অনুতাপ

তালহা অনুতাপ করার যুবক নয়। রাজনৈতিক নেতার আনুকূল্যে হেন অপকর্ম নেই যা সে করেনি। সমাজের মানুষ তার অপকর্মে অতিষ্ঠ হলেও প্রকাশ্যে কেউ কিছু বলার সাহস পায় না। তবে সবাই মনে প্রাণে তাকে ঘৃণা করে। এই ঘৃণার কথা তালহা বুঝতে পারে। কিন্তু এতে সে বিচলিত হয় না। রাজনৈতিক নেতা স্বীয় স্বার্থে তালহাকে প্রশয় দেন। নিজের পেশী শক্তির প্রয়োজনে তাকে গোপনে সহায়তা দিয়ে পরিচালিত করেন। এতে তার ক্ষতির চেয়ে লাভই বেশী বলে তিনি দেখতে পান।
দিনগুলো ভালোই কাটছিলো তালহার। জাতীয় নির্বাচনে তার নেতা এম.পি হয়ে সরকারের মন্ত্রী পরিষদে জায়গা পেলেন। তালহার আনন্দের সীমা রইলো না। সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছিল তার অপকর্ম। স্বীয় মন্ত্রীর কাছে নিয়মিত যাচ্ছিল তার ব্যাপারে অভিযোগ। মন্ত্রীর কান ঝালাপালা করে তুলছিল দলের নিরীহ নেতারা। অবশেষে তিনি তালহার বিরুদ্ধে একটি কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হলেন।
তালহার নামে অসংখ্য অভিযোগ থানায় জমা হচ্ছিল। নেতার হাত ইশারায় সেগুলো তদন্তের আগেই থেমে যেতো। এবার নেতা দেখলেন তার ছত্রছায়ায় থাকা তালহা তাকে সবার কাছে লজ্জিত করছে। তিনি থানায় নির্দেশ দিলেন তালহার বিরুদ্ধে আসা অভিযোগগুলো তদন্ত করে যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে।
কিছুদিনের মধ্যে গ্রেফতার হলো তালহা। অসংখ্য মামলায় রিমান্ড হতে থাকলো তার। মন্ত্রী গোপনে তালহার পক্ষে উকিল নিযুক্ত করেছিলেন। মামলার ধরণ দেখে নিশ্চিত পরাজয় বুঝে উকিলগণ তালহার মামলা ছেড়ে দিতে লাগলেন। রিমান্ডে স্পর্শকাতর অনেক মামলায় মন্ত্রীর যোগসাজশের কথা যখন তালহা স্বীকার করতে লাগলো তখন মন্ত্রীর মাথায় আঘাত পড়লো। মিডিয়ায় সেগুলো প্রকাশ হলে মন্ত্রী একেবারে চুপসে গেলেন। তালহার মুখ বন্ধ করতে তিনি মরিয়া হয়ে উঠলেন।
একদিন সকালে পত্রিকায় বের হলো কোর্টের প্রাঙ্গন থেকে তালহাকে ছিনিয়ে নিতে সন্ত্রাসী গ্র“পের আক্রমণ। পুলিশের সাথে বন্দুক যুদ্ধে তালহা গুলিবিদ্ধ। পঙ্গু হাসপাতালে তালহাকে ভর্তি। বুলেটের আঘাতে ডান পা ঝাঁঝরা হওয়ায় হাঁটুর উপরে কেটে ফেলা হয়েছে।

তালহার ডান পা কেটে ফেলার তিন মাস হয়েছে। সে এখন পঙ্গু। আগের মতো গায়ে শক্তি নেই। অন্যের সাহায্য ছাড়া বিছানা থেকে ওঠা নামাও সে করতে পারে না। দিনরাত চোখের পানি ফেলতে ফেলতে তার মন বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছে। প্রথমে সে বেঁচে থাকার আশাও ছেড়ে দিয়েছিল। অবশেষে সে দেখলো বেচে গেছে ঠিকই তবে পঙ্গু হয়ে। তার মাঝে দেখা দিল ভাবান্তর। সে স্মরণ করতে লাগলো অতীত দিনের কথা। অতীতে সে অনেক পাপ করেছে। ক্ষমার অযোগ্য সেই পাপগুলো। অসংখ্য মানুষের হক সে আত্মসাৎ করেছে। অসংখ্য মানুষকে কষ্ট দিয়েছে। অসংখ্য মানুষের অভিশাপ তার উপর।
তালহা স্বীয় জীবনের ভবিষ্যত নিয়ে নিরাশ হয়ে উঠলো। সাথে সাথে ভয় পেলো মৃত্যুর পরবর্তী জীবনের কথা ভেবে। তার মাঝে অনুশোচনা দেখা দিলো। সে তওবা করার ইচ্ছা করলো। তবে তার তওবা গ্রহণযোগ্য হবে কি না এ নিয়ে সংকিত। সে অনুরোধ করে একজন আলেমকে এনে সবকিছু খুলে বললো।
আলেম সাহেব সবকিছু শুনে তালহাকে আশ্বস্ত করলেন। তিনি বললেন-‘আল্লাহ এরশাদ করেছেন-তোমরা আমার রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না।’ এছাড়া খলিফা হজরত ওমর রা.-এর সময়ের একটি ঘটনা তিনি বর্ণনা করলেন। তিনি বললেন-‘হযরত ওমর রা.-এর আমলে এক গায়ক ছিল। লোকটি গোপনে গোপনে গান গেয়ে শখ পূরণ করতো।
তার গান শুনে মানুষ তাকে নগদ মুদ্রা দিত। এ দিয়ে তার জীবন চলত। কন্ঠ ছিল তার পূঁজি। এক সময় সে বৃদ্ধ হয়ে গেল। কন্ঠ শেষ হয়ে গেল। এখন আর কেউ তার গান শোনে না, কিছু দেয়ও না। শুরু হলো অভাবের জীবন। অনাহারে-অর্ধাহারে জীবন কাটে তার।
একদিন লোকটি ক্ষুধার্ত অবস্থায় জান্নাতুল বাকীর এক ঝোঁপের আড়ালে বসে বলতে লাগল, হে আল্লাহ! আমার সুরেলা কন্ঠ ছিল। আমার গান শুনে মানুষ আমাকে অনেক কিছু দিত। এখন বার্ধক্যের কারণে কন্ঠ শেষ হয়ে গেছে। কেউ আমার গানও শোনে না, কিছু দেয়ও না। তুমি তো সকলের কথাই শুনে থাক, আমার ফরিয়াদও শোনো। আমি দুর্বল হয়ে পড়েছি, আমার শক্তি শেষ হয়ে গেছে। একথা সত্য যে, আমি তোমার অবাধ্য। তবু তুমি আমার অভাব দূর করে দাও, আমার প্রয়োজন মিটিয়ে দাও।
হযরত ওমর রা. মসজিদে শুয়ে ছিলেন। হঠাৎ তার কানে আওয়াজ আসল, আমার বান্দা আমাকে ডাকছে, তুমি গিয়ে তাকে সাহায্য করো। জান্নাতুল বাকীতে এক ফরিয়াদি আছে, তুমি তার ফরিয়াদ পূরণ করে দাও। আদেশ পেয়ে হযরত ওমর রা. খালি পায়েই ছুটে গিয়ে দেখলেন, এক বৃদ্ধ ঝোপের আড়ালে বসে আছে। বৃদ্ধ হযরত ওমরকে দেখে ভয়ে উঠে পালাতে উদ্যত হলে হযরত ওমর রা. বললেন- দাঁড়াও, ভয় পেয়ো না। আমাকে তোমার কাছে পাঠানো হয়েছে। লোকটি থমকে গিয়ে বলল, আপনাকে কে পাঠিয়েছেন? হযরত ওমর রা.বললেন, তুমি যার কাছে ফরিয়াদ করছো তিনিই তো আমাকে তোমার কাছে পাঠিয়েছেন।
লোকটি আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, হে আল্লাহ! সত্তরটি বছর তোমার নফরমানি করেছি। এই দীর্ঘ সময়ে একটিবারও তোমাকে স্মরণ করিনি। আর এখন যখন করলাম পেটের খাতিরে করলাম। কিন্তু তার পরও তুমি আমার ডাকে সাড়া দিয়েছ। হে আল্লাহ! আমি নফরমানকে তুমি ক্ষমা করে দাও-ক্ষমা করে দাও-ক্ষমা করে দাও। এ বলে লোকটি কান্নায় ভেঙে পড়ল আর এ অবস্থায়ই সে মহান আল্লাহ তা‘আলার সন্নিধ্যে পরলোক গমন করলো। তার জানাজার ইমামতি হযরত ওমর রা. করেন।’ এই ঘটনা বলে আলেম সাহেব তালহাকে কিছু উপদেশ দিলেন। বললেন- ‘আমরা সঠিক সময়ে অনেক কাজ সঠিকভাবে করি না বলে ভবিষ্যত জীবনে অনেক দু:খ দুর্দশা নেমে আসে। আল্লাহ চান, কোনো না কোনো ওসিলায় তার বান্দাকে সুখে শান্তিতে রেখে পরকালে জান্নাত দান করতে। কিন্ত আমরা শয়তানের প্ররোচণায় আল্লাহর সেই সহজ পথকে খোঁজে পাই না। তাই কোনো কাজ করার আগে ভাবতে হবে সেটা আল্লাহর ইচ্ছার বিরুদ্ধে যাচ্ছে কি না। আর মানুষ যখন নিজের ভুল বুঝতে পেরে তার কাছে খালিছ তওবা করে সঠিক পথে ফিরে আসে তখন তিনি খুবই খুশি হন। সাথে সাথে বান্দাকেও ক্ষমা করে দেন। তবে খেয়াল থাকতে হবে, তওবা করে ফেরার পর ভুল করেও সে পথে যেন আর যাওয়া না হয়।’
আলিম সাহেবের কথা শুনে তালহা অঝর ধারায় অনেকক্ষণ কেঁদে খালিছ তওবা করলো। তার তওবা দেখে আশেপাশের অনেকের চোখ আদ্র হয়ে উঠলো।

Comments

comments

About

Check Also

বিদায়বেলা

জামুরাইল হাই স্কুলের বাংলা শিক্ষক ইমরান হোসেন। প্রতিদিন সকাল ৯ টায় স্কুলে আসেন। যথারীতি তিনি …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *