বাবা-মায়ের দোয়া

প্রতিদিনের মতো স্কুল থেকে বাসায় ফিরেন জোবায়ের ইকবাল। শহরের একটি বেসরকারি স্কুলের ইংরেজি বিষয়ের সহকারী শিক্ষক। শিক্ষার্থীদের ভালোবেসে মন দিয়ে পড়ান। স্কুলের সব শিক্ষার্থীর পছন্দের শিক্ষক তিনিই। প্রথমদিকে ব্যাচেলর থাকাকালীন প্রাইভেট-টিউশনিতে মন দেননি। তখন স্কুল থেকে যা পেতেন তা দিয়ে নিজে কোনমতে চলে বাড়িতে বাবা-মা’র জন্য বাকী টাকা পাঠাতেন।
কিন্তু নতুন করে সংসার সাজানোর পর নূন্যতম বেতনে হিমশিম খেতে হয় তাকে। এরপর স্কুল থেকে ফিরে প্রাইভেট-টিউশনিতে ব্যস্ত সময় পার করেন তিনি। প্রায়ই স্কুলের পর দুপুরে পড়াতে ইচ্ছে করে না তার। তবুও সুন্দর বেঁচে থাকার অভিযোজনিক খেলায় মাততে হয় তাকে।
স্ত্রীর হাতে ব্যাগটা দিয়ে তিনি সোফায় বসে চোখ বন্ধ করে ভাবছেন। ইতোমধ্যে মাসের দশ তারিখ হয়ে গেছে। এখনও বাড়িতে কোন টাকা পাঠানো হয়নি। বাবা-মা, ভাই-বোনেরা কী খাচ্ছেন! কিভাবে তাঁদের দিন কাটছে! ইত্যাদি ভাবতে ভাবতে তার চোখের কোণ জলে ভিজে যায়। এরপর প্যান্টের পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে বাবাকে রিং দেন তিনি,
-হ্যালো! আসসালামু আলাইকুম।
-কেমন আছো, বাবা?
-আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি। আপনারা কেমন আছেন? বেশ কিছুদিন হয়ে গেলো বাড়িতে টাকা দিতে পারিনি। নিশ্চয় আমার ওপর আপনাদের খুব রাগ হচ্ছে। কিন্তু কী করবো? স্কুল থেকে যে বেতন পেয়েছি তা দিয়ে বাসা ভাড়া আর খোকার স্কুলের বেতন দিতেই প্রায় শেষ।
-তোমার কোচিং-এর কী খবর?
-আপাতত বন্ধ করে রেখেছি। সরকারী নির্দেশ।
একটা কথা কোনভাবে মাথায় আসে না। স্কুল ছুটির পর শিক্ষকরা প্রাইভেট-টিউশনি করলে জাতির অমঙ্গল কোথায়? বরং শিক্ষিত ও উন্নত মেধা সম্পন্ন জাতি গড়ে ওঠে। অথচ আইন করে তা বন্ধ করতে চাচ্ছেন সরকার। এখন কি করবো বুঝতে পারছি না।
-থাক, ওসব নিয়ে কোন চিন্তা করো না। আমরা কোনমতে চলতে পারবো। তোমার কিছু হয়ে গেলে তো আমাদের সব শেষ হয়ে যাবে।
-দোয়া করো, বাবা। ভাবছি কয়েকদিন পর আবার প্রাইভেট শুরু করবো। কপালে যা আছে তা হবে। কিন্তু এভাবে আর চলা যাবে না। এতদিন পর মনে হচ্ছে শিক্ষকতা পেশায় আসাটা বড় ভুল ছিল। একজন ডাক্তার তার অফিসের সময়ের পর চেম্বারে রোগী দেখে বাড়তি রোজগার করতে পারেন। একজন ব্যবসায়ী দিনরাত ব্যবসার কাজে ব্যস্ত থাকতে পারেন। রাজনীতিবিদ রাজনীতির পাশাপাশি ব্যবসা-বাণিজ্যে জড়িত থাকতে পারেন। তাতে কোন সমস্যা হয় না! কিন্তু শিক্ষক প্রাইভেট টিউশনি করলে বড় অপরাধ হয়ে যায়!
-অধৈর্য্য হয়ো না। দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে। কেউ না কেউ এ নিয়ে ভাববে।
-একজন শিক্ষক কত টাকা বেতন পায়? এ টাকা দিয়ে কী তার সংসার খরচ চলে? এ নিয়ে কারোর কোন মাথা ব্যথা নেই।
কেউ কেউ ভাবছেন, প্রাইভেট টিউশনি বন্ধ হলে রাতারাতি সব ঠিক হয়ে যাবে। তুমি কী মনে করো, বাবা?
-উল্টো শিক্ষা ব্যবস্থা মার খেতে পারে। মেধাবীরা এই পেশায় ভবিষ্যতে নাও আসতে পারে। তাছাড়া আমার মনে হয় মেধাবী শিক্ষকরা শিক্ষকতার পাশাপাশি শিক্ষাভিন্ন অন্যান্য পেশায় জড়িয়েও যেতে পারে।
-হ্যাঁ, বাবা, তুমি একদম ঠিক কথা বলেছো। আমি নিজেও তাই ভাবছি। এখন তো সারাক্ষণ শিক্ষা কার্যক্রম নিয়ে ব্যস্ত থাকি। তখন হয়তো স্কুল থেকে ফিরে অন্য কোন কাজে মন দিতে হবে। বেঁচে থাকার জন্য এ ছাড়া হয়তো আর কোন উপায় থাকবে না।
-ওসব ভেবো না। আমরা আল্লাহর কাছে তোমার মঙ্গলের জন্য নামাজ পড়ে দোয়া করি। ইনশাল্লাহ সব ঠিক হয়ে যাবে।
-তাই যেন হয় বাবা। তুমি বাজারের দিকে যাও। আমি কিছু টাকা বিকাশ করছি।
-না থাক, এখন তোমার সমস্যা চলছে। তোমার চলতেও তো সমস্যা হচ্ছে। হাতে টাকা এলে পরে দিয়ো।
জোবায়ের ইকবাল কাঁদো গলায় বললেন,
-বাবা, আমার মতো শিক্ষিত জোয়ান ছেলে থাকতে তোমরা না খেয়ে থাকবে। এ কী হয়! তোমরা শুধু আমার জন্য দোয়া করো।
এই কথা বলে জোবায়ের ইকবাল বাবার কাছে বিকাশে টাকা পাঠানোর জন্য দোকানে চলে আসেন। মানিব্যাগে হাত দিয়ে দেখেন সাড়ে সাত হাজার টাকা আছে। তিনি সাত হাজার টাকা খরচসহ বিকাশ করেন। এরপর বাসায় এসে আনমনে ভাবছেন-
পকেটে আর মাত্র তিনশ’ ষাট টাকা আছে। এ টাকা দিয়ে আরো পনেরো দিনের মতো চলতে হবে।
এরিমধ্যে তার মোবাইলে কল আসে। কল রিসিভ করে শার্টটা গায়ে জড়িয়ে আবার ঘর থেকে বের হন তিনি।
তার ব্যাচের স্টুডেন্ট মিরাজের বাবা তার সাথে দেখা করতে এসেছেন। তিনি সালাম দিয়ে জোবায়ের ইকবালের হাতে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে নম্র গলায় বললেন,
-স্যার, এই টাকাগুলো রাখুন। আমি লজ্জিত। গত এক বছরে আপনাকে কোন টাকা দিতে পারিনি। আপনার মতো শিক্ষক না পেলে হয়তো আমার মিরাজের পড়াশুনা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হতো না।
-এ আপনি কি কথা বলছেন? মিরাজ ভালো ছেলে। পড়াশুনায় ভালো। আমি শুধু ওকে পড়িয়েছি।
-স্যার, আমরা মূর্খ মানুষ। সারাদিন গার্মেন্টসে পড়ে থাকি। ছেলের পড়াশুনায় কোন সহায়তা করতে পারি না। আমাদের মিরাজ তো সারাক্ষণ আপনার কথা বলে।
-আপনাকেও অশেষ ধন্যবাদ। এত কষ্ট করছেন। তবু সন্তানের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য দিনরাত চিন্তা করছেন। কয়জনে তা পারে?
এরপর মিরাজের বাবা বিদায় নিয়ে চলে যান।
জোবায়ের ইকবাল টাকাগুলো পেয়ে খুব খুশি হন। মনে মনে ভাবতে থাকেন- আল্লাহর এ কি খেলা! কিছুক্ষণ আগেও আমি আর্থিক অনটনে ছিলাম। যা ছিল তা বাবা-মা’র জন্য পাঠিয়ে দিয়েছি। ভেবেছিলাম নিশ্চিতভাবে অভাব-অনটনে কাটবে আমার সামনের কিছুদিন। কিন্তু সামান্য সময়ের ব্যবধানে আমার অবস্থান পাল্টে গেলো। মিরাজের বাবা গত এক বছরে কোন বেতন দেননি। আজ আমার দুর্দিনে তিনি এসে বেতন দিলেন। এ নিশ্চয় আমার বাবা-মা’র দোয়ার বরকত। সত্যি, বাবা-মাকে দিলে আল্লাহও খুশি হন। আর আল্লাহ যার ওপর খুশি হন তার জীবন তো সার্থক।

Comments

comments

About

Check Also

রাসুলুল্লার হিজরাত : প্রাসঙ্গিক ভাবনা

পৃথিবীতে তখন ঘোর অমানিশার রাজ। চারিদিকে বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্যের দৃঢ় ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। যে ভিন্নতার জন্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *