রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে ঈদ

ঈদ অর্থ আনন্দ। ঈদ শব্দের একটি অর্থ হলো ‘বারবার ফিরে আসা’ এ দিনটি বারবার ফিরে আসে বলে এর নামকরণ হয়েছে ঈদ। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এদিনে তার বান্দাহদেরকে অসংখ্য নিয়ামত দ্বারা ধন্য করে থাকেন। ঈদের খবর শোনার সাথে সাথে বিশ্বের প্রতিটি মুসলমান, ধনী-গরীব সবার জীবনে ঈদের আনন্দ জেগে ওঠে, মনের মধ্যে একটি আনন্দের জোয়ার বয়ে যায়। সেই ছোটবেলা থেকেই আমরা জানি ঈদ সবার জন্য। ঈদ এলে সবার নতুন-নতুন জামা- কাপড় কেনা, মজার মজার খাবার তৈরি করা, বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে যাওয়া, আনন্দ, উল্লাস, খুশি যার কোন শেষ নেই।
ঈদ সবার জন্য খুশি বয়ে আনলেও রোহিঙ্গাদের জন্য তা কখনো আনন্দের নয়। দেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে, আপনজন হারিয়ে কেমন করে আনন্দে থাকতে পারে ওরা? যারা কিনা ঈদের নামাযটাও শান্তিতে আদায় করতে পারেনা। নামায আদায়তো দূরের কথা প্রাণ রক্ষায় বনে জঙ্গলে ছুটাছুটি করতে হয়। তাদের মধ্যে যারা প্রাণ রক্ষায় বাংলাদেশ আশ্রয় নিয়েছেন তাদের নিরব কান্নার মাত্রা আরো অধিকতর। রেখে যাওয়া স্বজনদের না দেখার কান্না, অর্থের অভাবে সন্তানদের খাবার যোগাড় করে দিতে না পারার কান্না। তেমনি হাজারো বেদনা জোড়ো হয় তাদের অন্তরে। ঈদের আনন্দ উপভোগ করার ক্ষমতা তাদের নেই। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে আসা হাজার হাজার মুসলমান রোহিঙ্গা সীমান্তের জিরো লাইনের ছোট ছোট টিলা ও পাহাড়গুলোতে ঝুপড়ি ঘর তৈরি করে বসবাস শুরু করেছে। তাদের দেখতে প্রতিদিনই শতশত মানুষ শুকনো খাবার নিয়ে ছুটে আসছে। এতে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের খাবারের সংকট না থাকলেও ঈদ করার কোন সুযোগ না থাকায় আনন্দ নেই শিশুদের মনে। আগুন, গুলি করে হত্যা আর ধর্ষণের পর ধর্ষণ! এসবই চলছে রোহিঙ্গাদের ওপর। নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে তারা সহায় সম্বল ছেড়ে ঈদের দিনও পালিয়ে এসেছে বাংলাদেশে।
প্রথম আলো, ০২ সেপ্টেম্বর ২০১৭ এর রিপোর্টার আব্দুল কুদ্দুস এর একটি প্রতিবেদনে এমনি একটি নির্যাতিত রোহিঙ্গা পরিবারের করুণ ঘটনা উঠে এসেছে !!
বর্তমানে টেকনাফের ডেইলপাড়া গ্রামে বসবাসরত সেতারা বেগম (৪৫)। তাঁর বাড়ি ছিল মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের সিকদারপাড়ায়। তিনি তার ঈদের করুণ অনুভূতির প্রকাশ করতে গিয়ে অশ্র“সিক্ত নয়নে বলেন, গত বছর ঈদুল আজহার দিনে তিন মণ ওজনের গরু কোরবানি দিয়েছিলেন। আত্মীয়-স্বজনেরা বাড়িতে এসে চালের রুটির সঙ্গে গরুর মাংস খেয়েছেন পেটভরে। ছেলেমেয়েরা মংডু শহরে গিয়ে চার চাকার রিকশায় চড়েছে। আর এখন সেসব স্মৃতি। আজ ঈদের দিনে আশ্রয়ের আশায় টেকনাফের পথে পথে ঘুরতে হচ্ছে। সকালে ছেলেমেয়েরা কলা আর বিস্কুট খেয়েছে। দুপুরে মুখে দেওয়ার মতো কিছুই নেই। মিয়ানমারের সেনারা তাদের ঈদের আনন্দ কেড়ে নিয়েছে।
তিনি আগের দিন শুক্রবার রাতে পরিবারের চার সদস্য নিয়ে শাহপরীর দ্বীপ ওঠেন। সেখান থেকে রিকশায় যান টেকনাফ। তারপর হেঁটে হেঁটে এই ডেইলপাড়ায়। দুরবস্থার কথা শুনে লোকজন তাঁকে কিছু অর্থ সহায়তাও দেন।
টেকনাফের পথে পথে এখন নির্যাতনের শিকার অসহায় রোহিঙ্গাদের কান্নার মিছিল! শাহপরীর দ্বীপ-টেকনাফ সড়কে লাইন ধরে হাঁটছেন রোহিঙ্গারা। কেউ যাচ্ছেন উখিয়া-টেকনাফের বিভিন্ন রোহিঙ্গা শিবিরের দিকে। কেউ কেউ ঢুকে পড়ছে গ্রামে। তাঁরা আশ্রয় নিচ্ছেন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ঝোপজঙ্গলে। অসহায় বলে স্থানীয়রা রোহিঙ্গাদের প্রতিরোধ অথবা বাধা দিচ্ছেন না। সবাই তাদের সাধ্যমত আজ বিপদাপন্ন রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে । মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে আসা রোহিঙ্গাদের ঈদ কাটছে চরম কষ্টে। পলিথিন ও গাছের লতাপাতা দিয়ে তৈরি ঝুপড়িঘরে ঝড়বৃষ্টি উপেক্ষা করে তাঁদের কাটাতে হচ্ছে গৃহবন্দী অমানবিক জীবন।

রোহিঙ্গা মুসলমানদের অমানবিক নির্যাতন ইতিহাসে নতুন নয়! সেই ১৯৭৮ সাল থেকে মিয়ানমারে নির্যাতিত রোহিঙ্গা মুসলামানরা ব্যাপক হারে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে আসছে। বিভিন্ন সময় সেদেশের মগদস্যু এবং সরকারী বাহিনীর নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা প্রায় অর্ধলক্ষাধিক রোহিঙ্গা মুসলমান উখিয়া-টেকনাফের কয়েকটি জাতিসংঘ স্বীকৃত শিবিরে অবস্থান করলেও কক্সবাজার, চট্টগ্রাম ও বান্দরবনের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান করছে পাঁচ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা মুসলমান।
প্রতিবছর এভাবে ঈদ আসে ঠিকই, কিন্তু বরাবরই নিরানন্দে কাটছে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা অসহায় রোহিঙ্গা মুসলমানদের ঈদ। উখিয়া-টেকনাফের শরনার্থী শিবিরগুলোতে লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা মুসলমানরা যুগের পর যুগ ধরে নিরানন্দে ঈদ উদযাপন করে আসছে। একইভাবে মিয়ানমারে অবস্থানকারী রোহিঙ্গারাও মিয়ানমার সরকারের নানা বাধার কারণে উপভোগ করতে পারছেনা ঈদের আনন্দ। রোহিঙ্গা মুসলমানদের ঈদ আনন্দ যেন ধুলায় মিশে আছে।
মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমানরা বিশ্ব মুসলিম সমাজের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হলেও ঈদ আনন্দ আজ যেন একটি শোক দিবসে পরিণত হয়েছে। নির্যাতিত, ঘর ছাড়া, দেশ ছাড়া এসব রোহিঙ্গাদের ঈদ আনন্দ কি কখনো ফিরে আসবে না? এই কান্নার শেষ কোথায়? কবে এবং কিভাবে হবে এই নির্যাতনের শেষ ?
মানবতার ডাকে সাড়া দিয়ে অনেক সময় প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে, অনেক সংস্থা, সুহৃদ ব্যক্তি ত্রাণ নিয়ে গিয়েছেন এবং যাচ্ছেন। এখন আমাদের উচিত এই ঈদের দিনে রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়ানো। যথাসাধ্য তাদের সাথে আনন্দ ভাগ করা। তাই আসুন, আমরা যে যেভাবে পারি রোহিঙ্গা ভাইবোনদের পাশে দাঁড়াই। কারণ মানবতাই সবচেয়ে বড় ধর্ম। আসুন রোহিঙ্গাদের প্রতি আমরা মানবিক হই।

তথ্যসূত্র:
১. প্রথম আলো, ০২ সেপ্টেম্বর ২০১৭।
২. ইনকিলাব, ৭জুন ২০১৮

Comments

comments

About

Check Also

রাসুলুল্লার হিজরাত : প্রাসঙ্গিক ভাবনা

পৃথিবীতে তখন ঘোর অমানিশার রাজ। চারিদিকে বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্যের দৃঢ় ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। যে ভিন্নতার জন্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *