রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তি জীবনে ইসলামের খেদমতে এরশাদ

জাতীয় পার্টির সাবেক চেয়ারম্যান মরহুম হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ব্যক্তি ও রাষ্ট্রীয় জীবনের কর্মাবলীর মধ্যে দলমত নির্বিশেষে বাংলাদেশের মুমিন মানুষদেরকে সবচেয়ে বেশি যে বিষয়টি আলোড়িত করে সেটা হচ্ছে তাঁর ইসলামের খেদমত। একজন সাধারণ মুসলমান অথচ দেশের রাষ্ট্রপতি হওয়ার প্রেক্ষাপটে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের দাবীর প্রেক্ষিতে যে বিষয়গুলো আদায় করার কথা ছিল সেগুলো তিনি নিজ থেকে পূরণ করে ধর্মপ্রাণ মুসলমানের হৃদয়ে আসন গড়ে তুলেছেন। প্রথমত রাষ্ট্রধর্মের প্রসঙ্গ এলেই চলে আসে এরশাদের নাম। বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকের ধর্মীয় মূল্যবোধের বিষয়টি বিবেচনা করে ১৯৮৮ সালে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করেছিলেন তিনি। ইসলাম ও মুসলমানদের কল্যাণে বিভিন্ন পদক্ষেপ তাকে করেছে মহিমান্বিত। দেশের মসজিদ- মাদরাসা নিয়ে তাঁর অবদান কখনো ভুলার নয়। সরকারিভাবে মসজিদের বিদ্যুতের বিল মওকুফ ও শুক্রবারকে সরকারি ছুটির দিন ঘোষণার মাধ্যমে মুসলিম ধর্মপ্রাণ মানুষের কাছে প্রিয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হন এরশাদ। তিনি ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে রাষ্ট্রের বিভিন্ন মৌলিক বিষয়ে ইসলামি নির্দেশনা বাস্তবায়নের চেষ্টাও করেছিলেন।
স্ব^াধীনতার পর থেকে দেশের সাপ্তাহিক ছুটি ছিল রোববার। মুসলমানদের বিশেষ ইবাদতের দিন শুক্রবারে কোনো ছুটি ছিলো না। যার কারণে জুমার নামাজে ভোগান্তিতে পড়তে হতো কর্মজীবিদের। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের উদ্যোগেই সাপ্তাহিক ছুটি রোববারের পরিবর্তে শুক্রবার করা হয়। রেডিও-টেলিভিশনে নামাজের আগে আজান সম্প্রচারের কোনো ব্যবস্থা বাংলাদেশে ছিলো না। এরশাদের নির্দেশেই রেডিও এবং টেলিভিশনে সর্বপ্রথম আজান সম্প্রচার চালু হয়েছিল। সে ধারাবাহিকতায় এখনও নামাজের আগে দেশের রাষ্ট্রীয় রেডিও-টেলিভিশনে আজান দেয়া হয়। দেশের সর্বসাধারণের ধর্মীয় আবেগের প্রতি সম্মান জানিয়ে মসজিদ-মন্দিরের পানি ও বিদ্যুৎ বিল মওফুক করা ছিল এরশাদের অন্যতম জনপ্রিয় পদক্ষেপ। ধর্মীয় উপাসনালয়গুলোর বিদ্যুৎ ও পানির বিল রাষ্ট্রীয়ভাবে বহন করার সিদ্ধান্ত এরশাদকে হিন্দু-মুসলিম সবার কাছেই জনপ্রিয় করে তোলে। জীবনের পড়ন্তবেলায় বিভিন্ন ইসলামি অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে নিজের নেয়া পদক্ষেপগুলোর কথা জানাতেন সাবেক এ রাষ্ট্রপতি। ২০১৭ সালের ২৫ মে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে শরীয়াহ আন্দোলন বাংলাদেশ আয়োজিত একটি সেমিনারে অংশ নিয়ে এরশাদ বলেন, ‘আমি ইসলামের জন্য অনেক কিছু করেছি। শুক্রবারকে সাপ্তাহিক ছুটি, ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম, মসজিদ-মাদ্রাসায় পানি ও বিদ্যুৎ বিল মওফুক করেছি। ইসলামের বিরুদ্ধে কথা বললে সহ্য হয় না। দেশকে সামাজিক অবক্ষয় থেকে রক্ষা করতে এবং ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে আমাদের নেতৃত্বে বাকি ইসলামী দলগুলো ঐক্যবদ্ধ হন। কথা দিলাম, আজীবন আমি আপনাদের সাথে থাকব।’ ঠিক এভাবে ১৫ মার্চ ২০১৮ ইংরেজি তারিখে হুসেইন মুহমম্দ এরশাদ তাঁর বক্তব্যে বলেন, ‘ক্ষমতায় থাকাকালে ইসলামের জন্য অনেক কিছু করেছি। ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী বলে এসব করেছিলাম। শান্তির ধর্ম ইসলামের খেদমত করতে চাই। শেষ জীবনে ইসলামের জন্য কিছু করে যেতে পারলে খুশি হতাম। এজন্য দেশের আলেম উলামাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। আসুন, ঐক্যবদ্ধ হয়ে ইসলামের জন্য লড়াই করি। আমি রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করেছি, শুক্রবার ছুটির দিন ঘোষণা করেছি। দুপুরে নামাজের বিরতি দিয়েছি। মসজিদের বিদ্যুৎ বিল মওকুফ করেছি, বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদকে সৌন্দর্য্যবর্ধন করে সম্প্রসারণ করেছি। ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক করেছিলাম। কেন করেছি? ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী বলে এসব করেছি।
দুঃখজনক হলেও সত্য, দ্বীনি শিক্ষা এখন সবার জন্য আর বাধ্যতামূলক নাই। আমি ক্ষমতা থেকে যাওয়ার পর ১০০ থেকে ৫০ শতাংশ কমিয়ে দেওয়া হয়। পরে দ্বীনি শিক্ষা বাধ্যতামূলকই বাদ দেওয়া হয়। মহান আল্লাহ পাক ও তার প্রিয় হাবিব সম্পর্কে জ্ঞানার্জন মুসলমানদের জন্য ফরজ। এখন আমরা সেই শিক্ষা দিতে পারি না।
রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করেছিলাম। পরবর্তীতে এটি বাতিল করার চেষ্টা করা হয়েছিল, কিন্তু পারে নাই। প্রধানমন্ত্রী (শেখ হাসিনা) আমার সঙ্গে কথা বলেছিলেন, আমি বলেছিলাম বাতিল করলে আল্লাহ নারাজ হবেন। তিনি (প্রধানমন্ত্রী) বাতিল করেননি। বাংলাদেশ যতদিন থাকবে, রাষ্ট্রধর্ম ইসলামও থাকবে। ‘
এরশাদ দেশের আলেম ওলামাদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন- ‘ইসলামের কথা শুনলে মানুষ ঘৃণা করে, রিফুজি মনে করে। আমার দেশে আমি থাকতে পারব না। পশ্চিমারা আমাদের সন্ত্রাসী বলে। ডেমোক্র্যাসি নাই এই অপরাধে ইরাক, লিবিয়া ধ্বংস করা হলো। সিরিয়া ধ্বংসের পথে। বিদেশিরা এই কথা বলে একের পর এক ইসলামী রাষ্ট্রগুলোকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। ইসলামের পক্ষে কথা বলার কেউ নাই। কারণ, আমাদের মধ্যে ঐক্য নাই। কাতার একদিকে, সৌদি আরব একদিকে। তাদের মত দেশের মুসলমানদের মধ্যেও ঐক্য নাই। ঐক্যবদ্ধ থাকলে ইসলামকে কেউ ধ্বংস করতে পারবে না।
এক আল্লাহ এবং রাসুল সা. হলো আমাদের বিশ্বাস। ইসলামই একমাত্র শান্তির ধর্ম, শান্তির পথ। ইসলামকে রক্ষা করতে হলে সকলকে একত্রে কাজ করতে হবে। ‘
এরশাদের কথা, কাজ ও বক্তব্যে ইসলামের খেদমত আঞ্জাম দেয়ার ব্যাপারটা সবসময় ছিল সুস্পষ্ট। তিনি ইসলাম ধর্মের ব্যাপারে বলেছেন এক আর করেছেন ভিন্ন তা কখনো হয়নি।
রাষ্ট্রীয় জীবনে ইসলামের খেদমতে এরশাদ যে বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করেছিলেন সেগুলোর মধ্যে সংক্ষিপ্ত একটা তালিকা এভাবে দেয়া যায়-

  • হাইকোর্টের সামনে পুকুর ভরাট করে এরশাদই তৈরি করেছিলেনন দেশের জাতীয় ঈদগাহ।
  • তিনি যাকাত বোর্ড গঠন করেছিলেন।
  • তিনি মাদরাসা শিক্ষায় দাখিলকে এসএসসি এবং আলিমকে এইচএসসি সনদের সমমানের মর্যাদা প্রদান করেছিলেন।
  • তিনি এবতেদায়ী মাদরাসা শিক্ষকদের মাসিক অনুদান প্রদান করেছিলেন।
  • তিনি ইমামদের জন্যে ভাতা চালু করেছিলেন।
  • তিনি দেশের সকল মসজিদের পানি ও বিদ্যুৎ বিল মওকুফ করেছিলেন।
  • তিনি রেডিও টিভিতে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের আজান প্রচারের ব্যবস্থা করেছিলেন।
  • তিনি রেডক্রসের নাম পরিবর্তন করে রেড ক্রিসেন্ট করেছিলেন।
  • ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম এবং জুম্মার দিন ছুটি ঘোষণা করেছিলেন।
    বিশ্ব মুসলিম উম্মাহকে নিয়েও ভাবতেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। প্রথমে দেশের মুসলিম উম্মাহকে নিয়ে তাঁর পরিকল্পনা বারবার প্রকাশ্যে উল্লেখ করেন। এক বক্তব্যে আয়োজক আলিম উলামাগণকে উদ্দেশ্য করে এরশাদ বলেন- ‘আপনাদের মধ্যে ঐক্য নেই। যদি ইসলামী দর্শনে বিশ্বাসী দলগুলোর মধ্যে ঐক্য থাকত, তাহলে আপনারা আজ ক্ষমতায় থাকতেন। আমরা কী চাই? স্বাধীনতার চেতনা, ইসলামী মূল্যবোধ এবং বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী সবাইকে নিয়ে একটি জোট করতে। এর নেতৃত্ব যদি আমাকে দেন, তাহলে খুশি হব। আশা করি, সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমাদের আশা পূর্ণ হবে।’
    বক্তৃতায় মুসলিম উম্মাহ সচেতন এরশাদ আমেরিকাকে উদ্দেশ্য করে বলেন- ‘ আমাদের বলা হলো সন্ত্রাসী। সন্ত্রাসী বানালো কে? কেনো ইরাকে বোমা নিয়ে গেলেন? কেনো লিবিয়া গেলেন, কেনো সিরিয়া গেলেন? আপনারা সন্ত্রাসী বানিয়েছেন। আপনারা লিবিয়াকে ধ্বংস করেছেন। আমাকে সন্ত্রাসী বানিয়েছেন আপনারা সন্ত্রাসী। ইসলাম সন্ত্রাস বিশ্বাস করে না। লিবিয়া একটি সুন্দর দেশ ছিল। সেখানে নাগরিকদের সন্তানদের পড়ালেখার খরচ দেওয়া হতো। বিয়ের জন্য বিশেষ ভাতা দেওয়া হতো। আপনারা কেনো সেখানে বোমা নিয়ে গেলেন। আমাদের দেশ আমরা চালাবো, আমাদের জনগণ সিদ্ধান্ত নেবে। আপনারা কেনো গণতন্ত্র চাপিয়ে দিতে আসেন। আপনারা বিশ্ব শান্তি বিনষ্ট করছেন।’
    বাংলাদেশ প্রসঙ্গ টেনে এরশাদ বলেন-‘যে দেশের লোকজন নদী, ফুল ভালোবাসে, কোকিলের গানে বিমোহিত হয়, সে দেশের লোক সন্ত্রাসী হতে পারে না। ’
    জীবনের পড়ন্ত বেলায় শেষ দিন পর্যন্ত ইসলামের খেদমত করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করতেন এরশাদ। এরূপ এক বক্তব্যে তিনি বলেন- ‘আল্লাহর শাশ্বত ধর্ম ইসলাম এদেশে (রাষ্ট্রীয়ভাবে) প্রতিষ্ঠা করতে চাই। সেই সুযোগ আসবে কিনা জানি না, জীবনের শেষ প্রান্তে চলে আসছি। তাই জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ইসলামের খেদমত করতে চাই।’
    রাজধানী ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিশনের সম্মিলিত জাতীয় জোটের শরীক শরীয়াহ্ আন্দোলন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ও কর্মী সম্মেলনে তিনি বক্তব্যে দ্ব্যর্থহীনভাবে আলেম-ওলামাদের উদ্দেশ্যে বলেন- ‘আপনাদের সংস্পর্শে আসতে পারলে খুশি হতাম। কত মধুর কথা, কত মধুর কন্ঠ আপনাদের। এই কথা সবাইকে বুঝিয়ে দিতে পারলে ভালো হতো যে একমাত্র শান্তির পথ ইসলাম। সে দিন দূরে নয়, পরিবর্তন আসবেই। কারণ ইসলাম ছাড়া শান্তির পথ নেই। এত অত্যাচার আল্লাহ সহ্য করবেন না।’
    সবশেষে বলা যায়, একজন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ছিলেন আপাদমস্তক ইসলামের প্রকৃত দরদী। তাঁর অন্তরে ছিল দেশপ্রেম, ইসলাম ও মুসলিম প্রেম। তাঁর এই ধার্মিকতা তাকে মহিমান্বিত করলেও জন্ম দিয়েছিল অসংখ্য শত্র“র। কিন্তু তিনি আমৃত্যু এর পরোয়া করেননি। আলহাজ্ব হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নাম ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

Comments

comments

About

Check Also

রাসুলুল্লার হিজরাত : প্রাসঙ্গিক ভাবনা

পৃথিবীতে তখন ঘোর অমানিশার রাজ। চারিদিকে বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্যের দৃঢ় ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। যে ভিন্নতার জন্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *