জ্ঞানের কথা মুমিনের হারানো সম্পদ

পবিত্র কুরআন শরীফ মহানবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অন্যতম শ্রেষ্ঠ একটি মুজেযা। তৎকালিন আরবী ভাষায় পণ্ডিত সাহিত্যিক এবং কবিগণ পবিত্র কুরআন শরীফের রচনা- শৈলীর কোনভাবেই মোকাবেলা করতে পারেনি। পরিবর্তে তারা এ কথা বলতে বাধ্য হয়েছে যে, পবিত্র কুরআন শরীফ- মানুষের বানানো কোন কিতাব নহে।
উক্ত পবিত্র কুরআন শরীফের মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্যের বিভিন্ন দিক রয়েছে। তন্মধ্যে একটি মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, পবিত্র কুরআন শরীফ এত বেশী তেলাওয়াত হয় দুনিয়ার অন্য কোন কিতাব তত বেশি পঠিত হয় না। পবিত্র কুরআন শরীফ বারবার তেলাওতে বারবার স্বাদ বাড়তে থাকে। পবিত্র কুরআন শরীফের অপর একটি মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, পবিত্র কুরআন শরীফ মুখস্থ করা যত সহজ এবং যত শীঘ্র সম্ভবপর হয় দুনিয়ার অন্য কোন কিতাব এত সহজে এবং এত শীঘ্র মুখস্থ হয় না।
তারিখের নির্ভরযোগ্য কিতাবাদীর মাধ্যমে নিম্নে কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করছি, যে ঘটনাগুলোর দ্বারা পবিত্র কুরআন শরীফের উপযুক্ত মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্য সু-প্রমাণিত হয়।
* সায়্যিদুনা হযরত ওসমান গণী (রা.) প্রতি রাত্রে পবিত্র কুরআনশরীফের একটি খতম পূর্ণ করতেন। (ইক্বামাতুল হুজ্জাহ)
* সায়্যিদুনা হযরত ওসমান ইবনে আব্দুর রহমান তাইমী (রহ.) বলেন, আমাকে আমার মুহতারাম ওয়ালিদ ছাহেব বলেন, আজ রাত মাক্বামে ইব্রাহীমে তিনি জাগ্রত থাকবেন। তাই পবিত্র এশার নামায আদায় করে মাক্বামে ইব্রাহীমে গিয়ে পৌঁছলাম। আমি সেখানে দাড়িঁয়ে আছি। এমনি মুহুর্তে একব্যক্তি এসে আমার কোমরে হাত রাখলেন। তাকিয়ে দেখি, সায়্যিদুনা হযরত ওসমান গণী (রা.)। তিনি পবিত্র সুরায়ে ফাতেহা তেলাওয়াত শুরু করে পড়তে থাকলেন। এমনকি পবিত্র কুরআন শরীফের পূর্ণ একটি খতম করে রুকু এবং সেজদাহ করলেন। (ইক্বামাতুল হুজ্জাহ)
হযরত খারেজা বিন মুছআব (রহ.) ফরমান-চারজন এমন মহান ব্যক্তি ছিলেন যারা সমস্ত পবিত্র কুরআন শরীফ এক রাকাতের মধ্যে খতম করেছেন। ১. সায়্যিদুনা হযরত ওসমান গণী (রা.), ২. সায়্যিদুনা হযরত তামীমদারী (রা.), ৩. সায়্যিদুনা হযরত সাঈদ ইবনে জুবাইর (রহ.), ৪. সায়্যিদুনা হযরত ইমাম আযম আবু হানিফা (রহ.)। (মানাক্বিবে ইমাম আবু হানিফা (রহ.) লিল ইমামু কুরদী (রহ.)
* সায়্যিদুনা হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহুহু দিনে পবিত্র কুরআন শরীফের আট খতম পূর্ণ করতেন। (ইক্বামাতুল হুজ্জাহ)
* সায়্যিদুনা হযরত আসওয়াদ বিন ইয়াজিদ (রহ.) পবিত্র রামাদ্বানুল মুবারকে প্রতি দু’রাতে পবিত্র কুরআন শরীফের এক খতম পূর্ণ করতেন। (ইক্বামাতুল হুজ্জাহ)
* সায়্যিদুনা হযরত আব্দুল্লাহ বিন যুবাইর (রা.) এক রাতের মধ্যে পবিত্র কুরআন শরীফের এক খতম পূর্ণ করতেন। (ফাদ্বাইলে কুরআন)
* সায়্যিদুনা হযরত সাঈদ ইবনে জুবাইর (রহ.) পবিত্র কা’বা শরীফের মধ্যে পবিত্র কুরআন শরীফের এক খতম পূর্ণ করেছেন। তাঁর আমল ছিল প্রতি দু’রাতে পবিত্র কুরআন শরীফের এক খতম পূর্ণ করা। (ইক্বামাতুল হুজ্জাহ)
* সায়্যিদুনা হযরত মুজাহিদ (রহ.) পবিত্র রামাদ্বানুল মুবারকে পবিত্র মাগরিব ও পবিত্র এশার নামাযের মধ্যবর্তী সময়ে পবিত্র কুরআন শরীফের এক খতম পূর্ণ করতেন। (আল আযকার লিন্নব্বী (রহ.)
* সায়্যিদুনা হযরত ছাবিত আসলাম বুনানী (রহ.) প্রতিদিন পবিত্র যোহর ও পবিত্র আছরের নামাযের মধ্যবর্তী সময়ে পবিত্র কুরআন শরীফের এক খতম পূর্ণ করতেন। (ইক্বামাতুল হুজ্জাহ)
* সায়িদ্যুনা হযরত মনছুর বিন যাযান বিন উবাদ তাবেয়ী (রহ.) প্রতিদিন পবিত্র যোহর ও পবিত্র আছরের নামাযের মধ্যবর্তী সময়ে পবিত্র কুরআন শরীফের এক খতম পূর্ণ করতেন। কখনো পবিত্র মাগরিব ও পবিত্র এশার নামাযের মধ্যবর্তী সময়ে পবিত্র কুরআন শরীফের এক খতম পূর্ণ করতেন। পবিত্র রামাদ্বানুল মুবারকে পবিত্র মাগরিব ও পবিত্র এশার নামাযের মধ্যবর্তী সময়ে পবিত্র কুরআন শরীফের দু’খতম পূর্ণ করতেন। (সিয়র আ’লামুন্নুবালা)
* সায়িদ্যুনা হযরত ইমাম আযম (রহ.) চল্লিশটি বৎসর পবিত্র এশার নামাযের অযু দ্বারা পবিত্র ফজরের নামায আদায় করেছেন। তিনি প্রতি রাত্রে পবিত্র কুরআন শরীফের এক খতম পূর্ণ করতেন। পবিত্র রামাদ্বানুল মুবারকের ৩০ দিনে ৩০ খতম ৩০ রাত্রে ৩০ খতম এবং পবিত্র তারাবীহের নামাযের মধ্যে এক খতম পূর্ণ করতেন। এভাবে তিনি পবিত্র রামাদ্বান শরীফে পবিত্র কুরআন শরীফের ৬১ টি খতম পূর্ণ করতেন। (আল খাইরাতুল হাসান)
বর্ণিত আছে যে, সায়্যিদুনা হযরত ইমাম আ’যম আবু হানিফা (রহ.) সাত হাজার বার পবিত্র কুরআন শরীফ খতম করেছেন। (সিয়র আ’লামুন নুবালা)
যখন হযরত আব্দুল্লাহ বিন ইদরীস (রহ.) এর ইন্তেকালের সময় ঘনিয়ে আসল তখন তার ছাহেবযাদী কাঁদতে শুরু করলেন। এতে হযরত আব্দুল্লাহ বিন ইদরীস (রহ.) স্বীয় ছাহেবযাদীকে লক্ষ্য করে বললেন, হে বেটী! কেঁদো না। আমি এ গৃহে চারহাজার বার পবিত্র কুরআন শরীফ খতম করেছি। (নব্বী শরহে মুসলিম, জিলদ: ১০২: ১০) হযরত আবুবকর ইবনে আয়াশ (রহ.) এর ছাহেবযাদা হযরত ইব্রাহীম (রহ.) বলেন, একবার আমার মুহতারাম ওয়ালিদ ছাহেব বললেন, ‘‘ তোমার পিতা কখনও কোন মন্দকাজ করেননি এবং ত্রিশ বৎসর পর্যন্ত প্রতিদিন একটি করে পবিত্র কুরআন শরীফের খতম করেছেন। তিনি বলেন, বেটা! এ কক্ষের মধ্যে কখনও কোন মন্দ কাজ করোনা। আমি উক্ত কক্ষের মধ্যে বারো হাজার বার পবিত্র কুরআন শরীফের খতম করেছি। যখন তাঁর ওফাতের সময় ঘনিয়ে আসল তখন তাঁর ছাহেবযাদী কাঁদতে শুরু করলেন। তিনি বললেন, বেটী! কেঁদোনা। তুমি এ সন্দেহ করছ যে, মহান আল্লাহ পাক আমাকে শাস্তি দিবেন অথচ আমি এ কক্ষের মধ্যে চব্বিশ হাজার বার পবিত্র কুরআন শরীফ খতম করেছি।’’ (নব্বী শরহে মুসলিম জিলদ ১০২ : ১০)
হযরত ইমাম ওকী’ বিন জারাহ (রহ.) প্রতি রাত্রে পবিত্র কুরআন শরীফের একটি খতম পূর্ণ করতেন। (আল ফাওয়াইদুল বাহিয়্যাহ)
হযরত সুলাইম বিন আতার (রহ.) যিনি তাবেয়ীনদের অর্ন্তভূক্ত ছিলেন। সায়্যিদুনা হযরত ওমর (রা.) এর যুগে ফতহেমিছরে শরীক হয়েছিলেন। সায়্যিদুনা হযরত মুয়াবিয়া (রা.) তাঁকে ‘ক্বাছাছ’ এর আমীর নিযুক্ত করেছিলেন। হযরত সুলাইম বিন আতার (রহ.) এর মা’মুল ছিল তিনি প্রতি রাত্রে পবিত্র কুরআন শরীফের তিনটি খতম পূর্ণ করতেন। (ফাদ্বাইলে কুরআন- ০২: ৪৪)
হযরত ইমাম শাফেয়ী (রহ.) পবিত্র রামাদ্বানুল মুবারকে পবিত্র কুরআন শরীফের একষট্টিটি খতম পূর্ণ করতেন। এক খতম দিনে, এক খতম রাত্রে এবং পবিত্র তারবীহের নামাযে এক খতম এভাবে পবিত্র কুরআন শরীফের একষট্টিটি খতম পূর্ণ করতেন। (ফাদ্বাইলে কুরআন ০২:৩৯)
মুহাদ্দিসে কবীর হযরত বাক্কী বিন মাখলাদ আন্দুলুমী (রহ.) প্রত্যেহ তাহাজ্জুদ এবং বিতরের তিন রাকায়াতে পবিত্র কুরআন শরীফের একটি খতম পূর্ণ করতেন। (ফাদ্বাইলে নামায- ০২: ৭৪)
হযরত আবু আলী হাসান বিন আহমদ ছুফী যিনি ইবনুল কাতিব ছুফী নামে পরিচিত ছিলেন। তিনি দিবারাত্রিতে পবিত্র কুরআন শরীফের আটটি খতম পূর্ণ করেন। চার খতম দিনে এবং চার খতম রাত্রে পূর্ণ করতেন। (আল আযকার লিননব্বী- ২: ১৩৩) হযরত খাজা আবু আহমদ চিশতী (রহ.) এর আদত শরীফ ছিল তিনি দিনের বেলায় পবিত্র কুরআন শরীফের এক খতম এবং রাত্রি বেলায় পবিত্র কুরআন শরীফের এক খতম পূর্ণ করতেন। (তারীখে মাশায়িখে চিশত-পৃ: ১৫৫)
হযরত শায়েখ আব্দুল কাদির জিলানী, মাহবুবে সুবহানী (রহ.) ফরমান- ‘‘ আমি পঁচিশ বৎসর পর্যন্ত ইরাকের ময়দান এবং বনভূমিতে এমনভাবে ঘুরাফেরা করতে লাগলাম যে, আমি কাউকে চিনতাম না এবং আমাকে কেউ চিনত না। অদৃশ্য লোকেরা এবং জ্বিনগণ আমার নিকট আসত আমি তাদেরকে সত্য পথের দিশা দিতাম। চল্লিশ বৎসর পর্যন্ত পবিত্র এশার নামাযের অযু দ্বারা পবিত্র ফজরের নামায আদায় করেছি। পনের বৎসর পর্যন্ত আমার অবস্থা এমন ছিল যে, পবিত্র এশার নামাযের পর পবিত্র কুরান শরীফ এমন ভাবে তিলাওয়াত শুরু করতাম যে, আমি এক পায়ের উপর দাঁড়াতাম এবং অপর হাত দ্বারা দেওয়ালের কীলককে আঁকড়ে ধরতাম। এ অবস্থায় সারাটি রাত্রি চলে যেত এবং আমি পবিত্র কুরআন শরীফের একটি খতম পূর্ণ করতাম। কোন সময় এমন হত যে, তিন দিন থেকে চল্লিশ দিন পর্যন্ত পানাহারের কোন কিছু মিলত না ঘুমানোর সুযোগও পেতাম না।’’ (আখবারুল আখইয়ার ফার্সী- পৃ. ১১)

Comments

comments

About

Check Also

ইবাদতের বসন্তকাল রমজান

ঋতুরাজ বসন্ত যেমন প্রকৃতিতে অপার সৌন্দর্যের মোহনীয় রূপ এনে দেয়। তেমনি রমজান মাস পরওয়ারদেগারের পক্ষ …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *