জ্ঞানের কথা মুমিনের হারানো সম্পদ

(পূর্ব প্রকাশের পর )
পবিত্র কুরআন শরীফের অন্যতম আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে পবিত্র কুরআন শরীফ ক্বিয়ামত পর্যন্ত অবিকৃত থাকবে। যার একটি নুকতা পর্যন্ত পরিবর্তন হবে না। আর কেউ পরিবর্তন করতেও পারবে না। পক্ষান্তরে অন্যান্য আসমানী কিতাব সমূহ বিকৃত হযে় গিযে়ছে।
পবিত্র কুরআন শরীফ যে কখনও বিকৃত হবে না বা কেউ বিকৃত করতে পারবে না এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহপাক এরশাদ ফরমান ‘নিশ্চয় আমি কুরআন শরীফ নাযিল করেছি এবং এর সংরক্ষক আমি নিজেই (সুরা হিজর)
পবিত্র কুরআন শরীফের হেফাযতের দাযি়ত্ব মহান আল্লাহপাক নিযে়ছেন তার প্রমাণের একটি ঘটনা নিম্নে বর্ণিত হল।
আল্লামা ইমাম কুরতুবী (রহ.) মুত্তাসিল সনদ দ্বারা খলিফা মামুনের দরবারের একটি ঘটনা বর্ণনা করেছেন, মামুনের দরবারে মাঝে মাঝে শিক্ষা সম্পর্কিত বিষয়াদি নিযে় তর্ক-বিতর্ক ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হত। এতে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার পণ্ডিত ব্যক্তিগণের অংশগ্রহণের অনুমতি ছিল। এমনি এক আলোচনা সভায় জনৈক ইহুদী পণ্ডিত আগমন করল। আকার-আকৃতি, পোষাক ইত্যাদির দিক দিযে়ও তাকে একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি মনে হচ্ছিল।
তদুপরি তার আলোচনাও ছিল অত্যন্ত প্রাঞ্জল, অলংকারপূর্ণ এবং বিজ্ঞজন সুলভ। সভা শেষে মামুন তাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি ইহুদী? সে স্বীকার করল। মামুন তাকে পরীক্ষা স্বরূপ বললেন, তুমি মুসলমান হযে় যাও। তবে তোমার সাথে চমৎকার ব্যবহার করা হবে।
সে উত্তরে বলল, আমি পৈতৃক ধর্ম বিসর্জন দিতে পারি না। কথাবার্তা এখানেই শেষ। লোকটি চলে গেল। কিন্তু এক বছর পর সে মুসলমান হযে় আবার দরবারে আগমন করল এবং আলোচনা সভায় ফেকা সম্পর্কে সারগর্ভ বক্তৃতা ও যুক্তিপূর্ণ তথ্যাদি উপস্থিত করল। সভা শেষে মামুন তাকে ডেকে বললেন, আপনি কি ঐ ব্যক্তি যে বিগত বছর এসেছিলেন? সে বলল, হ্যাঁ, আমি ঐ ব্যক্তিই বটে। মামুন জিজ্ঞেস করলেন, তখন তো আপনি ইসলাম গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানিযে় ছিলেন। এরপর এখন মুসলমান হওয়ার কী কারণ ঘটল?
সে বলল, এখান থেকে ফিরে যাওয়ার পর বর্তমান কালের বিভিন্ন ধর্ম সম্পর্কে গবেষণা করার ইচ্ছা করি। আমি একজন হস্তরেখা বিশারদ। স্বহস্তে গ্রন্থাদি লিখে উঁচু দামে বিক্রি করি। আমি পরীক্ষার উদ্দেশ্যে তওরাতের তিনটি কপি লিপিবদ্ধ করলাম। এগুলোতে অনেক জায়গায় নিজের পক্ষ থেকে বেশকম করে লিখলাম। কপিগুলো নিযে় ইহুদীদের উপাসনালযে় উপস্থিত হলাম। ইহুদীরা অত্যন্ত আগ্রহ সহকারে কপিগুলো কিনে নিল। অতঃপর এমনিভাবে ইঞ্জিলের তিনটি কপি কমবেশ করে লিখে খ্রিষ্টানদের উপাসনালযে় নিযে় গেলাম। সেখানেও খ্রিষ্টানরা খুব খাতিরযতœ করে কপিগুলো আমার কাছ থেকে কিনে নিল।
এরপর পবিত্র কুরআন শরীফের বেলায়ও আমি তাই করলাম। এরও তিনটি কপি সুন্দরভাবে লিপিবদ্ধ করলাম। এবং নিজের পক্ষ থেকে কম-বেশ করে দিলাম। এগুলো নিযে় যখন বিক্রয় করার উদ্দেশ্যে বের হলাম তখন যেই দেখল, সেই প্রথমে আমার লেখা কপিটি নির্ভুল কিনা যাচাই করে দেখল। অতঃপর বেশ-কম দেখে কপিগুলো ফেরত দিযে় দিল।
এ ঘটনা দেখে আমি এ শিক্ষাই গ্রহণ করলাম যে, গ্রন্থটি হুবহু সংরক্ষিত আছে এবং মহান আল্লাহপাক নিজেই এর সংরক্ষণ করছেন। এরপর আমি মুসলমান হযে় গেলাম।
ঘটনা বর্ণনাকারী ইয়াইয়া ইবনে আকছাম বলেন, ঘটনাক্রমে সে বছরেই আমার হজ্জব্রত পালন করার সৌভাগ্য হয়। সেখানে প্রখ্যাত আলেম সুফিয়ান ইবনে উয়াইমা (রহ.) এর সাথে সাক্ষাৎ হলে ঘটনাটি তাঁর কাছে ব্যক্ত করলাম। তিনি বললেন, নিঃসন্দেহে একথা হওয়াই বিধেয়। কারণ পবিত্র কুরআন শরীফে এ সত্যের সমর্থন বিদ্যমান রযে়ছে। ইয়াহইয়া ইবনে আকছাম জিজ্ঞেস করলেন, পবিত্র কুরআন শরীফের কোন আয়াতে আছে? হযরত সুফিয়ান ইবনে উয়াইনাহ (রহ.) বললেন, পবিত্র কুরআন পাকে যেখানে তওরাত ও ইঞ্জিলের আলোচনা করেছে সেখানে বলেছে ‘ইহুদী ও খ্রিষ্টানদেরকে মহান আল্লাহপাকের গ্রন্থ তওরাত ইঞ্জিলের হেফাযতের দাযি়ত্ব দেওয়া হযে়ছে। এ কারণেই যখন ইহুদী ও খ্রিষ্টানরা হেফাযতের কর্তব্য পালন করেনি তখন এ গ্রন্থদ্বয় বিকৃত ও পরিবর্তিত হযে় বিনষ্ট হযে় গেছে। পক্ষান্তরে পবিত্র কুরআনপাক সম্পর্কে মহান আল্লাহ পাক বলেন, ‘আমি এর সংরক্ষক। মহান আল্লাহ পাক স্বয়ং এর হেফাযত করার কারণে শত্র“রা হাজারো চেষ্টা সত্ত্বেও এর একটি নুকতা এবং যের ও যবরে পার্থক্য আনতে পারেনি। রেসালত আমলের পর আজ দীর্ঘ চৌদ্দশ বছর অতীত হযে় গেছে। ধর্মীয় ও ইসলামী ব্যাপারে মুসলমানদের ত্র“টি ও অমনোযোগিতা সত্ত্বেও পবিত্র কুরআন শরীফ মুখস্ত করার ধারা বিশ্বের সর্বত্র পূর্ববৎ অব্যাহত রযে়ছে। প্রতি বছরই লাখ লাখ বরং কোটি কোটি মুসলমান যুবক, বৃদ্ধ এবং বালক ও বালিকা এমন বিদ্যমান থাকে, যাদের বক্ষ পাজরে আগাগোড়া পবিত্র কুরআন শরীফ সংরক্ষিত রযে়ছে। কোন বড় থেকে বড় আলেমের সাধ্য নেই যে, এক অক্ষর ভুল পাঠ করবে। তৎক্ষণাৎ বালকবৃন্দ নির্বিশেষে অনেক লোক ভুল ধরে ফেলবে। (তাফসীরে কুরতুবী)
তাফসীরে মাআরিফুল কুরআনের বর্ণনা মতে, পবিত্র কুরআন শরীফের আরও অনেক বৈশিষ্ট্যাবলী রযে়ছে, যা বর্ণনা করে শেষ করার মত নহে। যেমন পবিত্র কুরআন শরীফ এমন একটি ফাছাহাত ও বালাগতপূর্ণ কিতাব পৃথিবীতে এমন ফাছাহাত ও বালাগতপূর্ণ আর কোন কিতাব নেই। যেমন মহান আল্লাহ পাকের বাণী, ‘এদত সম্পর্কে যদি তোমাদের কোন সন্দেহ থাকে, যা আমি আমার বান্দার প্রতি অবতীর্ণ করেছি, তাহলে এর মত একটি সুরা রচনা করে নিযে় এসো। (সুরা বাক্বারাহ)
পবিত্র কুরআন শরীফ স্পর্শ করতে হলে অযু থাকা জরুরী, কিন্তু অন্য কোন কিতাব স্পর্শ করতে হলে অযু থাকা জরুরী নহে। যেমন মহান আল্লাহপাকের বাণী ‘পবিত্র লোক ব্যতিত কুরআন শরীফ স্পর্শ করবে না। (সুরা ওয়াক্বিয়াহ)
পবিত্র কুরআন শরীফ তেলাওয়াত করার সময় ‘আউযুবিল্লাহ’ পড়া জরুরী কিন্তু অন্য কিতাব শুরু করার সময় আউযুবিল্লাহ পড়া জরুরী নহে। এমন কি দুররুল মুখতার এর হাশিয়া রদ্দুল মুহতার এর মধ্যে উল্লেখ আছে যে, অন্য কোন কিতাব আরম্ভ করার সময় আউযুবিল্লাহ পড়বে না। যেমন মহান আল্লাহ পাকের বাণী, ‘যখন আপনি পবিত্র কুরআন শরীফ পাঠ করবেন তখন আপনি মহান আল্লাহ পাকের নিকট অভিশপ্ত শয়তান থেকে পানাহ চাইবেন।’
যখন পবিত্র কুরআন শরীফ তেলাওয়াত করা হয় তখন উহা মনোযোগ সহকারে শ্রবণ করা এবং চুপ থাকা জরুরী অথচ অন্য কোন কিতাবের ব্যাপারে এমন নহে। যেমন এরশাদে বারী তায়ালা ‘যখন বিত্র কুরআন শরীফ পাঠ করা হয়, তখন তোমরা তা মনোযোগ সহকারে শ্রবণ কর এবং চুপ থাক। (হেদায়াতুত তারতীল, পৃ. ৪১৯)
জেনে রাখা ভাল, পবিত্র কুরআন শরীফের আয়াতের সংখ্যা কতটি এ ব্যাপারে সাযি়্যদুনা হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) হতে সাযি়্যদুনা হযরত আতা (রা.) বর্ণনা করেছেন যে, পবিত্র কুরআন শরীফে ৬৬৬৬টি আয়াত রযে়ছে। (সাযি়্যদুনা হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) হতে ময়মনু বিন মেহরান রেওয়াযে়ত করেছেন যে, বেহেশতে সর্বমোট ৬৬৬৬টি স্তর রযে়ছে। পবিত্র কুরআন শরীফের আয়াতের সংখ্যা ও জান্নাতের স্তর সমপরিমাণ রযে়ছে। (আল কাউলুস সাদীদ)
৬৬৬৬টি নাযিলকৃত আয়াত সমূহের হিসাব নিম্নে প্রদত্ত হল। আদেশ ১০০০, নিষেধ ১০০০, ওয়াদা ১০০০, ওয়ীদ বা ভীতি ১০০০, আমছাল ১০০০, ক্বিছাছ ১০০০, হালাল ২৫০, হারাম ২৫০, তাছবীহ ১০০, বিবিধ ৬৬। মোট ৬৬৬৬টি আয়াত। (চলবে)

Comments

comments

About

Check Also

ইবাদতের বসন্তকাল রমজান

ঋতুরাজ বসন্ত যেমন প্রকৃতিতে অপার সৌন্দর্যের মোহনীয় রূপ এনে দেয়। তেমনি রমজান মাস পরওয়ারদেগারের পক্ষ …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *