক্ষতিও করতে ক্ষমতা রাখে না। এমন মজবুত শিক্ষায় চির ভাস্বর পবিত্র আশুরা।
হযরত ঈসা আ. কে এ দিনেই আল্লাহ পাক সশরীরে মেঘের উপর ভর করে ৪র্থ আসমানে তুলে নিয়েছিলেন। হযরত ইউসূফ আ. এ দিনেই অন্ধকার কূপ হতে উদ্ধার লাভ করেছিলেন। আবার সুদীর্ঘ ১৮ বছর রোগ শোকে সীমাহীন কষ্টভোগের পরে যেদিন হযরত আইয়ুব আ. পবিত্র আশুরা দিবসেই মুক্তিলাভ করেছিলেন। ৪০ দিন মাছের পেটে থাকার পরে হযরত ইউনুস আ. এ দিনেই নাজাত পেয়েছিলেন। এই দিবসেই আবরাহার হস্তীবাহিনীকে আল্লাহ তায়ালা নাস্তানাবুদ করে কাবা ঘরকে রক্ষা করেছিলেন। পবিত্র আশুরার দিনেই হযরত ইদ্রীস আ. সশরীরে জান্নাতে প্রবেশ করেছিলেন। এরূপ নবীদের জীবনের সমস্ত বালা মুসিবাত বিপদ হতে মুক্তি ও সাফল্যপ্রাপ্তির সুবর্ণ দিবস পবিত্র আশুরা।
অতএব জালিমের কবল থেকে মুক্তি, শয়তানের ধোঁকা ও গুনাহের প্রায়শ্চিত্ত লাভের জন্য, রোগ হতে মুক্তি, কাফির- মুশরিক ও আল্লাদ্রোহীদের থেকে চির মুক্তি এবং সকল অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনের শুভক্ষণ এই পবিত্র আশুরা। মহান আল্লাহ পাকও যেন এ দিনেই সব কিছু ঘটাতে চাচ্ছেন। তাই কোন এক শুক্রবার এ আশুরা দিবসেই সংঘটিত হবে কিয়ামত।
অপরদিকে এ ১০ মুহাররম তথা আশুরা দিবসেই রোজ শুক্রবার সংঘটিত হয় কারবালার করুণ ট্রাজেডি। যে কারণে এ দিনটি আমাদের কাছে বড়ই করুণ ও বেদনাদায়ক। ইসলামের ইতিহাসে সবচেয়ে কলঙ্কজনক অধ্যায় কারবালা উপাখ্যান। প্রিয় নবী স. এর কলিজার টুকরা ইমাম হুসাইন ইবনে আলী (রা.)-এর বিরুদ্ধে ইয়াজিদ বাহিনী কর্র্তৃক যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার নির্মম ঘটনা এই দিনে সংঘটিত হয়েছিল। খিলাফতে আরোহণের সুন্নাতী ধারা ও রীতিকে উপেক্ষা করে অন্যায়ভাবে ক্ষমতাগ্রহণকারী ইয়াজীদের নামে বায়াত হতে ইমাম হুসাইন রা রাজি হননি। শুধু এ কারণেই ইয়াজিদ কুফার গভর্নর উবায়দুল্লাহ বিন জিয়াদের নিকট হুসাইন (রা.)-কে গ্রেফতার করার জন্য কঠোরভাষায় পত্র প্রেরণ করেন। যার ফলশ্রুতিতে হুর বিন ইয়াজিদ, উমর বিন সাদ ও শিমর বিন জিলজাওশান এর নেতৃত্বে দফায় দফায় মোট ১২ হাজার সৈন্য প্রেরণ করে। তারা নিরস্ত্র ইমামের ক্ষুদ্র বাহিনীর উপর হামলা করে যুদ্ধ বাঁধিয়ে দেয়। ফোরাতকূল অবরুদ্ধ করে এক বিন্দু পানিও তারা ইমাম হুসাইনের শিবিরের কোন নারী শিশুকেও পান করতে দেয়নি। যুদ্ধে ইমাম হুসাইনের দলের ৭২ জন শাহাদাত বরণ করেন। ৬১ হিজরী ১০ মহররম শুক্রবার আসরের নামাজের পর ৪৭ বছর বয়সে দুনিয়া থেকে বিদায় নেন নবীর কলিজার ধন ইমাম হুসাইন রা.। প্রিয় নবীর কলিজার টুকরা ইমাম হুসাইন রা. এর শরীরে ৩৩টি তীরের আঘাত ও ৩৪টি তলোয়ারের আঘাত পাওয়া যায়।
শত্রুরা তাঁর কর্তিত শির প্রথমে উবাইদুল্লাহ বিন যিয়াদ ও পরে দামেস্কে ইয়াজিদের নিকট প্রেরণ করে। সাথে আহলে বাইতের জীবিত নারী ও শিশুদেরকেও প্রেরণ করা হয়। ইয়াজিদ তাদেরকে টাকা পয়সা ও সৈন্য হেফাজতে মদিনায় পাঠাবার ব্যবস্থা করে। হুসাইনের কর্তিত শির দেখে মদিনার আকাশ বাতাস কান্নার আওয়াজে ভরে যায়। প্রতিশোধের আগুন দাউ দাউ করে চারিদিকে জ্বলে উঠে। তারা আহলে বাইত, নবীর পরিবার। এঁদেরকে ভালবাসা, ইমানের দাবী। নবীর প্রতি ভালবাসার উজ্জ্বল প্রমাণ। হযরত ইমাম হুসাইন রা. যে ত্যাগ ও আত্মত্যাগের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, তা ধারণ করে কিয়ামত পর্যন্ত আশুরা দিবস ভাস্বর হয়ে থাকবে। অনাগত কালের সেই অনাগত মানব গোষ্ঠীও জেনে নিবে কিভাবে হযরত হুসাইন রা. শাহাদাত বরণ করেছেন।
কেবল দ্বীনের জন্যই ত্যাগ, কেবল সত্যের জন্যই ত্যাগ, খিলাফত সুন্নাত অনুযায়ী পরিচালিত হোক- শুধু এই দাবী নিয়েই তিনি শাহাদাত বরণ করেছেন। ক্ষমতার লোভে ইয়াজিদ বাহিনী জান্নাতী যুবকদের সর্দারকে হত্যা করে হলেও ক্ষমত। ধরে রাখার চেষ্টা করেছে। কিন্তু ইমাম হুসাইন নিজের থেকে কোন দিন কোন প্রাণীকে কষ্ট দেননি। কাউকে আগে আঘাত করতে যাননি। আমরা কি পারব, তাদের সীমাহীন ত্যাগের কিছু শিক্ষা নিজেরা গ্রহণ করতে? দীনের জন্য ত্যাগের কোন বিকল্প নেই। অগণিত নবী রাসুলের অপরিসীম ত্যাগের মহিমা থেকে অবশ্যই আমাদের শিক্ষা নেয়া প্রয়োজন। আজ আশুরা দিবসের এ সকল মহান শিক্ষায় আমরা যেন সকলে উদ্বুদ্ধ হতে পারি। ত্যাগের মহিমায় চির ভাস্বর পবিত্র আশুরা দিবসকে যেন আমরা ভুলে না যাই। আল্লাহ আমাদের তাওফিক দান করুন। আমীন।

Comments

comments

About

Check Also

স্পেনে ইসলাম ও মুসলমান

স্পেন তিনদিকে সমুদ্র দ্বারা বেষ্টিতে। পূর্ব দিকে ভূমধ্যসাগর, দক্ষিণে জিব্রাল্টার প্রণালী ও পশ্চিমে আটলান্টিক মহাসাগর। …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *