ইফতারির গুরুত্ব ও ফজীলত

মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর বান্দাকে ক্ষমা করার যে কয়টি সুবর্ণ সুযোগ ও উপলক্ষ সৃষ্টি করেছেন তার সর্বশ্রেষ্ঠ উপলক্ষ হচ্ছে রমজানুল মুবারক। শুধু দুনিয়াতেই নয়, আসমানের জগতেও যে রমজানের সাড়া পড়ে যায়। মহান আল্লাহ পাক প্রতিদিন জান্নাতকে নতুন করে সাজাতে নির্দেশ দেন। আর বলেন ‘সে দিন বেশি দূরে নয় যেদিন আমার বান্দারা দুনিয়ার কষ্ট ক্লেশ পাড়ি দিয়ে আমার কাছে ফিরে আসবে।’ রমজানের সবচেয়ে ব্যাপকভাবে সাড়া জাগানো ইবাদাত বা আমল হচ্ছে ইফতার। ইফতার হচ্ছে রমজানের অন্যতম একটি দুয়া কবুলের মোক্ষম মুহূর্ত। রমজানের শত উপঢৌকন, শত আয়োজন ও রকমারি ইবাদাতের মধ্যে ইফতার হচ্ছে এমন একটি আমল যার সুফল দুনিয়াতেও আমরা উপভোগ করি আর আখিরাতে তো জমা থাকবেই। এ জন্যই প্রিয় নবী স. ইরশাদ করেছেন ‘রোজাদারের দুটি আনন্দ রয়েছে। একটি ইফতারির সময় অন্যটি আল্লাহর দীদারের সময়। প্রিয় শ্রোতা, কেউ হয়তো ভাবতে পারে যে, ইফতারিতে এমন বড় আনন্দটাই- বা কী? হ্যাঁ এ আনন্দিত হওয়া না হওয়ার পার্থক্যটা স্পষ্ট করে একটু বোঝা দরকার। যখন একটি লোক রোজা রাখল না, দুপুরে পেট ভর্তি করে খেয়ে দেয়ে আসল; এ লোকটি যদি রোজাদারদের সাথে ইফতারি করতে বসে, তাহলে তার মনে কোন আনন্দ, অনুভূতি বা আত্মিক তৃপ্তি বলতে কিছু জাগবে? বলুন তো? নিশ্চয়ই কোন আনন্দ তার নেই। সুতরাং প্রকৃত রোজাদারের সীমাহীন আত্মিক তৃপ্তির মহা আনন্দের উৎসব ইফতারি। এটা কাউকে ব্যাখ্যা দিয়ে বুঝানো যাবে না।
ইফতারি শুধু ক্ষুধা নিবারণের জন্য খাবারের গরজ নয়, এটি আল্লাহর নির্দেশ। তিনি ইরশাদ করেন অতঃপর তোমরা রোজাকে রাত পর্যন্ত পূর্ণ কর। সুতরাং রাত আসলে ইফতারির মাধ্যমে রোজা ভঙ্গ করে ফেলাও তারই হুকুম। এখানে অবহেলা করে বিলম্ব করার কোন সুযোগ নেই। বরং অবিলম্বে ইফতার করা, দীন টিকে আছে বলে একটি প্রমাণ। শুনুন বুখারী শরীফের ১৯৫৭ নং হাদীসে প্রিয় নবী স. ইরশাদ করেন- ‘আমার উম্মতগণ ততদিন সঠিক পথে থাকবে, যতদিন অবিলম্বে ইফতার করবে।’ সহীহ ইবনে হিব্বান এর ৩৫১০ নং হাদীসে এসেছে ‘আমার উম্মতগণ সেই সময় পর্যন্ত সুন্নাতের উপর থাকবে, যতক্ষণ রোযা ছাড়তে দেরি করবে না।’ এ একই গ্রন্থের ৩৫০৯ নং হাদীসে আছে ‘দীন ততক্ষণ পর্যন্ত সমুন্নত থাকবে যতক্ষণ আমার উম্মতগণ রোজা ছাড়তে ব্যস্ত থাকবে এবং ইহুদী নাছারাদের মত ইফতার করতে দেরী করবে না।’

যদি ইফতারির সময়ে সামান্য পানিও পাওয়া না যায়, তাহলে সে যেন ঐ সময় রোজার নিয়ত ছেড়ে দেয়। অথাৎ, আমি এখন রোজা ত্যাগ করলাম। এরপর যখন কিছু খাদ্য দ্রব্য পাওয়া যায়, তখন যেন আহার করে। আর সামনে খাদ্য থাকলে কোন মতে বিলম্ব করা ঠিক না। এর মানে এই নয় যে, সময় হওয়ার আগেই তাড়াহুড়া করবে। বরং সূর্যাস্ত যাওয়ার পরেই হতে হবে। আর যে ব্যক্তি রোজা অবস্থায় বিমানে যাত্রা করল। আর যতই সামনে আগাচ্ছে ততই বেলা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাহলে সে ইফতারি করবে কখন? যেখান থেকে সে যাত্রা করেছিল সেখানে হয়তো ইতোমধ্যে সূর্য অস্ত গেছে, ইফতার হয়ে গেছে। অথচ বিমানের গতির কারণে তার সামনে সূর্য বেড়েই চলছে। তার সামনে দিন যতই বড় হোক এমন লোক কিন্তু তার নিজ দেশ বা স্থানের সূর্যাস্তের সময় অনুযায়ী ইফতার করতে পারবে না। তার চোখের সামনে সূর্যাস্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করে ইফতার করবে। আর তত সময় সে রোজা রাখতে না পারলে ভেঙে দিবে। কারণ সে এখন মুসাফির আর মুসাফির রোজা ভাঙতে পারে এবং পরে তা কাযা করবে। অতএব যানবাহনে সফরের ক্ষেত্রে তার তাৎক্ষণিক অবস্থানের সময় বা সূর্যাস্ত অনুযায়ী ইফতার করতে হবে। এতে তার রোজা খুব দীর্ঘ হোক বা খুব ছোট হোক। সফরের সময় এরূপ পাহাড়ের আড়ালে সূর্যাস্ত যেতে দেখে প্রিয় নবী স. বললেন আমাকে ইফতারি দাও। অতপর তিনি ইফতার করলেন। আবু দাউদ শরীফের ২৩৪৯ নং হাদীস থেকে জানা যায় প্রিয় নবী স. ইফতারিতে খেজুর খেতেন। তাজা খেজুর না পেলে তিনি শুকনা খেজুর খেতেন। আজ বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে যে, খেজুরে রয়েছে প্রচুর পরিমাণ ক্যালরি। যা সারা দিনের অভাবকে খুব দ্রুত পূরণ করে দেয়। আর অপরকে ইফতারি করানোর মাঝে রয়েছে অনেক সাওয়াব ও ফজীলত। শুয়াবুল ইমান এর ৩৩৩৬ নং হাদীসে প্রিয় নবী স. ইরশাদ করেন যে ব্যক্তি কোন রোজাদারকে ইফতার করাবে- তাতে তার গুনাসমূহ মাফ হয়ে যাবে। সে জাহন্নাম থেকে মুক্তি পাবে এবং সে রোজাদার ব্যক্তির সমান সাওয়াব পাবে। তাতে ঐ রোজাদারের সাওয়াবে কোন ঘাটতি হবে না। এ কথা শুনে সাহাবীরা বললেন ইয়া রাসুলাল্লাহ আমাদের সকলের তো রোজাদারকে ইফতার করানোর সামর্থ্য নেই। তখন তিনি বললেন- এ সাওয়াব আল্লাহ ঐ ব্যক্তিকে দিবেন, যে ব্যক্তি কোন রোজাদারকে ইফতার করাবে সামান্য একটু দুধ কিংবা এক টুকরো খেজুর অথবা একটু পানি দিয়ে। আর যে ব্যক্তি কোন রোজাদারকে পরিতৃপ্তি সহকারে আহার করাবে, তাকে আল্লাহ পাক আমার হাওজ থেকে এমন পানীয় পান করাবেন যে, জান্নাতে প্রবেশের আগ পর্যন্ত সে আর তৃষ্ণার্ত হবে না। ইফতারির এই সীমাহীন গুরুত্ব ও ফজীলতের দিকে আমাদের সতর্কতার সাথে খেয়াল রাখা দরকার। সাধ্যমত মুমিন ভাইকে নিমন্ত্রণ ও ইফতার করানো দরকার। বিশেষ করে গরীব দুঃখীর প্রতি সাহায্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়া। যে অভাবীর নেই ভাল কোন ইফতারির আয়োজন- নেই সাহরী খাবার মত উপয্ক্তু খাদ্যের ব্যবস্থা, সে গরীবের অভাব মোচনের জন্য আমরা যেন চতুর্দিক হতে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেই।
রাসুলে পাক স. বলেন, ‘ইফতারির সময় বান্দার দোয়া কবুল হয়ে থাকে।’ তাই দু হাত তুলে দোয়া কবুলের এ মোক্ষম সময়টিকে যেন আমরা কাজে লাগাই। সুতরাং, রমজানের প্রতিটি আমলকেই সর্বোচ্চ সতর্কতার সাথে গুরুত্ব দেয়া দরকার। আমাদের সকলের উচিৎ, বেশি করে দান সদকা করা, কুরআন তিলাওয়াত করা, তারাবীহ এবং কিয়ামুল্লাইল করা। আল্লাহ পাক আমাদের সবাইকে রমজানের রহমাত ও বরকত লাভে ধন্য করুন। আমীন।

Comments

comments

About

Check Also

রাসুলুল্লার হিজরাত : প্রাসঙ্গিক ভাবনা

পৃথিবীতে তখন ঘোর অমানিশার রাজ। চারিদিকে বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্যের দৃঢ় ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। যে ভিন্নতার জন্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *