বাবরের সংগ্রাম

৯ম পর্ব
জুনেদের কাছ থেকে ফিরে পাহাডে়র অপর পাশে এলাম। এখান থেকে দু’জনকে স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে। আমি যে জায়গাটায় আছি, ঠিক সে দিকেই তাদের রাইফেল তাক করানো। কখন গুলি আসে কে জানে। তাই নিরাপদ জায়গা বেছে শুযে় পড়লাম। এই শুযে় পড়া হচ্ছে সম্মুখ যুদ্ধে শত্রুর চোখ থেকে নিজের শরীরকে রক্ষার সামযি়ক একটা কৌশল।
আমি দেখতে পাচ্ছি তাদের। তবে ওরা আমাকে দেখতে পাচ্ছে বলে মনে হল না। না, দেখতে পাচ্ছে না। একটু ভেবে চিন্তে নিলাম। এজন্য আরও মিনিটখানেক সময় গেল। তারপরই গুলি করলাম। লক্ষ্য ঠিক করতে পারিনি। বুঝতে পারলাম পরে। যখন গুলি ছুড়লাম অথচ তাদের কারও শরীর স্পর্শ করলো না। তারা পাল্টা গুলি করলো। চলে গেল গাডি়র আড়ালে। এবার আমি নিশানা আরও ভাল করে গুলি করি। লাগলো না তারপরও। লাগার কথা না। ওরা মাথা বের করে গুলি করে আবার আড়ালে চলে যাচ্ছে। কিন্তু তখনই দেখলাম একজন লুটিযে় পড়লো। গাডি়র নিচ দিযে় দেখা গেলো। জুনেদের গুলিতে নিশ্চয়। গাডি়র নিচ দিযে় দেখা যাচ্ছে, সেখানে তখন চারটি পা। তারা আড়ালেই থাকলো। সামনে এলো না। গাডি়র আড়ালে থেকে গুলি করলো রাইফেল সামনে এনে। ঠিক তখন আমার রাইফেল থেকে সর্বশেষ গুলি বের হযে় গেলো। আমি বুঝতে পারিনি আগে যে এটাই হবে শেষ গুলি। কারণ ভাবিনি যে আমার কাছে গুলি আছে কি না। রাইফেল শূন্য। তাই গুলি বের হলো না। সঙ্গে সঙ্গে চমকে উঠলাম! এখন কি করি! জুনেদের ব্যাগে নিশ্চয় গুলি আছে! তখনও শত্রুপক্ষ গুলি করছে। আমি গুলি করছি না দেখে হয়তো তারা মনে করলো, নিহত কিংবা আহত হযে় গেছি। জানি আসলে তারা আমাদের সংখ্যা কত ভাবছে। ওরা গুলি বন্ধ করলো। এই সুযোগে তাড়াতাডি় জুনেদের কাছে চলে গেলাম।
‘বাবর!’ আমাকে আসতে দেখে বললো।
‘গুলি শেষ।’
‘ব্যাগে এখনও অনেক গুলি আছে, নিযে় নাও।’
‘ঠিক আছে।’ গুলি বের করলাম। এরপর ‘যাই।’ বলে চলে যাচ্ছিলাম। জুনেদ ডাকলো-
‘বাবর!’
‘হ্যাঁ, বলো।’
‘ঐ দেখো, বড় একটা ট্রাক নিযে় পাক বাহিনী আসছে।’
তাকালাম সে দিকে। ‘তাই তো।’
‘আমি নিশ্চিত এবার লড়াই জমবে। কিন্তু কঠিন যে হবে সেটা ধারণা করতে পারছি। আমরা মাত্র দু’জন।’
‘ভয় নেই। সাহস রেখো। আল্লাহ আমাদের সাহায্য করবেন। আমি দেখতে পাচ্ছি, জয় আমাদের।’
‘তোমার অন্তর্দৃষ্টি যেন সঠিক হয়।’
‘তবে তা এখানে থাকলে হবে না। আমার জায়গায় যেতে হবে।’ বলে মুচকি হাসলাম। ‘আমি যাই। ওদের দুই দিক থেকে আক্রমণ করতে হবে। তুমি এখানেই থাকো।’
‘বাবর, দেখো। ওরা এগুচ্ছে না। দূরে দাঁডি়যে় পডে়ছে।’
‘আমার মনে হয় ওরা এদিক আসবে না। কারণ, সামনে ফাঁকা। এলেই যে গুলির মুখে পড়তে হবে, তা ওরা ভাল করেই বুঝতে পারছে।’
‘হেঁ।’
‘জুনেদ,’ সামনে থেকে চোখ সরালাম না। ওদিকে তাকিযে়ই বললাম। ‘আমরা এখানেই থাকবো। এরমাঝে মুক্তি বাহিনীর লোকেরাও আসতে পারে। অফিসারকে যে পাক বাহিনী তাডি়যে় এই রাস্তা দিযে় নিযে় এসেছে, সেটা হয়তো অফিসার নিকটবর্তী কোন ঘাঁটিকে ওয়াকিটকি দিযে় জানিযে়ছেন। হয়তো এও বলেছেন, যে তাকে তাডি়যে় নিযে় যাওয়া গাডি়টির চাকা পামচার হযে় রাস্তায় পডে় আছে। তিনি তো আর জানেন না আসলে কি হযে়ছে। নিশ্চয় এতোক্ষণে এদের জবাব দিতে তারা আসতেও শুরু করেছেন। দেখো, তারা এলে তখন ওরা কোথায় যায়! ওরা এদিকে গুলি করছে, গেলাম…’
আমি আমার স্থানে যেতে না যেতে গুলির গর্জন শুনতে পেলাম। টিস, টিস, টিস! পাকিস্তানীরা আবার গুলি করছে। তবে কোন নির্দিষ্ট ভাবে নয়। আমার দিকেও ঠিক নয়। হঠাৎ পাহাডে়র বুক থেকে গুলির শব্দ হলো। একসঙ্গে কযে়ক সেকেন্ড। এটা জুনেদের কাজ। তারপর বন্ধ। অপরদিক থেকে গুলি হচ্ছে। আবার জুনেদের গুলি। ততক্ষণে আমি জায়গায় এসে গেছি। দেখি জীপের সামনে ওরা দাঁডি়যে় আছে। জুনেদের গুলির আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য এদিকে এসেছে তারা। এই সুযোগ হারালাম না। ঠিক মতো গুলি করলাম। কযে়কবার এক সঙ্গে। চোখ বন্ধ করে। একই নিশানায়। ৩-৪ সেকেন্ড। দু’জনই বুঝে উঠার আগে মাটিতে লুটিযে় পড়লো। একটু এগুলাম। ভাল করে ট্রাক দেখার চেষ্টা করলাম। তখন জুনেদের সঙ্গে তাদের গুলি বিনিময় হচ্ছে। এখানে এসে দেখতে পেলাম ট্রাকের আড়ালে পাঁচজন শুযে় গুলি করছে। চারজন তাদের গাডি়র সামনে রাস্তার পাশে লুকিযে়, জুনেদ হয়তো ওদেরে দেখছে না। ওরাও শুযে় আছে। আমি গুলি করলাম। অনেক। সবাইকে লক্ষ্য করে। সামনের চারজনের তিনজন একটু নডে়ই থেমে গেলো। এদের দু’জন গডি়যে় গডি়যে় পানিতে পডে় ডুব দিযে় ওপারে চলে গিযে় লুকালো গাছের আড়ালে। গুলি করলাম আবার। না, এবার ফল হলো না। চারজন গাডি়র পেছনে চলে গেছে। হঠাৎ একটা গুলি এলো। কোত্থেকে এলো ঠিক ধরতে পারলাম না। আমার পাযে় লেগে অনেক গোশত নিযে় চলে গেলো। সঙ্গে সঙ্গে একটা চিৎকার দিযে় উঠলাম। মাথা তুলে দেখলাম, রক্ত ঝরছে। কাপড় দিযে় শক্ত করে বেঁধে নিলাম সে জায়গাটি। আবার সামনে মনোযোগ দিলাম। ঐ গাছের দিকে গুলি করলাম। কোন উত্তর নেই। চমকে উঠলাম! ওরা নীরব কেন? ট্রাকের দিকে তাকালাম। তার পিছনে কযে়কজনের পা দেখা যাচ্ছে। জুনেদ গুলি করছে। তাহলে সে কি…! বুক মোচড় দিযে় উঠলো। আহত পা নিযে় খুব কষ্ট করে তার অবস্থানে গেলাম। না, সে নীরবে শুযে় আছে। মাথা তুলে রাইফেল তাক করে ঐ ট্রাকের দিকে। ডাকলাম-
‘জুনেদ…।’
‘কে!’ ও যেন চমকে উঠলো। রাইফেল গুরিযে় তাকালো। আমাকে দেখে গুলি করলো না। অল্পের জন্য। বলল, ‘ও বাবর! কি খবর?’ আমি তখন দাঁডি়যে়।
‘ভাল।’
‘একি! তোমার কন্ঠ এমন শুনাচ্ছে কেন!’
‘কই, নাতো।’ ওর কাছে আরও এগুলাম।
‘এরকম হাঁটছো কেন? গুলি লেগেছে?’
‘হেঁ, পাযে়। তবে বেঁধে ফেলেছি। আর কিছু হবে না।’
‘দেখি দেখি।’ বলে ও উঠে বসলো।
‘না, এখন দেখার সময় নেই। শত্রু বাহিনীকে মোকাবেলা করতে হবে আগে। ও দিকে খেয়াল দাও। পরে ওসব দেখা যাবে।’
আমাদের দিক থেকে গুলি হচ্ছে না দেখে ওরা বুঝলো হয়তো আমরা হেরে গেছি বা যে ক’জন ছিলাম মরে গেছি, তাই তারা গাডি়তে উঠতে লাগলো। কযে়কজন মাত্র। অনেককে খতম করেছি। ঐ জীপের কাছে তিনজন গেলো। দেখলো জীপে যারা ছিলো সবাই চির দিনের জন্য ঘুমিযে় পডে়ছে। মাথা তুলে পাহাডে়র দিকে তাকালো। মৃতদের অস্ত্র হাতে নিযে় ওরা তিনজনই ট্রাকের দিকে ছুটলো। ট্রাকের কাছে যাবার আগেই আমাদের দু’জনের রাইফেল থেকে গুলি বের হযে় গেল। একজন পডে় গেলো, দু’জন শুযে় রাস্তার নিচে নামলো। ঠিক তখন ট্রাকের দিক থেকে গুলি এলো। আমাদের কারো গাযে় লাগলো না। আর তখনই দেখলাম পাক বাহিনীর বেশ দূরে একটা ট্রাক গুলি করতে করতে এগিযে় আসছে। পাকদের নিচের দু’জন এসে গাডি়তে উঠতে গেলে জুনেদ গুলি করলো। যন্ত্রণায় আমি প্রায় নিস্তেজ হযে় গেছি। জুনেদের গুলির বিনিমযে় তারাও একঝাক গুলি আমাদের দিকে উপহার দিলো। কিন্তু কারও গাযে় গুলি লাগলো না। গাডি় চলতে শুরু করলো। ওরা পালিযে় যাবে। পেছনে গুলি করে ধীর গতিতে এগিযে় আসছে একটা ট্রাক। তারাও সে দিকে গুলি করলো। থেমে গেলো নবাগত ট্রাক। কিন্তু পাকদের ট্রাক চলে যাচ্ছে। তখনও আমাদের দিকে ওরা গুলি করছে। আমাদের সামনে দিযে় ট্রাক এগুচ্ছে। এখন গতি বেডে় গেছে। জুনেদ গুলি করলো। হঠাৎ করে একটা গুলি এসে আমার বাম পাঁজরের নিচের অংশে লাগলো। আমি প্রচন্ড চিৎকারে ঢলে পড়লাম মাটিতে। আর কোন গুলির শব্দ পেলাম না। চিৎকার শুনে জুনেদ আমার দিকে ফিরে তাকালো। আমি ভয়াবহ আহত হযে়ছি দেখে কাছে এসে ওর দুই বাহুতে আমাকে তুলে নিলো।
‘কি হলো বাবর?’
ও কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো। তার কথা শুনতে পেলেও যন্ত্রণায় কোন কথা বলতে পারলাম না।
‘যুদ্ধে এলে, এমনই… হয়…! ওদিকের কি অবস্থা?’
জুনেদ মাথা তুলে সে দিকে তাকালো। মুখ ফিরিযে় বললো, ‘আমরা যে পাকদের মেরেছি, তারা তাদের দেখছে। এখন ওরা পাহাডে়র দিকে তাকিযে় আছে। নিশ্চয় আমাদের খোঁজছে।’
‘তাই?’
‘ওরা আমাদের ডাকছে। জবাব দেব?’
‘দাও।’
জুনেদ খোলা জায়গায় এগিযে় গিযে় বলল, ‘এই যে, আমরা এখানে… আপনারা তাড়াতাডি় এদিকে আসুন।’ বলে সে আবার আমার কাছে ফিরে এলো। ‘ওরা আসছে।’
‘কো… কোন লাভ হবে না। আমা… র…’
‘লাভক্ষতির বিচার নয়। তোমাকে বাঁচতে হবে। এটাই এখন ভাবো।’
‘দম বন্ধ হযে় আসছে।’
‘তাহলে স্বাধীনতার সূর্য কে দেখবে? একবার ভাবো। তুমিই তো পাক সেনাদের মেরেছো। তোমারই তো দেখার কথা। এজন্য বাচতে হবে। একটু শক্ত হও বন্ধু।
‘আমি পারছি না।’
‘ফয়জুল চলে গেলো আমাকে ছেডে়। তুমি চলে গেলে যে আমি শেষ হযে় যাব। তোমার মাঝে শুধু তুমি নও। ফয়জুলও আছে। তুমি দুটি মানুষের স্বপ্ন নিযে় মরতে পারো না। তোমার কিচ্ছু হবে না। দেখো।’
আমার চোখ মোজে এলো। তাকাতে চাইলেও আর পারলাম না। স্বরও যেন গলার নিচে আটকে গেলো। বেশ চেষ্টা করেও মুখ দিযে় একটি কথা বের করতে পারলাম না আর। অন্ধকার লাগছে পুরো পৃথিবী।
১৩.
কিছু যখন বুঝতে পারছিলাম। সম্ভবত একটা বোধ আসছিল আমার মাঝে যে আমার ভেতরে বাইরে কিছু একটা হচ্ছে। কিন্তু কি হচ্ছে তা তখন বুঝতে পারছিলাম না। তখনই চোখ মেললাম। দেখলাম, চোখের উপরে সাদা টিন। পাশের দেয়ালে বাতি জ্বলছে। আমি শুযে় আছি। কিন্তু কোথায়, কার ঘরে? আস্তে আস্তে চোখ আরও মেললাম। ভাবতে লাগলাম- আমি শুযে় আছি কেন এই ঘরে। এই বেডে কেন? না, কিছুই ভেবে পাচ্ছি না। শরীর অবস লাগছে। একটু নড়লাম… উহ! ডান পাঁজরের নিচে ভয়ংকর যন্ত্রণা তখনই একটা মোচড় দিযে় উঠলো। বুঝলাম কিছু একটা হযে়ছে ওখানে। কি হযে়ছে। চোখ বন্ধ করলাম। আস্তে আস্তে অতীত মনে পড়লো। এখানে আসার কথা মনে করতে চেষ্টা করলাম। হেঁ, একে একে সব মনে পড়ছে। আমি আহত হযে়ছিলাম পাক সেনাদের গুলিতে। একি! এর পরও বেঁচে আছি? আমি? গুলি খেযে় তো পডে় গিযে়ছিলাম। তখন সঙ্গে জানি কে ছিলো, কে ছিলো! হেঁ হেঁ, বন্ধু জুনেদ। আর সে তখন বলল, মুক্তি বাহিনী এদিকেই আসছে। আর কিছু মনে হচ্ছে না। এরপর তাহলে কি হলো? তার কিছু হয়নি তো! কি জানি, এখন সে কোথায় কেমন আছে আর কিইবা করছে। আর আমিই বা এখানে কার ঘরে- কেন শুযে় আছি? আহত যখন, তো হাসপাতালে থাকতাম। এখানে কেন? কার বাসা? জুনেদের? না অন্য কারো?
চোখ বন্ধ করে এসব ভাবছি। প্রথমে চোখ খুলেছি বা নডে়ছি, তখন হয়তো কেউই খেয়াল করেনি।
চোখ আবার খোললাম। এবার ভাল করে দেখলাম। আলো জ্বলছে। উপরে ফ্যান শ্লথ গতিতে ঘুরছে। সুন্দর একটা রুম। মুখ উপরের দিকে। পাশে কেউ আছে কি-না, মুখ ঘুরিযে় তাকালাম। হেঁ, একজন নার্স। বসে আছে পাশের চেয়ারে। হাতে একটা বইও। আমি নড়াচড়া করলে সে মুখ তুলে তাকালো। আমি চোখ মেলেছি দেখে হাতের বই বন্ধ করে মুখের কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো, ‘কেমন লাগছে এখন?’ আমি কথা বলতে পারলাম না। শুধু ফেল ফেল করে তার দিকে তাকালাম। সে আবার বললো, ‘হেঁ বাবর, তুমি পাকিস্তানী সেনাদের গুলিতে গুরুতর আহত হযে়ছিলে। তবে চিন্তার কিছু নেই! তাড়াতাডি় ভাল হযে় উঠবে। এখন কি তোমার পানি লাগবে? আমি কি তোমাকে পানি দেবো? পিপাসা লাগছে?’
জ্ঞান হতেই পেঠে ক্ষুধা অনুভব করছি। ওর কথা শুনে এখন পানিও খেতে ইচ্ছে করছে। অন্য কিছুর কথা না বলে ইশারায় তাকে পানি দিতে বললাম। মাথা উপর নিচে দুলিযে়। নার্স চামচ দিযে় অল্প অল্প করে মুখে পানি তুলে দিলো।
‘বাবর, জ্ঞান ফিরেছে তোমার?’ কে যেনো চিৎকার দিযে় এভাবে বলে রুমে ঢুকলো। মুখ ফিরিযে় দেখি বন্ধু জুনেদ। মুখ আমার মুখের কাছে এনে সে আবার জিজ্ঞেস করলো, ‘বন্ধু, তোমার জ্ঞান ফিরেছে? আমি যে কত খুশি হযে়ছি।’ একটু থামলো। আমি তার দিকে তাকিযে় আছি। নীরব। মাথায় হাত বোলালো সে। ‘জানো, তুমি আজ তিন দিন ধরে অজ্ঞান। ডাক্তাররা অনেক চেষ্টা করেছেন তোমার জ্ঞান ফিরাতে। শেষ পর্যন্ত আজ এসে জ্ঞান ফিরলো।
আমি বিড় বিড় করে উচ্চারণ করলাম, ‘তিন দিন ধরে!’
তারা দু’জনের কেউই আমার কথা বুঝলো না। ‘কি বললে, বাবর?’ জুনেদের প্রশ্নের জবাবে মুখে অবশ্য কিছু বলতে পারলাম না ঠিক, তবে কযে়ক ফোঁটা চোখের অশ্রু দিযে় বুঝিযে় দিলাম যে, আমি তোমার প্রশ্নের উত্তর দিতে অক্ষম। এরপরও আমি অনেক চেষ্টা করলাম। কিন্তু কথা বলতে পারলাম না। দুর্বল তাই। জুনেদ পরপর আমাকে শুধু প্রশ্নের উপর প্রশ্ন করছে। তার একটি প্রশ্নেরও জবাব দিতে পারছি না। শুধু চোখের জল ফেলছি।
নার্স বললো, ‘জুনেদ, রোগিকে আর প্রশ্ন করতে দেয়া যাবে না। তাতে রোগির অসুবিধে হবে। তুমি যাও, খাটে গিযে় বসো। আমি স্যারকে খবর দিচ্ছি। প্লিজ, কথা বলার চেষ্টা করো না আর।’
আমি তাই করলাম। নীরবে ওর দিকে তাকিযে় থাকলাম। ও চোখ বন্ধ করে ঘুমাচ্ছে। একটু পরে ডাক্তার এলেন। আমাকে পরীক্ষা করে চলে গেলেন তিনি। শুধু বললেন, ‘বাচা, তুমি ভাল হযে় যাচ্ছো। আর সম্ভবত বিষ্ময়কর ভাবে তুমি পুরোপুরি সুস্থও হযে় উঠবে। হয়তো তোমার মা-বাবার দোয়া তোমার জন্য সহায় ছিল।’
আমি চোখ বন্ধ করলাম। কোন অনুভূতিই যেন আমার নেই। তিনি চলে গেলেন। এর ঠিক দু’ঘন্টা পরে আমাদের মুক্তি বাহিনীর স্যার এলেন। আমাকে দেখে চোখের পানি ছেডে় দিলেন। রোমাল দিযে় চোখ মুছলেন। ‘আপনি কাঁদছেন কেন?’
আস্তে আস্তে বললাম তারে। তিনি মনে হয় কিছুটা বুঝতে পেরেছেন। ‘কাঁদছি কেন?’ আমি মুছকি হাসি টানলাম ঠোঁটে। মাথা উপর-মাথা নিচে দুলালাম। চোখ মুছলেন আবার। হাসলেন তিনি। বললেন, ‘বলো, এখন কেমন লাগছে তোমার?’
মাথাটা বাযে় ধাক্কা দিলাম। বোঝালাম ভাল। কথা বললাম না।
‘কথা বলতে চেষ্টা করো না।’ বলে মাথায় হাত বোলালেন। বেশ কিছুক্ষণ আমার পাশে বসে তিনি চলে গেলেন।
এটা মুক্তি বাহিনীর জন্য নির্ধারিত সরকারী হাসপাতাল। চিকিৎসকরা অনেক চেষ্টা করলেন। ভালও হলাম কিছু। কিন্তু পুরোপুরি সারানো সম্ভব হলো না। পাজরের হাঁডে়র ভেতর দিকে নাকি গুলি রযে় গেছে। একদিন সেই ডাক্তার এসে বললেন, ‘তুমি অনেকটাই ভাল হযে় উঠেছো। আমরা চাই তোমার আরও উন্নত চিকিৎসা হোক। তুমি দেশের বীর। তাই তোমাকে কলকাতা পাঠানো হবে। কালই পাঠিযে় দেয়া হবে। ভাল হওয়ার পর একবার এসে যেযে়া আমাদের এখানে। আমরা আমাদের কিশোর বীরকে ভালবাসা দিতে চাই।’
আমি কিছু বললাম না। কলকাতা পাঠানো হলো পরদিনই। বাংলাদেশেও আমার অপারেশন হযে়ছে। পা থেকে ব্যান্ডিজ খুলে নেয়া হযে়ছে জখম শুকিযে় গেছে বলে। আমি ঠিক বুঝতে পারি না আসলে কি। ব্যাথা হয় প্রচণ্ড। অসহ্য এটা টের পেতাম। পরে শুনেছি। এই ব্যাথায় আমি নাকি বারবার অজ্ঞান হযে় পডি়। পাঁজরে গুলির বিষয়টিও জানি পরে।
২০ ডিসেম্বর। ১৯৭১। ডাক্তার আর.বি সিং আমার পাশে একটা চেয়ার টেনে নিযে় বসলেন। রুমে একজন নার্স, জুনেদ, তার সঙ্গে স্যারের দেয়া একজন লোক। ডা. সিং অত্যান্ত ভাল লোক। ভদ্রও। মমতার কোন অভাব নেই তার কাছে। তিনি আমার নাডি় বুডি় পরীক্ষা করে পাশের তিন জনের দিকে চেযে় মুচকি হাসলেন। আমার দিকে ডাক্তার তাকালেন। মুখে হাসি। চেযে় আছেন।
‘বাবু, আমি যদি তোমার আর তোমার পিতার নাম জানতে চাই, তাহলে কি বোকা ভাববে?’ প্রশ্নের জবাব না দিযে় হাসলাম। কারণ, তিনি আমার নাম ভাল করেই জানেন। ‘আমার নাতিটা না প্রায় প্রতিদিনই আমাকে নাম জিজ্ঞেস করে। তার ধারণা আমি মানুষের নাম প্রেসক্রিপশনে লিখতে লিখতে নিজের নামটাও ভুলে যেতে পারি। এজন্য যে কাজ শেষ করে যেন পকেট থেকে ভিজিটিং কার্ডটা দেখে নিযে় নামটা মুখস্ত করতে বলে। হা হা হা। কি অদ্ভুত ছেলে তাই না?’ হাসলেন একটু। ‘নিজের নাম তাহলে ভুলে গেছো?’ আবার হাসলেন। হাসলে তাকে বেশ দেখায়। গালে একটা তিল পডে়। তাতে বেশ ভাল লাগে। কেমন জানি বড় আপন মনে হয়। ‘নাম না জানলে সব সময় মুখস্ত করে রাখবে বাবর, আসার মতো।’ বলে তিনি হেসে উঠলেন শব্দ করে। ‘এই দেখো, তোমার নাম আমি বলে ফেলেছি। আমি জানি আবার জিজ্ঞেসও করছি! কি আবুল-তাবুল কাণ্ড!’ সবাই এক সঙ্গে হেসে উঠে। আমার ঠোঁটটাও একটু নড়লো। ‘আমি এবার সত্যি বলছি, তোমার পিতার নাম জানি না।’
‘আ… আ… আবু… বু…’
‘ঠিক আছে, ঠিক আছে, আর বলতে হবে না, অবসরে সব শুনবো। এখন থাক।’
জুনেদ এগিযে় এলো। মুখের সামনে এসে দাঁত দেখালো হেসে। তার দাঁত সুন্দর পরিপাটি। আমি শুধু নীরব দর্শক তখন।
‘জুনেদ, বাবরকে বেশি বিরক্ত করা যাবে না।’ বললেন ডাক্তার। ‘আর তুমি যে খবর জানাতে মরিয়া হযে় উঠেছো। তাও এখন তাকে জানানো যাবে না। আজ থেকে ঠিক পাঁচ দিন পর জানাবে। তখন তোমরা গল্পও করবে। বাবরের অবস্থাটা টেলিফোনে হাসান সাহেবকে জানিযে় দেব, কেমন?’
‘কাকে জানাবেন বললেন? স্যার কে?’
‘আর কাকেই বা জানাবো।’
‘আমাদের বাডি়তে খবরটা দিতে বলবেন।’
‘ওকে বলবো। এখন যাই। আর হেঁ, তোমরা তাকে কোন কথা বলাতে চেষ্টা করো না। আমিই এসে আলাপ করবো।’
‘ঠিক আছে।’ b r ‘বাবর, তোমার বিশ্রামের প্রযে়াজন। তাই তোমাকে ঘুমের একটা ইনজ্যাকশন দিযে় ঘুম পাডি়যে় দিচ্ছি। চোখ বন্ধ করে ঘুমিযে় পডে়া।’ ডাক্তার সাহেব এই বলে নার্সকে ইনজেকশন দিতে ইশারা করে চলে গেলেন। এরপর আমি আর চোখ মেলে রাখতে পারলাম না। ঘুমের অথৈ সাগরে ডুব দিলাম।
এভাবে প্রতিদিন একই সমযে় ডাক্তার এসে আমাকে দেখে যান। অল্প কথা বলেন। আর কারও কথা বলার অনুমতি নেই। এদিকে আমার বুকের ব্যাথাটাও একটু হালকা হযে় আসছে। তবে নিজেকে এতো ভারি লাগছে কেন, তা বুঝি না। ডাক্তারকে কিছু জিজ্ঞেসও করি না। ডাক্তার প্রশ্ন করলে শুধু আমি উত্তরই দেই। অন্য কোন কথা বলি না, কি বলব? বলার যে কিছুই খুঁজে পাই না। কিন্তু একটা কথা ভেবে আমি উত্তর পাই না, যে আমি এতো নীরব হযে় গেলাম কিভাবে? জুনেদের সঙ্গেও কথা হয় না। যা হয় ইশারায়। ভাল মন্দ। মাঝে মধ্যে দু’এক কথা। তবে সেটি আগের বাবরের মতো নয়।
(চলবে)

Comments

comments

About

Check Also

মুবাহাসা (২য় পর্ব)

(পূর্ব প্রকাশের পর)মুসাল্লা উঠিয়ে নাওইমাম আযম আবু হানিফা র.-এর আদত মুবারক ছিল যখন তিনি শাগরিদকে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *