হেমন্তের ছোঁয়া লাগুক প্রাণে প্রাণে

মানুষ নতুন সাজে সজ্জিত হয়। নানা ঢংয়ে, নানা রংয়ে রঙ্গিন হয় মানুষের লাইফ। তাতে চারিপাশের সবকিছু জেগে ওঠে। প্রাণবন্ত হয়। পল্লবিত হয়। সতেজ-সজীব হয়। বরং তো মানুষের নিজের সাজ নিয়ে বর্তমানে স্টাইল আর গবেষণার কোন শেষ নেই। প্রতিদিন কত রকমের প্রসাধনী কত রকমের মেশিন দিয়ে তৈরী হয়, তার কোন হিসেব নেই।
আজবে বিস্ময়ে ভরা বাংলার প্রকৃতির প্রতিটি দিক, প্রতিটি প্রান্তর। প্রকৃতির রূপ একটু চেইঞ্জ হলেই বাংলার রূপের পুরাটাই চেইঞ্জ হয়ে যায়। বদলে যায় আকাশ-বাতাস, নদী-সাগর, গাছ-পালা এমন কি মানুষের চেহারা-শরীর পর্যন্তও পাল্টে যায়। মানুষ তার মনোভাব দিয়ে সেটা অনুভব করতে পারে।
তো বাংলাদেশে প্রাকৃতিক চেইঞ্জটা স্মরণ রাখার জন্য বা সহজেই অনুভব করার জন্য বাংলাভাষায় কাল বা ঋতু হিসেবে ৬ ঋতুকে নির্ধারণ করা হয়েছে। এগুলোর ধারাবাহিক চেইঞ্জের মাধ্যমে বাঙ্গালী জাতি বুঝতে পারে, কাল বা প্রকৃতির রূপের বা অবস্থার বা দৃশ্যের পরিবর্তনের সময় হয়েছে, অথবা বলতে পারে, আর ক’মাস পরেই অমুক ঋতুর আগমন বা প্রকৃতির অবস্থা এই হবে। তো ষড়ঋতুর নাম হলো- গ্রীষ্ম, বর্ষা, বসন্ত, শরত, শীত ও হেমন্ত।
গ্রীষ্ম: বাংলাবর্ষ পঞ্জি অনুযায়ী বৈশাখ ও জৈষ্ঠ্য জুড়ে এ ঋতুর সরব অবস্থান। প্রখর তেজ থাকে, মাঠ-ঘাট শুকিয়ে যায়, ভূমি উত্তপ্ত হয়ে ফেটে চৌচির হয়ে যায়, নদীর নাব্যতা হারায়, শেষের দিকে হয় কালবৈশাখী ঝড়। অন্যদিকে, এ দুমাসে ফলে প্রকৃতির হরেক রকমের ফল: আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু ইত্যাদি ইত্যাদি।
বর্ষা: বাংলাবর্ষ পঞ্জি অনুযায়ী আষাঢ় ও শ্রাবণ জুড়ে এ ঋতুর আয়োজন। স্বাভাবিকভাবেই গ্রীষ্মের পরে হওয়ায় গরমের একটা ছোয়া থেকেই যায়। এ সময় এই বৃষ্টি হয়, এই গরম পড়ে। যখন গরমের প্রখরতা হঠাৎ বেড়ে যায়, তখন সবাই বুঝতে পারে, বৃষ্টি নামবে। বাস্তবেও তাই হয়। সে বৃষ্টির পর বিরাজ করে ভেপসা গরম-ঠান্ডা।
শরৎ: বাংলাবর্ষ অনুযায়ী ভাদ্র ও আশি^ন হলো শরৎ এর সময়কাল। এ সময় প্রায়শই আকাশে সাদা সাদা মেঘ উড়তে দেখা যায়, ঝোপে ঝোপে কাশফুল ফোটে। যেখানে কাশফুল ফোটে, সেখানে মানুষ স্পট হিসেবে ঘুরতে যায়। স্মৃতি ফটো করে মোবাইলে বা ক্যামেরায়। এ দুটি বিষয় প্রকৃতির সজ্জায় খুব সাহায্য করে থাকে। যা অন্য ঋতুতে দেখা যায় না।
হেমন্ত: মুখ্য এই প্রবন্ধে উক্ত ঋতুই হলো আলোচিত বিষয়। এ ঋতুর ব্যাপি হলো কার্তিক ও অগ্রহায়ণ- দুই মাস। এ ঋতুতে মাট-ঘাটের ফসলাদি রঙ্গিন হয়ে ওঠে। হলদে সোনালী রং ধারণ করে। ধান পাকে, কৃষকেরা কেটে ঘরে আনে। তারপর নতুন চালের মৌ মৌ গন্ধে আমোদিত হয় চারিদিক। ধুম পড়ে যায় নতুন পিঠা বানানোর উৎসবে।
শীত: শীতের ঋতুর ব্যাপ্তি হলো পৌষ ও মাঘ মাস। এ সময়ের প্রধানতম দৃশ্য হলো, সকালের কুয়াশা, খেজুরের রস, সূর্যের তেজের স্বল্পতা। পিঠাও বানানো হয়। পায়েস, গুড়, গুড়ের পিঠা ইত্যাদি ইত্যাদি। তাছাড়া দেশে বনভোজন ও শিক্ষাসফরের একটা উপযুক্ত সময় হিসেবে পর্যটকদের একটা হিড়িক পড়ে যায়।
বসন্ত: বাংলা পঞ্জিকা অনুযায়ী ফাল্গুন ও চৈত্র হলো বসন্ত ঋতুর ব্যাপ্তি। প্রকৃতিতে ও প্রাকৃতিক দৃশ্যে এর খুব প্রভাব। বরং তো পরিপূর্ণ সাজে সেজে ওঠে বাংলার গা। গাছে গাছে নতুন পাতা, নতুন রং বেরংয়ের ফুল, আবহাওয়ার পরিবর্তন প্রভৃতি কারণে একে ঋতুরাজ বলা হয়।
যাই হোক, আমরা এখন মূল কথায় ফিরে আসি। হেমন্ত নিয়ে লেখা চলছিলো। হেমন্ত নিয়ে কবি সাহিত্যিকদের গবেষণার কোন শেষ নেই। বরং তো এগুলো তো তাদের জন্য সাহিত্য ও কবিতার খোরাক।
গানে গানে, উৎসবে উৎসবে, লেখায় লেখায় হেমন্তকে বরণের সেকি আয়োজন। তবু যেন শেষ নেই। কবিদের কবিতার উৎকর্ষ হচ্ছে, সাহিত্যিকদের সাহিত্যের চর্চা হচ্ছে, শিল্পীদের শিল্পের প্রসারতা হচ্ছে- সব মিলে হেমন্তের অবদানকে অস্বীকার করা যায় না। বাংলার মানুষের মনোরঞ্জনের জন্য কিংবা বাংলা ভাষার অগ্রসরতার জন্য এ ঋতু একটা মাইলফলক।
হেমন্তের প্রাথমিক বৈশিষ্ট্য হলো, গরম কমে এসে মানুষকে শান্তি দেয়। শীতের আগমন জানিয়ে মানুষের আনন্দের মাত্রাকে বাড়িয়ে দেয়। হেমন্তের ভোর হয় শিশিরøাত ভেজা, দুপুরের রোদ হয় ¯িœগ্ধে কোমলতায় ভরপুর, বিকেল হয় রূপালী আলোয় ঝিলিক মারা হৃদয় কাড়া দৃশ্যে, রাত হয় হীম শীতলমাখা। এককথায়, প্রত্যেকটা মুহুর্ত মনে হবে উপভোগ্য।
আর পিঠা উৎসব! সেটা তো বাঙ্গালীদের আলাদা আনন্দোৎসব। ঘরে ঘরে পিঠা বানানোর ধুম পড়ে, সকালে-দুপুরে-বিকালে আকাশের গায়ে চুলার ধোঁয়া দেখলেই বুঝা যায়।
আর সংস্কৃতি, সাহিত্য ও কবিতার ক্ষেত্রে হেমন্ত যেন নিজের অবস্থানকে পাকাপোক্ত করে নিয়েছে। জাতীয় কবি থেকে বিশ^কবি সহ সকল খ্যাত ও প্রতিষ্ঠিত কবি সাহিত্যিক হেমন্ত নিয়ে নিজস্ব রচনা তৈরী করেছেন। প্রিয় কবি মরহুম নজরুল ইসলাম তার কবিতায় হেমন্তের প্রকৃতির রূপ ফটিয়ে তুলে ধরেছেন, তিনি বলেছেন,
ঋতুর খাঞ্জা ভরিয়া এলো কি ধরণীর সওগাত?
ইরীন ধানের অঘ্রাণে আজি হলো মাৎ।
ডবন্নি পলাশ চালের ফিরনি,
তশতরি ভরে নবীনা গিন্নি।
হাসিতে হাসিতে দিতেছে স্বামীরে
খুশীতে কাঁপিছে হাত,
ডশরনী রাধেন বড় বিবি
বাড়ি গন্ধে তেলেসমাত।
এ সময়ে গ্রামবাংলার ঘরে ঘরে যেন স্বর্ণ ফলেছে। হলদে ধানের কোটি কোটি গুটিতে দেখলে সোনাই মনে হয়। তাই না গরীব চাষীদের মুখে দেহে খুশীর আমেজ। গ্রামের মেঘবালাদের এখন কত ঝামেলা, কত কাজ! তবু কি আনন্দ কি উল্লাস!
কবি সুফিয়া কামালের কবিতায় হেমন্তের স্বাগতম আহবান:
গবুজ পাতার খামের ভিতর
হলুদ গাদা চিঠি লেখে,
কোন পাথারের ওপার থেকে
আনলো ডেকে হেমন্তকে।
এখানে কবি খুব আশ্চর্য হয়ে বর্ণনা তুলে ধরেছেন এবং প্রশ্নও তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশ তো চির সবুজের দেশ। আদিগন্ত সবুজের হাতছানি। মাঠ থেকে পাহাড়, ক্ষেত থেকে প্রান্তর। বাড়ির উঠোন থেকে বাগান সর্বত্র সবুজের সমারোহ। অথচ এই সবুজের ভেতরই যেন হঠাৎ করেই হলুদবরণ এক ঋতু এসে পড়েছে। তবে এই হলুদ জীবন সন্ধ্যার বার্তা বয়ে আনে না। তাকে রীতিমতো পত্রযোগে নিমন্ত্রণ করে আনতে হয়। কারণ চিরসবুজের দেশে এই ঋতু সোনা আভা ছড়িয়ে দেয়। বদলে দেয় প্রকৃতির রূপ।
প্রকৃতির রুপ বৈচিত্র্যের ভেতর হেমন্ত একেবারেই এক লাজুক ঋতু। যেমন বসন্ত ঋতুকে ঋতুরাজ বলা হয়। এ সময়ে মানুষ মূলত ফসল তোলার কাজে একাগ্র থাকে। সৃষ্টিশীল মানুষরাও নিভৃতে চর্চা করে শিল্পের, হয়তো এ কারণেই দেখা যায়, কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতায় হেমন্তের এমন বিচিত্র উপস্থিতি। বাংলার শ্রেষ্ঠ কবিরা হেমন্তকে দেখেছেন ফসল তোলার ঋতু হিসেবে, সৃষ্টির মাহেন্দ্রক্ষণ হিসেবেও। তাই হেমন্ত হয়ে উঠেছে কবিদের ধ্যানস্থ হওয়ার সময়। যে সময় অনেকটা চুপিসারে, নি:শব্দে কবির মনে, হৃদয়ে, মগজে কবিতার ছায়া এসে উপস্থিত হয়। তাই হেমন্তের কবিতা বর্ষা বা বসন্তের কবিতার চেয়ে তুলনায় কম। কিন্তু যে কয়টি কবিতা রচিত হয়েছে, সে কয়টি চিত্রকল্পে-উপমায়-বিষয়ে অনন্য। এতে কোন সন্দেহ নেই।

Comments

comments

About

Check Also

রাসুলুল্লার হিজরাত : প্রাসঙ্গিক ভাবনা

পৃথিবীতে তখন ঘোর অমানিশার রাজ। চারিদিকে বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্যের দৃঢ় ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। যে ভিন্নতার জন্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *