আল মাহমুদের আত্মার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী

পৃথিবীর সকল ক্ষমতাই একদিন ধ্বংস হয়ে যায় এবং যাবেও একথা যেমন ধ্র“ব সত্য, তেমনই পৃথিবীর সৃষ্টিলগ্ন থেকে এপর্যন্ত যতো ক্ষমতাবান ব্যক্তি জন্ম নিয়েছেন, তারাও নিক্ষিপ্ত হয়েছেনে ইতিহাসের আস্তা কুড়ে। অনন্তকাল হবেন বলেও ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়। আজ আপনার হাতে অঢেল ক্ষমতা, তাই আপনি যেভাবে খুশী সেভাবেই এর সদ্ব্যবহার কিংবা অপব্যবহার করতে পারছেন। কিন্তু কাল যখন আপনার হাতে ক্ষমতা থাকবেনা, তখন কি হবে? আপনি যতোই ক্ষমতাবান হননা কেন, আপনি কি নমরুদ, ফেরাউন, সাদ্দাদের চেয়ে অধিক ক্ষমতাসম্পন্ন? আশাকরি মোটেও না। তারা কি করেছে আর কি হয়েছে, তা জানার জন্যও তো অণুবীক্ষণ যন্ত্রের কোন প্রয়োজন নেই। তাদের ক্ষমতা ছিলো গোটা পৃথিবী জুড়ে। আর আপনার?
আধুনিক বাংলা সাহিত্যের প্রধান কবি আল মাহমুদ চলে গেলেন নীরবে। আর আমরাও দায়ভার এড়াতে ফেইসবুকে গুটিকয়েক স্ট্যাটাস দিয়ে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করলাম! এরচেয়ে বেশী কিছু করারও ছিলোনা। কারণ আমাদের হাতে যে ক্ষমতা নেই…! প্রবাদবাক্য অনুযায়ী ‘সামনে থাকলে অপমান, দূরে গেলে বাড়ে মান’। আল মাহমুদের মৃত্যু দেখে একসময়কার এই বিশ্বাসটিও হারিয়ে গেলো অবিশ্বাসের অতল গহ্বরে।
যৌবনের সৌন্দর্যগুলো খুবলে খায় বার্ধক্যের হাঙ্গর। মানুষের চিন্তা-চেতনা স্মৃতি-স্বপ্ন এবং সৃজনশক্তি কিছুই অবশিষ্ট রাখে না বার্ধক্য। সব খায়। সব। যৌবনের বাঁধনহারা গতি বার্ধক্যের ডোবায় এসে ডুবে যায়। তখন কী আর করার থাকে মানুষের? কিছুই থাকে না। কিছুই না। পৃথিবীর বাতাসে যে ক’টি নিঃশ্বাস নেয়ার অধিকার থাকে, তার বেশি একটিও গ্রহণ করার ক্ষমতা থাকেনা কারো। এমনি নির্মম পৃথিবী! জীবনের যাবতীয় ঘনঘটার কোলাহল থেমে যায়। নিভে যায় মানুষের দৃষ্টির জ্যোতি। পৃথিবী বলতে থাকে বিদায় হে মানুষ! বিদায় চিরদিনের তরে! তবুও বোঝে না মানুষ। তবুও ভাবেনা মানুষ। যৌবনের অহঙ্কারে বুঁদ হয়ে থাকার ঘোর মানুষকে অবিবেচক করে। মানুষ ভুলে যায় মানুষের পথ। ভুলে যায় পথের ঠিকানা। যার ফলে মানুষ কুৎসা রটায় মানুষের বিরুদ্ধে। অধিকার হরণ করে অন্যের। আল মাহমুদ এমন কুৎসার শিকার হয়েছেন আজীবন। জীবনের শেষ সময়েও অপতথ্যের শিকার তিনি। তার কবিতার মধুর শরাব পান করেননি বাংলাভাষী এমন শিক্ষিত মানুষ কমই আছেন। তার কবিতার প্রশংসা করেননি এমন পাঠকের সংখ্যাও নেই বললেই চলে। রাজনৈতিক দলাদলি আমাদের সাহিত্যে বিভাজনের দেয়াল তুলে দিয়েছে। শিল্প-সাহিত্যে রাজনৈতিক বিবেচনা বড় নির্মমতা। বড় নিষ্ঠুরতা। জাতি হিসেবে এটি আমাদের নীচতার পরিচয়। শিল্পের ভার রাজনীতি বহন করার ক্ষমতা রাখেনা। শিল্পকে শিল্পের নিরিখেই বিচার করা জরুরি। কিন্তু আমরা এক দুর্ভাগা জাতি। আমাদের শিল্পের বিচার হয় রাজনৈতিক বাটখারায়। আল মাহমুদ এর তীব্র শিকার হয়েছেন মৃত্যুঅবদি। তার এ বেদনা ছিলো আজীবন।
আল মাহমুদের মতো কবি যুগে যুগে জন্মায়না। বহু প্রতীক্ষার পর একজন বড় কবির আবির্ভাব ঘটে। একটি জাতির জন্য এটি গৌরবের। একটি দেশের জন্য সম্পদ। যদি সে জাতি এবং সে দেশ তা বোঝে। অনুভব করে। ব্যক্তি আল মাহমুদ নিয়ে কথা আছে। থাকতেই পারে। কিন্তু কবি আল মাহমুদ সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে। তিনি কবিতার জগতে এতটা উচ্চতায় নিয়েছেন নিজেকে যে, তাকে নিয়ে লিখতেই হয়। বলতেই হয়। আড্ডায় আসরে আলোচনায় তাকে উচ্চারণ করতে হয়। উপমা দিতে হয় তার কথা। তার কবিতা থেকে দিতে হয় উদাহরণ। তিনি নিজেকে নির্মাণ করেছেন তিলে তিলে। তার নির্মিত কাব্যিক প্রাসাদ বেশ উঁচু। তাকে অবহেলা করার কিছু নেই। অবজ্ঞারও নেই কিছু। তার যতো নাম, অনাম, সুনাম, বদনাম সবই কবিতা ঘিরে। প্রশংসা-নিন্দাও কবিতার জন্যই। তিনি কবি এবং একজন অসাধারণ কবি। তিনিই আল মাহমুদ। আল মাহমুদ-এর ইন্তেকালের পর থেকে মুষ্টিমেয় কিছু পত্রিকা, অনলাইন নিউজ পোর্টাল এবং ফেসবুকে লেখালেখি দেখেছি তাকে ঘিরে। তিনি লেখার বিষয়। তাকে নিয়ে লিখতেই হয়। লিখতে হবে। কথায় আছে, মৃত্যুর পরও পৃথিবীতে বেঁচে থাকার উপায় দু’টি অথবা দু’টির যেকোনো একটি। হয় এমন কিছু লিখে যাও, যা মানুষ পড়বে। অথবা এমন কিছু করে যাও মানুষ লিখবে। তার মানে অক্ষরে জেগে থাকা ছাড়া বেঁচে থাকার আর কোনো পথ নেই। আল মাহমুদ শব্দের আনন্দে যা নির্মাণ করেছেন, তা মানুষকে পড়তে হয়। হয়তো পড়তে হবে আগামী প্রজন্মকেও। পাশাপাশি তার লেখালেখি কর্মের গৌরব নিয়ে লিখতেও হবে। সুতরাং তাকে নিয়ে লেখালেখি হবে এটা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু…..
১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের ঢেউ যখন বাংলাদেশের সর্বত্র জাগিয়েছিলো প্রতিবাদের প্লাবন। সেই ঢেউ উদ্বেলিত করেছিলো আল মাহমুদকেও। ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর থেকে বের হলো একটি লিফলেট। ছবিসহ আল মাহমুদের একটি কবিতা ছাপা হলো লিফলেটে। যে কবিতার শরীরে জড়ানো ছিলো ভাষা আন্দোলনের উত্তাপ। পরিণামে পুলিশ তাড়া করেছিলো তাকে। খুঁজছিলো নানান গলি-সন্ধিতে। তার সঙ্গে ছিলেন তারই সমবয়সী সম্পর্কে চাচা সাংবাদিক মুসা। দু’জনই পুলিশের অগ্নিচোখের শিকার। ব্রাহ্মণবাড়িয়া ছেড়ে বেরিয়ে পড়লেন আল মাহমুদ। সেই যে বেরিয়ে গেলেন, বসবাসের জন্য আর কখনো ফেরেননি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। ১৯৭১ সালে যখন আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলছিলো, সরাসরি যুদ্ধে যোগ দিলেন আল মাহমুদ। চলে গেলেন কলকাতা। তখন কেবল তার পরিবার ব্রাহ্মণবাড়িয়া ফিরে গেলো কিছুদিনের জন্য। স্বাধীনতার পর আবার ঢাকায় ফিরলেন সবাই। এরপর তার পরিবারও আর কখনো থাকতে যায়নি গ্রামের বাড়ি।
সোনালী কাবিন’ শব্দ দুটো উচ্চারণ করলেই যার নাম সামনে আসে, তিনি হচ্ছেন কবি আল মাহমুদ। গত ৫০ বছর ধরে বাংলা কবিতার জগতে আলোড়ন তুলেছেন এই কবি। ‘সোনালী কাবিন’ কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমে সাহিত্যানুরাগীদের মনে স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছেন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম এই প্রধান কবি। কবিতা, গল্প এবং উপন্যাস-সব শাখাতেই তাঁর বিচরণ থাকলেও, আল মাহমুদ কবি হিসেবেই ব্যাপক পরিচিত। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘লোক লোকান্তর’ প্রকাশিত হয় ১৯৬৩ সালে। কিন্তু কাব্যগ্রন্থ ‘সোনালী কাবিন’ আল মাহমুদকে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে নিয়ে যায়। আল মাহমুদের কবিতা বাংলাদেশের অনেক কবিকে প্রভাবিত করেছিলো। এদের মধ্যে কবি আসাদ চৌধুরী অন্যতম। আল মাহমুদের কবিতা শুধু তাকেই নয়, বহু পাঠককে প্রভাবিত করেছে।
বিবিসিকে আসাদ চৌধুরী বলেন ‘আমি অজস্র মুক্তিযোদ্ধাকে দেখেছি সোনালী কাবিন তাদের মুখস্থ।’ আল মাহমুদের কবিতার বিষয়বস্তুতে প্রথম দিকে গ্রামের জীবন, বামপন্থী চিন্তা-ধারা এবং নারী মুখ্য হয়ে উঠলেও পরবর্তীতে ইসলামী ভাবধারাও প্রবল হয়ে উঠে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আগে এবং পরে-এ সময়ের মাঝে তাঁর মতাদর্শে ব্যাপক পরিবর্তন হয়। আল মাহমুদের কবিতায় মুক্তিযুদ্ধের আগে বাম ধারা দেখা গেলেও ১৯৭৪ সালের পর থেকে তাঁর কবিতায় ইসলামী ভাবধারাও লক্ষ্য করা যায়। ১৯৭২ সালে আল মাহমুদ তৎকালীন গণকন্ঠ পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। যে পত্রিকাটির মালিকানা ছিলো জাসদের এবং সেটি সরকার বিরোধী হিসেবে পরিচিত ছিলো। আল মাহমুদের সম্পাদনায় তখন গণকন্ঠ পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেছেন গবেষক মহিউদ্দিন আহমেদ। তিনি মনে করেন, আল মাহমুদ গণকন্ঠের সম্পাদক থাকলেও তার দলীয় কোন পরিচয় ছিলোনা। রাজনৈতিক দল জাসদের প্রতি সহানুভূতি থাকলেও আল মাহমুদ কখনো সরাসরি রাজনীতিতে জড়াননি। ১৯৭৪ সালের ১৭ই মার্চ তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ির সামনে জাসদের উদ্যোগে ঘেরাও কর্মসূচীর ডাক দেয়া হয়। সেদিন রাতেই তৎকালীন গণকন্ঠের সম্পাদক আল মাহমুদকে গ্রেফতার করা হয়। মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, “জাসদ গণকন্ঠের মালিক ছিলো বলে আল মাহমুদ ভিকটিম হলেন এবং তিনি অনেকদিন বিনা বিচারে কারাগারে ছিলেন”। মহিউদ্দিন আহমেদের বর্ণনায় জেল থেকে মুক্তি পাবার পর ‘অন্যরকম এক আল মাহমুদের’ দেখা মিললো। তখন আল মাহমুদের মধ্যে ইসলামী ধ্যান-ধারণা প্রবল হয়ে উঠে বলে উল্লেখ করেন মহিউদ্দিন আহমেদ। আল মাহমুদ কবি হলেও তিনি নিজেকে রাজনৈতিক দর্শন থেকে দূরে রাখেননি। এনিয়ে তর্ক-বিতর্ক যাই থাকুক না কেন, কবি আসাদ চৌধুরী আল মাহমুদকে বিচার করেন তাঁর লেখা এবং শিল্পের বিচারে। মহিউদ্দিন আহমেদ একসময় কবি আল মাহমুদের সহকর্মী ছিলেন। শুরুর দিকে বামপন্থী চিন্তাধারার হলেও, সেখান থেকে সরে এসে আল মাহমুদ কেন ইসলামী ভাবধারার দিকে ঝুঁকলেন? ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বিবিসি বাংলার সাথে এক সাক্ষাৎকারে তিনি সে ব্যাখ্যাও দিয়েছেন। আল মাহমুদ বলেছিলেন তিনি কখনো মার্কসবাদী ছিলেননা বরং তাঁর চরিত্রে এক ধরনের দোদুল্যমানতা ছিলো। তিনি বিবিসিকে বলেছিলেন, “আমি যে পরিবারে জন্মেছি, তারা সবাই ছিলো খুবই ধর্মপ্রবণ লোক। কিভাবে যেন তাদের মধ্যেই যে রয়েছে সত্যিকারের পথের ঠিকানা, এটা আমাকে দূর থেকে ইশারায় ডাকতো”।
আসাদ চৌধুরী বলেন, “বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর অনেক মুক্তিযোদ্ধার মতো তাঁরও ক্ষোভ বেশি ছিলো এবং ক্ষোভের প্রকাশটা রাজনৈতিক আচরণের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে। যেটা অনেকে পছন্দ করেননি। কিন্তু শিল্পীকে বিচার করতে হয় শিল্পের মাপকাঠিতে। আল মাহমুদকে বিচার করতে হবে তাঁর কবিতা দিয়ে”। কবি হলেও আল মাহমুদ বিভিন্ন সময় সংবাদপত্রে কাজ করেছেন। কিন্তু বরাবরই তিনি প্রাধান্য দিয়েছেন তাঁর কবিতাকে। লোক-লোকান্তর, কালের কলস, সোনালী কাবিন-একের পর এক কাব্যগ্রন্থ লিখেছেন তিনি। মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আল মাহমুদ সবসময় দাবী করতেন তিনি একজন কবি। তিনি কখনোই বলেননি যে তিনি একজন সম্পাদক’। আল মাহমুদ সবসময় চাইতেন তাকে তাঁর কবিতা দিয়েই মূল্যায়ন করা হোক। আল মাহমুদের কবিতা বহু সাহিত্যানুরাগীর মনে আলোড়ন তুলেছিলো। ১৯৫০ সালের পর বাংলা সাহিত্যে যতো কবির আবির্ভাব হয়েছে, শিল্পমান এবং লেখার বিচারে বিশ্লেষকরা আল মাহমুদকে সন্দেহাতীতভাবে প্রথম সারিতেই রেখছেন।
আমাদের ক্ষমা করে দিও প্রিয় আল মাহমুদ। জানই তো জাতি হিসেবে আমরা কতটুকু ব্যর্থতায় ভরপুর আমাদের ইতিহাস। তোমার উপযুক্ত পাওনাটুকুও আমরা পরিশোধ করতে পারিনি। তাই আমরা তোমার আত্মার কাছে করজোড়ে ক্ষমাপ্রার্থী…

তথ্যসূত্রঃ দৈনিক ইনকিলাব, দৈনিক নয়া দিগন্ত, বিবিসি বাংলা নিউজ।

Comments

comments

About

Check Also

রাসুলুল্লার হিজরাত : প্রাসঙ্গিক ভাবনা

পৃথিবীতে তখন ঘোর অমানিশার রাজ। চারিদিকে বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্যের দৃঢ় ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। যে ভিন্নতার জন্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *