অপরূপা সুন্দরী

মনে কর তুমি একটি সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছ। সবাই কিন্তু তোমার ক্ষেত্রে একইভাবে সাড়া দিবে না আর তুমি তা আশাও করতে পার না। কেউ কেউ তোমাকে নিচের দিক থেকে টেনে ধরে বলবে,
“তুমি পারবে না …সামনে এগিয়ে লাভ নেই …তোমার সেই শক্তি – সামর্থ্য – যোগ্যতা নেই…”
আসলে তারা হয়তো তোমাকে চিনতে পারেনি, নয়তো তোমাকে চিনতে পেরেই যাতে তুমি সেই সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে বিজয়মাল্য অর্জন করতে না পার তাই পিছনের দিক থেকে টেনে ধরছে, তারা হিংসুক, তারা পরশ্রীকাতর, অবজ্ঞা কর তাদের।
আরেক শ্রেণীর সাক্ষাৎ তুমি পেতে পার যারা তোমার চেয়ে সিঁড়ি বেয়ে কিছুদূর এগিয়ে গিয়েছে ..তারাও তোমাকে বলতে পারে,
‘তুমি পারবে না …সামনে এগিয়ে লাভ নেই …তোমার সেই শক্তি-সামর্থ্য-যোগ্যতা নেই…’
হতে পারে তারাও তোমাকে চিনতে পারেনি অথবা তারা চায় না তুমিও তাদের মতো বড় কেউ হও…অর্জন কর সাফল্য …তারা অহঙ্কারী …তারা স্বার্থপর …অবজ্ঞা কর তাদের …
তবে এই অবজ্ঞার অর্থ তাদের সাথে মন্দ ভাষায় কথা বলা বা গালমন্দ নয়; এর অর্থ হল তুমি শুনেছ তবে সেটাই যে সঠিক তা ভেবে না নেওয়া। নিজের মূল্য নিজের সচেতন বিবেককে জিজ্ঞাসা করে দেখ-বাস্তবের সাথে তোমার লক্ষ্য যদি মিল থাকে তবে স্রষ্টার নামে চলতেই থাক, থেম না, পথে চলতে চলতে হয়রান হয়ে গেলে সামান্য বিশ্রাম নাও, আবার চলতে থাক একদিন নিজেকে আবিষ্কার করবে তোমার স্বপ্নের মহলে।
কথাগুলো শেষ হতে না হতেই ক্লাস শেষ করার ঘন্টা বেজে উঠল। বাংলা স্যারের কথাগুলো মধুর মতোই মিষ্টি লাগছিল মিনতির কাছে। ক্লাসের পড়ার ফাঁকে ফাঁকে স্যার এত সুন্দর করে কিছু উপদেশ দেন মিনতির মনে হয় স্যার কেন সব বিষয়ের শিক্ষক হলেন না? অথবা অন্যান্য স্যারেরাও যদি তাঁর মতো করে বলতে পারতেন তাহলে কতই না ভালো হত!
মিনতি তার ছোটবোন সুরভির চেয়ে বছর দেড়েকের বড়। মিনতির বিএ ফাইনাল পরীক্ষা পাঁচ মাস পরে শুরু হবে। বহুদিন আগে থেকেই তার জন্য পাত্র ঠিক করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছিল অভিভাবকেরা। তবে সমস্যা হল সুরভিকে দেখলে মিনতিকে কেউ আর পছন্দ করতে চায় না। সুরভির সৌন্দর্য ছিল ফুটন্ত গোলাপের মতো যা চোখের দেখায় প্রথমবারেই আকৃষ্ট করে নেয়। আর মিনতির সৌন্দর্য ছিল হাসনাহেনার মতো প্রথম দেখাতেই আকৃষ্ট না করলেও ঘ্রাণ অন্ধকারের জোছনায় ধরা পড়ে। এরমধ্যে আমেরিকা থেকে এক ইঞ্জিনিয়ারিং পাস সুদর্শন পাত্র আসলেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটলে তাদের পিতামাতা শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিলেন সুরভিকেই আগে বিয়ে দিবেন কারণ এত ভালো পাত্র হাতছাড়া করতে তারা রাজি ছিলেন না। এ বিষয়ে মিনতির মতামত জানতে চাইলে সে উত্তর দেয়,
‘মা! আমি তো অনেক আগেই বলেছি সুরভিকে আমার আগে বিয়ে দিলে আমার কোন আপত্তি নেই আর তাছাড়া সামনে আমার পরীক্ষা। পরীক্ষা শেষ না করে বিয়ে নিয়ে আপাতত ভাবতে পারছি না।’
মধ্যবিত্ত পরিবারের বিয়েতে খুব ধুমধাম করা না হলেও যে একেবারে নিরামিষ হয়ে থাকে তা কিন্তু নয়। সুরভির বিয়েতেও সানাই বাজল, কিছু ফুলের ছড়াছড়ি হল, রান্নাবান্নার ঝনঝনানিও কম হল না। সবকিছু মেনে নিলেও কেন যেন মিনতির বুকের মাঝে একধরনের চাপা কষ্ট অনুভূত হচ্ছিল তার মনে কিছু প্রশ্ন বারবার উঁকি দিচ্ছিল,
‘মেয়েদের চেহারাই কি সব? একটা মেয়ে তত সুন্দরী নয়, এটা কি তার অপরাধ? ছেলেরা অসুন্দর হলেও কেন তেমন কোন সমস্যা নেই? মানুষ কেন বিধাতার সৃষ্টিকে অবমাননা করে?’

সুরভিকে বিয়ের কিছুদিনের মধ্যেই আমেরিকাতে নিয়ে যায় তার বর। মিনতির বিএ পরীক্ষা ততদিনে শেষ হয়ে যায়। তাদের গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের শিক্ষিত ছেলে রাসেলের প্রস্তাব আসে মিনতির জন্য। রাসেল দেখতে যেমন সুদর্শন তেমনই স্বভাব-চরিত্র উত্তম। সে স্থানীয় একটি মাধ্যমিক স্কুলে শিক্ষকতা করত। সমস্যা হল রাসেলের মা আর একমাত্র ছোটবোন রেণু বিয়েতে রাজি ছিল না, কারণ রেণুর বান্ধবী মিথিলাকে বাড়ির বৌ করতে চাইতেন তারা। তবে রাসেল মিথিলার অধিক আধুনিকতাকে পছন্দ করে না। মিথিলা সুন্দরী, শিক্ষিতা আর সেই সাথে বাবার আর্থিক অবস্থা বেশ ভালো, তবে অতি আধুনিক ধ্যানধারণায় বেড়ে ওঠা বিধায় ধর্মের অনুশাসন তার কাছে অপাংক্তেয়। তবে রাসেল পছন্দ করে ধার্মিক একটি মেয়ে দেখতে তত সুন্দরী হোক বা না হোক। তাই তো মিনতিকে দেখার পরে এবং তার সম্পর্কে খোঁজ খবর নেওয়ার পরে মিনতিকেই সে তার স্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে ঘরে তুলে আনতে বদ্ধপরিকর হয়। রাসেলের বাবা তার মাকে বললেন,
” বিয়ে করে সারাজীবন সংসার করবে ছেলে। ওকে ওর পছন্দ মতোই তা করতে দাও। আমরা জোর করে একটি মেয়েকে ওর ঘাড়ে চাপিয়ে দিলাম অথচ ওর পছন্দ না হলে আর ও যদি অসুখী থাকে তাহলে লাভ কী হল?”
যাহোক শেষে মিনতির সাথেই রাসেলের বিয়ে সম্পন্ন হয়। বিয়ের পরে মিনতি শ্বশুরবাড়িতে যখন থেকে পা দিয়েছে তখন থেকেই বুঝতে পেরেছে জীবনটা কতখানি জটিল। বিয়ের পূর্বের জীবন আর পরের জীবনের মাঝে ব্যবধান যে এতটাই ব্যাপক হবে সেটা তার ধারণারও অতীত ছিল। পূর্বে তার বিয়েতে বিলম্বকে সে পড়াশোনার জন্য ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতেই দেখেছিল আর বাবার বাড়িতে রাজকন্যার মতোই সম্মানের সাথে বড় হয়েছে। তাই বিয়ের পরে শ্বশুরবাড়িতে কথায় কথায় অসম্মান আর অবমাননাকে মেনে নিতে তার কতখানি কষ্ট অনুভূত হত সেটা কেবলমাত্র বিধাতা যিনি দেহ ও মনের স্রষ্টা তিনিই অনুভব করতে পারেন। তবে দমে যাবার পাত্র নয় মিনতি, আর সে শিক্ষা নিয়ে সে বড়ও হয়নি। কথায় কথায় শাশুড়ি আর ননদ তাকে বুঝিয়ে দেয় তারা তাকে একদমই পছন্দ করে না বা এই বাড়ির বৌ হবার যোগ্যতা তার নেই। একবার তাদের বাড়িতে বেড়াতে আসে রাসেলের ফুফু। বিয়ের সময় আসতে পারেনি বিধায় মাস ছয়েক পরে সময় সুযোগ করে ভাতিজার বৌ দেখতে আসা। মিনতিকে দেখে অবাক হয়ে গেলেন তিনি।
“আমার এত সুন্দর ভাইস্তার জন্য কিনা এমন কালো কুশ্রী বৌ এনেছেন? আপনাদের কি রুচি পছন্দ বলে কিচ্ছু নেই? কার পাশে কাকে মানাবে সেটাও ভাবলেন না!”
মিনতি তাদের চা-বিস্কুট দিয়ে যাওয়ার পর রুম থেকে বের হতে না হতেই রাসেলের ফুফুর বলা কথাগুলো পাশের রুম থেকে তীরের মতো বিঁধে মিনতির হৃদয়কে রক্তাক্ত করে দেয়। উত্তরে তার শ্বশুর-শাশুড়ি কি জবাব দিলেন তা আর শোনা হয়ে ওঠেনি তার। এরই মধ্যে আসরের নামাজের আজান ধ্বনিত হয় মসজিদের মিনার হতে। মিনতি ওজু করে নামাজ পড়তে চলে যায় তার ঘরে। নামাজ শেষে সৃষ্টিকর্তার কাছে সবসময় তার প্রার্থনা থাকে-
‘হে আল্লাহ্! আমাকে ধৈর্য দান করুন, জ্ঞানের অধিকারী করুন এবং আমার হৃদয়কে প্রশান্ত করুন। আর ইহকালে ও পরকালে আমাকে বিজয়ীদের অন্তর্ভুক্ত করুন, আমীন ।’
মিনতি বাড়ির বৌ হিসেবে তার দায়িত্বগুলো যতœ করে পালন করতে থাকে। রাসেল মিনতিকে পেয়ে নিজের সৌভাগ্যের জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে। বেশ কিছুদিন পার হয়ে গেলে মিনতির বাবা মিনতিকে বাড়ি নিয়ে যেতে আসেন। অথচ এরমধ্যে রাসেলের মা অসুস্থ হয়ে পড়েন। একে তো ডায়াবেটিসের রোগী এরপরে আবার হঠাৎ করে প্রেসারটা বেড়ে গেছে। মিনতি অনেকক্ষণ যাবৎ মাথায় পানি ঢালছিল। এরপর ডাক্তার এলে তিনি ঔষধ দেন, অধিক চিন্তা ভাবনা না করার জন্য বলেন আর খাবার দাবারের বিষয়ে কিছু পরামর্শ দেন। পরবর্তীতে কিছুটা সুস্থ হয়ে গেলে মিনতিকে তার বাবার বাড়িতে বেড়াতে যাবার অনুমতি দেন তার শাশুড়ি। কিন্তু মিনতি কিছুতেই শাশুড়িকে পুরোপুরি সুস্থ না দেখে বাবার বাড়িতে বেড়াতে যেতে রাজি হয় না। শেষে মিনতির বাবা বাধ্য হয়ে চলে যান। মিনতি যাবার সময় তার বাবাকে বলে,
“আব্বা! আপনি দিন দশেক পরে এসে আমাকে নিয়ে যাবেন। আমার শাশুড়ি ততদিনে পুরোপুরি সুস্থ হোক। এমন অবস্থায় তাকে রেখে আমি যেতে পারি না। আর তাছাড়া রেণু ওর শ্বশুরবাড়িতে আছে। আমার শাশুড়িকে দেখাশোনা করার মতো কেউ নেই। রেণু এই সপ্তাহে আসলে আমি তখন যেতে পারি।”
বাবা-মেয়ের কথাবার্তা পাশের ঘর থেকে শুনে মিনতির শাশুড়ি প্রশান্তির হাসি হাসলেন। তিনি এতদিনে তার ভুল বুঝতে পারলেন। আর মনে মনে বলতে লাগলেন,
‘মা! কত সুন্দর তুমি! আমি অনেকটা অন্ধ ছিলাম তাই তোমাকে পুরোপুরি দেখতে না পেয়ে অযথা ভুল ধারণা করেছিলাম আর তোমাকেও কষ্ট দিয়েছিলাম। সত্যিই তুমি অপরূপা সুন্দরী!’


Comments

comments

About

Check Also

বিদায়বেলা

জামুরাইল হাই স্কুলের বাংলা শিক্ষক ইমরান হোসেন। প্রতিদিন সকাল ৯ টায় স্কুলে আসেন। যথারীতি তিনি …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *