- আপা একটু বসতে পারি? আমার সি-২।
- ও আচ্ছা ।
কিছুটা বিরক্তির সাথে একটু সরে গিয়ে বোরখা পরিহিতা একজন মহিলাকে বসার জায়গা করে দিলেন মিসেস আজিজ। আঁড় চোখে প্রচন্ড বিরক্তির সাথে একবার তাকালেন আপাদমস্তক বোরখায় আচ্ছাদিত মহিলাটির দিকে। মিসেস আজিজ পড়লেন মহা বিপাকে। পর্দানশীল কোন মহিলার পাশে থাকলে সাধারণ মহিলারা যে ফ্যাসাদে পড়ে যান। মন না চাইলেও সেই পর্দানশীল ভদ্র মহিলার সাথে নিজের ভদ্রতার তাল মিলাতে গিয়ে নিজেকেও কিছুক্ষণের জন্য হলেও ভদ্র সেজে থাকতে হয়। ধর্মীয় কারণে নয় সৌজন্যের খাতিরে নিজের মেলে ধরা শরীরটাকে জড়োসড়ো করে রাখতে হয়। আজান হলে মাথার উপর আঁচল উঠাতে হয়। আরও কত কি! যা মিসেস আজিজের একদম পছন্দ নয়। তারপরও কি আর করা।
মিসেস আজিজ নিজের পড়ে থাকা আঁচলটা পিঠের উপর দিয়ে আঁচলটা মাথার কাছাকাছি এনে রাখলেন। দুই জনই নীরব। নীরবতার মুহূর্ত ভেঙে বোরখা পরা মহিলা শাহানারা বেগম মিসেস আজিজের উদ্দেশ্যে বললেন - বিরামপুর থেকে উঠেছেন বুঝি?
-হ্যাঁ আপনি ভাদুরিয়া থেকে?
কথা বলতে ইচ্ছে না করলেও সৌজন্যের খতিরে তার প্রশ্নের সাথে তাল মিলিয়ে বললেন মাত্র।
-হ্যাঁ। কোথায় যাচ্ছেন আপা?
-আমি মেয়ের কাছে যাচ্ছি। আপনি?
-আমিও মেয়ের কাছেই যাচ্ছি। ঢাকা ভার্সিটি। - তাই! অপনার মেয়ে ঢাকা ভার্সিটিতে পড়ে? কোন সাবজেক্টে?
কিছুটা বিস্ময়ের সাথে শাহানারা বেগমের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন মিসেস আজিজ। – কেমিস্ট্রি।
উত্তর শুনে মিসেস আজিজের চোখ ছানাবড়া। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন এই আপাদমস্তক বোরখায় আচ্ছাদিত মহিলার মেয়ে! তাও আবার কেমিস্ট্রিতে! একটু নড়েসড়েও বসলেন যেনো। মিসেস আজিজ আবার প্রশ্ন করলেন
-আপার কয় ছেলে মেয়ে?
-দুই মেয়ে এক ছেলে। - আর দুটা কিসে পড়ে?
ছোট মেয়েটা ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে পড়ে। আর ছেলেটা এবার এস. এস. সি. দিল। ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ হয়ে বাসা ফিরবো ।
মিসেস আজিজ এবার আরো বিস্মিত হয়ে গেলেন। এক মেয়ে ঢাকা ভার্সিটিতে কেমিস্ট্রিতে পড়ে, আর একজন মেডিকেল কলেজে ! বোরখা পরা মহিলারা তো সাধারণত গোড়া টাইপের হয়। মেয়েদের, শুধু মেয়েদের কি; ছেলেদেরও বাড়ির বাইরে পাঠাতে চায়না পড়া-শুনার জন্য। আর তিনি কিনা মেয়েকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়েছেন পড়াশুনার জন্য !
-আচ্ছা আপা আপনি মেয়েকে বাইরে পড়তে পাঠিয়েছেন, আপনার ভয় লাগেনি? মেয়ে যদি নষ্ট হয়ে যায়? খারাপ বন্ধু-বান্ধবের পাল্লায় পড়ে যায়নি? আমার মেয়েটাতো…।
কি যেনো বলতে গিয়ে থেমে গেলেন মিসেস আজিজ।
-না আপা আল্লাহর রহমতে সে অনেক ভালো আছে। নষ্ট হয়ে যায় নি তো এ পর্যন্ত।
-আমার মেয়েটা নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে বি.বি.এ. করছে। হঠাৎ মেয়েটার মাথায় কি যে চাপলো। এক মাস থেকে মেয়েটার কোনো…।
আবারও থেমে গেলেন মিসেস আজিজ ।
-কেন আপা অসুস্থ বুঝি? - হ্যাঁ তা তো একটু ।
-মেয়ে আপনাকে যেতে বলেছে না? আমার মেয়েটা একটু অসুস্থ হলেই সংসারের কাজ-কাম সব ফেলে আমাকে ওর কাছে ছুটে যেতে হয়। এই বুড়া বয়সেও হলে কাটাতে হয়। অবশ্য খারাপ লাগে না। পঁচিশ বছর আগের জীবনটাকে ফিরে পাই যেন । - কেন আগে হলে ছিলেন বুঝি?
- হ্যা রাজশাহী ভার্সিটিতে যখন পড়তাম তখনতো হলেই ছিলাম। খালেদা জিয়া হলে ছিলাম ।
এবার যেনো আরও থমকে গেলেন মিসেস আজিজ। ভার্সিটির স্টুডেন্ট এই মহিলা। অবশ্য মহিলার কথা-বার্তায় বেশ স্মার্ট ভাব আছে । এ রকম সংসার সন্তান নিয়ে বিভিন্ন গল্প করতে করতে শাহানারা বেগম ও মিসেস আজিজ বেশ কাছের মানুষ হয়ে উঠলেন। কথা বলতে বলতে আচমকা মিসেস আজিজ শাহানারা বেগমকে বলে ফেললেন
-আচ্ছা আপা আপনার মেয়েদের কোথাও সম্পর্ক নেই?- সম্পর্ক?
-না মানে, তারা কোন ছেলের সাথে ইনগেজ কিনা? - যতদুর জানি তারা কেউই ইনগেজ না। তারপরও আমি মাঝে মাঝে ওদের ভেতর থেকে টেকনিক্যালি কথা বের করার চেষ্টা করি। মনে হয় এখনও পর্যন্ত সেরকম কোন ঝামেলায় পড়ে নি ।
-আমার মেয়েটা তো ইনগেজ হয়েই হারিয়ে গেল ।
-হারিয়ে গেল মানে? - হ্যাঁ আপা। একটা নেশাখোর ছেলের পাল্লায় পড়ে মেয়েটা আমার নষ্ট হয়ে গেছে। গত মাসে ছেলেটার সাথে পালিয়ে গেছে। কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না ওদের। থানায় জিডিও করা হয়েছে। আর এর ভেতরই আবার আমার একমাত্র ছেলেটা তার হেরোইন খাওয়ার টাকা যোগাড় করতে বাপের মটর সাইকেলটা বিক্রি করেছে গতকাল। কি যে করি আপা? কোন তাল পাচ্ছি না। ছেলে মেয়ে দুইটাই শেষ হয়ে গেল। একটাকেও মানুষ করতে পারলাম না আপা।
মিসেস আজিজের চোখ বেয়ে ঝরে পড়ছে অশ্রু। রুমালে চোখের জল মুছতে মুছতে তিনি বললেন
-মাঝে মাঝে লজ্জায় আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে করে আপা। কি অপরাধ করেছি? আল্লাহ আমাকে এভাবে শাস্তি দিচ্ছেন?
-আপা ! এতো ভেঙে পড়বেন না। সব ঠিক হয়ে যাবে ইনশাল্লাহ। আর এটা কোন শাস্তি নয় আপা। এটা দুনিয়াবাসীর জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে শিক্ষা মাত্র। ন্যায় ও সততার পথ থেকে সরে যাওয়ায় হাজার হাজার সুন্দর পরিবার এভাবে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে ।
শাহানারা বেগম মিসেস আজিজের মাথাটা অতি যতেœ আলতো করে নিজের কাঁধের উপর রেখে আস্তে আস্তে বললেন এসব কথা । - আপা এখন কি করবো আমি?
- এখন কি করবেন?
- কিছুক্ষণ নিরব থাকলেন শাহানারা বেগম। কন্ঠে আশ্বাসের সুর মাখিয়ে বললেন
-আল্লাহর কাছে দোয়া করবেন আপা। আল্লাহ চাইলে এখনও আপনার সংসার সুন্দর হয়ে উঠতে পারে। সন্তানদের কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করুন। তাদের প্রয়োজনগুলো বুঝার চেষ্টা করুন। আর যেকোন ধরণের সৎ ও সুন্দর কাজের জন্য সন্তানদের কোনভাবে বাধ্য করা উচিৎ নয়। বরং সেটা করলে তাদের কি কি উপকার হতে পারে; তারা কিভাবে সফল হতে পারে, তা বুঝানোর চেষ্টা করা দরকার। এতে তারা বাধ্য হয়ে নয়, বরং আপন খুশীতে সে সৎ পথে চলতে চায়। আর সবচেয়ে বড় কথা হল যে সুন্দর পথে বাবা-মা সন্তানদেরকে চলতে বলছে, সে পথে বাবা-মা চলছে কিনা তা কিন্তু সন্তানদের উপর বেশ প্রভাব ফেলে; কাজেই আগে বাবা-মাকে সেই পথে সঠিক ভাবে চলতে হবে ।
কিছুক্ষণ পরে ঢাকায় পৌছে গেল তাদের গাড়ি। সবাই নেমে পড়লো গাড়ি থেকে। মিসেস আজিজ তার শাড়ির আঁচলটা মাথায় তুলে নিলেন। ঠুনকো বাতাসের ঝাঁপটায় মিসেস আজিজের মাথার উপর থেকে যাতে শাড়ির আঁচলটা পড়ে না যায়; সে জন্য শাহানারা বেগম স্কার্ফের একটা সুন্দর ক্লিপ দিয়ে চুলের সাথে আটকে দিলেন তার আঁচলটা। শাহানারা বেগম মিসেস আজিজকে বিদায় জানিয়ে চলে গেলেন। আর এদিকে মিসেস আজিজও চলছেন তার গন্তব্যের দিকে ।
রাস্তার মানুষের বাজে দৃষ্টি তার দিকে চেয়ে নেই। দৃষ্টিগুলোতে যেন শ্রদ্ধার ঢল নেমেছে। সবাই যেনো অনেক শালীন হয়ে গেছে। দুপুরের প্রখর রৌদ্রে বাইরে বের হলে পিঠে ও মুখে অনেক তাপ লাগতো মিসেস আজিজের। আথচ আজ রৌদ্রও তার দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। মিসেস আজিজের দেহ ও মনে ছড়িয়ে পড়ছে প্রশান্তির আবহ।
Check Also
বিদায়বেলা
জামুরাইল হাই স্কুলের বাংলা শিক্ষক ইমরান হোসেন। প্রতিদিন সকাল ৯ টায় স্কুলে আসেন। যথারীতি তিনি …