মাসিক অভিযাত্রিক-এর সম্পাদক রফীকুল ইসলাম মুবীন ভাই আর আমি মুহিববুল্লাহ জামী ছারছীনা মাদরাসায় সমসাময়িক এবং সতীর্থ হলেও আমি ৪ বছরের জুনিয়র। তার ছারছীনার জীবন দুই মেয়াদে ৪ বছর (আলিম ও কামিল তথা ১৯৯৭-’৯৮ এবং ২০০১-’০২), আমার টানা ১২ বছর (৫ম-কামিল; ১৯৯৪-২০০৬)। তিনি যখন ১৯৯৭ সনে আলিম ১ম বর্ষে ভর্তি হন, আমি তখন ৮ম শ্রেণির ছাত্র, ছারছীনার জীবনের ৪র্থ বছর চলছে। জুলফিকার শিল্পী-গোষ্ঠীর ১ম সফল অডিও অ্যালবাম ‘গোলাপ-কুঁড়িরা’য় মুবীন ভাই’র কয়েকটি সঙ্গীত তখন হিট হয়েছে বলা চলে। যেমন-
১. নীল আকাশের সন্ধ্যা তারায় কার ছবি ভাসে?/আল্লাহ-আল্লাহ ধ্বনি তোলে পূর্ণিমা-চাঁদ হাসে।
২. আমরাই নজরুল, ফররুখ/আমরাই জমানার সংগ্রামী মুখ। /আমাদের কবিতায় আগুন জ্বলে/বাতিলের কানে-কানে শীসা গলে। …
৩. মাধবী রাত যদি ভোর হয়ে যায়/শিউলি-হাসনা-হেনা যদি ঝরে যায়/তোমার জীবন তো শেষ হবে/এই পৃথিবী লয় হবে।
৪. ঐ কৃষ্ণচূড়ার ডালে-ডালে/ঐ বসন্তেরই কালে-কালে/বাজে কার সুরের ধ্বনি/সেই তো আমার আল্লাহ যিনি।
১৯৯৭-’৯৮-এ দু’/একটি লিখা লিখলেও সম্ভবত ১৯৯৮ সনের দিকে ৯ম শ্রেণিতে অধ্যয়নকালেই লেখালেখির নেশা আমার ভেতরে দানা বাঁধছিল। কবিতা, সঙ্গীত, কুঁড়িমুকুল পত্রিকার লেখালেখি ইত্যাদি সূত্র ধরেই সিনিয়র মুবীন ভাই’র সাথে আমার পরিচয়। ১৯৯৯-২০০০ সালের দিকে আমার ভেতরে ব্যাপকভাবে কবিতার কোলাহল শুরু হয়। ২০০১-২০০২ এবং ২০০৩ সালের দিকে সেটা কিছুটা ম্যাচ্যুরিটির (পরিপক্কতার) দিকে যাত্রা করে। খুব অল্প সময়ে আমার একটি অভাবনীয় জনপ্রিয়তা অর্জিত হয়।
কুঁড়িমুকুলের আওতায় তখন পরপর ২ বছরে ২টি লেখক-সম্মেলন (২য়টি ২০০৩ সনে আর ১মটি সম্ভবত ২০০২-এ) অনুষ্ঠিত হয়, যার প্রধান উদ্যোক্তা বলা যায় কুঁড়িমুকুল পত্রিকার তৎকালীন সহকারী সম্পাদক কবি আবু জাফর ছালেহীকে। উনি আমাকে দায়িত্ব দিলেন প্রধান-প্রধান লেখকদেরকে নিয়ে কিছু লিখার। সেই লেখক-সম্মেলনের কোনটিতেই মুবীন ভাই সশরীরে উপস্থিত থাকতে পারেননি; তবে ২য় সম্মেলনে যে ক’জন লেখককে পুরস্কৃত করা হয়, তার ভেতরে উনি একজন। ১ম লেখক সম্মেলনে যাদেরকে পুরস্কৃত করা হয়, তাদের মধ্যে প্রধান আকর্ষণ ছিলেন, ‘জীবনের মোহনায়’ জনপ্রিয় উপন্যাসের লেখক, গল্পকার, নাট্যকার আব্দুর রশীদ আল ফারিদী। ২য়টিতে যারা উপস্থিত ছিলেন, তাঁদের মধ্যে রয়েছেনÑ
১. হাবীবুর রহমান, কুঁড়িমুকুলের প্রবীণতম লেখক; ধর্মতত্ত্ব, ভাষা-আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধসহ বহু বিষয়ে ১৭২ খানা গ্রন্থের রচয়িতা, যার মধ্যে ১০২ খানা প্রকাশিত, ৭০ খানা অপ্রকাশিত। ২০১৮’র ২১ শে পদক-এর জন্য পিরোজপুর জেলা প্রশাসনের আওতায় যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে তাঁর নাম ও তথ্য এন্ট্রি করা হয়েছে। পুরস্কারপ্রাপ্তদের মধ্যে ইনিই ছিলেন এ সম্মেলনের প্রধান লেখক।
২. হযরত মাওলানা ডক্টর সাইয়্যেদ শরাফাত আলী, সম্পাদক, মাসিক কুঁড়িমুকুল এবং তৎকালীন উপাধ্যক্ষ ও বর্তমান অধ্যক্ষ, ছারছীনা দারুস্সুন্নাত কামিল মাদরাসা।
৩. কাজী মফিজ উদ্দীন জিহাদী, কেন্দ্রীয় সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র হিযবুল্লাহ।
৪. আখতার ফারুক, ‘ফেলে আসা ইতিহাস’ কলামের লেখক, আবু জাফর ছালেহীর ঘনিষ্ঠ সতীর্থ ও ক্লাসমেট।
৫. যায়েদ বিন আবদুস সালাম, কুঁড়িমুকুলের লেখক এবং আমার ক্লাসমেট।
৬. রফীকুল ইসলাম, কুঁড়িমুকুলের লেখক ও খেদমতগার এবং আমার ক্লাসমেট।
এদেরকে নিয়ে আমি আমার উদীয়মান হাতে যা লিখেছিলাম, বর্তমান স্মৃতি থেকে তার গুরুত্বপূর্ণ অংশ তুলে ধরছি।
লেখক হাবীবুর রহমানকে নিয়ে-
হাবীবুর রহমান
সাড়ে তিন যুগ ব্যাপি
লেখা তাঁর বহমান।
একদিন এই ভবে
জীবনের ইতি হবে
রয়ে যাবে তবু তাঁর
কলমের কলগান।
হাবীবুর রহমান।
আমার এই কবিতাংশকেই বাঁধাই করে এই মহান লেখককে অভিনন্দনপত্র আকারে দেয়া হয়। সামান্য বা অসামান্য সেই স্মৃতিটুকু এখনও আমাকে আনন্দ দেয়।
আব্দুর রশীদ আল-ফারিদীকে নিয়ে লেখা কবিতার একাংশ-
ফারিদী ও ফারিদী
প্রতিভার বারিধি
দরিয়ার ঊর্মি
কলমের কর্মী
লেখনীর রণমাঠে
সুবিশাল পরিধি
ফারিদী।
তখনকার আখতার ফারুক ভাইকে নিয়ে-
ফেলে-আসা ইতিহাস
লিখে যেই আখতার
পাঠকের অঙ্গনে
কী যে নাম-ডাক তার।
তার মেধা-মননের
চলা-বলা-কথনের
ভাবনাটা ভাবে যে-ই
চুলে ধরে পাক তার
(প্রিয় ভাই আখতার। )
আমার, বুখারি শরীফ, ‘কিতাবুল মাগাযী’ অংশের দরসদাতা উস্তায, কুঁড়িমুকুলের সম্পাদক সাইয়্যেদ শরাফাত আলীকে নিয়েÑ
সম্পাদকের নাম নিতে মুখ হাঁকি
আধেক সমান উল্টে জিভে, আধেক থাকে বাকি
ওব্ বাবা কী মস্ত মেধা, সব দিকে চৌকস
সম্পাদনায় ছড়িয়ে গেছে দশ দিকে তার যশ!
তাই এ বুকে পুষছি বিশাল আশা
একদিন আমি কেড়েই নেব সম্পাদনার ভাষা।
এই লেখক-সম্মেলনেই যুগের ফররুখ, আমাদের পথিকৃৎ কবি রূহুল আমীন খানের উপস্থিতিতে আনুষ্ঠানিক ঘোষণার মাধ্যমে আমার নামের শেষে ‘জামী’ অংশটুকু যুক্ত হয়। আমি পরে যা জানতে পেরেছি, পূর্বপ্রেক্ষাপটসহ তা এরকম-
একবার দেখি, কুঁড়িমুকুলে আমার একটি লেখায় আমারই নামের শেষে ব্রাকেটে ‘পণ্ডিত’ শব্দটি যুক্ত হয়েছে। পরের মাসেও তাই। এরপর ধীরে-ধীরে ব্রাকেট উঠে গিয়ে আমি হয়ে যাই মুহিববুল্লাহ পণ্ডিত। এই পণ্ডিত শব্দটা নাকি প্রথমে আমার ক্লাসমেট আবদুল্লাহ যায়েদ ওরফে যায়েদ বিন আবদুস্ সালাম তার মামার (আবু জাফর ছালেহীর) সাথে পরামর্শ করে যুক্ত করেছিল। অথবা জাফর ভাই নিজেই একাই এই কাজ করেছিলেন। এই নামে যখন আমি পরিচিতি অর্জন করি, তখন মুবীন ভাই জাফর ভাইকে জানান যে, ‘পণ্ডিত’ শব্দের ভেতরে হিন্দুত্বের ঘ্রাণ থাকায় শব্দটিকে অন্য কিছু দিয়ে বদলানো দরকার। আর সেই দরকার মেটাতে গিয়েই তিনি (মুবীন ভাই) প্রস্তাব করেন ‘জামী’ শব্দ, আল্লামা আবদুর রহমান জামী’র নামের শেষাংশের দিকে খেয়াল করে। আল্লামা জামী ছিলেন যুগপৎ কবি, আলেমে দ্বীন ও আশেকে রাসূল। এই নামের পক্ষে আরও যুক্তি দেখানো হয় যে, রুমী, সাদী এসব নাম কমন এবং বহুলব্যবহৃত। তার মোকাবেলায় ‘জামী’ শব্দটি আনকমন, দুর্লভ-এটি বাড়তি ফ্যাসালিটি। সব মিলিয়ে ডায়েসে দাঁড়িয়ে যতদূর মনে পড়ে কবি রূহুল আমীন খানের মুখ থেকে আমার নামের শেষাংশ তথা ‘জামী’ ঘোষণাটি আসে।
১. মোটকথা, আমার কলমী নামের (পেন-নেম) গুরুাত্বপূর্ণ অংশের প্রস্তাবক খোদ রফীকুল ইসলাম মুবীন ভাই।
২. এরপরে তার বিয়ের স্মারক ‘মাধবী রাত’ সম্পাদনার দায়িত্বটি ঘটনাচক্রে আমিই পালন করি।
৩. অবশেষে ২০০৯/২০১০-এর দিকে তিনি জানালেন তার মাসিক ম্যাগাজিন প্রকাশের পরিকল্পনার কথা। শুরু হল নাম খোঁজাখুঁজির পালা। তো আমি যেহেতু এক সময় ‘অ্যাকটিভ ইকনমিক অ্যান্ড কালচারাল অ্যামিটি’ নামে একটি সাংস্কৃতিক সংস্থার সর্বোচ্চ দায়িত্ব পালন করেছি, সেখানের কোন কাজ উপলক্ষে পরিচিত হয়েছিলাম মহিলা কবি বেগম সুফিয়া কামালের কবিতা ‘অভিযাত্রিক’-এর সাথে। ওই কবিতার প্রথম ৪/৫টি লাইন আমাকে খুব আকর্ষণ করেছিল। সেই লাইনগুলোর চেতনাকে সামনে রেখেই আমি ‘অভিযাত্রিক’ নামটি পছন্দ করে প্রস্তাব করলাম। কিছু যাচাই-বাছাইয়ের পরে নামটি সাদরে গৃহীত হল। (কবিতার লাইনগুলো সামনে আসছে)
৪. এবারে একটি স্লোগানের খোঁজে নামলাম আমরা। যতদূর মনে পড়ে স্মৃতিবিভ্রাট না ঘটে থাকলে সেই স্লোগানটিও আল্লাহ আমার উচ্চারণ থেকে বের করেছিলেন, তা এ রকম-‘মুখর তারুণ্যের দৃপ্ত মিছিল’। ‘মিছিল’ এখানে অবিরাম তৎপরতার প্রতীক। আর যেহেতু যুবশক্তিকে নিয়েই আমাদের যাত্রা, অভিযাত্রা এবং যৌবন বা তারুণ্যকে উস্কে দেয়াই আমাদের লক্ষ্য, সে কারণে ‘মুখর তারুণ্যের’ শব্দবন্ধ-এর অবতারণা।
৫. তারপর নিয়মিত এবং মুখ্য কলাম নির্বাচনের পালা। কলামের নামটিও সম্ভবত ফাইনাল করেছিলাম আমি। (পরে মুবীন ভাই ব্যাপারটি নিশ্চিত করেছেন)। যেহেতু আমরা এই কলামে কখনও কুরআনের তা’লীম বা তাফসীর পেশ করব, সেদিক থেকে এটি কুরআনের আলো। আবার অনেক সময়ই হয়ত হাদীছ থেকে কথা হবে, সে হিসেবে হাদীছের আলো। দুই আলোর দিকে তাকিয়ে নাম দিলাম ‘কুরআনের আলো, হাদীছের আলো’। দু’টো আলোই তো অবিচ্ছেদ্য, দু’টো নিয়েই পূর্ণতা। এই পূর্ণতার পুণ্যময় চর্চায় ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় আমাকেই বেশি সময় দিতে হয়েছে। অর্থাৎ, কয়েকটি লেখা বাদে সিংহভাগ লেখা ছিল আমি অধমের। এর একটি ইতিবাচক সাড়াও পাওয়া যাচ্ছে।
৬. এরপর ‘কৌতুক’, ‘রঙ্-বাহারি’ (কলাম) বাদে আর কোন কলামের দিকেই তেমন নজর দিতে পারিনি। (এই মাত্র লেখাটি শেষ করে মনে হল, ‘রঙ্-বাহারি’ নামটিও তো বোধ হয় আমারই দেয়া।) [পরবর্তীতে মুবীন ভাই এটিসহ ওপরের প্রতিটি তথ্যের সত্যতা ও যথার্থতা নিশ্চিত করেছেন]
আজ সেই অভিযাত্রিক’-এর পক্ষ থেকেই আয়োজিত হতে যাচ্ছে একটি লেখক-সম্মেলন (লেখক-সম্মেলন ২০১৭)। নানা সীমাবদ্ধতার কারণে ভাললাগার অনুভূতি থাকলেও তাতে তেমন রং লাগছিল না। বর্তমান স্মৃতিচারণটি করতে গিয়ে দেখলাম, অভিযাত্রিক-এর কয়েক বছরের অভিযাত্রায় লক্ষ্যে-অলক্ষ্যে অনেক বেশিই জড়িয়ে আছি। কিছুটা বর্ণাঢ্য অংশগ্রহণের স্মৃতি খুঁজে পেলাম বলে মনে হল।
একদিন যে দুঃসাহসী অভিযাত্রার কথা মাথায় রেখে নামকরণ করা হয়েছিল এই ম্যাগাজিনটির, সেই চেতনাটি শেয়ার না করলেই নয়-
“দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে যারা দুর্জয়ে করে জয়
তাহাদের পরিচয়
লিখে রাখে মহাকাল
সব যুগে-যুগে সবকালে টীকা-ভাস্বরে শোভে ভাল
হার মানে মহাকাল।”-বেগম সুফিয়া কামাল, কবিতার নাম: ‘অভিযাত্রিক’
মহাকালকে জয় করতে সক্ষম, এমন একটি অভিযাত্রা ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর জন্য খুব জরুরী। সেই জরুরী অভিযাত্রার একটি মাইলফলক হোক এই লেখক-সম্মেলন। নতুন-নতুন অভিযাত্রিক-এর পদচারণায় মুখর হোক ইসলামী সাহিত্য ও জ্ঞান-গবেষণার এই অঙ্গন। সমৃদ্ধ ও সুচারু হোক ‘অভিযাত্রিক’-এর নতুন অভিযাত্রা।
(ক) নির্বাহী সম্পাদক পদে নাম থাকায় আমি মুবীন ভাই’র কাছে অল্প-বিস্তর খোঁজ নিয়ে জেনেছি যে, এই ম্যাগাজিনটি, ইসলাম ও লেখালেখি-প্রিয় কয়েকজন সুধী’র ডোনেশন এবং মহানুভবতাকে পুঁজি করেই তার অভিযাত্রা সচল রেখেছে।
(খ) এমনকি লেখক-সম্মেলনটিও এমন কতকের সদিচ্ছা ও সক্রিয় সহযোগিতার সন্তান। (আলহামদুলিল্লাহ)। শুভাকাক্সক্ষী, সমাজসেবী, লেখক এবং ইসলাম-প্রিয় সিলেটবাসীর শুভেচ্ছা ও আন্তরিকতার হাওয়ায় পক্ষ বিস্তার করে এই দীনী ম্যাগাজিনটি পৌঁছে যাক তার কাক্সিক্ষত গন্তব্যে। সর্বশক্তিমান, দয়ালু আল্লাহর দয়ার নজর আমাদের বড়ই প্রয়োজন। আল্লাহ মহান আমাদের সহায় হোন। আমীন, ইয়া রব্বাল আলামীন!লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, মাসিক অভিযাত্রিক, শিক্ষক, বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ পাবলিক কলেজ, পিলখানা, ঢাকা।