নারীর মাধুরী রূপ-লাবণ্য নির্দিষ্ট হয়েছে কেবল তার স্বামীকে প্রদর্শনের জন্যে। নিজ স্বামীকে সুন্দর সে রূপ উপহার দিতে না পারলে একজন নারীর কোনো মূল্যই থাকে না। অঙ্গের ওপর সুন্দর অঙ্গরাজ দিয়ে আরও মনোহারী ও লোভনীয় করে স্বামীকে উপহার দেয়ার মাধ্যমে পরমানন্দ ও প্রকৃত দাম্পত্য সুখ অর্জন করা যায়। যুগের সঙ্গে নারীদের অঙ্গসাজ, মেকআপ ও প্রসাধন সামগ্রী অনেক বেড়েছে। এসব প্রসাধন সামগ্রী ব্যবহারে রয়েছে শরয়ি কিছু নীতিমালা। আসুন তা জেনে নেয়া যাক।
নারীর সাজসজ্জার ব্যপারে ইসলাম বৈধতা দিয়েছে। তবে তা হতে হবে কেবল স্বামীকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে। পরপুরুষকে দেখানোর জন্য কোনো প্রকার সাজসজ্জা করা ইসলামের দৃষ্টিতে জায়েজ নেই।
টাইটফিট চুস্ত বা মিহি জামা পরে বাইরে বেরোনো কোনো মুসলিম নারীর পক্ষে শোভা পায় না। কারণ, অন্যের সামনে নারীর সর্বাঙ্গ ঢেকে রাখা ফরজ। আর এসব জামায় পর্দা
লঙ্ঘন হয়। হজরত আলকামা ইবনে আবু আলকামা তার মা থেকে বর্ণনা করেন, একবার হাফসা বিনতে আব্দুর রহমান তার ফুফু উম্মুল মুমিনিন আয়েশা (রা.) এর নিকটে এলেন। তখন তার পরনে ছিল একটি পাতলা ওড়না। উম্মুল মুমিনিন হজরত আয়েশা (রা.) তা ছিঁড়ে ফেললেন এবং একটি মোটা ওড়না পরিয়ে দিলেন। (মুয়াত্তা মালেক ২/৯১৩, হাদিস : ৬)
আবু ইয়াজিদ মুজানি (র.) বলেন, হজরত ওমর (রা.) মহিলাদেরকে কাবাতি (মিসরে প্রস্তুতকৃত এক ধরণের সাদা কাপড়) পরতে নিষেধ করতেন। লোকেরা বললো, এই কাপড়ে তো ত্বক দেখা যায় না। তিনি বললেন, ‘ত্বক দেখা না গেলেও দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ফুটে ওঠে।’ (মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা, হাদিস : ২৫২৮৮)
তবে টাইট ও মিহি পোশাক একান্তভাবে স্বামীর সামনে পরতে পারবে একজন নারী।
নিউ মডেল বা ফ্যাশনের জামা-কাপড় পরিধান করা তখনই বৈধ হবে, যখন তা পর্দার কাজ দেবে এবং তাতে কোনো হিরো-হিরোইন বা কাফেরদের অনুকরণ না হবে। হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস (রা.) বলেন, নবী করিম (সা.) আমাকে ‘উসফুর’ (ছোট ধরণের লাল বর্ণের ফুল) দ্বারা রাঙানো দুটি কাপড় পরতে দেখে বললেন, ‘এগুলো হচ্ছে কাফেরদের পোশাক। অতএব তুমি তা পরিধান করবে না।’ (মুসলিম, হাদিস : ২০৭৭)
প্যান্ট-শার্ট যদিও টাইটফিট না হয় তবুও তা পরা মুসলিম নারীর জন্য জায়েজ নেই। কারণ, প্যান্ট-শার্ট হলো পুরুষের পোশাক। আর পুরুষের বেশ ধারিণী নারী অভিশপ্ত।
হজরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, নারীর পোশাক পরিধানকারী পুরুষকে এবং পুরুষের পোশাক পরিধানকারিনী নারীকে রাসুলুল্লাহ (সা.) লানত করেছেন।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৪০৯২)
অতিরিক্ত উঁচু সরু হিল তোলা জুতা ব্যবহার জায়েজ নয়। কারণ এগুলো পরে চলাচল করলে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষিত হয় ও তাদের কু-রিপুকে প্রলুব্ধ করে। তাছাড়া এসব জুতা পরলে চলাফেরায় সমস্যা হয়। অনেক সময় পড়ে যাওয়ার আশংকাও থাকে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তারা যেনো নিজেদের ভূষণ প্রকাশ না করে।’ (সুরা নুর : ৩১)
নারীদের চুলে বেণী বা জুঁটি গেঁথে মাথা বাঁধা উত্তম। খোঁপা বা লোটন মাথার উপরে বাঁধা জায়েজ নেই। পেছন দিকে কাপড়ের ওপর থেকে যদি খোঁপার উচ্চতা ও আকার নজরে আসে তাহলে তাও জায়েজ নেই। চুল বেশি বা লম্বার আন্দাজ যেনো পরপুরুষ না করতে পারে, সেদিকে লক্ষ্য রাখা নারীর কর্তব্য। কারণ, নারীর সুকেশ এক সৌন্দর্য; যা পরপুরুষের সামনে প্রকাশ করা হারাম।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘শেষ জামানার আমার উম্মতের মধ্যে কিছু এমন লোক হবে যাদের মহিলারা হবে অর্ধ নগ্না। তাদের মাথা কৃশ (খোঁপা) উঁটের কুঁজের মত হবে। তোমরা তাদেরকে অভিশাপ করো, কারণ তারা অভিশপ্ত।’
চুল বেশি দেখানোর উদ্দেশ্যে কৃত্রিম চুল বা পরচুলা ব্যবহার করা হারাম। স্বামী চাইলেও তা মাথায় লাগানো যাবে না। হজরত ইবনে ওমর (রা.) হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) অভিসম্পাত করেছেন ওইসব মহিলার ওপর, যারা পরচুলা লাগিয়ে দেয় এবং যে পরচুলা লাগাতে বলে।’ (বুখারি, হাদিস : ৫৯৩৭)
সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য মহিলারা কালো খেজাব ছাড়া অন্যান্য খেজাব দিয়ে চুল রাঙাতে পারে। ফ্যাশনের জন্যে চুল ছোট ছোট করে কাটা বৈধ নয়। তবে চুলের অগ্রভাগ এলোমেলো হলে সামান্য কাটতে পারে। কিন্তু না কাটাই উত্তম। কেননা, অধিক চুল নারীর সৌন্দর্য।
স্বামী চাইলেও কপালের পশম চাঁছা বা ভ্রু প্লাগ করা জায়েজ নেই। কেননা, এর দ্বারা আল্লাহর সৃষ্টিতে পরিবর্তন করা হয়, যার অনুমতি ইসলামে নেই। এমনিভাবে মুখে বা হাতে সুঁই ফুটিয়ে নকশা আঁকা বা ট্যাটু করা বৈধ নয়। হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, ‘আল্লাহর অভিশাপ বর্ষিত হোক ওই নারীর উপর, যারা দেহাঙ্গে উল্কি উৎকীর্ণ করে এবং যারা করায়, যারা ভ্রু চেঁছে সরু (প্লাক) করে ও যারা সৌন্দর্যের মানসে দাঁতের মাঝে ফাঁক সৃষ্টি করে এবং যারা আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যে পরিবর্তন আনে।’ (বুখারি, হাদিস : ৪৮৮৬)
পুরুষের দাড়ি-মোচের মতো মহিলার গালে বা ঠোঁটের ওপর লোম থাকলে তা তুলতে দোষ নেই। কারণ, বিকৃত অঙ্গে স্বাভাবিক শ্রী ফিরিয়ে আনার অনুমতি শরীয়ত দিয়েছে।
মহিলার নাক-কান ফুড়িয়ে তাতে কোনো অলঙ্কার ব্যবহারের ব্যাপারে ইসলামে বৈধতা রয়েছে। এমনিভাবে গলায় হার বা পায়ে নূপুর পরাও বৈধ। তবে যদি নূপুরে বাজনা থাকে তাহলে ঘরের বাইরে পরপুরুষের সামনে তা পরে হাঁটাচলা করা জায়েজ নেই।
স্বামীর দৃষ্টি ও মন আকর্ষণের জন্য সরাসরি হারাম বস্তু ও ক্ষতিকর পদার্থমুক্ত লিপিস্টিক, মেকআপ, স্নো, পাউডার প্রভৃতি অঙ্গরাজ ব্যবহার বৈধ। স্বামীর জন্য নিজেকে সর্বদা সুরভিত করে রাখায় নারীত্বের এক আনন্দ আছে। এজন্য স্বামীর কাছে যাওয়ার পূর্বে এলকোহল ও হারাম স্পিরিটমুক্ত সেন্ট-পারফিউম ব্যবহার নারীর জন্য জায়েজ।
নখে নেইলপালিশ ব্যবহার জায়েজ। তবে ওযুর পূর্বে তা তুলে ফেলা আবশ্যক। না তুললে ওযু হবে না। এটি ব্যবহারের উত্তম সময় হল মাসিকের দিনগুলো। কেননা তখন ওজু-গোসল করতে হয় না।
মেয়েদের হাত-পা ও নখ সর্বদা মেহেদি দিয়ে রাঙিয়ে রাখা উত্তম। কেননা এতে স্বামীর মনোরঞ্জনে তৃপ্তি আসে। আর ওজু-গোসলের সময় তা কষ্ট করে তুলে ফেলার ঝামেলাও নেই। কারণ, নেইলপালিশের মতো এতে কোনো আবরণ নেই।
হাত-পায়ের নখ বড় রাখা বিজাতীয়দের স্বভাব ও একটি ঘৃণিত কাজ। অনেক সময় নখের ভেতর ময়লা জমে খাবারের সময় পেটে যাওয়ার আশংকা থাকে। তাই প্রতি সপ্তাহে হাত-পায়ের নখ কাটা সুন্নত।
দাঁত ঘষে ফাঁক করা ও চিরনদাঁতির রূপ আনা জায়েজ নেই। অবশ্য কোনো দাঁত অস্বাভাবিক ও অশোভনীয়ভাবে বাঁকা বা অতিরিক্ত থাকলে তা সোজা করা বা তুলে ফেলা বৈধ।
কোনো বিকৃত অঙ্গে সৌন্দর্য আনয়নের জন্য অপারেশন বৈধ। এমনিভাবে অতিরিক্ত আঙ্গুল বা মাংস হাতে বা দেহের কোনো অঙ্গে লটকে থাকলে তা কেটে ফেলা জায়েজ। কিন্তু ত্রুটিহীন অঙ্গে অধিক সৌন্দর্য আনয়নের উদ্দেশ্যে অস্ত্রোপচার করা জায়েজ নয়।
মনে রাখতে হবে, সৌন্দর্য বর্ধনের যেসব উপকরণের ব্যবহার ইসলামে বৈধতা রয়েছে, তা অপচয় করা কিংবা মহিলা মহলে তা নিয়ে পরস্পরে গর্ব করা জায়েজ নেই। কেননা রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা যা ইচ্ছা খাও, পান করো ও পরিধান করো। তবে যেন তাতে দু’টি জিনিস না থাকে; অপচয় ও গর্ব।’ (বুখারি :১০/১৫২)
অন্যত্র হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি দুনিয়াতে সুখ্যাতি ও প্রদর্শনীর পোশাক পরবে আল্লাহ তাআলা কেয়ামতের দিন তাকে লাঞ্ছনার পোশাক পরাবেন।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ৬২৪৫)
Check Also
রাসুলুল্লার হিজরাত : প্রাসঙ্গিক ভাবনা
পৃথিবীতে তখন ঘোর অমানিশার রাজ। চারিদিকে বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্যের দৃঢ় ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। যে ভিন্নতার জন্য …