নেক সন্তান ও পিতামাতার করণীয়

সন্তান-সন্তুতি আল্লাহর পক্ষ হতে শ্রেষ্ঠতম উপহার। একটি সন্তান নিজেরই নব সংস্করণ। আল্লাহ তা’আলা মানুষকে যত চাহিদা ও আকর্ষণ দান করেছেন, তার মধ্যে সন্তান-সন্তুতির আকর্ষণ অন্যতম। একমাত্র আল্লাহ তা’আলাই সন্তান দানের মালিক। একটি সৎ সন্তান যেমন পিতামাতার জন্য আশীর্বাদ অনুরূপ একটি সন্তান পিতামাতা ও দেশের জন্য অভিশাপ ও ভোগান্তির কারণ হয়েও দাঁড়াতে পারে। সুতরাং প্রত্যেক মানুষের উচিত আল্লাহ তা’আলার নিকট নেক সন্তান কামনা করা। ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি আল্লাহর পক্ষ থেকে পরীক্ষা। আল্লাহ কাউকে ধন-সম্পদ বা সন্তান-সন্ততি দিয়ে পরীক্ষা করেন আবার কাউকে এগুলো না দিয়ে পরীক্ষা করেন। এ ব্যাপারে পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন স্থানে একাধিক স্পষ্ট বক্তব্য বিদ্যমান।
৬৪ নাম্বার সুরা আত-তাবাগুন এর ১৫ আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে-“তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি তো শুধুমাত্র পরীক্ষাস্বরূপ। আর আল্লাহর কাছে রয়েছে মহা-পুরস্কার।”
সুরা আশ-শূরাঃ ৪৯-৫০ আয়াতে ঘোষণা এসেছে-“যাকে খুশী তিনি কন্যাসন্তান দান করেন, যাকে খুশী পুত্রসন্তান দান করেন। অথবা তাদেরকে পুত্র ও কন্যা সন্তান উভয়ই দান করেন এবং যাকে ইচ্ছা বন্ধ্যা করে দেন। নিশ্চয় তিনি সর্বজ্ঞ, ক্ষমতাশীল।” সুতরাং সন্তান সন্ততি যেন দুনিয়া আখেরাতে বিপদ মুসিবত ও চরম ভোগান্তির কারণ হয়ে না দাঁড়ায় সে জন্য আল্লাহর কাছে আমাদের নেক সন্তান কামনা করা একান্ত কর্তব্য। নেক সন্তান কামনায় পিতামাতার কিছু করণীয় আছে। যেমন দুয়া করা, তাওবা করা, বেশী করে কুরআন তেলাওয়াত করা, চরিত্রকে পূত পবিত্র রাখা ইত্যাদি।
এর মধ্যে সর্বাগ্রে দুয়া করা। আর সন্তান হওয়ার জন্য দু’আ করা পয়গাম্বরগণের সুন্নাত। আল্লাহর কাছে বিশ্বাস ও আশা রেখে বেশি বেশি করে দুয়া করে যেতে হবে। হতাশ হওয়া যাবেনা, বা দুয়া কবুল হতে দেরী হচ্ছে কেন, আল্লাহ আমার দুয়া কবুল করেন না, আমি কি দোষ করেছি, দুয়া করেছি কিন্তু আল্লাহ শুনেন না (নাউযুবিল্লাহি মিন যালিক), এই ধরনের নাফরমানীমূলক, কুফরী কথাবার্তা কখনোই মুখে আনা যাবে না। কারণ আল্লাহ বান্দার কোন দুয়াই বিনষ্ট করেন না। তার একটি প্রতিদান দিয়ে থাকেন। সে বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার বিষয় আজকে নয়। আজকের কথা হচ্ছে আল্লাহর কাছে দুয়া করতে হবে। বিশেষ করে দুয়া কবুলের সময়গুলোতে। যেমন – ফরয নামাযের পরে, তাশাহুদের পরের সালাম ফেরানোর আগে, তাহাজ্জুদে, যে কোন নামাযের সিজদাতে, নফল-সুন্নত রোযা রেখে, আযান-ইকামতের মাঝখানে, জুমআর দিন আছরের পরে, বৃষ্টি বর্ষণের সময়। দুয়া বেশি কবুল হবার এ রকম বহু সময় আছে, সেগুলো জেনে আমাদের বেশি বেশি দুয়া করতে হবে।
ক. নেককার স্বামী/ স্ত্রী ও সন্তান পাওয়ার জন্য আল্লাহ আমাদেরকে এই দোয়া শিখিয়ে দিয়েছেন। ‘রব্বানা হাবলানা মিন আযওয়াজিনা ওয়া যুররিয়্যাতিনা ক্বুররাতা আ’ইয়ুন, ওয়াজআ’লনা লিলমুত্তাক্বীনা ইমামা।’’
অর্থ: ‘’হে আমাদের পালনকর্তা, আমাদের স্ত্রীদের পক্ষ থেকে এবং আমাদের সন্তানের পক্ষ থেকে আমাদের জন্যে চোখের শীতলতা দান করুন এবং আমাদেরকে মুত্তাকীদের জন্যে আদর্শস্বরূপ করে দিন।’ [সুরা আল-ফুরক্বানঃ ৭৪]
খ. সন্তান কামনায় হযরত যাকারিয়া আলাইহিস্ সালাম দু‘আ করেছিলেন এভাবে-“রাব্বি হাব্লী মিল্লাদুন্কা যুররিইয়াতান্ ত্বাইয়িবাহ, ইন্নাকা সামী-‘উদ্ দুআ’-হে আমার রব! আমাকে আপনার নিকট হতে পবিত্র সন্তান দান করুন, নিশ্চয় আপনি দুআ শ্রবণকারী।’’ [আলে-ইমরান, ৩/৩৮]
গ. সন্তান কামনায় হযরত ইবরাহীম আলাইহিস্ সালাম বৃদ্ধাবস্থায় এভাবে দু‘আ করেছিলেন-“হে আমার প্রতিপালক! আমাকে এক সৎপুত্র দান কর।” (সূরা সাফফাত, আয়াতঃ ১০০)
ঘ. এ ছাড়াও প্রিয় নবী স. শিখিয়ে দিয়েছেন- ‘আল্লাহুম্মা আকসির মালি ওয়া ওয়ালাদি, ওয়া বারিকলানা ফিমা আ’তাইতানি। অর্থ: ‘’হে আল্লাহ! তুমি আমাকে অধিক সম্পদ ও সন্তান দান করুন এবং আমাকে যা দান করেছেন তার মাঝে বরকত দান করুন।’’ [হিসনুল মুসলিম]


দ্বিতীয়ত : তওবা করা : কোন ব্যক্তি আন্তরিকভাবে তওবা করে পাপকাজ ছেড়ে দিয়ে চরিত্রের সংশোধন করে নিলে, কুরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করলে, আল্লাহ তাআ’লা তার সম্পদ ও সন্তান বৃদ্ধি করে দেবেন এ ঘোষণা দিয়েছেন। সুরা আন-নূহ এর ১০-১২ আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে- ‘তোমরা তোমাদের পালনকর্তার কাছে তওবা করো (ক্ষমা প্রার্থনা কর), তিনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল। (যদি তোমরা তাওবা করো তাহলে) তিনি তোমাদের উপর অজস্র বৃষ্টিধারা দেবেন এবং তোমাদেরকে ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি বাড়িয়ে দিবেন, তোমাদের জন্যে উদ্যান স্থাপন করবেন এবং তোমাদের জন্যে নদীনালা প্রবাহিত করবেন।”
তওবা করার কিছু দুয়াঃ যেই দোয়া পড়ে রাসুলুল্লাহ সা. তওবা করতেন ও আমাদেরকে করতে বলেছেন : ‘আমি মহামহিম আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। যিনি ছাড়া ইবাদতের আর কোন যোগ্য উপাস্য নেই। যিনি চিরস্থায়ী, সর্বসত্তার ধারক। আমি তাঁর কাছে তওবা করছি।’ [হিসনুল মুসলিম]
এই দুয়াটি প্রসঙ্গে রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন- ‘যেই ব্যক্তি এই দোয়া পড়বে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দেবেন, যদিও সে জিহাদের ময়দান থেকে পলাতক আসামী হয়’।
আমাদের আদিপিতা আদম আ. ও মা হাওয়া আ.-কে ক্ষমা প্রার্থনা ও তওবা করার জন্য স্বয়ং আল্লাহ তাআ’লা এই দুয়াটি শিখিয়ে দেন-‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা নিজেদের প্রতি যুলুম করেছি, অতএব আপনি যদি আমাদেরকে ক্ষমা না করেন এবং আমাদের প্রতি দয়া না করেন তাহলে নিশ্চয়ই আমরা ক্ষতিগ্রস্থদের অন্তর্ভুক্ত হব।’ [আল-আ’রাফঃ ২৩]
এছাড়া ছোট্ট এই দুয়া পড়েও তওবা করা যায় : আমি আল্লাহ্র কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি এবং তাঁর নিকটই তাওবা (প্রত্যাবর্তন) করছি। প্রতি দিন ১০০ বার করে বা বেশি করে এটি পড়া কর্তব্য।
তৃতীয়ত: বেশি বেশি কুরআন তেলাওয়াত করাঃ সুসন্তান প্রত্যাশী পিতামাতার বেশি বেশি কুরআন তেলাওয়াত করা উচিত, বিশেষত সন্তান সম্ভবা মায়ের। এটি খুবই জরুরি ও কার্যকরী একটি আমল। কারণ গর্ভাবস্থায় ১২০ দিনের দিন ফেরেশতা সন্তানকে রূহ ফুঁকে দেন [সহিহ বুখারী, মুসলিম] এবং মেডিক্যাল সাইন্স স্বীকার করে যে, আনুমানিক ১৮ সপ্তাহ সময় থেকেই মায়ের গর্ভে সন্তান শুনতে শুরু করে। আমাদের খেয়াল রাখা উচিত- আমাদের কাছ থেকে শুরু থেকেই নবজাতকেরা যাতে পরিবারে ইসলামী সংস্কৃতি দেখতে পায়, অনৈসলামিক কর্মকাণ্ডে আমরা যাতে ওদের হাতেখড়ি না দেয়াই, কেননা সেটাই ওদেরকে ভুল পথের পথিক বানানোর জন্য যথেষ্ট। রাসুলুল্লাহ সা. সাবধান করে গেছেন-‘প্রতিটি নবজাতক ফিতরাতের উপর জন্মগ্রহণ করে। এরপর তার পিতামাতা তাকে ইয়াহুদী বানায়, খ্রিস্টান বানায় এবং অগ্নিপূজক বানায়…সুতরাং সন্তানের সামনে অশ্লীল কথা উচ্চারণ করা ঠিক নয়। ওরা সেই খারাপ কথাটিই শিখে ফেলে বারবার বলতে চাইবে। খারাপ আচরণটির অনুকরণ করতে চাইবে। তাই পিতামাতাসহ পরিবারের সবাইকে এ ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে।
এ ছাড়া আল্লাহ তায়ালার একটি গুণবাচক নাম হলো ‘আল-মুতাকাব্বিরু’। যে ব্যক্তি স্ত্রী সহবাসের পূর্বে এ পবিত্র গুণবাচক নাম ‘আল-মুতাকাব্বিরু’- ১০ বার পাঠ করবে; আল্লাহ তাআলা তাকে সৎ সন্তান দান করবেন। যে ব্যক্তি স্ত্রী সহবাসের পূর্বে এ পবিত্র গুণবাচক নাম ‘আল-মুতাকাব্বিরু’-১০০ বার পাঠ করবে; আল্লাহ তাআলা তাকে ভাগ্যবান সু-সন্তান দান করবেন। মোটকথা, পিতা মাতা এবং পরিবারের লোকজনের আমল আখলাক যেরূপ হবে, নবাগত মানব সন্তান সে পরিবারে তা-ই শিক্ষা গ্রহণ করে নিবে। আল্লাহ তায়ালা আগত ভবিষ্যত প্রজন্মকে নেককার ও পরহেজগার মুসলিম জাতিতে পরিণত করার জন্যে আমাদের সকলকে তাঁর দীনের উপর পুরোপুরি আমল করার তাওফিক দান করুন। আমীন।

Comments

comments

About

Check Also

রাসুলুল্লার হিজরাত : প্রাসঙ্গিক ভাবনা

পৃথিবীতে তখন ঘোর অমানিশার রাজ। চারিদিকে বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্যের দৃঢ় ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। যে ভিন্নতার জন্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *