আকাশ ছোঁয়া বৃক্ষ হৃদয় ছোঁয়া ফুল

স্বপ্নের অনুভব
স্বপ্ন মানুষকে আনন্দ দেয় অথবা স্মৃতিকাতর করে। ভয় জাগানিয়া স্বপ্ন দেখে মানুষের কান্নাও পায়। স্বপ্নের সাথে কখনো জীবনের ঘটে যাওয়া স্মৃতির একটা যোগ অথবা অনাগত দিনের কোন ঘটিতব্য বিষয়ের ইংগিত থাকে। আমার শিশুকাল ও কৈশোরের স্মৃতির সাথে নিজের বাড়ি তারাপুর ও হলদিপুর (আমার দাদার বাড়ি, আব্বার মামা মরহুম দলীল উদ্দীন চৌধুরীর স্নেহছায়ায় থেকে হলদিপুর সরকারী প্রাইমারী স্কুলে ক্লাস থ্রি থেকে ফাইভ পর্যন্ত পড়েছি) এবং নানাবাড়ির ছোট ছোট অনেক ঘটনা, বিষয়-আসয়ের সম্পর্ক জড়িয়ে আছে, যা সবারই থাকে। আমার বাস্তব চিন্তায় এসব বিষয়-আশয় কখনো কখনো ঘুরে ফিরে আসে, কিন্তু স্বপ্নের অনুভবে এসব বিষয় খুব কমই দেখতে পাই। কৈশোরের অনেকটা সময় এবং এর পরবর্তী একটা দীর্ঘ সময় আমার কেটেছে ফুলতলীতে। বলতে গেলে আমার বেড়ে ওঠা কালের বেশ দীর্ঘ সময়তো বটেই একটা ছন্দময়-স্বপ্নীল সময় কেটেছে ফুলতলী ছাহেব বাড়িতে। এখন যখন অতীতের কোন ঘটনা প্রবাহের স্মৃতি স্বপ্ন-খোয়াবে দেখতে পাই তখন প্রায়শই ফুলতলী সংশ্লিষ্ট বিষয়-আশয়, ছাহেব ক্বিবলাহ, ছাহেববাড়ি, ফুলতলী মাদ্রাসা এবং ঐসব প্রিয় মানুষজনের স্মৃতিময়তায় আবেশ-সুবাসে মোহিত হই, যাঁদের কারো সাথী হয়ে অথবা কারো সান্নিধ্য ধন্য হয়ে দুই দশকেরও অধিককাল ব্যাপী আমার সকাল-সন্ধ্যা হয়েছে আলোকোজ্জ্বল, হয়েছে বর্ণময়। তাই আক্ষরিক অর্থেই আমার ফুলতলীর স্মৃতি বা মাদ্রাসা জীবনের স্মৃতি বলতে এক-দুই ক্লাস বা এক-দু বছর পড়–য়া বোর্ডিং আবাসিক তালাবার মতো রাত ও দিন যাপনের রুটিন স্মরণ করেই শেষ হবার নয়। এটা কোনো মহাকাব্য বা বিশাল স্মৃতিগাঁথার শব্দসম্ভার জাতীয় কিছু তাও বলতে চাচ্ছিনা বরং স্মৃতির জাহাজ ভর্তি মণি-মুক্তার এই ঢের, আমার বুক-পাঁজরের গভীর অলিন্দে অগুনতি ঢেউয়ের সমাহার; যা আমি আগে কখনো গুনতে বসিনি।

শুরুর সন্ধ্যা
আব্বা আমাকে যেদিন ফুলতলীতে নিয়ে আসেন সে দিনটি ছিল রৌদ্রজ্জ্বল সুন্দর একটি দিন। আমাদের বাড়ি থেকে রওয়ানা হয়ে ফুলতলী গিয়ে পৌঁছতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল। আমারতো তর সই ছিল না, মনে হচ্ছিল আমরা যেন এক-দেড় দিন ধরে বাসেই চড়ছি। ১৯৮১ সনের সেপ্টেম্বর অথবা অক্টোবর মাস হবে। রামাদ্বানের মাসখানেক পূর্বে, এই হিসাবে হিজরী বর্ষের রজব মাসের শেষের দিকে অথবা শাবান মাসের শুরুর দিক হবে। আমরা ছাহেব বাড়িতে দু’দিন অবস্থান করে ফিরে এসেছিলাম। আমাদেরকে বলা হয়েছিল, একমাস পরেই রামাদ্বান শুরু হবে আর রামাদ্বানে মাদ্রাসা বন্ধ থাকে, তাই রামাদ্বানের পরে গিয়ে ভর্তি হতে। অথবা রামাদ্বানের শুরুতে এসে ‘দারুল ক্বিরাতে’ ভর্তি হতে পারব। দারুল ক্বিরাত কি আমাদেরকে বুঝিয়ে বলা হলে, এ ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করতে করতে বাড়িতে ফিরে আসি। আব্বার ইচ্ছা ছিল রামাদ্বানের পর আবার নিয়ে গিয়ে মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিবেন। আমার কেন জানি ফুলতলীর জন্যে একটা মায়া লেগে গিয়েছিল, তাই মন চাইছিল রামাদ্বানেই গিয়ে দারুল ক্বিরাতে ভর্তি হই। আম্মাকে দিয়ে আব্বাকে বলালাম আর রামাদ্বান শুরু হওয়ার তিন-চার দিন আগেই আব্বা আমাকে ফুলতলীতে রেখে আসলেন। আমার ফুলতলী জীবনের শুরু এভাবেই।

রোদেলা পাহাড়
আমাদের বাড়ি থেকে উত্তরের মেঘালয়ের পাহাড়গুলো আবছা চোখে পড়ে। আমার ছোটবেলার আগ্রহের বিষয়গুলোর একটি ছিল এই দূরের পাহাড়, যা হিমালয় পর্বতমালার অংশ, বাংলাদেশের উত্তর সীমান্তে অবস্থিত ভারতের মেঘালয় রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত। পুকুর বা নদীর পাড়ে অথবা খোলা মাঠে দাঁড়িয়ে কখনো কখনো আনমনে এই পাহাড়গুলোর দিকে চেয়ে থাকতাম। এর বিশালতা, উচ্চতা আর অবিচলতা আমাকে আকৃষ্ট করত। আকাশের নীলের সাথে মিশে অন্য এক ধরণের নীল রং ধারণ করা বিশাল-বিস্তৃর্ণ পাহাড়রাজী আমার শিশু বয়সের ধারণা-চিন্তায় এক বিস্তৃত ঔজ্জ্বল্য এনে দিত। ফুলতলী যাত্রায় আমাদের বাস জনপদ, হাওড় আর ফসলের মাঠ পেরিয়ে যত সামনের দিকে এগুচ্ছিল, একসময় দূরের পাহাড়গুলোকে বেশ কাছ থেকে দেখছি বলে মনে হলো। হাঁ, আমাদের বাড়ি থেকে চোখেপড়া পাহাড়ের তুলনায় অনেক কাছে এগুলো। সবুজ বৃক্ষরাজির অস্তিত্ব আর পাহাড়ী সড়ক ও জনপদের চিহ্ন-রেখা লক্ষ্য করলেই বোঝা যাচ্ছে। অস্তগামী সূর্যের আলোকচ্ছটায় পাহাড় আর পাহাড়ঘেঁষা গ্রামগুলোকে সাদা মেঘের সামিয়ানার নীচে রোদমাখা সবুজ সোনার চাদর বিছানো ঢেউখেলানো মাঠ বলে মনে হচ্ছিল। যতই দেখছিলাম অভিভূত হচ্ছিলাম।

সান্নিধ্যের দুপুর
ছাহেব বাড়ির দক্ষিণের বাংলো ঘরের উত্তর পাশে একটি চৌকিতে আমার বিছানা। (তখনকার দিনে সাহেব বাড়িতে দুটি বাংলো ঘর বা টংগিঘর ছিল, দুটি ঘরের মাঝখানে ছিল ভেতর বাড়ির মূল প্রবেশ পথ এবং মেইন ফটক। এই সদর দরজার দুপাশে দুটি বিল্ডিং-এর উত্তরদিকের উত্তরের টংগি এবং দক্ষিণ দিকেরটিকে দক্ষিণের টংগি বলা হত।)
দুপুরে খেয়ে-ধেয়ে বসে আছি। আনমনে গুনগুন করছি। কখন জানি সুর এবং বুল দুটিই একটু উচ্চে উঠে গেছে-‘ইয়া নবী সালাম আলাইকা, ইয়া রাসূল সালাম আলাইকা…’। ঐ দিকটার (বাড়ির মূল প্রবেশ পথের) জানালা খোলাই ছিল। একটি মায়াভরা কন্ঠ, দরদমাখা সম্বোধন-‘বাচ্চা, তোমার খাওয়া অইছেনি? অথবা ‘বাচ্চা তুমি খাইছনি?’ দেখলাম ছাহেব ক্বিবলাহ জানতে চাচ্ছেন আমি খেয়েছি কি না। আমি তাঁর প্রথম এই মায়ার সম্বোধন এবং স্নেহভরা শুভদৃষ্টির আকর্ষণে ভীত হই, আনন্দিত হই এবং কী যেন এক প্রাপ্তির তৃপ্তিতে স্ফীত হই অন্তরে ও বাহিরে। (আগের দিন সন্ধ্যায় ছাহেব ক্বিবলাহর সাথে আমাদের দেখা হয়েছিল, আলাপ হয়েছিল। বাড়ি-ঘরের খোঁজ-খরব নিয়েছেন। মাদ্রাসায় ভর্তি হতে এসেছি, রামাদ্বানে দারুল কিরাতে পড়ব, এই সব তথ্যের পর আব্বা আমানত সমজানোর মত করে আমাকে তাঁর হাতে সমজিয়ে দেন।) আমি ঘর থেকে বের হয়ে তাঁকে অনুসরণ করি। তিনি উত্তরের বাংলো ঘরের বারান্দার দক্ষিণ পাশে রাখা ইজিচেয়ার নিতে গেলে আমিও এতে ধরি এবং এটি বসাতে বসাতে আমাকে শিক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্যে বলেন, ‘ওলান ওলান’ (এভাবে এভাবে)।
এটা ছিল আমার ফুলতলী জীবনের দ্বিতীয় দিনের কথা। স্মৃতির এই একান্ত সান্নিধ্যধন্য দুপুর, প্রশস্ত এক আত্মার সাথে আমার হৃদয়সূত্রের বন্ধন সূচনায় মুহব্বতের স্বচ্ছ ঝর্ণার সূত্রপাত করেছিল বলে মনে করি। সময়ের সাথে সাথে এই একান্ততার মহিমায় আমি আলোকপ্রাপ্ত হয়েছি, সান্নিধ্য-সুষমায় মহাপ্রাণের সুঘ্রাণ প্রভাবে আমি কখনো গেয়েও উঠেছি-
ঘুচাতে যামানার আঁধার
এলেন তিনি মুজাদ্দিদ,
দিলেন দিশা ভ্রান্তজনে
টুটলো সবার চোখের নিঁদ,
হেজাযী চেরাগের আলোয়
ভাসলো এ বাংলার যমীন,
বালাকোটের সত্যবাণী
শুনালেন ফের মুয়াজ্জিন,
বদরপুরীর আদরের ধন
পীরানে পীর ফুলতলী;
রাহবারে দ্বীন, মুরশিদে হক্ব,
পীরানে পীর ফুলতলী-
ছাহেব ক্বিবলাহ ফুলতলী।

বটবৃক্ষের ছায়া
বাড়িতে অবস্থান কালে ছাহেব ক্বিবলাহ দিনের একটা নির্দিষ্ট সময়ে প্রায়ই উত্তরদিকে মুখ করে ইজিচেয়ারে আরাম করতেন। তাঁর চেয়ারটি সাধারণত: উত্তর দিকের বাংলোর সামনের পাকা স্থানে পাতা হতো। এখান থেকে উত্তরের পাহাড়গুলোর অনেকটাই দেখা যেতো। তখনকার দিনে ছাহেব বাড়ির পুরুনো মসজিদ ছাড়া অদূরের গ্রাম পর্যন্ত এদিকটায় কোন বিল্ডিংই ছিলনা। ছাহেব ক্বিবলাহর বৈকালিক এই বিশ্রাম কালে আমি কখনো কখনো সান্নিধ্য পেতাম। কোন কোন দিন দেখতাম গ্রামের বয়স্ক-মুরব্বীদের এক-দুই জন এসে বসতেন, কথা-বার্তা বলতেন। ছাহেব ক্বিবলাহ উনাদের কদর করতেন, আপ্যায়ন করাতেন। মানুষকে মূল্যায়ন করা, সম্মান করা, স্নেহ করা, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য না করা ছিল তাঁর বৈশিষ্ট্যপূর্ণ স্বভাব। হয়তো আমাদের অনেকেরই স্মরণ আছে জমসেদ নামের মানুষটির কথা, যিনি ছাহেব ক্বিবলাহর প্রায় সকল মাহফিলগুলিতে উপস্থিত থাকতেন। একটু অন্য রকমের জমসেদ তেমন কারো সাথে মিশতেন না। সহস্র মানুষের মাঝেও ইনি তাঁর নিজের মত করে একা থাকতেন। কেউ কেউ তাঁকে বিরক্তও করতো, হয়ত বা তিনি সামান্যতেই ক্ষেপে যেতেন। যাই হোক, এই মানুষটি যে ছাহেব ক্বিবলাহকে মুহব্বত করতেন তাতে কোন সন্দেহ ছিলনা। ব্যতিক্রম ছাড়া প্রায় প্রতি জুমুয়া বারেই ছাহেব ক্বিবলাহর সিলেট সুবহানীঘাটস্থ (পুরনো) বাসভবনে অতি সকাল সকাল হাজির হতেন। চিৎকার করে কয়েকবার ‘ছাহেব ক্বিবলাহ জিন্দাবাদ’ ইত্যাদি শ্লোগান দেবার পর, এ দিক ও দিক ঘুর ঘুর করতেন। আমি লক্ষ্য করেছি এই মানুষটির প্রতিও ছাহেব ক্বিবলাহর খেয়াল রাখার বিষয়টি। ‘ও এতো সকালে আসে, ওকে খাইয়ে দিতে’- বাবুর্চিকে এ রকম কিছু বলে দিতে অনেক বার শুনেছি। আমি ছাহেব ক্বিবলাহর আশ-পাশের নগন্য-ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র মানুষটিকেও কোন না কোন ভালো গুণে গুণান্বিত পেয়েছি। আবার এমনও কিছু মানুষকে পেয়েছি যাদের উদাহরণ হাজারে আসওয়াদের ঐ পাহারাদারের ন্যায় যে জীবনে কখনো হাজারে আসওয়াদে চুমুই খায়নি! অথবা যাদের উদাহরণ ঐ ব্যক্তির ন্যায় যে সুগন্ধির পাহাড়ে আরোহণ করেও একটু সুগন্ধিও গায়ে মাখেনি! জমসেদকে ছাহেব ক্বিবলাহর মাহফিলে-দোআয় যে ভাবে ব্যাকুল হয়ে কাঁদতে দেখেছি, আমি এমনটি আর কমই দেখেছি।
অনুগামী-অনুসারী ছাড়াও তাঁর সমকালীনদের জন্য তিনি বিশাল বটবৃক্ষের মতো ছিলেন ছায়া স্বরূপ।
তাঁর বিশ্রামকালীন সময়ে বৈকালিক বসার স্থান থেকে পিছনে দাঁড়িয়ে উত্তরের পাহাড়ের সবচেয়ে উঁচু শৃঙ্গটি আমি প্রায়ই মনোযোগ দিয়ে দেখতাম। তখন আমার মনের মধ্যে অলৌকিক কোন এক যোগ-আবেশের অনুভব হতো। একদিন গ্রামের সম্মানিত এক বয়স্ক জিজ্ঞেস করলেন-হযরত নিজামুদ্দিন আউলিয়া এবং খাজা মুঈনুদ্দিন চিশতি’র মধ্যে কে বড় ওলী! ছাহেব ক্বিবলাহ কিছুক্ষণ নিরব থেকে পাহাড়ের দিকে ইশারা করে বললেন, “ঐ পাহাড় দেখো, ঐ দুইটি পাহাড়ের মধ্যে কোনটির ওজন বেশী হবে বলতে পারো কি? ‘জি না এটা কিভাবে বলা যাবে!’ তাহলে, হযরত নিজামুদ্দিন আউলিয়া এবং খাজা মুঈনুদ্দিন চিশতিকে মাপার জন্য (ওজন করার জন্য) কোন্ পাল্লা নিয়ে এসেছ?”
কী হিকমাতপূর্ণ উত্তর, তা’লিম-তারবিয়াতের কী সুন্দর দৃষ্টান্ত। আল্লাহর ওলীগণের শিক্ষা ও আদর্শ থেকে নিজের জীবনে আলো ছড়াও। তোমার চরিত্র গঠনে তাঁদের নসিহত থেকে দীক্ষা নাও, তাঁদেরকে মাপতে-ঝোঁকতে চেষ্টা করো না কত সহজ করে তা বুঝিয়ে দিলেন।
এখানেতো ছায়া ছিল,
শ্যামল ছায়া
বহু যুগ ধরে ছায়ায় লালিত শিশু গাছগুলো হঠাৎ বুঝতে পারে,
আজ ছায়া নেই
বহু চেনা বহু জানা শ্যামল ছায়া;
ছিন্ন হয়েছে মাটির যোগাযোগ
আকাশ ছোঁয়া অশ্বত্থ মিশে গেছে আকাশের সাথে।
(চলবে)

Comments

comments

About

Check Also

রাসুলুল্লার হিজরাত : প্রাসঙ্গিক ভাবনা

পৃথিবীতে তখন ঘোর অমানিশার রাজ। চারিদিকে বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্যের দৃঢ় ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। যে ভিন্নতার জন্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *