ধেয়ে আসছে ‘ওয়েস জনসনগণ’

২০০৫ সালের ২৪ রমযান। আমি বাজারের একটি দোকানের দিকে মুখ করে বসা। দোকানী আমাকে বলল “নূরুল আমীন ভাই, দেখলেন? কারা গেল রিক্সায়? চট করে রাস্তার দিকে ঘুরলাম। ততক্ষণে পেছনের রিক্সাটির আরোহীদের শুধু নজরে পড়লো। বাকী রিক্সা সামনে অগ্রসর হযে় যাবার কারণে আরোহীদের দেখতে পাইনি। তবে রিক্সার ছাউনির উপর দিযে় দৃশ্যমান যাত্রীদের মাথা ও চুল বলে দিচ্ছে এরা বাঙালী নয়। বাঙালীদের চাইতেও উঁচু আর ধবধবে সাদা। নিশ্চিত বিদেশি হবে। তাহলে ওরা কোন দেশ হতে আসলো? কোথায় যায়? আমিও দ্রুত পদে হাঁটা শুরু করলাম। দুই তিন মিনিটের রাস্তা মাত্র। দেখি ওরা চৈতা মাদরাসার সামনে নেমে চারিদিক প্রত্যক্ষ করছে। নিজেদের কথাগুলো বলছে ইংরেজিতে। কৌতূহল আমারও বাড়লো। তাহলে এরা ইংরেজ নিশ্চয়। এই অবেলায় কেন এরা এখানে? এই একই কৌতূহলেই আমার পিছু নিযে় আরো অনেকে হাজির হচ্ছিল। দেখেই তো অবাক! এমন নিভৃত পল্লীতে এক সাথে সাত জন ধবধবে সাদা মানুষ। একজনের পিঠে একটি কালো ব্যাগ। দু একজনের হাতে বড় বড় ভিডিও ক্যামেরা। আমি তাদের একজনকে জিজ্ঞাসা করলাম
-Where have you come from?
অতি উচ্ছ্বাস আর অকৃত্রিম হাসি মুখে আমার দিকে হাত বাডি়যে় দিযে় একজন উত্তর করলো-
-We are from America. How are you dear?
তার সাথে কুশল বিনিমযে় লিপ্ত হযে় পডে়ছি। বেশ কিছু লোক ইতোমধ্যে জডে়া হযে় গেছে।
তার উদ্বেলিত হাসি আর আমার হাত ধরার আনন্দভংগি দেখে অবাক সবাই। আমি যেন তার হারিযে় যাওয়া বন্ধু। দশ বছর পরে সারা দুনিয়া তন্ন তন্ন করে এই নিভৃত পল্লীতে যেন এইমাত্রই আমার দেখা পেযে় গেছে। তাই তার খুশীর শেষ নেই।
তাদের সাথে আসা এক বাঙালী আমার দিকে এগিযে় আসতে আসতে বলতে লাগল “এরা সবাই আমেরিকার লোক। এরা বরিশালে ছিলো সেখান থেকে খোঁজ নিযে়ছে যে, আমরা ইসলাম সম্পর্কে কিছু জানতে চাই। কোথায় গেলে ভাল আলেম পাওয়া যাবে। বরিশাল থেকে আপনাদের এই (চৈতা, মির্জাগঞ্জ, পটুয়াখালী) দরবারের ঠিকানা দেয়া হযে়ছে। তাই তারা এখানে এসেছে।”
ইতোমধ্যে দেখলাম আমার উস্তাদ “জনাব, হযরত মাওলানা নূরুল হক খান বের হযে় তাদের দিকে আসছেন। অমনি তার দিকে আগালাম। তিনি আমাকে দেখে দূর হতেই বলা শুরু করলেন- নূরুল আমীন, তুমি এখানে হাজির! আমি তো ভাবছিলাম তোমাকে খবর দেয়া যায় কিনা। আচ্ছা শোন, রমজান মাস, মাদরাসা বন্ধ, অন্য হুজুররা কেউ নেই। আর উনারা আমেরিকা থেকে ইসলাম জানতে আর কোন দেশের ঠিকানা পেলেন না? আবার বাংলাদেশে ইসলাম জানার আর কোন জায়গা খুঁজে পাননি? বিমান থেকে নেমে রাজধানীর শহর ডিঙিযে় বরিশাল বিভাগে, আবার সেখান থেকে ছারছীনা শরীফে না গিযে় এই জংলায় ইসলাম সম্পর্কে জানতে এসেছেন?
এখন এদেরকে বসতে দিলেও ঝামেলা। আর যদি না বসতে দেই তাও আরেক বিপদ। খালের পাডে় রাস্তা পর্যন্ত আসতে আসতে তিনি ঐ কথা কয়টা বললেন। যা হোক মাদরাসা বন্ধ থাকায় তৎক্ষণাৎ কোন রুমের বা লাইব্রেরির চাবি ম্যানেজ করা গেল না। তাই তাদের নিযে় মসজিদের দো তলায় খোলা জায়গায় বসার ব্যবস্থা করা হল। সেই বাঙালী লোকটা ইংরেজ দলনেতাকে বলল-We going to mosque. এমন ভুল ও আনাডি় ইংরেজি শুনে আর সহ্য হল না। তখনই বলে উঠলাম- ভাই কি বললেন? এটা কোন জাতের ইংরেজি?। সে আমার মুখের দিকে তাকাল। তারপর বলল এদেরকে এক রকম বললেই বুঝে।
যাইহোক, সে আমাদের মুখ্য বিষয় নয় বিধায় তার সাথে কথা বাড়ালাম না। দোতলায় হুজুর পশ্চিম মুখো হযে় বসলেন। আর যিনি হুজুরের সাথে মুখোমুখি বসলেন তার নাম ডবং Wes Johnson। খবরটি যার কানে পৌঁছল, হুড়মুড় করে সিঁডি় বেযে় মসজিদের দোতলায় ছুটতে লাগল। সেদিন অনেক উপস্থিতির মধ্যে মাদরাসার দক্ষিণ পাশের বাডি়র জনাব আ. আউয়্যাল সাহেব, আমার আরেক প্রিয় শিক্ষক জনাব আ. জলিল সাহেব এবং ছাত্রদের মধ্যে জাহিদ, হাফেজ সাইফুদ্দীনসহ বোর্ডিযে়র ছাত্র ও এলাকার লোকজন ছিল। চারদিক দিযে় কৌতূহলী জনতা এমন ভাবে ভীড় করছে, যেমন বাজারে সাপের খেলা দেখানো সাপুডে়কে বেষ্টন করে ফেলে। সে প্রথমেই বলল –
Wes Johnson. I want to hear same Quran.
আমি বিছু কুরআন শুনতে চাই।
(হুজুর আমাকে নির্দেশ দিলেন শুনাও একটু তিলাওয়াত। আমি তিলাওয়াত শুরু করছি প্রায়, এর মধ্যেই সে বলে উঠল)
Wes Johnson: From the sura Al-E-Imran, from verse 42.
আমি হুজুরকে বললাম- ইনি সুরা আলে ইমরান এর ৪২ নং আয়াত হতে পাঠ করতে বলছেন। হুজুর চোখের ভ্রƒ জোড়া উপরের দিকে তুলে মাথা ঘুরালেন। তারপর হাত উঠিযে় এক জিলদ কুরআন শরীফ চাইলেন। আবার আমার হাতে দিযে় বললেন- বের করো। আমি আবার পড়া শুরু করলাম। একটু ‘সুদাইসী’ স্টাইলেই তিলাওয়াতের চেষ্টা করলাম। যা শুনে সে আওয়াজ দিযে় উঠল
– – Very sweet sound, very sweet sound. Five more sentences.
খুব মিষ্টি। খুব মিষ্টি। আরো পাঁচ আয়াত।
সামনের আয়াতগুলো পড়তেই দেখি যে, এগুলো সব হযরত ঈসা আ. এর মোযেযা সম্পর্কিত আয়াত। তখন বুঝলাম হুজুর এটা বুঝতে পেরেই ভ্রƒ উচাটন করেছিলেন। এই আয়াত নির্বাচনের তার উদ্দেশ্য এবার আমিও কিছু আঁচ করতে পারলাম।
Wes Johnson: What’s the meaning? এগুলোর অর্থ কি?
তাকে সবগুলো আয়াতের ভাবানুবাদ একসাথে বোঝাবার জন্য মূল কথাগুলো এ ভাবে শুরু করলাম Brother, In these recited Aiats Almighty Allah narrates the history of Isa (pbuh). He said, ‘I make a pattern of bird with soil. And When I whiff into it, it would turn into a real bird. I heal the birth blind and leprosy and give life into dead body by dint of the command of Allah. I can tell out what you have eaten and what stored in your house. There are instructions for you, if you be the believers.
– হযরত ঈসা আ. বলেন আমি মাটি দিযে় পাখির আকৃতি বানিযে় ফুৎকার করলে সেটি আল্লাহর নির্দেশে প্রকৃত পাখি হযে় যাবে। আল্লাহর নির্দেশে আমি জন্মান্ধ ও কুষ্ঠ রোগীকে আরোগ্য দান করতে এবং মৃতকেও জীবিত করতে পারি। আর যা তোমরা খেযে়ছ এবং ঘরে খাবার জন্য কি জমা রেখেছ, তা (মুখ দেখে) বলে দিতে পারি। এসব কিছুতে তোমাদের জন্য নিদর্শন রযে়ছে, যদি তোমরা মুমেন হও।
আমার সে দিনের অনুবাদটি ঠিক এমনই ছিল। কোন দিন কোন ইংরেজি কোরআন থেকে এগুলো পডি়নি। কারণ ঘটনাটি একেবারে আকস্মিক। হয়তো কোন ইংরেজি Translation এর সাথে মিলবেও না। কেবল নিজস্ব ভায়ায় যেমন মুখে এসেছিল তেমনি বলতে থাকলাম। দেখলাম যে, তার উচ্চারণগুলো আমার বুঝতে কষ্ট হলেও আমার এই নিজস্ব ইংরেজি সে অতি দ্রুত বুঝে ফেলছে। আমি যা বলছি সে তা অংগভংগি দিযে় হাত নেডে় অভিনয় করে আরো স্পষ্ট করে দিচ্ছে।
আমার এ বর্ণনা শেষ হতে না হতেই সে বলে উঠল-
Wes Johnson: Isa (pbuh) was a great Prophet. He had many powerful miracles.
He could quicken the dead body. Is there any prophet who had such miracle? Show me from the Quran.
= ঈসা আ. ছিলেন মহান এক নবী। তাঁর ছিল অনেক অলৌকিক মোযেযা। তিনি মৃতকেও জীবিত করতে পারতেন। আর কোন নবী আছে কি, যার এরকম মোযেযা ছিল? কুরআন থেকে দেখান।
– তখন আমার মনে হল মূসা আ. ও ফিরাউনের যাদু যুদ্ধের সেই আজীব ঘটনাটি কোরআন হতে তাকে শোনানো যায়। তাই হাফেজ ছাত্রদের দিকে ইশারা করে বললাম “ফাতানাযাউ আমরাহুম বাইনাহুম ওয়া আসাররুন নাজওয়া” এই আয়াতটি কোথায়? সাথে সাথে হাফেজ সাইফুদ্দীন বলে দিল ১৬ পারার ১৪ নং ছাপায়।
এবার তাকে সেখান থেকে সূরা ‘ত্বহা’ তিলাওয়াত শুনালাম। তিনিও তেল দিতে ভুল করলেন না। ফাঁকে ফাঁকে বললেন- Very sweet sound, very sweet sound.
এবারে ৬২ হতে ৬৯ আয়াতের Summary তাকে এভাবে বর্ণনা করলাম।-
Myself: When Hazrat Musa (pbuh) said to Firawn – I am a Prophet from Allah, Firawn didn’t believe him. He called him a magician and gathered all magicians of his region against Musa (pbuh). The number of them was 80 thousands. They said Oh Musa, Do you throw your magic first or do we? Musa said that you can throw first. The magicians filled the ‘maidan’ with snakes, scorpions, tigers, fires and more others by dint of their magic power. They were making laughs and jokes. Then Musa (pbuh) threw stick from his hand. It turned into a great snake. One, two of the ‘Mufassirs’ said that the dimension of that snake was 22 miles large.
Wes Johnson: How long the snake was! Was it so long?
Myself: Yes. This only snake did swallow the total magic of Firawn.
= যখন হযরত মুসা আ. ফিরআউনকে বললেন- আমি আল্লাহর পক্ষ হতে প্রেরিত নবী। ফিরআউন তাঁকে বিশ্বাস করল না। তাঁকে সে যাদুকর বলে আখ্যা দিল। পরে তার রাজ্যের সমস্ত যাদুকরকে হযরত মুসা আ. এর বিরুদ্ধে এক মাঠে জডে়া করল। তাদের সংখ্যা ছিল আশি হাজার। উল্লাসে ফেটে তারা মুসা আ. কে তুচ্ছ করে প্রশ্ন করলো – হে মুসা, তুমি আগে যাদু নিক্ষেপ করবে নাকি আমরা? মুসা আ. বললেন বরং তোমরাই প্রথমে নিক্ষেপ করো। যাদুকররা সাপ, বিচ্ছু, বাঘ, আগুন ইত্যাদি দিযে় ময়দান বোঝাই করে ফেলল। তারা আনন্দে উল্লাস করছিল। তখন হযরত মুসা আ. হাতের লাঠিটি ফেলে দিলেন। এটা বিরাট একটি সর্পে পরিণত হযে় গেল। দুএকজন মুফাসসির বলেন -এই সাপের দৈর্ঘ্য ছিল ২২ মাইল লম্বা।
এই দৈর্ঘ্যরে কথা শুনে সে আসন থেকে ঘুরে বসল। বলল-কত লম্বা ছিল সাপটি! সেটি এত লম্বা ছিল?
আমি বললাম- হ্যাঁ। এই একটি মাত্র সাপ-ই ফিরআউনের সমস্ত যাদুকরের যাদু গিলে ফেলেছিল।
Wes Johnson: No doubt, It is one of the greatest miracles. I recognize. But miracles of
Isa (pbuh) was greater than any other prophet. He could give life into the dead body.
=নিঃসন্দেহে এটি একটি বড় মোযেযা। আমি স্বীকার করি। তবে হযরত ঈসা আ. এর মোযেযা ছিল যে কোন নবীর চাইতে বড়। তিনি মৃতকে জীবিত করতে পারতেন।
তার এই কথার জবাবে হুজুর আমাকে বললেন- বল যে, আল্লাহ পাক যাকেই নবী বানিযে় পাঠিযে়ছেন তাদের সকলকেই আল্লাহ মোযেযা দিযে়ছিলেন। তবে এক এক নবীর মোযেযা ছিল এক এক রকমের। তাকে এটা Translateকরে এভাবে বললাম-
Myself: Brother, every sent person by Allah as a prophet was given miraculous power.
There power differs from others.

Comments

comments

About

Check Also

বিদায়বেলা

জামুরাইল হাই স্কুলের বাংলা শিক্ষক ইমরান হোসেন। প্রতিদিন সকাল ৯ টায় স্কুলে আসেন। যথারীতি তিনি …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *