ধারাবাহিক উপন্যাস

নোনাজল অথবা কষ্টের নদী

By mumin

February 17, 2018

(পূর্বে প্রকাশের পর) রহিম রাগিল না। কহিল-আহা অতো চটিস্ ক্যান্? একা-একা যাচ্ছিলি, থামিয়ে তোর বডিগার্ড হলাম, তাতেই এতো অপরাধ? আয়েষা কহিল-কে ডেকেছে বডিগার্ড হতে? যাও, আমার দরকার হবে না। সাবধান। ঘাটে-পথে এমনি হ্যাংলা কুকুরের মতো পিছু-পিছু ঘুরবে না। বারণ করে দিলাম, বুঝলে? রহিম শান্তভাবে কহিল-নেহাৎ তোকে ভালোবাসি বলেই, যা-তা বলছিস, সহ্য করছি। নইলে-যাক গে যা চাই তা পেলে হলো। গালের কথা তখন মনেই থাকবে না। শ্লেষপূর্ণ কণ্ঠে আয়েষা কহিল-সে গুড়ে বালি। সে জন্য পাতে ভাত রেখে লাভ নেই, বুঝলে? রহিম কহিল-কেনো, আমি অনুপযুক্ত কিসে? আমার মতো সুপাত্র তোর কপালে আর জুটবে নাকি? তুইও সে জন্যে পাতে ভাত রাখিসনে। আয়েষা তীক্ষèকণ্ঠে কহিল-না জোটে তোমার জন্য হাত-পা ধুয়ে বসে থাকবো। তখন এসো। এখন নয়। রহিম একটু কৃত্রিম বেদনা প্রকাশমানসে আবেগ জড়াইয়া কহিল-তুই বুঝলি না, আমি তোকে কতো ভালোবাসি। তোকে কতোবার চিঠি লিখলাম, একটা জবাব পর্যন্ত দিলিনে। এতো সাধ্য-সাধনা করছি তবু তোর করুণা হবে না? একটু প্রেমবিতরণ করতেও কার্পণ্য? এতো ব্যাকুল তোর মন পাবার জন্য-তবু পাবো না? আয়েষা কহিল-যাও-যাও, আর ন্যাকামী করতে হবে না। তোমাদেরকে আমি ভালো করেই চিনি। লম্পটের ভালোবাসা আমি প্রত্যাশা করি না। তুমি ভালোবাসলেই যে, তোমাকে ভালোবাসতে হবে, সেটা তোমার গরজে নয়-আমার গরজে। আর তোমার বরাত-গুণে, আমার সে-গরজও নেই। রহিম নিরুপায় হইয়া শেষটায় কহিল-আচ্ছা, দেখা যাবে দেমাগ কয়দিন থাকে।… … … যথা সময়ে ওরা গৃহে পৌঁছিয়া গেল। বলাই বাহুল, রহিম তখন হইতে আয়েষার দর্পচ্ছূণ করিতে আদাজল খাইয়া লাগিয়া রহিল।

সাত. মেয়ের বিবাহ অবধি জোহরা খাতুনের মনে শান্তি নাই। অবশ্য মাসুদা কখনও স্বামীগৃহের অশান্তির কথা কখনও আসিয়া মায়ের কাছে বলে না। কেননা, মা উহার প্রতিকার করিতে পারিবেন না। শুধু ব্যথা পাইবেন মনে। তাই সে সকল অসুবিধার কথা চাপিয়া যাইত। কিন্তু তাঁহার শুনিতে কিছু বাকী থাকিত না। আমরা জানি এ-গাঁয়ের রহিমের ফুফু মরিয়মের মা কাজীর গাঁয়ের বউ। তিনি যখন বাপের বাড়ি আসিতেন, তখন সেখানকার সকল সংবাদ এখানে সরবরাহ করিতেন। এইভাবে তিনি সবকিছু জানিতে পারিতেন। আজ প্রায় দই বৎসর হইল মাসুদাকে বিবাহ দেওয়া হইয়াছে। এই সুদীর্ঘ দিনেও সে জামাইয়ের মন যোগাইতে পারিল না। শাশুড়ি-ননদ তাহাকে আদর করিত, তবেও কতকটা শান্তি পাইত। কিন্তু তাহারাও তাহাকে দু’চোখে দেখিতে পারে না। প্রায়শ: কলহ লাগিয়া থাকে। সংসারে এইরকম কলহ থাকিলে, সেখানে মানুষ কেমন করিয়া কাল কাটায়? সেটাও ধর্তব্যের মধ্যে হইত না যদি জামাই তাহাকে আদর করিত। মেয়েদের স্বামী যদি অপছন্দও হয়, তবুও আদার-যতœ এবং মধুর ব্যবহারে তাহাদিগকে আপনার করিয়া লওয়া যায়। সেই গুণও সফির নাই। যদি থাকিত নিশ্চয় এতোদিন মাসুদা সকল কিছু ভুলিয়া, ঘৃণা বিসর্জন দিয়া তাহাকে লইয়াই সুখ-শান্তির নীড় রচনা করিতে সক্ষম হইত। মেয়েরা পুরুষদিগকে ভালো না বাসিয়া পারে? আজকাল ছেলেরা প্রায়শ: স্ত্রীর বশীভূত হইয়া থাকে এবং তাহারা আব্দার রক্ষা করিতে সদা-সচেষ্ট। কিন্তুু সফি ইহার ব্যতিক্রম। স্ত্রীর আবদার রক্ষা তো দূরে থাকুক, সে তাহাকে মানুষ বলিয়াই গণ্য করে না। যখন-তখন গালাগালী, মার-পিট করিয়া থাকে। তাহার মায়ের নালিশ শুনিয়া সে বিচার-বিবেচনা করিয়া সত্যাসত্য বুঝিতে চেষ্টা করিবে না। নালিশ শুনিয়াই সে ক্ষেপিয়া যাইবে। অন্যায়ভাবে লাঞ্চনা-গঞ্জনা দিবে। ইহা সহ্য করিবার মতো নয়। তবু সহিতে হয়। কে বুঝিবে এ-ব্যথা? জোহরা খাতুন এ-সকল সংবাদ মুনিয়া মর্মান্তিক ব্যথা বোধ করেন। মেয়ের দুর্ভাগ্যের জন্য নীরবে অশ্র“ বিসর্জন করেন। এ-ছাড়া তিনি আর কী করিতে পারেন? তিনিও যে অসহায় নারী! বিকালবেলা! জোহরা খাতুন মুখভার করিয়া বসিয়া ছিলেন। ভাবিতে ছিলেন মেয়ের দুর্ভাগ্যের কথা। এমন সময়ে প্রতিবেশী বাড়ি হইতে কতিপয় বর্ষীয়সী মেয়েরা আসিলেন। রহিমের মা কহিলেন-কী বুজান, মুখবার কইর‌্যা রইল্যা ক্যা? মাইয়া বিয়া দেলা, জামাই অইলো, আর কয়দিনবাদে নাতী-নাতিনের মুখ দ্যাখবা। তোমারতো এহন ফূর্তির সময়। জোহরা খাতুন বেদনার্ত কণ্ঠে কহিলেন-ফূর্তির কপাল কী আমার আছে? না জানো এমনতো নয়। মরিয়মের মায়ের কাছে তো সব সংবাদই পাও। মেয়েটা বিয়ে দিয়ে অবধি একটা দিন নিশ্চিন্ত মনে থাকতে পারলাম না। এমন গোঁয়ারই মেয়ের বরাতে ছিলো! প্রতিবেশীরা আসন গ্রহণ করিলেন। অতঃপর রহিমের মা কহিলেন-হেই সময়ই তোমারে কইছেলাম, ওহানে সোমন্দ কইরে‌্যানা। তোমার মাইয়ার নাহান এট্টা সোন্দর বউ যদি ঘরে আনতে পারতাম, তয় হ্যারে মাথায় কইর‌্যা রাখতাম। তোমাগো টাহা-পয়সা আছে আর আমরা কইতে গ্যালে গরীব, হেই জন্য মুহে আনি নাই, তয় মনে-মনে ইচ্ছা ছেলো রহিমের লইগ্যা কই। জোহরা খাতুন কহিলেন-এখন আর সে কথা বলে লাভ কী? কপালের ফ্যার। নইলে আরও সম্বন্ধ ছিলো। একটা গরীব ছেলে কলেজের পড়ার খরচ চেয়েছিলো-ইচ্ছা করলে সেখানে করা যেতো। মাসুদার ফুফুর ছেলে হানিফেরও মনে-মনে ইচ্ছা ছিলো ওকে বিয়ে করবার। অবশ্য মুখফুটে কখনও বলেনি। আর, মেয়েও তাকে ভালোবাসতো, সেটা আমি মা হয়েও কখনো বুঝতে পারিনি ভেবেছ? কিন্তু কী হলো তাতে? মেয়ের বাপ, জানোই তো, কেমন একরোখা মানুষ। আমাদের কাছে কিছু না জেনে বা কোনোরূপ খোঁজ-খবর না দিয়েও কাজীর গাঁয়ে সম্বন্ধ ঠিক করে এলো। তাতে আমার অমত। মেয়েরও মত থাকবে না জানতাম বলে মেয়ের বাপকে বললাম। কিন্তু কথা শোনার লোক সে? আরো বেশি করে জিদ চাপল। বিয়ে দিয়ে খালাস হলো। বাপের কর্তব্যতো শেষ করেছে। এখন তার ভাবনা কী? আয়েষার মা কহিলেন-এহুন আর করবা কী? কপালের ভোগ না ভুইগ্যা কি গো আছে? আরও কিছুক্ষণ এইরূপ আলোচনা চলিল। অতঃপর প্রতিবেশিনীরা স্ব স্ব গৃহে ফিরিয়া গেলেন। রফিজ মিয়া কর্মস্থল হইতে বাড়ি ফিরিয়াছেন। রাতে স্বামী-স্ত্রীতে কথা বইতে ছিলো। জোহরা খাতুন স্বামীকে লক্ষ্য করিয়া বলিলেন-মেয়ের বিয়ে দিয়েই খালাস-ওদিকে মেয়ে কী সুখে আছে, সে-খোঁজ রাখো? রফিজ মিয়া বলিলেন-খোঁজ আর কখন রাখি, বলো? ক’দিনই বা বাড়িতে থাকি আমি? জোহরা খাতুন অভিমানহত কণ্ঠে কহিলেন-হ্যাঁ, তোমার আর কী? তুমিতো বিদেশে পড়ে থাক। এদিকে কেউ বাঁচল কি মরল, তাতে তোমার কী আসে যায়? : তবে আর বলো কেনো? : তোমাকে বলা আর একটা গাছের কাছে বলা একই কথা। তখনই বলেছিলাম অই ছেলের সাথে মেয়ের বিয়ের কাজ নেই। তা মেয়ে মানুষের কথা মতো কাজ করলে কি পুরুষের ইজ্জত থাকে! : অতো ভূমিকা না করে, হয়েছে কী, তাই বলো। : হতে আর বাকী রয়েছে কী? বিয়ে দেবার পর স্বামীর বাড়ি গিয়ে অবধি মেয়েটা একটু শান্তি পেল না। : কেনো? : সে খোঁজ কি তুমি রাখো যে জানবে? শাশুড়িবুড়ী কেবল ঝগড়া করে, খোঁচা দিয়ে কথা বলে। কতোদিন সওয়া যায়? : খামাখা কেউ ঝগড়া করতে পারে? আসলে তোমার মেয়েই ঝগড়াটে। রাগিয়া জোহরা খাতুন কহিলেন-আমার মেয়ে ঝগড়াটে? : নাতো কী? শাশুড়ি বুড়ো মানুষ। এমন-অমন দেখলে বউকে দু-কথা বলতে পারে। সেজন্য তার মুখে-মুখে জবাব দিয়ে ঝগড়া বাঁধাতে হবে না কি? : বেশ বিচার তোমার। আসলে বুড়ি কী দজ্জাল, তার তুমি কী জানো? শুধু শুধু গাল-মন্দ দ্যায়। : শুধু শুধু গাল-মন্দ দেবে ক্যানো? তুমিই মেয়েকে ‘লাই’ দিয়ে খারাপ করছ। নইলে

Comments

comments