বৈশাখী মেলা

এই, এটা কেডা আনিকানা? মনে অয়তো আনিকাই। ডাক দে-
অই আনিকা- আনিকা-
ফসলী জমির সরু আল ধরে হেঁটে যাচ্ছিল আনিকা। ডাক শুনে ফিরে তাকায় সে। হাতের ডান দিকে ছোট জমিটুকুর পরেই পাহারা দেবার খুপড়ি ঘর। তার সামনে তকতা পেটানো বেঞ্চিতে বসে সাহারা আর নদী ডাকছে তাকে। জমির আল চেয়ে একটু ঘুরপথে ওদের কাছাকাছি আসতেই উচ্ছল হযে় ওঠে ওরা। জিজ্ঞেস করে, ‘ঢাকা দিয়া কবে আইছো?’ আনিকা উত্তর দিতে দিতে কাছে আসে-‘এইতো গেছে কাইল সন্দায় আইলাম আর যামুনা।’ সাহারা আর নদী দু’জনে দু’দিকে ফাঁক হযে় বসতে দেয় আনিকাকে। বসতে বসতে আনিকা বলে যায়- আল্লাহর রহোমাত দ্যাশে আইতে পারছি, পরান থাকতে আর জাহান্নামে যামুনা।
: ক্যান কি অইছে? কাহিনী কি খুইল্লা কি দেহি? জানতে চায় সাহারা।
: কি অইছে ক দেহি? একই কথা জানতে চায় নদীও।
সাহারা, নদী এবং আনিকা প্রায় একই বয়সী হওয়াতে সবাই সবার মনের কথা জানে। একজনে একটা নতুন কথা জানলে তিন জনেই জানবে। নিতান্ত গরীব ঘরের মেয়ে সবাই। মুখের খাবার জোটানোই দায় আর বিযে় শাদী, সে তো আর বললেই হযে় যায় না। ওদের মতো মেয়েদের যারাই বিয়ে করতে আসবে তাদের ৯৯ জন হয় যৌতুক লোভী। আর যৌতুকের বিয়ে বেশীরভাগ টেকেনা। যাও বা টেকে নির্যাতনের চরম সীমানায় পৌঁছে যায়। এসব দেখে দেখে বিযে়র প্রতি ওদের অনিহা ধরে গেছে। এর মধ্যে হঠাৎ করে একদিন আনিকা উধাও। সে তার এক ফুফুর বাসায় নিয়োগ পেয়ে ঢাকায় চলে গিয়েছে।
ওরা দু’জন খবর নিয়ে জেনেছে- আনিকা সুখে আছে। ঢাকায় আনিকার ফুফাতো বোন আছে। সে তার সাথে সাথে থাকে। ফুফা প্রতিশ্র“তি দিযে়ছে আনিকাকে তারাই একসময় বিয়ে-শাদী দেবে। কিন্তু মাস না পেরুতেই আনিকা আবার গ্রামে। তাই ব্যাপারটা জানতে বান্ধবীরা আগ্রহী।
আনিকা দু’বান্ধবীর মধ্যখানে আরাম করে বসেছে। সে বলে ঢাকা থেকে সে পালিয়ে এসেছে। শুনে ওরা আরো আগ্রহী হয়ে ওঠে ঘটনা জানার জন্য। আনিকা গল্পের মত কায়দা করে নিজের ভাষায় বলতে থাকে- হোন, পলাইয়া তো আর এমনে আই নাই, বাদ্য অইছি আইতে। ফুফুর মোর বয়সি একটা মাইয়া নাম সুহা। হেই ছোডো মেমসাব আই.এ.পডে়। এ হোন হের বয় ফেরেন সাতজন। মেরাদারে সব কতা কয়। আবার হের মায়রে কিছু কইতে নিষেদ। মোর কাম অইলো হেই ছোডা মেমসাবের লগে লগে থাকা আর হেরে পাহারা দেওয়া। মাইয়া চালাক খুব। মোরে ঘুষ দিয়া মায়ের কাছে হগোল কথা গোপন রাহে।
ছোডো মেমসাব মোরে একশ টাহা ধরাইয়া দিয়া কয় তুই এইহানে বইয়া যা যা মন চায় খা। মুই ফেরেনগো লগে এটটু ডেটিং কইরা আহি। হেরপর পোলাগো হাত ধইররা কোতায় জানি উদাউ অইযা যায়। একদিন গেছে তো গেছে আর আয়না। চাইর পাঁচ ঘণ্টা পর আইছে। আইয়া মোরে কি খাওয়াইবে হের লাইগগা পেরেশান অইয়া গেছে। মুই চাইয়া রইছি হের চেহারার দিকে। চেহারা কেমন ফ্যাকাইস্যা অইয়্যা গেছে। তারপর এই রোহোম রোজ- রোজ যাইতে লাগল। এর মদ্যে- আইলো পহেলা বৈশাক। ফুফু কইলো সুহার লগে রমনায় যা পান্তা-ইলিশ খাইয়া আয়। সাজুগুজু কইররা ছোডো মেমসাবের লগে বাইরাইছি। জিনিসটা পেরথোম বুজিনাই যে পান্তা-ইলিশটা কি! যাইয়া দেহি বিরাট মেলা বইছে। মোর জীবনে অতো বরমেলা আর অতো মানুষ মুই দেহিনাই। হেরপর ছোডো মেম সাব ফোন কইরা মনে হয় এককুড়ি পোলাপান আনছে মেলায়। হককলে মিল্যা পান্তা-ইলিশ খাইলাম কিন্যা। মোর তেমন বাল লাগেনায় হেরপরও হগলতিরলগে খাইলাম। দাম অইল নয় আজার টাহা। আসোল কাহিনী অইলো হেরপর। হাঁটতে হাঁটতে গেলাম মেলার মইদ্যে। পোলাপানগুলা মোগা দুইজনার লগে লগে আইলো। যতো সামনে যাই ততোই ভীর বাড়ে। এক সেমায় ভীর আর সামলাইতে পারি না। মানুষ আর মানুষ। নিজের ইচ্ছায় আর হাঁটতে পারি না। মানুষের চাপ যেদিক যায় মুই আর ছোডো মেমসাবও হেইদিক যাই। মোগো চাইরপাশে আরো অনেক মাইয়া। মাইয়া আর পোলা সোমানে সোমান। দুষ্ট পোলারা হারা শরীল হাতায়। লড়ার কোনো উপায় নাই। সব মাইয়াগো একই দশা। পোলাগো লগে মাইয়ারা চ্যাপ্টা অইয়া যায়। পোলারা মাইয়াগো জামা-ওড়না টাইন্না ছিররা হালায়। চিককইর মারলেও শব্দ আয়না। অনেক মাইয়া পোলাগো ডলাডলিতে কান্দা শুরু করছে। কেউ পোলাগো হাতানিতে বইসা পড়ে পোলারাই আবার টাইন্না দার করায়। কোন কোন মাইয়া দেহি খুব হাসিখুশি করতেছে। আর মুইযে কান্দা শুরু হরছি আর থাকায় কেডা। শ্যাষে দের-দুই ঘণ্টা পোলাগো হাউস মিডাইয়া মেলা দিয়া বাইর অইতে পারছি। আর মেলায় বইয়াই পালানোর সিদ্দান্ত নিছি। একবার এই চাপাচাপি দিয়া বাইর অইতে পারলে আর থাকুম না এই ঢাকার শহরে। মোর মনে হয় যে পোলা এটটু সজাগ হেই পোলায় মেলায় যাওয়া মাইয়াগো বিয়া করবে না। জীবনে যতোবার পহেলা বৈশাক আইক মোর মনে ওডবে ঐ জাহান্নামের কতা।
গল্পের মতো কাহিনী শুনতে শুনতে নির্বাক হয়ে যায় সাহারা ও নদী। তারা ভাবে বৈশাখী মেলা আর পান্তা-ইলিশের নামে টিভিতে যতো ভাল কথাই বলুক ভেতরে ভেতরে মেয়েদের চরিত্রকেই পান্তাভাত করে ফেলে। চিরদিনের জন্য দাগ পড়ে যায় প্রতিটি বৈশাখী মেয়ের চরিত্রে।

Comments

comments

About

Check Also

বিদায়বেলা

জামুরাইল হাই স্কুলের বাংলা শিক্ষক ইমরান হোসেন। প্রতিদিন সকাল ৯ টায় স্কুলে আসেন। যথারীতি তিনি …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *