কুরবানি : আত্মসমর্পণ ও আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের একটি বড় মাধ্যম

বনের পশু নহে মনের পশুর
হোক আজ কুরবানি
রক্তের বন্যায় ভেসে যাক
অন্যায়, অবিচার গ্লানি।
সমর্পিত আতœা সত্যের পথে
হোক আজ ক্ষত
কুরবানি হোক জ্ঞান পাপীদের
হিংস্র জীর্ণতা যত।
পাপের তরূ চূর্ণ হয়ে আসুক
আত্মশুদ্ধির পালা।
কলুষিত হৃদে জ্বলে উঠুক
ভ্রাতৃত্বের ফুল মালা।
কুরবানি হলো আত্মত্যাগ, ভ্রাতৃত্ব সৌহার্দ্য, সাম্য, মৈত্রী, সম্প্রীতি, ভালবাসা, সহমর্মিতা, সহানুভূতি ও আত্মত্যাগের বিনিময়ে মহান আল্লাহ তালার নৈকট্য লাভের অন্যতম মাধ্যম। কুরবানি বা ঝধপৎরভরপব ঈমানদারদের (বিশ্বাসী) জীবনের এক তাৎপর্যপূর্ণ গৌরবের উৎস এবং অনন্য ইবাদত। মুসলিম মিল্লাতের পিতা হযরত ইবরাহিম আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তার একান্ত অনুগত পুত্র হযরত ইসমাঈল আলাইহি ওয়া সাল্লামের আত্মত্যাগের স্মৃতি বিজড়িত ইবাদত ও মহান রবের নৈকট্য লাভের অনুষ্ঠান-ই হলো কুরবানি। মহান স্রষ্টা আল্লাহর প্রতি অবিচল আস্থা-বিশ্বাস ও জীবনের সর্বস্ব উৎসর্গের মাধ্যমে তার নৈকট্য লাভের বার্তা নিয়ে এ দিনটি প্রতিটি বছর মুসলিম জাতির নিকট উপস্থিত হয়। তাই মুসলিম জাতিকে বুঝতে হবে কুরবানির আসল উদ্দেশ্য কি?
কুরবানি শব্দের শাব্দিক ও আভিধানিক অর্থ : আরবি ‘কুরবান’ শব্দটি উর্দু বা ফারসিতে ‘কুরবানি’ রূপে রূপান্তরিত হয়েছে। যার অর্থ সান্নিধ্য, নৈকট্য। আর ‘কুরবান’ শব্দটি ‘কুরবাতুন’ শব্দ থেকে নির্গত। আরবি ‘কুরবান’ ও ‘কুরবাতুন’ উভয় শব্দের শাব্দিক অর্থ সান্নিধ্য লাভ করা, নিকটবর্তী হওয়া, নৈকট্য লাভ করা, রক্ত প্রবাহিত করা, ত্যাগ স্বীকার করা, উৎসর্গ করা ইত্যাদি। ইসলামী শরিয়ার পরিভাষায় কুরবানি ঐ মাধ্যমকে বলা হয়, যার দ্বারা আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য অর্জন ও তার ইবাদতের জন্য হালাল কোন জন্তু যবেহ করা হয়। (মুফরাদাত লি ইমাম রাগিব, আল-কামুসূল মুহিত)
মহাগ্রন্থ কোরআনুল কারিমে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেন:
আল্লাহর নিকট পৌঁছায় না তাদের মাংস এবং রক্ত; বরং পৌঁছায় তোমাদের তাকওয়া। এভাবে তিনি এগুলোকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন যাতে তোমরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা কর এজন্য যে, তিনি তোমাদের পথ-প্রদর্শন করেছেন; সুতরাং আপনি সুসংবাদ দিন সৎকর্ম পালনকারীদের। (সুরা আল হাজ্ব : ৩৭)

পশু কুরবানি করা হবে কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেন:
অর্থ: বল আমার সালাত (নামাজ), আমার কুরবানি, আমার জীবন ও মরণ বিশ্বজাহানের প্রতিপালক কেবল আল্লাহর জন্য। তার কোন অংশিদার নেই এবং আমি এর জন্য আদিষ্ট হয়েছি। আর আমিই প্রথম মুসলিম। (সূরা আল আনআম: ১৪২-১৪৩)
ইমাম আবু হানীফা, ইমাম আওযায়ী, ইমাম লাইস, রাহিমাহুল্লাহ্ আলাইহিম প্রমুখের মতে সামর্থবানদের জন্য কুরবানি করা ওয়াজিব। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তার নবীকে কুরবানি করতে নির্দেশ দিয়েছেন। বলেছেন- ‘আপনি আপনার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় করুন ও কুরবানি করুণ।’ (সূরা কাওসার : ২)
কুরবানির প্রচলন ও প্রাক ইতিহাস: বর্তমান পদ্ধতির কুরবানির সূচনা নবী হযরত ইবরাহীম আলাইহিস্ সালাম স্বীয় পুত্র ইসমাঈল আলাইহিস সালামকে কুরবানি করার পরীক্ষা থেকে হলেও এর ইতিহাস মানব সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকেই লক্ষ্য করা যায়। কুরবানির প্রথম ঘটনাটি ঘটে মানবজাতির পিতা হযরত আদম আলাইহিস্ সালাম এর স্বীয় দুই পুত্র হাবিল ও কাবিলের মাধ্যমে। কোরআন শরীফে ঘটনাটির বর্ণনা এভাবে এসেছে ‘‘আদমের দুই পুত্রের বৃত্তান্ত তুমি তাদেরকে যথাযথভাবে শুনিয়ে দাও, যখন তারা উভয়ে কুরবানি করেছিল, তখন একজনের কুরবানি কবুল হলো এবং অন্যজনের কুরবানি কবুল হলো না। তাদের একজন বলল, আমি তোমাকে অবশ্যই হত্যা করব। অপরজন বললো, আল্লাহ তো মুত্তাক্বী (পরহেযগার ও সংযমী) দের কুরবানীই কবূল করে থাকেন। (সুরা মায়েদা:২৭)
কুরআনে বর্ণিত হাবিল ও কাবিল কর্তৃক সম্পাদিত কুরবানির ঘটনা থেকেই মূলত কুরবানির ইতিহাস গোড়াপত্তন হয়েছে। সেই তখন থেকেই মানবজাতির জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে যত শরীয়ত নাযিল হয়েছে, প্রত্যেক শরীয়তের মধ্যে কুরবানি করার বিধান জারি ছিল। আল্লাহ বলেন, ‘‘প্রত্যেক উম্মতের জন্য আমি কুরবানির বিধান রেখেছিলাম (সুরা হজ্জ:৩৪) ।
এই আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লামা নাসাফী ও জামাখসারী বলেন, “হযরত আদম আলাইহিস্ সালাম থেকে নিয়ে হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পর্যন্ত প্রত্যেক নবী ও রাসুলদের উম্মতকে আল্লাহ তালা তার নৈকট্য লাভের জন্য কুরবানির বিধান দিয়েছেন। (তাফসীরে নাসাফী ৩/৭৯, তাফসীরে কাশশাফ ২/৩৩)।
মহান আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক যুগে যুগে প্রেরিত অসংখ্য নবী রাসুলকে কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়েছে। নিঃসন্দেহে নবী রাসুলগণ তাদের পরীক্ষায় চরম ধৈর্যের পরীক্ষা দিয়ে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করেছিলেন । কিন্তু তাদের মধ্যে ইবরাহিম আলাইহিস্ সালাম কুরবানির পরীক্ষায় সর্বোচ্চ ধৈর্য্য ও ত্যাগের পরিচয় দিয়ে কৃতকার্য হয়েছিলেন এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভ করেছিলেন। এ সম্পর্কে কুরআনুল করিমে ইরশাদ হচ্ছে ‘‘যখন ইবরাহিম আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে তাঁর পালনকর্তা কয়েকটি বিষয়ে পরীক্ষা করলেন, অতপর তিনি তা পূর্ণ করলেন, তখন তিনি বললেন, আমি তোমাকে মানব জাতির নেতা বানিয়ে দিলাম।’’ (সুরা বাকারাহ: ১২৪)
ইবরাহিম আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কুরবানি প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে ‘‘দুজনেই যখন আনুগত্যে মাথা নুইয়ে দিল আর ইবরাহিম আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে (ইসমাইল) কাত করে শুইয়ে দিল। তখন আমি তাকে ডেকে বললাম, হে ইবরাহিম! তুমিতো স্বপ্নকে সত্য প্রমাণিত করে দেখালে। এভাবেই আমি সৎ কর্মশীলদের প্রতিদান দিয়ে থাকি। অবশ্যই এটা ছিল একটি সুস্পষ্ট পরীক্ষা। আমি এক মহান কুরবানির বিনিময়ে পুত্রকে ছাড়িয়ে নিলাম। আর আমি তাকে পরবর্তীদের মাঝে স্মরণীয় করে রাখলাম।’’ (সূরা সাফ্ফাত -১০৩-১০৮)।
কুরবানির মুল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য : কুরবানির দু’ধরনের উদ্দেশ্য রয়েছে। জাগতিক ও স্বর্গীয় । স্বর্গীয় উদ্দেশ্য হল মহান আল্লাহর নির্দেশ প্রতিপালন ও তার নৈকট্য লাভ। মুসলিম জাতির পিতা ইবরাহিম আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব নবীদের সর্দার মোহাম্মদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাতকে সমুন্নত রাখা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন ‘‘যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কুরবানি করে না সে যেন আমাদের ঈদগাহের ধারে না আসে। (ইবনে মাজাহ)।
কুরবানি দাতা জবাইকৃত পশুর রক্ত প্রবাহিত করার মাধ্যমে মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভ করে থাকে। কুরআন শরীফে আল্লাহ বলেন, ‘‘আল্লাহর নিকট ওদের গোশত-রক্ত পৌঁছায় না। বরং পৌঁছায় তোমাদের তাকওয়া বা খোদাভীতি।’’ (সূরা হজ্জ-৩৭)।
সুতরাং আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সন্তুষ্টি লাভ, ত্যাগের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ এবং প্রত্যোকের ভিতরে লালিত পশু-প্রবৃত্তিকে দমন করে তাকওয়া অর্জনই হলো কুরবানির মূল লক্ষ্য।
কুরবানির জাগতিক উদ্দেশ্য হল: পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী, গরীব-মিসকিন, অভাবীদের আনন্দ দান, নিজে কুরবানির গোশত খাওয়া ও স্বজনদেরকে গোশত খাওয়ানোর ব্যবস্থা করা। কুরআন শরীফে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেন, ‘‘যাতে ওরা ওদের কল্যাণ লাভ করে এবং নির্দিষ্ট দিনগুলোতে আল্লাহর নাম স্মরণ করে তার দেয়া পশুগুলো যবেহ করার সময়। অতপর তোমরা তা থেকে আহার কর এবং দুস্থ-অভাবীদের আহার করাও।’’ (সূরা হজ্জ-২৮)
হযরত ইবরাহিম আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর কলিজার টুকরা প্রিয় সন্তান ইসমাঈল আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে কুরবানির পরীক্ষা দেয়ার মাধ্যমে যে সুমহান দৃষ্টান্ত স্থাপন করে ঈমানী অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে মানব জাতিকে আত্মত্যাগের শিক্ষা দিয়ে গেছেন, সে আদর্শ ও প্রেরণায় আমরা আমাদের জীবনকে ঈমানী আলোয় উদ্ভাসিত করব, এটাই কুরবানির মৌলিক শিক্ষা। ত্যাগ ছাড়া কখনোই কল্যাণকর কিছুই অর্জন করা যায় না। মহান ত্যাগের মধ্যেই রয়েছে অফুরন্ত প্রশান্তি। ত্যাগ ছাড়া কখনোই কল্যাণকর কিছুই অর্জন করা যায় না। কুরবানি আরও শিক্ষা দেয় যে, দুনিয়াবী সকল মিথ্যাচার, অনাচার, অবিচার, অত্যাচার, জুলুম, নির্যাতন, হানাহানি, স্বার্থপরতা, দাম্ভিকতা, অহমিকা, লোভ-লালসা ত্যাগ করে পৃথিবীতে শান্তি ও সাম্যের পতাকা সমুন্নত রাখতে। পশু কুরবানি মূলত নিজের কু-প্রবৃত্তিকে কুরবানি করার প্রতীক। কুরবানি আমাদেরকে সকল প্রকার লোভ-লালসা, পার্থিব স্বার্থপরতা, ইন্দ্রিয় কামনা-বাসনা হতে মুক্ত ও পবিত্র হয়ে মহান রবের প্রতি নিবেদিত বান্দা হওয়ার প্রেরণা যোগায় এবং সত্য ও হকের পক্ষে আত্মোৎসর্গ করতে অনুপ্রাণিত করে। কুরবানির সার্থকতা এখানেই। তাই পশু গলায় খঞ্জর চালানোর সাথে সাথে যাবতীয় পাপ-পঙ্কিলতা, হিংসা-বিদ্বেষ, ক্রোধ, পরনিন্দা-পরচর্চা, পরশ্রীকাতরতা, সংকীর্ণতা, গর্ব-অহংকার, কৃপণতার মত পশুসুলভ আচরণের কেন্দ্রমূলে ছুরি চালাতে হবে। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে, প্রতিটি পদক্ষেপ, প্রতিটি মুহূর্তে মহান রবের আনুগত্য ও ভীতির দ্বিধাহীন শপথ গ্রহণ করতে হবে। তাহলেই কুরবানি হবে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের অন্যতম মাধ্যম ।

Comments

comments

About

Check Also

রাসুলুল্লার হিজরাত : প্রাসঙ্গিক ভাবনা

পৃথিবীতে তখন ঘোর অমানিশার রাজ। চারিদিকে বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্যের দৃঢ় ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। যে ভিন্নতার জন্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *