ইলমুল ফিকহের কঙ্কাল

আমরা এমন একটি সমাজে বাস করি যেখানে লাশবাহী গাড়ির চেয়ে বাঁশবাহী গাড়ির তাড়া বেশি। যেখানে রিকশাকে সাইড দেয়ার জন্য এম্বুলেন্সকে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। যেখানে ট্রাফিক লাইট কেবল তখনি গুরুত্ব পায়, যখন গদা হাতে দুজন ট্রাফিক সার্জেন্ট সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। আমি-আপনি সবাই এর রকম হাজারটা অপরাধে অপরাধী, যেগুলোকে আমরা অপরাধ বলে বিবেচনাই করিনা। প্রতিটি উন্নয়নশীল (বিশেষত মুসলিম) দেশেই এ অবস্থা সমভাবে বিরাজমান।
কিন্তু জানেন কি, এসব ‘ধর্মহীন’ আইনও ইলমুল ফিকহের অন্তর্গত বিষয়? জানি, আপনাদের হাসি পাচ্ছে! ট্রাফিক আইন কিভাবে ইলমুল ফিকহের অন্তর্ভুক্ত হয়? জি, হতে পারত, যদি আজ একজন আবু হানিফা বেঁচে থাকতেন।
একটু প্রেক্ষাপট বলি।
ইসলামের প্রথম যুগে মুসলিম বিশ্ব ছিল মূলত আরব কেন্দ্রিক। আরবের রীতিনীতির মধ্যে যেগুলো বৈধ ছিল সেসব রীতিনীতি ইসলামে প্রবেশ করেছিল। আর আরবের যেসব বিষয়াদি ইসলামের মাপকাঠিতে ভুল ছিল, রাসুলুল্লাহ (স.) সেগুলোকে পরিবর্তন করে ঠিক করে দিয়েছিলেন। মানুষ ছিল কম, যুগ ছিল সহজ-সরল, তাই আইনি প্রশ্নও এতো অধিক ছিলনা। সুতরাং সে যুগে আকীদা ও তাযকিয়া/তাসাউফকেই ইলমুল ফিকহ বলে গণ্য করা হত। এদিকে ঈঙ্গিত করেই উসুলে ফিকহে বলা হয়েছে-
অর্থাৎ, প্রাথমিক যুগে (সাহাবা-তাবেয়ীনের যুগ) ফিকহের হকিকত ছিল আল্লাহ সম্বন্ধিত জ্ঞান (আকীদা) এবং অন্তরের লুকায়িত ব্যাপার সম্বন্ধে জ্ঞাত হওয়া (তাযকিয়া/তাসাউফ)।

এক প্রজন্ম পরেই ইসলামের প্রসার বৃদ্ধি পেল। বিপুল সংখ্যক মানুষ আল্লাহর দ্বীনে প্রবেশ করল। সাথে নিয়ে আসল আপন আপন সংস্কৃতি, প্রথা ও রীতিনীতি। এছাড়া উম্মাহ’র বিস্তৃতির সাথে সাথে ধর্মীয় বিষয়ের বাইরেও নানাবিদ সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক বিষয়াদিও প্রবেশ করল ইসলামের আঙ্গিনায়। যুগের চাহিদা ও জিজ্ঞাসার ফলশ্র“তিতে প্রয়োজন পড়ল নতুন আইনি কাঠামো তৈরি করার। সে প্রয়োজন মেটাতে এগিয়ে এলেন কুফার অধিবাসী নুমান ইবনে সাবিত। চল্লিশজন প্রাজ্ঞ মুহাদ্দিছ-মুফাসসির-ফকীহ ও মুতাকাল্লিম নিয়ে গঠন করলেন একটি ফিকহী পরিষদ। কুরআন-হাদিস, সাহাবিদের আমল-ফতোয়া এবং নিজের ইজতিহাদি যোগ্যতায় ইসলামি আইনশাস্ত্রকে নিয়ে গেলেন অনন্য উচ্চতায়। তাঁর জীবদ্দশায়ই উক্ত ফিকহী পরিষদ প্রায় ৮৩ হাজার মাসয়ালা নির্ধারণ করে এগুলোর সমাধান গ্রন্থবদ্ধ করলেন (যার বর্তমান সংখ্যা পাঁচ লক্ষাধিক)। অপরিসীম মেধাবি এই মানুষটিকে বিশ্ববাসী ইমাম আবু হানিফা নামে স্মরণ রেখেছে। হানাফি ফিকহে মাসয়ালা নির্ণয় ও সমাধান করা হতো ওহফঁপঃরাব গবঃযড়ফড়ষড়মু অনুসারে। কেবল ঘটমান বা পুরাঘটিত সমস্যা নিয়েই তাঁরা আলোচনা করতেন না। বরং ভবিষ্যতে যা ঘটতে পারে, এমন সম্ভাব্য সমস্যা নিয়েও এ পরিষদ আলোচনা করত। তাঁরা বলতেন- যদি কখনো ‘এমন’ হয় তাহলে তার সমাধান কী হবে? এরপর শুরু হতো কুরআন-সুন্নাহ তালাশ করা! একদিন, দুদিন, দশদিন, এক মাস, কখনো তিন মাসও লেগে যেত। এরপর একটি সমাধান আসত।
ঠিক একই সময়ে মদীনায় আরেকজন জ্ঞানী ব্যক্তি ইসলামি আইনশাস্ত্রের উন্নয়নে ব্রতী হলেন। তাঁর নাম ছিল মালিক ইবনে আনাস আল-আসবাহী। ইতিহাস তাঁকে ইমাম মালিক নামে স্মরণ রেখেছ। তাঁর ফিকহী পদ্ধতি ছিল উবফঁপঃরাব গবঃযড়ফড়ষড়মু. তিনি কেবল সংঘটিত হয়েছে এমন সমস্যারই সমাধান করতেন।
এক প্রজন্ম পরে এ দুই ঘরানার সার-নির্যাস নিয়ে উঠে এলেন মুহাম্মদ ইবনে ইদরিস নামক আরেক জ্ঞানী। ইতিহাসে তিনি ইমাম শাফেয়ী নামে পরিচিত। এরপর এলেন ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল, যদিও তাঁর মাযহাব প্রথমদিকে কেবল আকীদার মাযহাব ছিল। তাঁদের মেধা ও শ্রম পরবর্তী কয়েক শতাব্দীব্যাপী সারা মুসলিম জাহানকে আলোকিত করে রাখল। ইতোপূর্বে এবং তৎসময়ের আশেপাশে এ পৃথিবীতে যত আইনশাস্ত্র ছিল; সৌন্দর্য, মাহাত্ম্য ও পরিপূর্ণতার দিক থেকে কোন আইনশাস্ত্র ইসলামি আইনবিজ্ঞানের ধারেকাছেও ছিল না। কি ধর্ম, কি সমাজ, কি রাজনীতি, কি সংস্কৃতি, কি অর্থনীতি- সবকিছুই তাঁদের ফিকহে অন্তর্ভূক্ত ছিল। বাদশাহি পেশিশক্তিও ইসলামি জ্ঞানরাজ্যের কাছে এসে সমাধানের জন্য হাত পাতত।
এরপর শুরু হল নিম্নমুখী প্রবণতা। আলেমদের লোভ-লালসা, দুনিয়াপ্রীতি, লেজুড়বৃত্তি এবং সর্বোপরি তাকওয়া-বিসর্জনের ফলে ইলমুল ফিকহ কঙ্কালসার হয়ে গেল। গত শতাব্দীর প্রথমার্ধে যখন মুসলিম বিশ্বে ভিন্ন ভিন্ন জাতিরাষ্ট্র আত্মপ্রকাশ করল, তখন মানবরচিত বিধিবিধানের তুড়ে রাতারাতি আল্লাহর আইনসমূহ হয়ে গেল চবৎংড়হধষ খধি বা ব্যক্তিগত আইন। কিতাবাদি আজো রচিত হচ্ছে, ফকীহদের সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে আগের জোর নেই। এর ফলাফল হচ্ছে- আজ নামাজে আমীন জোরে বলা-আস্তে বলা, শবে বরাতের রোজা রাখা না রাখা, বিবাহের তিন কবুল এবং বিচ্ছেদের তিন তালাকের মধ্যেই ইলমুল ফিকহ সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে।
এজন্যই বলেছিলাম, আজ যদি ইমাম আবু হানিফা, মালিক, শাফেয়ী, আহমদের মতো আলেম বেঁচে থাকতেন-
তবে ট্রাফিক আইনও ইলমুল ফিকহের অন্তর্ভুক্ত হতো। তবে খাদিজাকে কোপানোর জন্য বদরুলকে আলেমদের সামনে জবাবদিহি করতে হতো। তবে ঢাকা-চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য আলেম সমাজে আলোচনা হতো। তবে অবৈধ হোটেলসমূহে দেহব্যবসা বন্ধ করার জন্য আলেমগণ প্রশাসনকে চাপ দিতেন। তবে ট্রেন লেইট হলে আলেমগণ যাত্রীদের জন্য চিন্তিত হতেন। তবে বৃক্ষনিধন রোধে আলেমগণ বিবৃতি দিতেন। তবে রাজনৈতিক-সন্ত্রাসকে তর্জনী উঁচিয়ে শাসাতেও আলেমগণ কুণ্ঠাবোধ করতেন না।
বলা হয়- আলেমগণ নবীদের উত্তরসূরি। সত্যিই কি তাই? সত্যিই?

Comments

comments

About

Check Also

রাসুলুল্লার হিজরাত : প্রাসঙ্গিক ভাবনা

পৃথিবীতে তখন ঘোর অমানিশার রাজ। চারিদিকে বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্যের দৃঢ় ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। যে ভিন্নতার জন্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *