শুদ্ধি

তানভীর আহম্মেদ তার স্ত্রী শিলা ও ছেলে সাফিন, বসুন্ধরা শপিং মল থেকে ঈদের মার্কেট করে বাসায় ফিরছিল।
সাফিন ক্লাস থ্রি-তে পড়ে। ছোট হলেও সাফিন বেশ বুদ্ধিমান ও চটপটে। ওর কাছে বাবা-মা উপস্থিত থাকলে ক্রমাগত প্রশ্ন করে করে হাঁপিয়ে তোলে আশেপাশের জিনিস ও বিষয়গুলো নিয়ে,এই যেমন:
এটা কী? এটা কেন ছোট হলো? বড় হলে কী সমস্যা হতো ইত্যাদি টাইপের প্রশ্ন তার মাথায় সবসময় ঘোরপাক খায় বিধায় তার প্রশ্ন চলতেই থাকে; আজ গাড়ির মধ্যেও তার ব্যত্যয় ঘটেনি।
শিলা ড্রাইভারকে হঠাৎ বললো, ‘ড্রাইভার সামনে একটু ফাঁকা জায়গা দেখে ফুটপাতের দোকানের কাছে গাড়িটা রাখবা তো।’
তানভীর অবাক হয়ে ভ্রুকুচকে, ‘কেনো তুমি আবার ফুটপাতের দোকানে কী করবা?’
-একটু দরকার আছে।
বলতে বলতে ড্রাইভার গাড়িটা থামাতেই শিলা গাড়ি থেকে নেমে গেল।
-বাপি, মাম্মি ওখানে কী কিনবে?
-জানি না বাবা
-চলনা বাপি আমরাও নামি। ও বাপি চলনা, চলনা বাপি চলনা চলনা… সাফিন এই চলনা চলনা করতে থাকে আর বাবার হাত ধরে টানতে থাকে। সাফিনের আবদারে ওকে নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে শিলার কাছে গেল তানভীর।
-তোমরা আবার এই ধূলাবালি আর গরমের মধ্যে নামতে গেলে কেন? শিলার প্রশ্ন।
-আরে সাফিন জিদ করছিল খুব একটু বিরক্তির ভঙ্গিতেই তানভীর শিলাকে বললো-শিলা কী কিনবা তুমি এখান থেকে?
-আরে তুমি বুঝছো না! আমাদের ঐ যে কাজের মেয়ে ময়না, ওকেও তো ঈদে কিছু দিতে হবে তাইনা, তাই ওর জন্যই একটি ড্রেস কিনতে নামলাম।
সাফিন চট করে বলে উঠল, ‘মাম্মি তুমি ময়না আপুর সাথে সাথে আমার জন্যও একটা ড্রেস কিনো তো।’ মা ছেলের মুখে এই কথা শুনে একেবারে চোখ পাকিয়ে-কী বল তুমি এসব সাফিন? তোমাকে না অত্তগুলো ড্রেস কিনে দিলাম শপিং মল থেকে।
-তবুও আমি এখান থেকে একটি ড্রেস নিব।
মা এবার প্রচণ্ড রেগে গিয়ে নাক ফুলিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে চোখ বড় বড় করে সাফিনের দিকে তাকিয়ে ধমকের সুরে বলে উঠলো, ‘সাফিন!’ সাফিনও বড্ড জেদি ছেলে হালকা ঠোঁট ফুলিয়ে কান্না ও রাগ মিশ্রিত কণ্ঠে জোরে মায়ের উদ্দেশ্যে বললো, ‘বেশি তো চাচ্ছি না,জাস্ট একটা ড্রেস চাচ্ছি তুমি অমন করতিছো কেনো?’
বাবা বললো, ‘সাফিন, প্লিজ বাবা তুমি জেদ করো না, আমি তোমাকে আরো ড্রেস কিনে দেব শপিং মল থেকে।
-না আমি এখান থেকেই নিবো।
মা বললো, ‘এখানকার সস্তা ড্রেস তুমি পরবা! বাবা-মা’য়ের কথা, বড়দের কথা তুমি মানো না কেনো?’
কাল রাতে তোমাকে কী পড়ালাম? বাবা-মা’য়ের কথা মেনে চলতে হয় সেটা পড়ালাম না?
-তোমরাই তো কোন কথা মেনে চলো না, তাহলে আমি মানবো কেন?
ছেলের মুখে এই কথা শুনে বাবা-মা দু’জনই হতবাক হয়ে পরস্পরের দিকে তাকাল, তারপর একত্রে বলে উঠলো, ‘মানে?’
-সব জায়গায় তো এই কথাগুলো লেখা থাকে, টিভিতেও বলে, আমি কার্টুনেও দেখেছি ওরাও বলেছে, পুওর পিপলকে ভালোবাসতে, নিজেরা যা খাবা তাদেরকেও তাই দিবা; কিন্তু আমি দেখেছি, আমরা যা খাই মাম্মি ময়না আপুকে সেগুলো খেতে দেয় না;ফ্রিজের সব পঁচা খাবারগুলো খেতে দেয়।
মাম্মি ময়না আপুকে সোফাতে বসতে দেয় না, ডাইনিংয়ে বসতে দেয় না; আমরা সবাই ডাইনিংয়ে বসে খাই আর ময়না আপু কিচেনের ফ্লোরে বসে খায়। আমরা বেডে ঘুমাই আর ময়না আপু সিঁড়ির ঐ সরু জায়গাটাতে ফ্লোরে ঘুমায়। আজকে আবার আমাদের ড্রেসগুলো শপিং মল থেকে কেনা হলো আর ময়না আপুরটা এখান থেকে। তাই আমি ঐ ড্রেসগুলো পরবো না, এখান থেকে কিনে দেওয়া ড্রেসটাই ঈদের দিন পরবো। তা না হলে পাপ হবে।
বাপি, তুমি আর মাম্মি ঐ যে সেদিন আট তলার আন্টিদের বাসায় গেলে না, আমি যে টিভি দেখছিলাম তখন ঐ যে একটা দাঁড়িওয়ালা হুজুর আছে না, সে বলেছে, গরীবদের ভালো না বাসলে পাপ হয়।
ছোট ছেলে সাফিন একটু থেমে, ভেবে, ঢোক চিপে কথাগুলো বলে দিল। পুরোটা যেন একটা ক্লাসরুমের লেকচারের মত।
তবে তার সাথে এখানটার পার্থক্য হলো, সেখানে যাদের শিক্ষা গ্রহণ করা প্রয়োজন তারাই নেয়, এবং যাঁদের দেওয়া দরকার তাঁরাই দেন। কিন্তু এখানে উল্টো চিত্র! কী আর করা–
বিবেক যখন নির্বাসনে থাকে তখন এমন চিত্রও দৃশ্যমান হওয়া অসম্ভব না কারণ চৈতন্য ফেরাটা তখন অত্যাবশ্যকীয় হয়ে পড়ে।
আর শিশুরা আমাদের অর্থাৎ বড়দের মত থিয়েটারের পাকা নট নয় সুতরাং তারা যেটা দেখে বা শোনে সেটাই অবশ্যই করণীয় ও মান্য বলে মনে করে।
কিন্তু সেই নিষ্পাপ হৃদয়গুলো যখন বই-মুখের নীতিকথা ও বাস্তবতার মধ্যে ব্যাপক বিস্তর পার্থক্য দেখতে পায়,তখন দ্বন্ধের বৃত্তে ঘোরপাক খাওয়া হৃদয়ের কথাগুলো এভাবে আঁচড়ে পড়তেই পারে নীতিবাক্য আওড়ানো আপন ঘরের সমাজ শীর্ষ অভিনেতাদের উপর; পার্টি ও সভা মিটিংয়ে মানবিকতার বিজ্ঞাপনওয়ালাদের অমানবিকতার উপর!
আজ ঠিক তা-ই হলো; আর এতেই দম্ভ-অহংকার-নৈতিকতা বিহীন অসাড় হৃদয়ের বৃহৎ আকৃতির কীটদ্বয়ের উপর যেন বিশাল এক টর্নেডো বয়ে গেল, তারা শুধু ঐ মানুষের ভিড়ে নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে একে অপরের মুখের দিকে তাকিয়ে নিজ সন্তানের প্রচণ্ড আঘাতে ভেঙে যাওয়া অহমিকা আবৃত সম্মান-অট্টালিকার জ্বালাময়ী বিপুল বিশাল আওয়াজ শুনছিল।

Comments

comments

About

Check Also

বিদায়বেলা

জামুরাইল হাই স্কুলের বাংলা শিক্ষক ইমরান হোসেন। প্রতিদিন সকাল ৯ টায় স্কুলে আসেন। যথারীতি তিনি …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *