আলিম সমাজের কাছে জাতির প্রত্যাশা

শিরোনামের উল্লেখিত ‘আলিম’ এবং ‘জাতি’ শব্দদ্বয়ের সংজ্ঞা জানার প্রয়োজনবোধ করছি। আলিম শব্দটি আরবি। এটা কর্তৃবাচকে একবচনের শব্দ। অর্থ জ্ঞানী। ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায় যিনি পবিত্র কুরআন হাদীসের জ্ঞানার্জন করেন এবং এগুলো থেকে নির্গত বিধি-বিধান বুঝার জন্য আনুষঙ্গিক জ্ঞান আহরণকারী বা যিনি ইসলামী শরীয়াত সম্পর্কে জ্ঞাত তিনিই আলিম। আর আলিমগণের সমষ্টিই আলিম সমাজ।
বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত ‘জাতি’ শব্দটির ইংরেজি প্রতিশব্দ হল ঘধঃরড়হ. এর উৎপত্তি হয়েছে ল্যাটিন শব্দ ঘধঃরড় বা ঘধঃঁং থেকে। যার আভিধানিক অর্থ বংশ, জন্ম। পৌরবিজ্ঞানের পরিভাষায় জাতির অনেক সংজ্ঞা পরিলক্ষিত হয়। সবচেয়ে প্রামাণিক সংজ্ঞা অধ্যাপক ম্যাকাইভার’র ভাষায়, একত্রে বসবাস করতে ইচ্ছুক, সম্প্রদায়গত মনোভাবের অধিকারী একটি জনসমাজ যখন নিজেরাই শাসনব্যবস্থার মালিক হতে কামনা করে, তখন তাকে জাতি বলে। অন্যভাবে বলা যায়, কোনো নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে বসবাসকারী জনসমষ্টি, যারা ধর্ম, ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য প্রভৃতি অথবা কোনো এক বা একাধিক ঐক্যের বন্ধনে আবদ্ধ ও জাতীয়তাবোধের প্রতি উদ্বুদ্ধ হয়ে রাজনৈতিক সংগঠনের মাধ্যমে স্বাধীন বা স্বাধীনতা লাভের চেষ্টা করে, তারা একটি জাতিকে পরিণত হয়।

জেনে রাখা দরকার, আলিম সমাজ আবার দু’প্রকার-সৎ আর অসৎ। এ ব্যাপারে হজরত আহওয়াস বিন হাকিম (রাদ্বি.) থেকে বর্ণিত, রাসূলে মকবুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ ফরমান, ‘সাবধান! খারাপের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অসৎ আলিমগণ! আর উত্তমের মধ্যে সর্বাধিক উত্তম সৎ আলিমগণ।’ (মিশকাতুল মাসাবিহ : পৃষ্ঠা-৩৭)
সৎ বা হক্কানী আলিমগণের উপমায় হজরত আনাস ইবনে মালিক (রাদ্বি.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রহমতে আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন ‘ভূপৃষ্ঠে অবস্থিত আলিমের উপমা হল আকাশে অবস্থিত নক্ষত্রের ন্যায়। নক্ষত্রের মাধ্যমে (নাবিকরা) জলে ও (সাধারণ মানুষ) স্থলে পথ চিহ্নিত করার কাজ নেয়। অতএব নক্ষত্রগুলো যদি ডুবে যায় তাহলে খুব শীঘ্রই পথের দিশাপ্রার্থী লোকদের বিভ্রান্তি ঘটবে।’ (ইমাম আহমদ : আল মুসনাদ, ৩য় খণ্ড পৃষ্ঠা-৩৭)
সঙ্গত কারণেই উপরিউক্ত আলিম সমাজের কাছে জাতির প্রত্যাশা অনেক। কারণ আলিমগণ নবীগণের ওয়ারিস। মুমিন মুসলমান হিসেবে দ্বীনের প্রয়োজনে মানুষ আলিমগণের শরণাপন্ন হয়। আলিম সমাজের কাছে জাতির প্রত্যাশাকে আমরা কয়েকটি দিকে আলোচনায় আনতে পারি।
১. ধর্মীয় দিক : ইসলামের পঞ্চস্তম্ভ ঈমান, নামাজ, রোজা, হজ্জ, যাকাত সম্পর্কীয় সঠিক বিধি-বিধান আলিমরাই জাতির কাছে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করবেন। নামাজ রোজা যেভাবে মুমিন মুসলমানের উপর ফরজ তেমনি সামর্থ্য থাকলে হজ্জ আদায় করা সাহেবে নেসাব হলে যাকাত প্রদানও ফরজ, এটা মানুষদেরকে ওয়াজ মাহফিলে, সভাসমিতিতে, বক্তৃতায় ও ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় বুঝানোর দায়িত্ব আলিম সমাজের উপর বর্তায়। ধর্মের খুঁটিনাটি বিষয় কুরআন সুন্নাহ ইজমা ক্বিয়াসের আলোকে প্রকাশ ও প্রচার করবেন আলিম সমাজ।

ইসলাম ধর্মের মৌলিকত্ব, ইসলাম ধর্মের সৌন্দর্য, ইসলাম যে শান্তির ধর্ম, মানবতার ধর্ম জাতি আলিম সমাজের কাছে এর সুস্পষ্ট বক্তব্য প্রত্যাশা করে সর্বক্ষেত্রে সর্বদায়। মানুষের ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে জাতীয় জীবন পর্যন্ত সকল সমস্যার সমাধানে আলিম সমাজ কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে পারেন। এর জ্বলন্ত প্রমাণ, কয়েক বছর পূর্বে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশে ‘জেএমবি’ নামক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সদস্যরা যখন দেশের আনাচে কানাচে সিরিজ বোমা হামলা করে মানুষ হত্যা ও সরকারি সম্পদ নষ্ট করেছিল। তখন দেশের হক্কানী আলিম সমাজ মসজিদ মাদরাসায়, সভা সেমিনারে, তাদের লেখনিতে প্রকৃত জিহাদ ও ইসলামের নামে বোমাবাজীর পার্থক্য তুলে ধরেন। যার ফলে অল্পদিনের মধ্যেই জাতি বোমাবাজদের সম্পূর্ণ রূপে প্রত্যাখ্যান করে। আলিম সমাজের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় জাতি বুঝতে পেরেছে তথাকথিত বোমাবাজদের আসল মতলব আর ইসলামের স্বরূপ।
বাংলাদেশের মানুষ ধর্মপ্রাণ। ধর্মের উপর আঘাত এলে আলিম সমাজের ডাকে এখনও মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে মুহূর্তের মধ্যে। তাই আলিম সমাজের উচিত অন্তত ইসলামের মৌলিক বিষয়ে নিজেরাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে জাতিকে এ দিকে আহ্বান করা।
২. সামাজিক দিক : মূলত আলিম সমাজই জাতির আশা আকাক্সক্ষার আশ্রয়স্থল, এটা দিবালোকের ন্যায় সুস্পষ্ট। একজন মুসলিম নবজাত শিশু যখন ভূপৃষ্ঠে পদার্পণ করে, তখনই আলিম তার ডান কানে আজান বাম কানে ইকামত দিয়ে থাকেন। শিশুর নাম রাখা থেকে শুরু করে আকিকার পশু জবাই, বিসমিল্লাখানী, মসজিদ মকতবে পাঠদান, নামাজ কালাম শিখানো, অন্যান্য শিক্ষাদীক্ষা, বিবাহে খুতবা পাঠ, মুমূর্ষ অবস্থায় কালিমার তালকিন, মৃতের জানাজা, কাফন দাফন এমনকি শেষ দোয়া পর্যন্ত সমাজের সকল ভালোকাজে আলিমগণের সরব পদচারণা লক্ষণীয়। বিশ্বের সর্বকালের সেরা বিজ্ঞানী হজরত মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উত্তম আদর্শ সমাজের সর্বস্তরে বাস্তবায়ন করতে পারেন একমাত্র আলিমগণ। সমাজ থেকে সকল অপসংস্কৃতি আর দুর্নীতি দূর করার দায়িত্ব গ্রহণ করতে পারেন সৎ আলিম সমাজ, এটা জাতির প্রত্যাশা, এজন্য আলিম সমাজকে পরিপূর্ণরূপে নায়িবে নবী হিসেবে সমাজে আত্মপ্রকাশ করা জাতির অপরিহার্য দাবি।
৩. রাজনৈতিক দিক : ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। ব্যক্তি জীবন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের সকল কর্মকাণ্ডের বাস্তবসম্মত সমাধান রয়েছে ইসলামে। রাজনীতির মধ্যে ইসলাম নয়, বরং ইসলামের ভেতরে রাজনীতি আছে। তবে তা হতে হবে ‘খেলাফত আলা মিন্হাজিন্ নবুওয়াত’ এর আদলে। তথাকথিত মানব রচিত গণতন্ত্রের নামে ইসলামকে কলুষিত করা আলিম সমাজের উচিত নয়। ইসলামের নিজস্ব গণতন্ত্র রয়েছে। তার চর্চা করতে হবে। ইসলাম এবং মুসলমানি বিসর্জন দিয়ে নারী নেতৃত্ব জায়িজ করে মানব রচিত গণতান্ত্রিক চাদরে আশ্রয় নেওয়া মদীনার ইসলাম সমর্থন করে না।
জাতি এখনও চায় আলিম সমাজ আজ রাজনীতি করুক খোলাফায়ে রাশিদুন’র অনুসরণ অনুকরণে ঐক্যবদ্ধ হয়ে। যারা রাজনীতি করবেন না, তাদের কাছেও জাতির প্রত্যাশা কোন অংশে কম নয়। নিজ নিজ অবস্থানে থেকেও ইসলাম, মুসলমান এবং সমাজের খেদমতে নিজেকে নিয়োজিত রাখতে পারেন। এ প্রসঙ্গে মরহুম আল্লামা শামছুল হক ফরিদপুরী বলেন, ‘যে সকল আলিম পলিটিক্যল কোন জমাতেই (দলে) দাখিল হবে না, তারাও বেকার থাকবেন না; তারা বরং এর চেয়েও বড় এবং সঠিক প্রয়োজনীয় কাজে নিজেকে লিপ্ত রাখবেন। সে বড় কাজ এবং অধিক প্রয়োজনীয় কাজ হল সমগ্র মুসলিম সমাজকে এবং সমগ্র মানব সমাজকে জাগ্রত করে আল্লাহর দিকে এবং আল্লাহর সত্য ধর্মের দিকে আহ্বান করা।’
যবানিকায় বলা যায়, ইসলাম যেমন সর্বকালের, সর্বযুগের, সর্বজনীন; আলিম সমাজের কাছে জাতির প্রত্যাশাও তেমন সর্বকালীন।

Comments

comments

About

Check Also

রাসুলুল্লার হিজরাত : প্রাসঙ্গিক ভাবনা

পৃথিবীতে তখন ঘোর অমানিশার রাজ। চারিদিকে বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্যের দৃঢ় ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। যে ভিন্নতার জন্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *