লাল জামা

গাড়ির হর্ণ বাজছে এক মিনিট হয়ে গেলো। দারোয়ান গেট খুলছে না। মিসেস আমানের মেজাজের ভোল্টেজ নিঃসন্দেহে বেড়েই চলেছে। এসির মধ্যেও উনি টিস্যু দিয়ে বারবার মুখ মুছছেন। সাধারণত রাগ হলে উনি এমনই করেন। গত তিন বছর ধরে এরকম বহুবার দেখেছে ইদ্রিস মিয়া। গাড়ির লুকিং গ্লাসে এসব দেখে সে ভাবতে থাকে’বড়লোকের মেজাজ বুঝা দায়। ‘
অবশেষে গেট খুলে গেলো। দারোয়ানের চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছে তার কলিজায় পানি নাই। মিসেস আমান গাড়ি থেকে নেমে সজোরে গাড়ির দরজাটা লাগিয়ে হনহন করে হেঁটে সোজা বাড়ির ভেতর ঢুকে গেলেন। ইদ্রিস গাড়ি থেকে নেমে ব্যাকডালা ভর্তি শপিং ব্যাগগুলো এক এক করে হাতে নিতে লাগলো। দারোয়ান মতিন ভয়ার্ত চোখ নিয়ে এগিয়ে আসে।
-অহন কী হইবো ইদ্রিস ভাই?
-এহ্,যতো কই মিয়া ষাঁড়ের মতো ঘুমাইবানা। কতা তো হোন না। লও,এইবার ঠ্যালা সামলাও!!
মতিনের মুখটা আরো শুকিয়ে গেলো। ইদ্রিস তা দেখে কেমন যেন একটা আনন্দ পেলো। মতিনকে আরো কিছু একটা বলতে যাবে এমন সময় বাড়ির ছাদ থেকে মিসেস আমানের ডাক কানে আসলো।
-ইদ্রিস!
ইদ্রিসের কাজের গতিবেগ বেড়ে গেলো। কলিংবেল টিপতেই সোনিয়া দরজা খুলে দিলো। সোনিয়া এ বাড়ির কাজের লোকদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ। ১২ বছরের এ মেয়েটার মুখে অদ্ভুত রকমের একটা মায়া খেলা করে। সে মায়ার মাঝে ইদ্রিস কতবার যে হারায় তার ইয়ত্তা নেই। ওর মুখের দিকে চাইলে কেমন একটা শান্তি পায় ইদ্রিস। মনে হয় যেন নিজের মেয়ে রাইসাকে দেখছে।
ব্যাগগুলো ড্রইংরুমে রেখে বের হবার পথে মেয়েটার দিকে আবার তাকায় সে।
–আমি আবার আসছি। তুমি দরজা লাগাবে না, কেমন?
মাথা নেড়ে সায় জানায় সোনিয়া।

ইদ্রিস গিয়ে বাকি ব্যাগগুলো নিয়ে আসে। চলে যাবার পথে মেয়েটার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।
—এত্তোগুলা কীসের ব্যাগ, কাকা?
–এগুলা ঈদের জন্য মেডাম কেনাকাটা করছে বুঝছো?
সোনিয়ার চোখগুলো জ্বলজ্বল করে ওঠে।
–আমার লাইজ্ঞা কী কিনছে?
ইদ্রিসের বুকটা ধক করে ওঠে। সারাটা সময় ও মিসেস আমানের সাথেই ছিল। ওর জন্য কিছু তো কেনা হয় নি। না বলতে গিয়েও ইদ্রিস থেমে গেলো। মেয়েটার এই হাসিটা মিলিয়ে যাক সেটা মনে চাইছে না। ইচ্ছে করে তাই মিথ্যে বলল ইদ্রিস।
-হ্যাঁ রে মা, খুব সুন্দর একখান জামা কিনছে তোমার লাইজ্ঞা।
মেয়েটার চোখ মুখ আরো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। হাসিটা আরো প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে।
-কী রংগের? লাল?
-হ।
-ফুল আছে?
-হ।
-বড় ফুল?
ইদ্রিস মহাফাঁপড়ে পড়লো। এই মেয়ে তো প্রশ্ন করেই চলেছে।
–মা, আমি তোমার লগে পরে কথা কমু নে। মেডাম দেখলে রাগ হইব।
মেয়েটাও বুঝতে পারলো, সত্যিই মেডাম দেখলে তো রাগ হবে। তাই আর কথা না বাড়িয়ে দরজা লাগিয়ে দিলো।
দুদিন পর ঈদ। ইদ্রিসের মন খারাপ। ওকে ছুটি দেওয়া হয় নি। পরিবারের সাথে এবারো আর ঈদ করা হল না। বড় আশা ছিল মনে। ছোটছোট বাচ্চাগুলোর চেহারা চোখের সামনে ভেসে উঠলো। না চাইতেও চোখের কোণে জল আসলো। হঠাৎ পেছন থেকে ওর কাঁধে কেউ একজন হাত রাখে। চমকে উঠে পেছন ফেরে চায় ইদ্রিস। পেছনে সোনিয়া দাঁড়িয়ে।
–মা,তুমি এতো রাইতে? কেউ দেখে নাই? দেখলে তো ঠ্যাং ভাইঙ্গা ফালাইবো।
–না, দেহে নাই। তুমি আমারে মিত্তা কথা কিল্লাই কইছো, কাকা?

ইদ্রিসের বুকটা ধক করে ওঠে।
-মেডাম আমার লাইগা কোন জামা কিনে নাই। সব জামাকাপড় সবার লাইগা পাঠাই দিছে। আমার লাইগা একটাও নাই।
বলেই টপটপ করে চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে কাঁদতে থাকে মেয়েটা। সে কান্না কারো কানে না পৌঁছলেও ইদ্রিসের বুকে শিলের মতো বিঁধে।
‘হায় রে বড়লোক! এতো টাকা এতদিকে উড়ায়,সারাবছর এতো শপিং করে। আর ঈদের সময় এই ছোট্ট মেয়েটার জন্য একটা জামা কিনতে পারে না। ‘–আপনমনে ভাবতে থাকে ইদ্রিস। ভাবতে ভাবতে কেমন একটা ঘৃণা ঘিরে ধরে ইদ্রিসকে।
মেয়েটা এখনো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। ইদ্রিস কাছে টেনে ওর চোখের পানি মুছে দেয়। ট্রাঙ্ক থেকে রাইসার জন্য কেনা নতুন লাল জামাটা বের করে সোনিয়ার হাতে দিয়ে বলে,
“মা, কাকু তো ভুইলাই গেছি। পরশুদিন তোমার বাপের লগে দেহা হইছিল। এইডা আমারে দিয়া কইলো, ইডা সুনিয়া রে দিয়েন।
সোনিয়া জামাটা নেড়েচেড়ে দেখে। খুব খুশি হয়।
-সুন্দর না মা?
-হ, অনেক সুন্দর। বেশি সুন্দর।
-ঠিক আছে মা। তাড়াতাড়ি ঘরে যাও। কেউ দেখলে পিডানি দিবো।
সোনিয়া বেরিয়ে যেতে গিয়ে থমকে দাঁড়ায়। তারপর, ফিরে এসে ইদ্রিসের কানের কাছে মুখ লাগিয়ে বলে
‘আমি জানি,তুমিই আমার বাবা।’
ইদ্রিস আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। মেয়েটাকে বুকের মাঝে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। দুজন দুজনকে আঁকড়ে ধরে কাঁদতে থাকে। আর, মেঝেতে পড়ে থাকে সেই লাল জামাটা।

Comments

comments

About

Check Also

বিদায়বেলা

জামুরাইল হাই স্কুলের বাংলা শিক্ষক ইমরান হোসেন। প্রতিদিন সকাল ৯ টায় স্কুলে আসেন। যথারীতি তিনি …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *