পহেলা বৈশাখ : উৎসব না অশ্লীলতা

‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’ এরকম একটা ধর্মবিরোধী শ্লোগান আজ আমাদের সমাজে চালু করার ঘৃণ্য প্রয়াস করছে একদল ধর্মবিদ্বেষীরা। একটু গভীরভাবে চিন্তা করলে বোঝা যাবে কথাটির মধ্যে ভুল কোথায়। সত্যিই কি ‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার’? ঈমানদার মাত্রই একথার অসারতা টের পাবেন। কেননা প্রত্যেকটি ধর্মীয় উৎসবের সঙ্গে জড়িত আছে ধর্মবিশ্বাস। আমাদের দেশে রয়েছে নানা ধর্মের লোক। হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান। সবাই মিলেমিশে আছে যুগ যুগ ধরে। প্রত্যেক ধর্মের লোকদের আলাদা আলাদা ধর্মীয় উৎসব রয়েছে। মুসলমানদের প্রধান ধর্মীয় উৎসবগুলো হচ্ছে-ঈদুল ফিতর, ঈদুল আদ্বহা, মহররম, শবেবরাত, শবেকদর, ঈদে মিলাদুন্নবী, ইসালে সওয়াব ইত্যাদি। খ্রিস্টানদের ‘বড়দিন’, বৌদ্ধদের ‘বৌদ্ধ পূর্ণিমা’। বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উৎসবগুলোর মধ্যে আছে বিভিন্ন পূজাপর্ব যেমন, দুর্গাপূজা, লক্ষীপূজা, কার্তিকপূজা, স্বরসতিপূজা, ইত্যাদি। প্রত্যেক ধর্মাবলম্বীরা কোন ধরণের বাঁধা বিপত্তি ছাড়া তাদের নিজেস্ব ধর্মীয় উৎসব পালন করবে। অন্য কারো উপর চাপিয়ে দিবেনা! এটাই হলো প্রকৃত ধর্মীয় চেতনা বা বিশ্বাস। এটাই হলো মানবতা, এটাই হলো ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’!! পহেলা বৈশাখ উদযাপনের নামে যে উৎসব পালন করা হয় সেটাও মুলত একটি ধর্মীয় উৎসব! আমাদের যুব সমাজের পর্যাপ্ত ধর্মীয় জ্ঞান না থাকার কারণে বিজাতীয় সংস্কৃতির প্রতি তারা আকৃষ্ট হচ্ছে, তাই আমাদেরকে বিশেষ করে মুসলমানদেরকে পহেলা বৈশাখ সম্পর্কে অবশ্যই জানতে হবে।

পহেলা বৈশাখ পালনের ইতিহাস এবং ইসলামিক মূল্যবোধ
বাংলা বর্ষপঞ্জিকা চালু করেন মোগল সম্রাট আকবর। কৃষকদের কাছ থেকে খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে বৈশাখ মাসকে বছরের প্রথম মাস হিসেবে গণনা করা হয়। তখন কৃষকের ঘরে ধান উঠে। এরপর হিন্দুরা তাদের সৌর পঞ্জিকা অনুসারে বাংলা বার মাস পালন করতে শুরু করে। বাংলাদেশে পহেলা বৈশাখ উদযাপন নতুন বছরের সূচনার নিমিত্তে পালিত হলেও এক সময় এমনটি ছিল না। তখন পহেলা বৈশাখ (হিন্দু ধর্মের) আর্তব উৎসব তথা ঋতুধর্মী উৎসব হিসেবে পালিত হত। পহেলা বৈশাখে বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে কিছু অনুষ্ঠান করা হতো। মোগল সম্রাজ্যের প্রজারা চৈত্রমাসের শেষ পর্যন্ত খাজনা পরিশোধ করতেন এবং পহেলা বৈশাখে জমিদারগণ প্রজাদের মিষ্টিমুখ করাতেন এবং এ উপলক্ষ্যে কিছু আনন্দ উৎসবও করা হতো। এছাড়া বাংলার সকল ব্যবসায়ী ও দোকানদার পহেলা বৈশাখে ‘হালখাতা’ করতেন। পহেলা বৈশাখ এসব কর্মকাণ্ডের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু বর্তমানে পহেলা বৈশাখ উপলক্ষ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের দেশ বাংলাদেশে এমন কিছু কর্মকাণ্ড করা হচ্ছে যা কখনোই পূর্ববর্তী সময়ের বাঙালীরা করেননি। বর্তমান উৎসব পালনের অধিকাংশ রীতিনীতিই মুসলিম জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় মূল্যবোধের সাথে প্রচণ্ডভাবে সাংঘর্ষিক। পহেলা বৈশাখ উদযাপনের নামে যুবক-যুবতী, কিশোর-কিশোরীদেরকে অশ্লীলতা ও বেহায়াপনার প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। পহেলা বৈশাখ উদযাপনের নামে যে অশ্লীলতার সয়লাব আমাদের সংস্কৃতির অংশ বানানোর অপপ্রয়াস করা হচ্ছে, এই কয়েক বছর আগেও এদেশের মানুষেরা জঘন্য এই উৎসবের কথা জানতনা! আমাদের দেশজ সংস্কৃতি যা ধর্মের সাথে সাংঘর্ষিক নয় সেই সব সংস্কৃতিতে অনেক ভাল দিক আছে। সেগুলো সামাজিক শিষ্টাচার, সৌহার্দ্য, জনকল্যাণ, মানবপ্রেম ইত্যাদি বৃদ্ধি করে! কিন্তু বেহায়াপনার নামে সেইসব মূল্যবোধ আমরা আমাদের সমাজ থেকে তুলে দিচ্ছি। পক্ষান্তরে দেশীয় সংস্কৃতির নামে অশ্লীলতার প্রসার ঘটানো হচ্ছে। বেপর্দা, বেহায়াপনা, অশ্লীলতা, মাদকতা, যুবক-যুবতীদের অবাধ মেলামেশাসহ অন্যান্য অপরাধ যে আমাদের সন্তানদের এইডস সহ মারাত্মক ব্যধির মধ্যে ঢেলে দিবে না, এরূপ চিন্তা করার কোনো অবকাশ নেই। অন্যান্য অপরাধের সাথে অশ্লীলতার পার্থক্য হলো-একটি উপলক্ষ্যে একবার এর মধ্যে নিপতিত হলে সাধারণভাবে কিশোর-কিশোরী ও যুবক-যুবতীরা আর এ থেকে বেরোতে পারে না। বরং ক্রমান্বয়ে আরো বেশি পাপ ও অপরাধের মধ্যে নিপতিত হতে থাকে। কাজেই নিজে এবং নিজের সন্তান ও পরিজনকে সকল অশ্লীলতা সহ মরণব্যধি থেকে রক্ষা করা আমাদের অপরিহার্য দায়িত্ব।
আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন বলেছেন: ‘‘তোমরা নিজেরা জাহান্নাম থেকে আত্মরক্ষা কর এবং তোমাদের পরিবার-পরিজনকে জাহান্নাম থেকে রক্ষা কর। যার ইন্দন হবে মানুষ ও পাথর; যার উপর নিয়োজিত রয়েছেন কঠোর হৃদয় সম্পন্ন ফিরিশতাগণ, তারা আল্লাহ যা নির্দেশ করেন তা বাস্তবায়নে অবাধ্য হোন না, আর তাদের যা নির্দেশ প্রদান করা হয়, তা-ই তামিল করে’’। [সূরা আত-তাহরীম: ৬] মুসলমান হলে অন্য ধর্মের উৎসব যেমন পালন করা যাবেনা, অন্য ধর্মাবলম্বীরাও ইসলামের উৎসব পালন করতে হবে এমন বাধ্যবাধকতাও নেই।

পবিত্র কোরআনে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেন।
‘হে নবী! আপনি বলে দেন, হে কাফেররা, আমি (তাদের) ইবাদত করি না যাদের ইবাদত তোমরা কর। না তোমরা (তাঁর) ইবাদত কর যার ইবাদত আমি করি। এবং আমি (কখনোই তাদের) ইবাদত করব না যাদের তোমরা ইবাদত কর। না তোমরা কখনও (তাঁর) ইবাদত করবে যাঁর ইবাদত আমি করি; অতএব তোমাদের ধর্ম তোমাদের জন্য আর আমার ধর্ম আমার জন্য।’ (সূরা আল কাফিরুন: ১-৬)।
আজ আমাদের বুদ্ধিজীবি দায়িত্বশীলদের বুঝতে হবে আমাদের দ্বায়িত্ব কি? উৎসবের নামে অশ্লীলতা, এক ধর্মের উৎসব অন্য ধর্মের উপর চাপিয়ে দেয়া কি নুন্যতম মানবতার পরিচয়?
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, ‘‘তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বপ্রাপ্ত এবং তোমাদের প্রত্যেককেই তার অধিনস্তদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে, রাষ্ট্রপ্রধান তার প্রজাদের সম্পর্কে দায়িত্বশীল আর তাকে তাদের পরিচালনার ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। একজন পুরুষ লোক তার পরিবারের ব্যাপারে দায়িত্বশীল, তাকে তাদের পরিচালনার ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। একজন মহিলা তার স্বামীর ঘরের সার্বিক ব্যাপারে দায়িত্বশীলা, তাকে সেটার পরিচালনার ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। একজন পরিচালক তার মালিকের সম্পদের সংরক্ষক, আর তাকে সেটার ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। ” (বুখারী শরীফ : ৮৯৩; মুসলিম শরীফ: ১৮২৯)
উপসংহার
ধর্মীয় উৎসবকে সর্বজনীনতার রূপ দিতে গেলে সমস্যা আছে। মুসলিম সম্প্রদায়ের কোনো উৎসব কে সর্বজনীন করতে গেলে তার মধ্যে অশ্লীলতা, গান-বাজনা, নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা, মাদকতা সহ বিভিন্ন অবৈধ কার্যক্রম ইসলাম কোনোভাবেই অনুমোদন করে না। তবে সব ধর্মের উৎসব ও আনুষ্ঠানিকতার সময় পারস্পরিক সহযোগিতা ও সহনশীলতা বজায় রাখার ব্যপারে ইসলামের নির্দেশনা ও গৌরবজনক ঐতিহ্য রয়েছে। সব ধর্মের আচার-অনুষ্ঠান সুষ্ঠুভাবে করতে দেয়া আর সব ধর্মীয় উৎসব কে সবার বলে পরিচয় করিয়ে দেয়ার মধ্যে তফাত আছে।
রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করছেন,
‘যে ব্যক্তি অন্য জাতির সাদৃশ্য অবলম্বন করবে সে তাদের দলভুক্ত বলে গণ্য হবে। ’ (সুনানে আবু দাউদ:৪০৩১)।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রা. বলেছেন, অর্থাৎ যারা বিধর্মীদের মত উৎসব করবে, কিয়ামত দিবসে তাদের হাশর ঐ লোকদের সাথেই হবে। (আস-সুনানুল কুবরা: ১৫৫৬৩)।
আল্লাহ আমাদেরকে অশ্লীলতা ও বেহায়াপনা থেকে রক্ষা করুন। আমিন।

তথ্যসুত্র:
১. বাংলাপেডিয়া (National encyclopaedia of Bangladesh) অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম।
২. বিজাতীয় সংস্কৃতির আগ্রাসনে বিপন্ন যুবসমাজ, এডভোকেট এম মাফতুন আহম্মদ
৩. ইসলামের দৃষ্টিতে পহেলা বৈশাখ উদযাপন, মাহফুযুল হক্ব।

Comments

comments

About

Check Also

রাসুলুল্লার হিজরাত : প্রাসঙ্গিক ভাবনা

পৃথিবীতে তখন ঘোর অমানিশার রাজ। চারিদিকে বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্যের দৃঢ় ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। যে ভিন্নতার জন্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *