সেতুর অপেক্ষা

বিকেলে সেতু আর ওর বাবা শফিউল আলম বাসার ছাদে বসে গল্প করছে। সেতুর স্কুল ছুটির পর মাঝে মাঝে ছাদে বসে। ছোট্ট শহরে অনেক মানুষের বাস। সেতুর স্কুল ওর বাসার কাছে। হেঁটেই স্কুলে যেতে পারে। শহরে বাবা ব্যবসা করেন। মা শাহেদ খানম গৃহিনী। সেতু ওর আব্বুকে যেমন ভালোবাসে তেমনি ওর মাকেও। কারণ দুজনই সেতুকে অনেক আদর করে। সেতুর তৃতীয় শ্রেণিতে পডে়। যদিও ডিসেম্বরে বার্ষিক পরীক্ষা শুরু হবে। এরপরে নতুন বছরে নতুন ক্লাস। সেতু যখন স্কুল নিযে় ভাবে তখন ওর ভালোই লাগে। কারণ সেতুর কাছে স্কুলের শিক্ষকরা অনেক ভালো। ক্লাসের পড়াটা ক্লাসে শিখিযে় দেন। কখনও মনে মনে ভাবেÑ স্কুলেও যদি রাতে থাকার ব্যবস্থা থাকত তাহলে মন্দ হতো না। সেতু ওর নিজের মতো করে ভাবে। এর পাশাপাশি স্কুল নিযে় ওর অভিযোগও আছে। প্রধান অভিযোগ স্কুলে খেলার মাঠ নেই। সব অভিযোগ সেতু ওর বাবাকে বলে। বাবা শফিউল আলম নিজে মতো করে যুক্তি দেখান। শহরে জায়গা কম। খেলার মাঠ সব স্কুলে রাখা যায় না। আরও অনেক যুক্তি। সেতুর কখনো কখনো এসব যুক্তি ভালো লাগে। আবার কখনো মন খারাপ করে। চুপ হযে় গম্ভীর হযে় শুধু বাবার মুখের দিকে তাকিযে় থাকে।
আজও স্কুলের এসব নিযে় কথা হল।
‘বাবা তোমার স্কুলটাও কী আমাদের এ স্কুলের মত ছিল?’ জানতে চায় সেতু।
শফিউল আলম এ প্রশ্নের উত্তর অনেকবার দিযে়ছেন। শফিউল আলম বড় হযে়ছেন গ্রামে। গ্রামের স্কুল আর শহরের এখনকার স্কুলের তফাৎ অনেক। শফিউল আলমের ইচ্ছে ছিল গ্রামেই থাকবেন কিন্তু চাকরির খোঁজে শহরে এসে ব্যবসায় যুক্ত হযে়ছেন।
‘না মামনি এমন ছিল না।’
‘কেমন ছিল? খেলার মাঠ ছিল বাবা?’
‘হুম। অনেক বড় মাঠ। প্রতিদিন বিকেলে আমরা খেলতাম।’
‘বাবা আমি গ্রামের স্কুলেই ভর্তি হব।’ সেতু কান্নার স্বরে বলে।
শফিউল আলম সেতুকে সান্ত্বনা দেন। বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখান। আলোকিত মানুষ হওয়ার জন্য উৎসাহ দেন।
সেতুর মনে শুধু নানা প্রশ্ন জাগে। কখনো মাকে প্রশ্ন করে উত্তর জানার চেষ্টা করে। যখন বাবাকে কাছে পায় তখন বাবার পাশে বসে উত্তর জানার চেষ্টা করে ওর প্রশ্নগুলোর। বাবা মা দুজনই সমান ভালোবাসে সেতুকে। সেতুকে ঘিরে দুজনার নানান স্বপ্ন। যে স্বপ্নগুলো সাধারণত সবারই থাকে। লেখাপড়া করবে, ভালো মানুষ হবে। বাবা যখনই অবসর পায় তখনই সেতুর সাথে গল্প করেন। ছোট্ট সেতুও ওর মনের কথাগুলো সাজিযে় বড় মানুষের মত করে বলে। কথা শুনলে মনে হবে সেতু এক কিশোরী মেযে়।
বাবা যখন বাসা থেকে বেরিযে় পডে়ন তখন সেতুর সঙ্গী টিভি আর ওর আম্মু। কার্টুন চ্যানেলে কার্টুন দেখে নিজেই উচ্চস্বরে হাসে। মা কাজের ফাঁকে ফাঁকে এসে ওর পাশে বসেন। কখনো সেতুর মত হাসার চেষ্টা করেন। বাসায় যে কাজ থাকে সেটাকে কাজ বলা যায় না। টিভি দেখেই অবসর কাটাতে হয় শাহেদা খানমের। টিভি দেখতে দেখতে ক্লান্ত এলে সেতু শুযে় পডে়। খেযে়ছে কিনা তার খেয়াল থাকে না। চোখে ঘুম এলে আর কথা নেই। বালিশের উপর মাথা রাখতেই মুহূর্তে ভেতর ঘুম।
শাহেদা খানম সেতুর পাশে বসেন। টিভি বন্ধ করে সেতুর মাথায় হাত বুলিযে় আদর করেন। বাবা রাতে যখন বাসায় ফিরেন তখন সেতু থাকে ঘুমের রাজ্যে। সে রাজ্যে রানি সেতু। নিজের ইচ্ছে মতো ঘুরে বেড়ানো ছাড়া রানির কাজ নেই। মন চাইলে রাজ্যের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে যায়। সেতুর ঘুমের রাজ্যে কারো অভিযোগ নেই—নেই কোনো অভিমান। রানির একারই সব অভিযোগ আর অভিমান। কখনো কখনো ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত দেহে বিরক্তবোধ করে তখনই চোখ মেলে তাকায়। মুহূর্তের ভেতর ঘুম কেটে যায়। সেতু মাযে়র গলা জডি়যে় ধরে পুনরায় ঘুমানোর চেষ্টা করে। শাহেদা বেগম সেতুর মাথায় হাত রেখে গল্প শোনান। শাহেদা বেগমের গল্প বলা শেষ করার আগেই সেতু ঘুমিযে় যায়।
রোজ সকালে বাবা বের হযে় পডে়ন। আজও বাবা যাওয়ার সময় ঘুমন্ত সেতুর কপালে চুমো দিযে় গেলেন। বাসা থেকে বের হওয়ার সময় মনে কেমন যেন অনুভব করলেন। সেতুর ঘুমন্ত চেহারাটাই বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। শাহেদা বেগম প্রতিদিনের মতো সকালের খাবারে জন্য ব্যস্ত। স্বামীর চলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত থাকে ব্যস্ততা। শফিউল আলমকে বিদায় জানিযে় শাহেদা খানম সেতুর দিকে একবার নজর দিযে় নিজের কাজে মনোযোগ দিলেন। সেতু ঘুম থেকে জাগে। মাযে়র সাথে স্কুলেও যাওয়া হল। আজ অন্যান্য দিনের মতো আনন্দ নেই। স্কুলের বন্ধুরাও কথা বলার চেষ্টা করে। সেতু নিশ্চুপ থাকে। স্কুল শেষ করে বাসায় ফিরেও সেতুর একই অবস্থা। বাসায় এসে খাবারের রুটিন থাকলেও সেতু কোনোই খাবার খায়নি। শাহেদা খানম শত চেষ্টা করেও খাওয়াতে পারেনি। পড়ন্ত বিকেলে বাসার ছাদে খেলতে না গিযে় ঘুমিযে় যায় সেতু। সন্ধ্যা অবধি ঘুমায় সেতু।
রাত গভীর হতে থাকে। ঘডি়র কাটার দিকে সেতু চোখ রাখে। মাকেও জিজ্ঞেস করে বাবার ফেরার কথা। মা প্রতিদিনকার মতো করে উত্তর দেন—‘আসবে মামনি আসবে।’ সেতু একথায় সন্তুষ্ট থাকার চেষ্টা করে। কিন্তু মনের ভেতর বাবাকে নিযে় ওর আশঙ্কার কথা লুকিযে় রাখে।
রাত গভীর হয় বাবার ফেরা হয় না। সেতু না ঘুমিযে় বসে থাকে বাবার জন্য। বাবা আসলেই বাবার গলা জডি়যে় ধরে এক সাথে ঘুমাবে। অপেক্ষা করতে করতে এক সময় সেতুর চোখে ঘুম আসে। নিজের অজান্তেই সেতু ঘুমিযে় পডে়।
রাতে আর বাবার ফেরা হয় না। শাহেদা খানমের মনে জমল নানা দুশ্চিন্তা। কেনইবা সন্ধ্যা রাত থেকে শফিউল আলমের মোবাইল ফোনটি বন্ধ। খোঁজ নিলেন সব খানে। রাত পার হয়। পুব দিকে সূর্য ওঠে। সেতুর ঘুম ভাঙ্গে। ঘুম থেকে জেগেই সেতু জানতে চায় ওর বাবা কেন এখনো আসল না।
এক, দুই, তিন দিন নয় পাঁচ দিন পার হল। শাহেদা খানমের কাছে এখনো অজানা তার স্বামীর প্রকৃত খোঁজ। দুএকজন ধারনা করে বলেছেন থানায় খোঁজ নিতে। শাহেদা আর তার আত্মীয়রা থানায় খোঁজ নিলেন। শফিউল আলম নামের কেউ একবছরেও থানায় আটক হয়নি।
সেতু স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিল। বাবা ফিরে এসে ওকে স্কুলে নিযে় যাবে। বার্ষিক পরীক্ষায় অংশ নেয়ার প্রস্তুতি নিবে। কখন বাবা ফিরবে সেতু না জানলেও সর্বক্ষণই ভেতরের দরজার পাশে লাগানো কলিং বেলের দিকে নজর রাখে। হঠাৎ কলিং বেল বেজে উঠলে সেতু দরজায় দাঁডি়যে় থাকে। ওর বাবাকে না পেযে় হতাশ হয়। শাহেদা খানম নীরবে একাকি কাঁদেন। মাকে এমন কাঁদতে দেখে সেতু জিজ্ঞেস করে—
‘আম্মু তুমি কাঁদছ কেন? আব্বু কী আজও ফিরবে না?’ শাহেদা খানম চুপ থাকেন। সেতু ওর আম্মুর মুখের দিকে তাকিযে় নিজেই এবার কেঁদে উঠল।

Comments

comments

About

Check Also

বিদায়বেলা

জামুরাইল হাই স্কুলের বাংলা শিক্ষক ইমরান হোসেন। প্রতিদিন সকাল ৯ টায় স্কুলে আসেন। যথারীতি তিনি …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *