আল মাহমুদের চির বিদায় এবং অতি প্রগতিবাদ ও আমাদের চেতনা

প্রযুক্তির বিকাশের যুগে বাংলা সাহিত্য জগতের তারকা এবং অন্যতম প্রধান কবি আল মাহমুদ গত শুক্রবার ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ সালে ৮২ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। কবি আল মাহমুদ আধুনিক বাংলার একজন বহুমাত্রিক শক্তিমান কবি। আধুনিক বাংলা কবিতাকে নতুন আঙ্গিকে, চেতনা ও বাকভঙ্গিতে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করেছেন আল মাহমুদ। তিনি কবিতা, গল্প, উপন্যাস দুই হাতে লিখলেও সবকিছুকে ছাড়িয়ে তাঁর কবি খ্যাতিটি উৎরে গেছে। ১৯৬৩ সালে প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘লোক লোকান্তর’ সর্বপ্রথম তাকে অগ্রগণ্য কবিদের সারিতে জায়গা করে দেয়। এরপর কালের কলস, সোনালী কাবিন, মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো, প্রহরান্তরের পাশ ফেরা, আরব্য রজনীর রাজহাঁস, মিথ্যেবাদী রাখাল, আমি দূরগামী, দ্বিতীয় ভাঙন, নদীর ভেতরে নদী, বখতিয়ারের ঘোড়া, উড়াল কাব্য ইত্যাদি কাব্যগ্রন্থগুলো তাকে প্রথম সারির কবি হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত করে। তবে ‘সোনালী কাবিন’ কাব্য গ্রন্থটি তাঁকে খ্যাতির শীর্ষে পৌছে দিয়েছে! গ্রন্থটি তথাকথিত নাস্তিক্যবাদীদের কাছে আলাদিনের প্রদীপের শিখা অনির্বাণ ছিল, কবিতা গ্রন্থে নরীর নগ্নতা ও মার্কসবাদ যেমন ফুটে উঠেছে তেমনি গ্রামের জীবন, মায়ের প্রতি ভালাবাসা সহ গ্রাম বাংলার চমৎকার চিত্র প্রকাশ পেয়েছে। তবে গ্রাম বাংলা সম্পর্কে তার লেখাগুলো পাঠককে সহজেই কাছে টানতে পেরেছিল। কবিতা, গল্প ও উপন্যাসে গ্রামের লোকজ উপাদানের অনবদ্য বর্ণনা তাঁকে করে তুলেছিল কিংবদন্তী। নাস্তিক্যবাদী লেখকরা তাই তাকে মাথার মুকুট করে রেখেছিল । আমরা জানি আল মাহমুদ প্রথম জীবনে অনেকটা সংশয়বাদী, বামপন্থী, মার্কসীয় চিন্তা-চেতনার ধারক ছিলেন। ধীরে ধীরে তাঁর বিশ্বাসে আমুল পরিবর্তন ঘটতে থাকে। একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা কবি আল মাহমুদ দেশ স্বাধীন হবার পর বাংলাদেশে ফিরে তৎকালীন সরকারের বিরোধিতার কারণে কারারুদ্ধ হন এবং এ কারাবাসকালেই কোরআন শরীফের সংস্পর্শে এসে তাঁর জীবনে এবং বিশ্বাসে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনটি ঘটে। কথাটি কবি আল মাহমুদ তাঁর নিজের ভাষায় এভাবেই প্রকাশ করেন: “আমি ইসলাম গ্রহণ করেছি জীবনের একটি আলৌকিক কিন্তু প্রাকৃতিক নিয়ম হিসেবে। মার্কসবাদ সম্পর্কে বীতশ্রদ্ধ হয়ে । কবির আত্মবিশ্বাস: আল মাহমুদ রচনাবলী তৃতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৮৬)।
কবি অন্যত্র বলেন, ‘আমি মার্কসীয় দ্বান্দ্বিক তত্ত্ব, মানবজাতির শ্রম ও অর্থনৈতিক ইতিহাসের বিস্ময়কর ব্যাখ্যা, শ্রেণীদ্বন্দ্ব ও পুঁজিগঠনের দুঃসাহসিক বর্ণনার সাথে সাথে উদ্বৃত্ত পুঁজির কেন্দ্রীভূত হওয়ার গূঢ় কারণসমূহের পঠনপাঠন একদা গভীর অভিনিবেশ সহকারে পাঠ করেছিলাম বলেই পবিত্র কোরআন হৃদয়ঙ্গম করা সহজ হয়েছে। (আল মাহমুদ রচনাবলী, ঐতিহ্য প্রকাশনী)
আল মাহমুদ দৃঢ় প্রত্যয়ের সাথে আরো বলেন, “নাস্তিকতার ওপর মানবতা দাঁড়াতে পারে না, পারবে না।” ( মাহমুদ : কবির আত্মবিশ্বাস, পৃষ্ঠা ১৮)।
কবি আল মাহমুদ যখন জীবনের মোড় ঘুরিয়ে একত্ববাদের প্রতি, আধ্যাত্মিকতার বলয়ে যাত্রা শুরু করে বখতিয়ারের ঘোড়া সহ অন্যান্য গ্রন্থে আস্তিকতার কথা কলমের তুলিতে আঁকতে শুরু করেন, তখনই নাস্তিক্যবাদীদের ওপর বজ্রপাত পড়ে। তারা তার এই পরিবর্তন সহ্য করতে পারেনি!! নেকড়ে বাঘের মতো হিংস্র হয়ে ওঠে, তাকে তথাকথিত স্বাধীনতা বিরোধী একটি ইসলাম পন্থী দলের লেভেল লাগিয়ে অপপ্রচারের মাধ্যমে অপদস্থ করতে থাকে! কবি তার জীবদ্দশায় অনেকবার এই সম্পর্কে আফসোস করেছেন। কবি আল মাহমুদ বলেন আমি কোনো দিন এবং অতীতেও জামায়াতপন্থি ছিলাম না। এরাই আমাকে জামায়াত বানিয়েছে এবং যারা বানিয়েছে, তারা তো দৈত্য বানিয়েছে। এখন দৈত্য তারা সামাল দিতে পারে না। জামাতি কাউকে আমি চিনতামই না। কিন্তু আমার যারা ক্ষতি করতে চেয়েছিল তারা কিন্তু নাই। আমি আছি, কারণ আমি তো সাহিত্য করি। আমি কবিতা লিখি, গল্প উপন্যাস লিখি, আমাকে তো গুলি করে মারা যায় না। গুলি করে মারলেও আমি সাহিত্যে থাকব। না মারলেও থাকব।


কবি আল মাহমুদকে তথাকথিত ইসলাম বিদ্বেষী নাস্তিক লেখক বুদ্ধিপাগলরা যথাযথ সম্মান প্রদর্শন না করলেও মহান স্রষ্টা তাকে সম্মানীত করেছেন! তার আকুতি কবুল করেছেন ।
শুক্রবারে মৃত্যুর আকাংখা ছিল কবি আল মাহমুদের; হয়েছেও তাই! আল্লাহ কবির ইচ্ছা পূর্ণ করেছেন।
‘স্মৃতির মেঘলাভোরে’ নামক একটি কবিতায় কবি ইচ্ছার প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন। ওই কবিতায় তিনি লিখেছিলেন:
কোনো এক ভোরবেলা, রাত্রিশেষে শুভ শুক্রবারে
মৃত্যুর ফেরেস্তা এসে যদি দেয় যাওয়ার তাকিদ;
অপ্রস্তুত এলোমেলো এ গৃহের আলো অন্ধকারে
ভালোমন্দ যা ঘটুক মেনে নেবো এ আমার ঈদ।
আলহামদুলিল্লাহ। শুক্রবারেই মৃত্যুর ফেরেস্তা এসে তাকে ডাক দিলে তিনি খুশি মনেই তার ডাকে সাড়া দিয়ে মাওলায়ে হাক্বিকীর কাছে এ পৃথিবী ছেড়ে চলে যান।
আমার দৃষ্টিতে কবি আল মাহমুদ ছিলেন কবি শামসুর রাহমানের চেয়েও অনেক উচু মার্গের কবি!! কারণ আল মাহমুদের কবিতার ভাষায় ধারণ করেছিলেন, স্রষ্টা এবং তার অনুপম সৃষ্টি! অবহেলিত গ্রাম, নদী, পাহাড়, পর্বত, দেশ, নগর থেকে শুরু করে পুরো বৈশ্বিক পরিসর। অন্যদিকে, শামসুর রাহমান নিতান্তই একজন নাগরিক কবি ছিলেন, যার কবিতার ভাষা একটা সীমাবদ্ধতার মধ্যে ছিল! শামসুর রাহমান প্রধানত নগরসমাজ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণিকেই ঘিরেই আবর্তিত হয়েছিলেন। আমার স্পষ্ট মনে আছে, শামসুর রাহমানের মৃত্যুর পর শহীদ মিনারে নিয়ে যাওয়া হয় তার কফিন, ফুলেল শ্রদ্ধা জানানোর জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়েন উভয় বাংলার তথাকথিত বুদ্ধিজীবী, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও কবিরা। তার মৃত্যু সংবাদ ও জানাযা নিয়ে আমাদের প্রতিটি জাতীয় দৈনিকের প্রথম পাতায় বিশাল জায়গাজুড়ে ছিল লিড প্রতিবেদন।
সত্যি বলতে কি এই সব ধর্ম বিদ্বেষী মিডিয়া আল মাহমুদকে শামসুর রাহমানের মতো আয়োজন করে সম্মান প্রদর্শন করেনি!!
শুক্রবার (১৫ ফেব্র“য়ারি ২০১৯) রাতে আল মাহমুদের মৃত্যুর পরদিন বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি প্রধান জাতীয় দৈনিকের প্রথম পাতা খোঁজে দেখলাম। নাহ, আল মাহমুদকে তারা পারেনি শামসুর রাহমানের মতো সম্মান প্রদর্শন করতে!! এর একটাই কারণ: শামসুর রাহমান ব্যক্তি হিসেবে তথাকথিত প্রগতিশীল সেকুলার ছিলেন; কিন্তু আল মাহমুদ পরিবর্তিত হয়ে একজন বিশ্বাসী ধার্মিক কবি হয়ে উঠেছিলেন। আল মাহমুদের এই পরিবর্তন তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা মেনে নিতে পারেনি! তাই হলুদ মিডিয়ার মাধ্যমে আল মাহমুদকে তারা একজন মৌলবাদী বা প্রতিক্রিয়াশীল ব্যক্তি হিসেবে ট্যাগ দিয়ে মূলধারা থেকে কাবু করে রেখেছিল বছরের পর বছর।
পরিতাপের বিষয় হলো: কবি আল মাহমুদের সাথে আমাদের মিডিয়া যতটা আচরণ করেছে কবি হিসেবে, তারচেয়েও বেশি করেছে ব্যক্তি হিসেবে। আল মাহমুদের ক্ষেত্রে তারা নিরপেক্ষ থাকতে পারলো না। আল মাহমুদকে অন্তত একজন মহান কবি হিসেবে তারা যথাযথ মর্যাদা ও সম্মান জানাতে পারেনি। এটা তাদের ব্যর্থতা ও দৈন্যতা!
মৃত্যুর পর তথাকথিত মিডিয়ার মাধ্যম ছাড়াই জনগণের অকৃত্রিম ভালবাসায় আল মাহমুদ যেভাবে ধ্বনিত ও অনুভূত হয়েছেন, প্রকৃতপক্ষে সেটাই আল মাহমুদের আসল প্রাপ্তি ও বিজয়!

আল মাহমুদ একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। জীবন বাজি রেখে দেশকে স্বাধীন করেছেন। ভাষা সৈনিক ছিলেন! কিন্তু তথাকথিত মুক্তিযুদ্ধ ও ভাষার চেতনাধারী ধর্ম বিদ্বেষী হিংসুকরা আবারো প্রমাণ করল বাংলাদেশের প্রগতিশীল সেকুলাররা আসলে ফ্যাসিস্ট মিডিয়াতেই কৃত্রিমভাবে বেঁচে থাকে, জনগণের হৃদয়ে তারা জায়গা করে নিতে ব্যর্থ।

তথ্য সুত্র:
(১) আল মাহমুদ রচনাবলী, ঐতিহ্য প্রকাশনী, ২০০২।
(২) দৈনিক ইনকিলাব, সংগ্রাম

Comments

comments

About

Check Also

রাসুলুল্লার হিজরাত : প্রাসঙ্গিক ভাবনা

পৃথিবীতে তখন ঘোর অমানিশার রাজ। চারিদিকে বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্যের দৃঢ় ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। যে ভিন্নতার জন্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *