ছাহেব কিবলাহ ফুলতলী র.’র রাজনৈতিক জীবন

রাজনীতি বা পলিটিক্স কোন নিন্দনীয় কাজ নয়, কিন্তু আমাদের সমাজে এমন অনেক মানুষ আছেন যারা রাজনীতিকে নিন্দনীয় কাজ বলে মনে করেন। তথাকথিত রাজনীতিবিদরা রাজনীতিকে পছন্দ করলেও আলেম উলামা বা ইসলাম পন্থীরা রাজনৈতিক অঙ্গনে নেতৃত্বের আসনে সমাসীন হোক তা তারা কোনভাবে মেনে নিতে রাজি নন। দীর্ঘদিন পাশ্চাত্যের পরাধীনতা এবং ত্রুটিপূর্ণ ইসলামী জ্ঞানের কারণে অনেক ধর্মভীরু দ্বীনদার মানুষেরাও রাজনীতিকে হারাম ঘোষণা করেছেন। অথচ আল্লাহর প্রিয় হাবিব হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার পুরো জিন্দেগী ইসলামকে সমাজ-রাষ্ট্রে, তথা মানুষের জীবনে প্রতিষ্ঠার জন্য আত্মনিয়োগ করে গেছেন। পৃথিবীতে তিনি নিছক কোন ধর্ম প্রচারক হিসেবে আবির্ভূত হননি, নবী মুহাম্মদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মিশন ছিল দুনিয়াতে এক বিরাট সংস্কারমূলক আন্দোলন। এটি মূলত একাধারে আধ্যাত্মিক, নৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে ব্যাপক ও সর্বাত্মক আন্দোলন। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন বিশ্বের জন্য বিশেষ করে মুসলিম জাহানের জন্য উসওয়াতুন হাসানা। তিনি ছিলেন পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ, একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক, সংগঠক এবং সমাজ সংস্কারক। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আদর্শের প্রতীক ছিলেন বিংশ শতাব্দীর মুজাদ্দিদ মুরশিদে বরহক্ব আল্লামা ছাহেব কিবলাহ ফুলতলী রহ.। আদর্শহীন স্বার্থবাদী রাজনীতির প্রতি তার অনীহা থাকলেও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রদর্শিত রাজনীতি থেকে তিনি কখনো মুখ ফিরিয়ে নেননি! রাসুলে আরাবীর প্রদর্শিত রাজনীতিতে ছাহেব কিবলাহ ফুলতলী রহ. সবসময়ই ছিলেন সোচ্চার।
রাজনৈতিক জীবনে শামসুল উলামা আল্লামা ছাহেব ক্বিবলাহ ফুলতলী রহ. ছিলেন আপোসহীন এক বীর। ভোগ-বিলাস কিংবা ক্ষমতার রাজনীতিতে তিনি বিশ্বাসী ছিলেন না। তাইতো তার জীবনে বেশ কয়েকবার মন্ত্রিত্বের প্রস্তাব আসলেও তিনি তা অনায়াসে প্রত্যাখ্যান করেন। মন্ত্রীত্ব লাভের পর ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিভিন্ন সময় সরকারের অধীনস্থ লোকেরা সাধারণ মানুষের অধিকার কিভাবে নষ্ট করেছে তিনি তা প্রত্যক্ষ করেছেন, আর সে কারণেই তিনি বলতেন ক্ষমতা চাই না। ক্ষমতার বাইরে থেকেও তিনি জনগণের মৌলিক অধিকার আদায়ে যে সংগ্রাম করে গিয়েছেন তার জন্য জনগণের হৃদয়ে আজো আপন মহিমায় সমাসীন। তার রাজনীতি ছিল একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে, ইসলাম, সাধারণ মানুষ এবং শিক্ষার স্বার্থে। ব্রিটিশ খেদাও আন্দোলনে তিনি মরণপণ সংগ্রাম করেছেন। ব্রিটিশ রাজ্যের শোষণের বিরুদ্ধে মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার্থে জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ এর নেতৃত্বে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। পরবর্তীতে যখন জানতে পারেন জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ সম্পূর্ণভাবে কংগ্রেস কর্তৃক প্রভাবিত তখনই তিনি ঘোষণা দিয়ে জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ ত্যাগ করেন। আন্দোলন করতে গিয়ে তাঁকে বারবার মসনদে আসীন জালিমদের চক্ষুশূলে পরিণত হতে হয়েছে। ১৯৫০ সালে আসাম প্রদেশিক সরকার মুসলিম এডুকেশন বোর্ড বন্ধের ঘোষণা করলে বদরপুরে অবস্থিত আল্লামা ছাহেব কিবলাহ ফুলতলী রহ. বাতিলের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেন, তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলেন। প্রতিবাদ, আন্দোলন করতে গিয়ে প্রদেশিক সরকারের রোষানলে পতিত হন। সরকার তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে। তাকে গ্রেফতার না করতে পেরে সরাসরি গুলির নির্দেশও জারি করে। এত কিছুর পরেও তিনি আত্মগোপনে না গিয়ে সরকারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বিভিন্ন সভা সমাবেশে জ্বালাময়ী বক্তব্য দিতে থাকেন। আন্দোলনের তীব্রতায় সরকার নমনীয় হতে বাধ্য হয় ।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় নীতিগতভাবে দেশ বিভক্তির পক্ষে ছিলেননা, কিন্তু পরোক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিকামী নির্যাতিত মানুষের পক্ষে ছিলেন, মুক্তিযুদ্ধে ছাহেব কিবলাহ ফুলতলী রহ. এর ভূমিকা কেমন ছিল সে সম্পর্কে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল এম এ জি ওসমানীর একটি উক্তিতে পরিস্কার ধারণা পাওয়া যায়। জেনারেল এম এ জি ওসমানী বলেন-উনি (ছাহেব কিবলাহ) যদি সে সময় সিলেটে না থাকতেন তাহলে হাজার হাজার লাশ নদীতে ভাসতো (সূত্র: দৈনিক যুগান্তর ১২ ফেব্র“য়ারি ২০০০)। তাঁহার এলাকায় হিন্দু জনবসতি বেশি ছিল, মুক্তিযুদ্ধের সময় ছাহেব কিবলাহ জাতি, ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে সবার জন্য ছিলেন রক্ষাকবচ! পাক হানাদার বাহিনীর হাত থেকে নিরীহ মানুষের জান মাল ইজ্জত আব্র“ রক্ষার্থে তার সাহায্য ও সহযোগিতার হাত ছিল প্রসারিত। বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকদের নিরাপত্তা রক্ষার্থে ছাহেব কিবলাহর ভুমিকা ছিল খুবই উজ্জ্বল। সাবেক চেয়ারম্যান মানিকপুর ও আওয়ামীলীগ নেতা প্রয়াত শ্রী জগনানন্দ পুরকায়স্থ এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্যতম নেতা শ্রী মনোরঞ্জন বিশ্বাস প্রমুখের বিভিন্ন সমাবেশের বক্তব্যে ছাহেব কিবলার সেই অবদানের কথা বারবার উচ্চারিত হয়েছে ।

১৯৮৮ সালে সালমান রুশদী, ১৯৯৪ সালে তসলিমা নাসরীন সহ কুখ্যাত নাস্তিক মুরতাদদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আন্দোলনে ছাহেব কিবলাহ ফুলতলী রাহ. ছিলেন সোচ্চার। ছাহেব কিবলাহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। ১৯৯২ সালে ভারতে বাবরী মসজিদ ভাঙার প্রতিবাদে তাঁর ভুমিকা ছিল খুবই বলিষ্ঠ ও সোচ্চার, সিলেট আলীয়ার মাঠে তাঁর সেই হুঙ্কার বজ্র নিনাদের মত আজো কানে বাজে।
২০০০ সালে সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের হল নামকরণ বিরোধী আন্দোলনে ছাহেব কিবলার নেতৃত্বে সফল আন্দোলনের কথা সিলেটের ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা পরম শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ রাখবে। ২০০১ সালে আদালত কর্তৃক ফতোয়া নিষিদ্ধকরণ এর রায়, তৎকালীন সরকারের সময় মাদ্রাসা শিক্ষার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র, ডক্টর কুদরত ই খুদা শিক্ষা ব্যবস্থা বাস্তবায়ন এবং দেশব্যাপী সিরিজ বোমা, বিশেষ করে সুলতানে সিলেট শাহজালাল মুজাররদে ইয়ামনী রহ.-এর মাজার প্রাঙ্গণে বোমা হামলার বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন ও সংগ্রামে তিনি ছিলেন অত্যন্ত সক্রিয় নির্ভিক এক বীর যোদ্ধা। তাঁর সেই আপোসহীন ভূমিকার কথা দেশবাসী কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ রাখবে ।
২০০৬ সালে স্বতন্ত্র আরবী বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন এবং ফাযিল ও কামিলকে যথাক্রমে বিএ এবং মাস্টার্সের মান প্রদানের দাবীতে ১৫ সেপ্টেম্বর ঢাকার উদ্দেশ্যে যে লংমার্চ করেন তা বাংলাদেশের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
তাঁর সেই আপোসহীন আন্দোলনের ফলশ্র“তিতে ২০১৩ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর ‘ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয় বিল-২০১৩’ মহান জাতীয় সংসদে সর্বসম্মতিক্রমে পাস করে ২০১৫ সালে এসে এর কার্যক্রম শুরু করে এবং গত ২৩ আগষ্ট ২০১৫ বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে শিক্ষামন্ত্রী মহোদয় ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রমের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন।
আল্লামা ছাহেব কিবলাহ ফুলতলী রাহ. বিশ্ব মুসলিমের জন্যেও আন্দোলন করেছেন। ইরাকে মার্কিন হামলার প্রতিবাদে ৬ মার্চ ২০০৩ সালে ঢাকার পল্টন ময়দানে যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনের মহাসমাবেশ করেন। এছাড়া কাশ্মীর, ফিলিস্তিন, আফগানিস্তান, বসনিয়া, চেচনিয়া, কসবো সহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নির্যাতিত, নিরীহ মুসলমানদের নির্যাতনের প্রতিবাদে আন্দোলন সংগ্রামে তার ভূমিকা ছিল খুবই উজ্জ্বল। তার সাহসিকতার কথা, আপোসহীন আন্দোলনের কথা যুগে যুগে সত্যের পথে প্রতিবাদী মানুষকে প্রেরণা ও সাহস যোগাবে।
মুরশিদে বরহক্ব আল্লামা ছাহেব কিবলাহ ফুলতলী রহ. এর বর্ণাঢ্য ও গৌরবময় সংগ্রামী জীবন আমাদের জন্য যেন প্রেরণার উৎস হয়, আমরা যেন বাতিলের কাছে কখনো মাথা নত না করি এই কামনা মাওলার দরবারে সতত।
পরিশেষে, কবির ভাষায় বলতে হয়-
যে আন্দেলনের সূচনা তুমি করে গেছো,
যে মানযিলের পথ আমাদের দেখিয়ে গেছো,
আমরা সে পথ ছাড়বো না,
এ আন্দোলন থামবে না, কথা দিলাম ॥

Comments

comments

About

Check Also

রাসুলুল্লার হিজরাত : প্রাসঙ্গিক ভাবনা

পৃথিবীতে তখন ঘোর অমানিশার রাজ। চারিদিকে বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্যের দৃঢ় ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। যে ভিন্নতার জন্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *