স্বাধীনতার ৪৮ বছর : প্রত্যাশা-প্রাপ্তি

ডিসেম্বর মাস বাঙালির বিজয়ের মাস। বর্ষ পরিক্রমায় ঘুরে আবার আমাদের মাঝে এলো বহুল কাঙ্খিত ডিসেম্বর মাস। এই মাসটা এলেই মনে করিয়ে দেয় আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কথা, কত বীরত্ব ও অসামান্য আত্মত্যাগের কথা। মহান মুক্তিযুদ্ধে জয় লাভের এই মাসটিকে আমরা বড় আবেগের আনন্দ ও বেদনা নিয়ে উদযাপন করি। আর বিজয়ের মাসটিকে স্মরণ করে রাখার জন্য জাতীয়ভাবে বিভিন্ন কর্মসূচীও পালিত হয়। এটি দেশ এবং জাতির জন্য গৌরবের দিন। আনন্দ বিজয়ে, বেদনা লাখো শহীদের আত্মদান আর রক্তের ¯্রােতের কারণে। তবুও স্বাধীন বাংলাদেশ আমাদের প্রাণে গর্ব ও গৌরবের বাঁশি বাজায়। কিন্তু ‘সোনার বাংলা’ কতটা সর্বজনীন সোনার বাংলাদেশ হতে পেরেছে তা আমাদের ভাবনায় খুব কমই আসে। একবারও কি ভেবে দেখেছি যে, স্বাধীন বাংলাদেশ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে কতটা অগ্রসর হয়েছে? একাত্তরে স্বাধীনতা অর্জনে আমাদের সার্বিক প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মধ্যে কতটা ফারাক রয়েছে? নাকি আদৌ কোন ফারাক নেই! বিষয়টি তখনই স্পষ্ট হয়ে ওঠে যখন আমরা স্বচ্ছ দৃষ্টিতে স্বাধীনতা পরবর্তী অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থার দিকে তাকাই। দেখতে পাই- উচ্চবিত্ত, শ্রেণি বিশেষ এবং রাজনৈতিক দলের নেতা-নেত্রীদের ভাগ্যই কেবল উন্নতির দিকে যাচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে নি¤œবিত্ত তথা কৃষক-শ্রমিক ও কারিগর শ্রেণির মানুষের ভাগ্যে তেমন একটা প্রভাব পড়েনি।
বুক ভরা আশা নিয়ে এ দেশের সর্বস্তরের মুক্তিকামী মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে। শুরু হয় স্বাধীনতা যুদ্ধ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে দীর্ঘ নয় মাস সে যুদ্ধ চলে। যার চূড়ান্ত বিজয় আসে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১। এই গৌরবোজ্জ্বল দিনটিই বাংলাদেশের মহান বিজয় দিবস। দেশ স্বাধীন হয়েছে ঠিকই; কিন্তু ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটেনি এ দেশের সাধারণ মানুষের। জীবনযুদ্ধে প্রতিনিয়ত তাদের একমুঠো ভাত যোগাড় করতেও হিমশিম খেতে হচ্ছে। এসব দেখার যেন কেউ নেই! সর্বদা সুবিধাভোগীরা নিজেদের স্বার্থ নিয়েই সন্তুষ্ট থাকে। স্বাধীন বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সূচক পূরণে যতটা এগিয়ে যাচ্ছেতার চেয়ে সুবিধাভোগীরাই বেশি সমৃদ্ধি লাভ করছে। সুবিধাভোগীরা বাঙালী, আর বঞ্চিতরাও বাঙালী। আর এই অর্জন কেবলমাত্র শ্রেণি বিশেষের জন্যই যুদ্ধে অর্জিত বিজয় তা প্রমাণ করে দিয়েছে। স্বাধীনতা তথা বিজয়ের মাস নিয়ে গর্ব কি শুধু সমৃদ্ধ শ্রেণির জন্যই? সমাজ পরিবর্তন না হওয়া পর্যন্ত এ অবস্থা চলতেই থাকবে? তবে কি এই অবস্থা থেকে এদেশের সাধারণ মানুষ রেহাই পাবে না? এ প্রশ্ন আজ সমাজের সচেতন ও বিবেকবান সব মানুষের।
বিশ্ব ইতিহাসে আমাদের মতো অধিক মূল্য দিয়ে কোনো জাতি স্বাধীনতা অর্জন করেছে বলে খুব একটা জানা যায় না। ১৭৫৭ সালের পলাশী ট্র্যাজেডির মাধ্যমে আমাদের স্বাধীনতার লাল সূর্যটা অস্তমিত হয়েছিল। মীর জাফরসহ অতিঘনিষ্ঠজনদের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে পলাশীর আম্রকাননে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলা’র পরাজয়ের মাধ্যমে আমরা স্বাধীনতা হারিয়েছিলাম। কিন্তু আমরা যখন আবার স্বাধীনতা ফিরে পেলাম তখন বেশ মূল্য দিতে হয়েছে আমাদেরকে। আমরা যদি সমসাময়িক স্বাধীনতা সংগ্রাম ও বিভিন্ন গৃহযুদ্ধের দিকে তাকাই তাহলে একথা অবশ্যই মানতে হবে যে, স্বাধীনতা অর্জনের জন্য আমাদের যে ত্যাগ ও কোরবানীর প্রয়োজন হয়েছে, অন্যদের ক্ষেত্রে তেমনটা নয়। আমাদের স্বাধীনতা যেমন ছিল রক্তপিচ্ছিল, ঠিক তেমনিভাবে গৌরবেরও। আমাদের দেশে মাত্র নয় মাসেই প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে ত্রিশ লাখ। সম্ভ্রম হারিয়েছেন দু’লাখ মা-বোন। যদিও উল্লিখিত সংখ্যা নিয়ে কিছুটা বিতর্ক আছে; কিন্তু একথা অনস্বীকার্য যে, বাংলাদেশের সমসাময়িক কালের মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে এতো চড়ামূল্য আর কোনো জাতিকে দিতে হয়নি।
১৯৪৭ সালে ঔপনিবেশিক শাসনের অবসানের পর ভারত বিভাজিত হয়েছিল দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে। আসলে ভারত কখনোই বিভাজিত হতো না যদি ভারতীয় রাজনীতিকরা সিদ্ধান্ত গ্রহণে দূরদর্শিতার পরিচয় দিতেন। বিশেষ করে মহন দাস, করম চাঁদ, গান্ধী (মহাত্মা গান্ধি)’র সাম্প্রদায়িক মনোবৃত্তির কারণেই মুসলমানদের পক্ষে অখন্ড ভারত মেনে নেয়া সম্ভব হয়নি। বৃটিশরা চলে যাওয়ার পর স্বাধীন ভারতে কোন বিষয়টি অগ্রাধিকার দেয়া হবে এমন এক প্রশ্নের জবাবে মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন, ‘ভারত স্বাধীনের পর অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গো হত্যা নিবারণ করা হবে’। তার এই সাম্প্রদায়িক মনোবৃত্তির পর মুসলমানদের পক্ষে কোনোভাবেই অখন্ড ভারতে যোগ দেয়া মোটেই সম্ভবপর ছিল না।
অনিবার্য কারণেই ভারত বিভাজিত হয়েছে। ঠিক সঙ্গত কারণেই পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান এক ও অখন্ড থাকতে পারেনি। সাম্য, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা, দুর্নীতিমুক্ত সমাজ, সামাজিক মূল্যবোধ, অর্থনৈতিক শোষণ থেকে মুক্তি ও সাংস্কৃতিক গোলামী থেকে মুক্তি লাভের জন্যই এদেশের আপামর জনসাধারণ দীর্ঘ নয় মাসের মরণপণ মুক্তি সংগ্রামের মাধ্যমে বিশ্বমানচিত্রে বাংলাদেশ নামের একটি নুতন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটিয়েছিল। কিন্তু যে প্রত্যাশা নিয়ে আমরা পিন্ডির গোলামীর শৃঙ্খল থেকে বেড়িয়ে এসেছিলাম সে প্রত্যাশা আমাদের কাছে অধরাই থেকে গেছে। মূলত দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতেই ভারত বিভাজিত হয়ে ভারত ও পাকিস্তান নামের পৃথক দু’টি রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটেছিল। শেখ মুজিবুর রহমানও পাকিস্তান আন্দোলনের একজন তুখোর ছাত্রনেতা ছিলেন। তিনিও স্লোগান দিতেন ‘লরকে লেঙ্গে পাকিস্তান, কায়েম করেঙ্গে আল-কুরআন’। আসলে পাকিস্তান প্রস্তাবনায় ধর্মনিরপেক্ষতার কোনো স্থান ছিল না।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও মহান বিজয়ের পর ধর্মনিরপেক্ষতা জাতির ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। ধর্ম, বিশেষ করে ইসলামকে মুক্তিযুদ্ধের প্রতিপক্ষ হিসাবে দাঁড় করিয়েছে। আসলে ১৯৭০ সালের নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ স্বাধীনতার বিষয় নিয়ে কোনো কথা বলেনি। মূলত পাকিস্তানি শাসনচক্রের ক্ষমতালিপ্সা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অভাবেই পাকিস্তান ভেঙেছে। এমন কী তারা তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে ‘কুরআন-সুন্নাহ’ বিরোধী কোনো আইন প্রণয়ন করা হবে না বলেও জাতির কাছে অঙ্গীকার করেছিল। কিন্তু পিন্ডির গোলামী থেকে মুক্তির পর সবকিছুই পাল্টে গেছে। যে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ভাগ হলো স্বাধীন বাংলাদেশে তার কোনো প্রতিফলন দেখা গেল না।
অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা ও রক্তের বিনিময়ে গণমানুষের স্বাধীনতার আকাঙ্খা বাস্তরূপ লাভ করেছিল ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। এই জনপদের মানুষের স্বাধীনতার আকাঙ্খা দীর্ঘ দিনের লালিত বিষয়। স্বাধীনতার লক্ষ্যে তারা যুদ্ধ করেছে ইংরেজদের বিরুদ্ধে, পাকিস্তানের জালিম শাসকদের বিরুদ্ধে। স্বাধীনতার এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় নেতৃত্ব প্রদানের জন্য আমরা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে থাকি- নবাব সিরাজউদ্দৌলা, শহীদ তিতুমীর, নবাব স্যার সলিমুল্লাহ, শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, শেখ মুজিবুর রহমানসহ আরও অনেক মহান নেতাকে। তবে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে বিশেষ অবদান রেখেছেন শেখ মুজিবুর রহমান ও স্বাধীনতার সংগঠক অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধারা। আমরা জানি যে, স্বাধীনতা অর্জনের চেয়েও কঠিন হলো স্বাধীনতা রক্ষা এবং স্বাধীনতার লক্ষ্যসমূহ অর্জন করা। এ ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জিত না হলে রাষ্ট্রও পরিণত হতে পারে ব্যর্থ রাষ্ট্রে।
একটি গণতান্ত্রিক, সুখী, সমৃদ্ধ, শোষণ ও বঞ্চনামুক্ত সমাজ বিনির্মাণের প্রত্যয় নিয়েই বীর মুক্তিযোদ্ধারা দীর্ঘ নয় মাস মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে প্রিয় মাতৃভূমিকে স্বাধীন করেছিলেন। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষমতালিপ্সা, অপরাজনীতি ও অহমিকার কারণে আমাদের স্বাধীনতার প্রায় পাঁচ দশক অতিক্রান্ত হলেও সে প্রত্যাশা পূরণ হয়নি; বরং অর্জন যৎসামান্যই বলতে হবে। মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে যখন পুর্ণগঠনে মনোনিবেশ করা উচিত ছিল তখন ক্ষমতাসীনরা নিজেদের ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত বা চিরস্থায়ী করার জন্য যা যা করা দরকার তাই করেছে। বিশেষ মহলকে খুশি করার জন্য সংবিধানকে ভিনদেশী সংবিধানের ডুপ্লিকেট কপি বানালেও তাও তাদের ক্ষমতাকে নিরাপদ করতে পারেনি।
দেশের গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এখন খাদের কিনারে। যার জন্য দেশের মানুষ ক্ষমতাসীনদেরই দায়ি করছেন। পরমত সহনশীলতা গণতন্ত্রের মূল উপাদান। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নাগরিকের কতিপয় অধিকার সংরক্ষণ রাষ্ট্রের দায়িত্ব। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নাগরিক তিন ধরনের অধিকার ভোগ করবে-
১. সামাজিক অধিকার
২. রাজনৈতিক অধিকার
৩. অর্থনৈতিক অধিকার।


পাঠকদের জ্ঞাতার্থে নিম্নে নাগরিক অধিকার নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হলো-
সামাজিক অধিকার : ১. জীবনধারণের অধিকার, ২. ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকার, ৩. মত প্রকাশের অধিকার, ৪ সভা-সমিতি করার অধিকার, ৫. সম্পত্তি ভোগের অধিকার, ৬. ধর্মীয় অধিকার, ৭. আইনের অধিকার, ৮. চুক্তির অধিকার, ৯. ভাষার অধিকার, ১০. পরিবার গঠনের অধিকার ও ১১. শিক্ষা লাভের অধিকার।
রাজনৈতিক অধিকার : ১. ভোটাধিকার, ২. প্রার্থী হওয়ার অধিকার, ৩. অভিযোগ পেশ করার অধিকার, ৪. সমালোচনা করার অধিকার, ৫. চাকুরী লাভের অধিকার ও ৬. বসবাসের অধিকার।
অর্থনৈতিক অধিকার : ১. কাজের অধিকার, ২. উপযুক্ত পারিশ্রমিক লাভের অধিকার, ৩. অবকাশ যাপনের অধিকার, ৪. সংঘ গঠনের অধিকার ও ৫. রাষ্ট্র প্রদত্ত নির্দেশ প্রতিপালনের অধিকার ইত্যাদি।
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নাগরিকের যেসব অধিকারের স্বীকৃতি রাষ্ট্র তার নিশ্চয়তা বিধান করতে পারেনি; বরং নাগরিকরা তাদের অধিকার থেকে প্রতিনিয়ত বঞ্চিত হচ্ছেন। অথচ এসব অধিকার নিশ্চিত করা রাষ্ট্রেরই সাংবিধানিক দায়িত্ব। গণতন্ত্রের মূলমন্ত্র জনগণের শাসন, শাসক গোষ্ঠীর জবাবদিহিতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও স্বাধীন গণমাধ্যমকে সরকার মোটেই গুরুত্ব না দিয়ে তাদের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করার জন্যই গণতান্ত্রিক সকল রীতিনীতি উপেক্ষা করছে। যা আমাদের জন্য রীতিমতো অশনি সংকেত। মূলত শাসনকার্যে জনগণের সম্পৃক্ততা উপেক্ষা করে দেশকে এগিয়ে নেয়া মোটেই সম্ভব নয়।
মূলত- পুঁজিবাদ, সা¤্রাজ্যবাদী একচেটিয়া মহাজনী, মূলধনের চরম জাতীয়তাবাদী, প্রতিক্রিয়াশীল ও সন্ত্রাসমূলক প্রকাশই হচ্ছে ফ্যাসীবাদ। ফ্যাসীবাদ চরম জাতীয়তাবাদী, অযৌক্তিক ধর্ম ও বর্ণ বিদ্বেষ এবং উদ্দেশ্য সাধনে চরম বর্বরতার আদর্শ প্রচার করে। ফ্যাসীবাদ পুঁজিবাদের চরম সঙ্কটের পরিচয় বাহক। সা¤্রাজ্যবাদী যুগ হচ্ছে পুঁজিবাদের চরম যুগ। জাতীয় ক্ষেত্রে পুঁজিবাদের বিকাশ যখন নিঃশোশিত, তখন পুঁজিবাদ নিজের শোষণমূলক ব্যবস্থা কায়েম রাখার জন্য সা¤্রাজ্যবাদী চরিত্র গ্রহণ করে। ফ্যাসীবাদের মূলনীতিগুলো নিম্নরূপ-
ক. প্রথমত, ফ্যাসীবাদ গণতন্ত্রের প্রতি আস্থাশীল নয়। মূলত ফ্যাসীবাদ- ছোট, মধ্যম, বড় এবং সর্বোচ্চ নেতা যা আদেশ করবেন তাই রাষ্ট্রের আদেশ বলে নির্বিবাদে মেনে নিতে হবে।
খ. ফ্যাসীবাদ সমাজতন্ত্রেও অবিশ্বাস করে।
গ. ফ্যাসীবাদে ব্যক্তি স্বাধীনতা ও ব্যক্তিস্বতন্ত্র স্বীকৃত হয় না। ফ্যাসীবাদের মূলমন্ত্র হলো সবকিছুই রাষ্ট্রের আওতাভূক্ত, কোনো কিছুই রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নয়; বরং কোনো কিছুই রাষ্ট্রের বাইরে নয়।
ঘ. ফ্যাসীবাদ শান্তি কামনা করে না। ফ্যাসীবাদ নিয়মিত সংগ্রামে লিপ্ত থাকার অনুে প্ররণা যোগায়। মুসোলিনির মতে, মহিলাদের নিকট যেমন মাতৃত্ব; পুরুষদের নিকট তেমন যুদ্ধ-বিগ্রহ।
ঙ. ফ্যাসীবাদে একদলীয় ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয় এবং দলীয় নেতা রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আসনে আসীন হন। একদল ও একনেতা সরকারের এবং সমাজের সকল কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করেন।
চ. ফ্যাসীবাদে এলিট শ্রেণির শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। এতে বিশ্বাস করা হয় যে, পৃথিবীতে কিছু ব্যক্তি শাসন করতে এবং শাসিত হওয়ার জন্য জন্মগ্রহণ করে।
বিভেদের রাজনীতির কারণে আমরা অনেক পিছিয়েছি। বিশ্বের প্রতিটি রাষ্ট্র যখন উন্নতির স্বর্ণ শিখরে আরহণ করতে সক্ষম হচ্ছে, তখন আমরা নিজেরাই আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছি। আমরা যে প্রত্যাশা নিয়ে পিন্ডির গোলামী থেকে মুক্তিলাভের জন্য মরণপণ যুদ্ধ ও বিজয় অর্জন করেছিলাম প্রতিহিংসা ও অপরাজনীতির কারণে এর সুফল আমরা ঘরে তুলতে পারিনি। দেশে আজও গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বিকশিত হয়নি। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সুস্থ্যধারার রাজনীতি চর্চার সংস্কৃতি এখনও গড়ে ওঠেনি। এ অবস্থায় কোন গণতান্ত্রিক ও সভ্য সমাজ চলতে পারে না। যে প্রত্যাশা নিয়ে আমরা মুক্তি সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতার লাল সূর্য্যটা ছিনিয়ে এনেছিলাম; কিন্তু প্রাপ্তিটা এখনো অনেকটাই অধরা। যা আমাদের দুর্ভাগ্যই বলতে হবে।
প্রতিবছর মহান স্বাধীনতা দিবসে আমরা অনেক আলোচনা করে থাকি। ত্রিশ লক্ষ শহিদের রক্তের বিনিময়ে, দুই লাখেরও বেশি মা- বোনের নির্যাতন ভোগে যে স্বাধীনতা অর্জিত হলো তার সুফল কতটুকু পূর্ণতা পেয়েছে— সেই সুফল জনগণ কতটুকু ভোগ করতে পেরেছে, তার মূল্যায়ন প্রয়োজন। দেশের অনেক অগ্রগতি হয়েছে। আর্থসামাজিক অবস্থার অনেক উন্নয়ন হয়েছে, তবে প্রত্যাশিত ও কাঙ্খিত উন্নয়ন হয়নি। স্বাধীনতার দীর্ঘ ৪৮ বছর অতিবাহিত হয়েছে। এ দীর্ঘ সময়ে আরও অনেক উন্নয়ন হবার কথা ছিলো; কিন্তু তা হয়নি। বিগত বছরগুলোতে স্বনিভরতা, সোনার বাংলা, দারিদ্র্য বিমোচন, সবার জন্য শিক্ষা, একবিংশ শতাব্দির চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা ইত্যাদি নানান ধরনের কর্মসূচি গৃহীত হলেও ৪৮ বছরে বাংলাদেশের অর্জন আশানুরূপ নয়। এই জন্য একদিকে যেমন জনসংখ্যার আধিক্য, শিক্ষার অভাব, দাতাদেশ ও উন্নয়ন সংস্থাগুলোর কঠিন শর্ত আরোপ এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ দায়ী; অন্যদিকে অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি, দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা ইত্যাদিও কম দায়ী নয়।
স্বাধীনতার সুফল অর্জন ও তা জনগনের দ্বারে পৌঁছিয়ে দিতে হলে এসব সমস্যার সমাধানে সকলকে বিশেষভাবে সচেতন ও আন্তরিক হতে হবে। আমরা সবাই দেশের উন্নতি চাই। রাজনৈতিক দলগুলোও দেশের কল্যাণ চায় বলে প্রচার করে থাকে। তাহলে আমাদের প্রত্যাশিত উন্নতি অর্জিত হচ্ছে না কেন? এসবের কারণ খুঁজে বের করে তা দূর করতে হবে। দেশে কল্যাণকামী সকলকে, সকল রাজনৈতিক দলকে ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে দেশের স্বার্থকে স্থান দিতে হবে। কথায় ও কাজে এক হতে হবে। তবেই হবে দেশের উন্নতি, তবেই হবে দেশের কল্যাণ।

Comments

comments

About

Check Also

রাসুলুল্লার হিজরাত : প্রাসঙ্গিক ভাবনা

পৃথিবীতে তখন ঘোর অমানিশার রাজ। চারিদিকে বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্যের দৃঢ় ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। যে ভিন্নতার জন্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *