ধারাবাহিক উপন্যাস

কর্মের ফল

By lazy-coder

January 05, 2014

(পূর্ব প্রকাশের পর) নূরজাহান বলেন : কোরআন পাকের সুরা দ্বোহায় আছে,‘নিশ্চয়ই তোমার জন্য এ কাল অপেক্ষা পরকাল উত্তম’। সুতরাং দুঃখ করার কোনো কারণ নেই। পরকালে তুমি প্রমোশন নিশ্চয় পাবে। সাত শাহেদ আলী মুছল্লী মোত্তাকী পরিবারের সন্তান। তাই ইংরেজি শিক্ষিত এবং আধুনিক পরিবেশে তাকে পথভ্রষ্ট করতে পারেনি। তার চাকুরী ক্ষেত্রে যথেষ্ট ঘুষ খাবার অবকাশ থাকলেও তিনি আদৌ সে পথে যাননি। আল্লাহ এবং রাসুলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বিধি-বিধান কখনও লঙ্ঘন করেননি। তার স্ত্রী নূরজাহানও অনুরূপ পরিবারে জন্মেছিলেন। তিনি কখনও স্বামীকে অবৈধ কর্মে প্ররোচিত করেন নি। শোনায় চাকুরীজীবীদের আধুনিকা স্ত্রীরা বিলাস ব্যাসনে এমনই আসক্ত হযে় পডে়ন যে, স্বামীদের কাছে থাকে তাদের অফুরন্ত চাহিদা। সেই চাহিদা মেটাবার প্রযে়াজনেও স্বামীদেরকে অবৈধ উপার্জনের পথে যেতে হয়। কেউ কেউ বন্ধু-বান্ধবকে বলেন- আল্ট্রা মডার্ণ আপটুডেট মেযে় বিযে় করে মহামুসিবতে আছি, তাদের নিত্য নতুন শাড়ী-গয়না, প্রসাধনী পার্টি-সিনেমার রসদ যোগাতে যোগাতে কম্ম সারা। ঘুষ খাওয়া জানি খারাপ। কিন্তু অবস্থার সঙ্গে তাল মিলিযে় চলতে হযে় ঘুষ না খেযে় গত্যন্তর কোথায়? নূরজাহানের শাড়ী গয়নার দাবী নেই। নাটক-সিনেমা-পার্টি-ক্লাবের বিলাসিতা নেই। যেটুকু একান্ত প্রযে়াজন, সেটুকু পেলেই তিনি খুশি থাকেন। বাসায় তার কাজের লোকের প্রযে়াজন হয় না। নিজের হাতে রান্না-বান্না করেন। তিনি অল্পতেই তুষ্ট। হিসেবী জীবন যাপনে তিনি অভ্যস্থ। আয় বুঝে ব্যযে়র পক্ষপাতী তিনি। তিনি কোরআন পাকের বাণীতে বিশ্বাসী। কুরআন পাকে বলা হযে়ছে; ‘অযথা খরচকারী শয়তানের ভাই’। তাই তার অপব্যয় নেই। অভাবও তার সংসারের ত্রিসীমানাতেও প্রবেশ করতে পারে না। যথাসমযে় শাহেদ আলীর চাকুরীর মেয়াদ শেষ হলো। তিনি রিটায়্যার করলেন। হালাল উপার্জনের দ্বারা সৎ জীবন যাপন করেছেন। ছেলে- মেযে়দের শিক্ষা-দীক্ষা, বিযে়-সাদী যথারীতি সম্পন্ন করতে পেরেছেন আল্লাহর মর্জি। তবে শহরে বাড়ী-গাডি় কিছুই হয়নি। ব্যাংক ব্যালেন্সও হয়নি তেমন। তবে রিটায়্যারের পর এককালীন গ্রাচুযি়টীর টাকা পেযে়ছেন বেশ কিছু। তিনি স্ত্রীকে বললেন : এবার আমি হজ্বে যেতে চাই। তোমার কি অভিমত? নূরজাহান বললেন : আমার আর অভিমত কি? টাকা থাকলে হজ্ব ফরজ হযে় যায়। বাবা-মা বেঁচে থাকলে তাদের সম্মতির দরকার হয়। তারা এখন বেঁচে নেই। ছেলে মেযে়দের বিযে় হযে় গেছে। শুধু মাসুদের বিযে় বাকী। সে তো ডাক্তারী পড়ছে, তার জন্য আর ভাবনা কি? তুমি হজ্বে গেলে আল্লাহ চাহেন তো না খেযে় মরবার কারণ নেই। তোমার আর বাঁধাটা কোথায়? তুমি স্বাচ্ছন্দে হজ্বে যেতে পারো। তবে, তোমার আব্বাতো হজ্ব করতে পারেননি। তার জন্য ওমরাও করে আসতে পারো। শাহেদ আলী বললেন : তাতো অবশ্য করবো যদি আল্লাহ সুযোগ দেন। আমার ইচ্ছা, তোমাকে নিযে়ই হজ্বে যাই। এ বিষযে় কি বলো? নূরজাহান বললেন : তোমার ইচ্ছার উপর আমার কি বলার থাকতে পারে? তুমি সংগে নিলে আমারও হজ্ব করার নসীব হয়। এটাতো মহা আনন্দের কারণ। শাহেদ আলী সস্ত্রীক হজ্বে যাবার সময় যাবতীয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে যথা সমযে় বিমানের ফ্লাইট ধরলেন। তারপর হজ্ব সমাপনান্তে ছহি সালামতে দেশে ফিরলেন। দেশে ফিরে এসে তিনি স্ত্রীকে বললেন এখনতো চাকুরী করছিনা। বেহুদা ঘর ভাড়া দেওয়া কেন। চল এবার গ্রামের বাডি়তে ফিরে যাই। নূর জাহান বললেন : অবশ্যই। শহরে পরিবেশে এতোকাল থেকে হাঁফিযে় উঠেছি। এখন গ্রামের মাটিতেই ফেরা উচিত। এখন আর কী বাকী? শুধু কবরের খবরটা অজানা রযে় গেছে। শাহেদ আলী বললেন : তা’ অবশ্য। কুল্লি নাফছিন জাযে়কাতুল মউত। কেতাবের কথা। এখন শুধু বাকী মাসুদের এমবিবিএস কোর্সটা শেষ করা। তারপর চাকুরী না হলেও আল্লাহর মর্জি প্রাইভেট প্র্যাকটিস করেও একরূপ চলে যাবে আল্লাহর রহমতে। ওর বিযে়টা বাকী। সেইটা সমাধা করে যেতে পারলেই দীলের মকসুদ পুরা হয়। নূরজাহান বললেন : আল্লাহ ভরসা। তিনিই সব কিছুর মালিক। তার ইচ্ছা থাকলে দীলের মকসুদ পুরা হবে। শাহেদ আলী বললেন : তাহলে সব গোছগাছ করতে লেগে যাও। গ্রামে গেলে অনেক সুবিধা। নিয়মিত মা-বাবার কবর যিয়ারত করতে পারব। গ্রামের আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীর খেদমতে লাগতে পারবো। এর চাইতে আর খুশির বিষয় কি আছে?

আট শাহেদ আলী গ্রামের বাডি়তে ফিরে এলেন। প্রথমে তার নজরে পড়লো, তার বাবার প্রতিষ্ঠিত কেরাতিয়া মাদ্রাসাটি আর চলছে না। গ্রামের জামে মসজিদের ইমাম সাহেব রোজ ভোরে ঘন্টা খানেক কোরআন পড়ান ছেলেদের। তাও সংখ্যায় নগন্য। দ্বীনি এলেমের প্রতি গ্রামের লোকদের কম। তাই তিনি একদিন নির্দিষ্ট স্থানে গ্রামের প্রভাবশালীদের নিযে় এক আলোচনা সভার আযে়াজন করলেন। সভা বসেছিল মসজিদ প্রাঙ্গনে। সভায় উপস্থিত ব্যক্তিদের মাঝে তিনি বক্তব্য রাখেন : ভাইসব, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- ‘জ্ঞান অন্বেষণ উত্তম এবাদত।’ তিনি আরও বলেছেন- ‘জ্ঞানার্জনের জন্য সুদূর চীন দেশে হলেও যাও।’ শিক্ষার মাধ্যমে জ্ঞানার্জন হয়। সাধারণ শিক্ষায় দ্বীনি এলেম অর্জনের সুযোগ নেই বললেই চলে। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- ‘প্রত্যেক নর-নারীর জন্য শিক্ষা গ্রহণ ফরজ। এই শিক্ষা হলো দ্বীনী এলেমের শিক্ষা। অথচ আমরা সেদিকে খেয়াল করি না। আখেরাতে ফায়দা আমরা কিসে পাবো? আপনারা এ- প্রসঙ্গে কি বলেন? সভার এক বযে়াবৃদ্ধ ছুরত আলী বললেন : ‘বাবা শাহেদ, তুমি যা কইলা, কেতাবের কথাই কইলা। তয় আইজ কাইল আমাগো এদিকে মন নাই। তোমার বাপে মইরা যাওনের পর দ্বীনী এলেম গ্রামথিক্যা একরহম উইঠ্যা গ্যাছে। ইবলিসের কাণ্ডকারখানা বাইড়া গেছে। অহন কী করন যায় কওদেহি? শাহেদ আলী বলতে শুরু করলেন : আমার আব্বা যে কেরাতিয়া মাদ্রাসাটি চালাতেন, তাতো বন্ধ হযে় গেছে। তিনি মারা যাবার পর গ্রামের লোকেরা মাদ্রাসার কথা আর ভাবেননি। আমরা মুসলমান। আমাদের মৃত্যুর পর জানাজা লাগে। কবর যিয়ারত করা দরকার। বিয়া-সাদীতে আলেমের দরকার হয়। গ্রামে আলেম না থাকলে অন্য জায়গায় আলেমের খোঁজে যেতে হয়। এটা আমাদের দূর্ভাগ্যের ব্যাপার। তাই আমি বলতে চাই, আমাদের গ্রামে একটা আলীয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করা দরকার। কি বলেন, আপনারা? আরেক প্রবীণ ব্যক্তি জোনাব আলী বললেন : স্বীকার করি, মাদ্রাসা করন দরকার। তয় আমরা কি তা পারুম? শাহেদ আলী বললেন : সাহস রাখেন। আল্লাহ চাহেন তো চেষ্টা করলে তা বিফলে যায় না। মইজুদ্দীন মোল্লাহ বললেন : মাদ্রাসা যদি করন যায়, আমি আল্লাহর ওয়াস্তে পাঁচকাঠা জমি দিমু। শাহেদ আলী বললেন : আলহামদুল্লিহা। আমিও সাধ্যমতো টাকা-পয়সা দেবো। সবাইর সম্মিলিত চেষ্টা থাকলে ইনশা আল্লাহ কাজ সমাধা করা যাবে। তাহলে আগামী জুম্মাবাদ মসজিদে বসে আবার আলাপ হবে এ বিষয় নিযে়। শুভ কাজে বিলম্ব করা ঠিক নয়। ঝটপট কাজে লেগে গেলেই ভালো হয়। এদিনের আলোচনা এই পর্যন্ত শেষ হলো। পরবর্তী জুমাবাদ আবার আলোচনা সভা বসলো। আলাপ-আলোচনায় সিদ্ধান্ত হলো যে, মসজিদের বারান্দায় আপাতত : কাজ শুরু করা হবে। তারপর একটা কমিটি গঠন করা হলো। শাহেদ আলীকেই সবাই কমিটির সভাপতি মনোনীত করলেন। প্রথমে এবতেদায়ী থেকে শুরু করা হলো। সমস্যা দেখা দিল ছাত্রের। অনেকেই অনাগ্রহী। কেউ কেউ বলে- মাদ্রাসায় পডে় কেউ জজ-মুনসেফ হতে পারে না। শুধু ওয়াজ-নসিহত আর কবর যিয়ারত শিখলেতো কাজ হবে না। তাতে খয়রাতীর সংখ্যাই বাড়বে। তাতে রাষ্ট্র চলবে না। শাহেদ আলী সবাইকে বুঝালেন : আল্লাহ সবকিছুর মালিক। তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন তার ইবাদতের জন্য এটা কুরআন পাকে আল্লাহ বলেছেন। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরবদেশে রাষ্ট্র চালাননি? সেই আরবের লোকেরাই তো ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন না। দ্বীনী এলেম শিখলে দুনিয়ার কাজ অচল হযে় পড়বে, এ ধারণা ভুল। আল্লাহ মানুষকে হেকমত শেখান। মানুষ ইংরেজি বিদ্যা না শিখলেও হেকমত শিখতে পারবে। আস্তে আস্তে মাদ্রাসায় ছাত্র সংখ্যা বৃদ্ধি হলো। একবার এক ওয়াজ মাহফিলের আযে়াজন করে গ্রামের লোকদেরকে মসজিদ-মাদ্রাসায় দানÑখয়রাতের ফায়দার কথা বুঝানো হলো। মানুষ মরে গেলে তার পুণ্য কামাইযে়র সুযোগ থাকেনা। মসজিদ-মাদ্রাসায় দান করলে তার ছওয়াব মৃতব্যক্তির আমলনামায় লেখা হয়। দ্বীনী এলেমের আলেম ছেলে থাকলে, তারা বাপ-মাযে়র জন্য দোয়া করতে পারে। আল্লাহ তাদের দোয়া কবুল করেন। কাজেই মাদ্রাসা শিক্ষা গ্রহণ মুসলমানদের অবশ্য কর্তব্য। ওয়াজ-নসিহাতে কাজ হলো। গ্রামের লোকদের মন-মানসিকতা পাল্টে গেল। অনেকেই মাদ্রাসায় দান করবার অংগীকার করলেন। ছেলেদের মাদ্রাসায় ভর্তি করাতে সম্মত হলেন। অল্প দিনের মধ্যেই রহমত পুর গ্রামে একটি দাখিল মাদ্রাসা গডে় উঠলো। গ্রামের চেহারা বদলে গেল। পরিবেশ পরিবর্তন হলো। মসজিদে মুছল্লীর সংখ্যা বাড়লো। পাঁচ ওয়াক্ত জামাতে নামাজ হয়। গ্রামে থেকে ইসলাম বিরোধী কান্ড কারখানা প্রায় বন্ধ হযে় গেল। শাহেদ আলীকে সবাই বাহবা দিতে লাগলো। চাকুরী করে ফিরে এসেও সে বাপের বেটা বটে। বাপও যেমন আল্লাহওয়ালা ছিলেন, ছেলেও তেমনি হযে়ছে। একেই বলে, বাপকা বেটা। গ্রামের মানুষ বুঝতে পারলো যে, এতোকাল তারা গোমরাহীতে ছিলেন। শাহেদ আলীর উছিলায় তারা সঠিক পথের সন্ধান পেযে়ছেন। শাহেদ আলী বললেন : সব কিছু আল্লাহর মর্জিতে হয়। আল্লাহর ইচ্ছার বাইরে মানুষের কিছু করবার সাধ্য নেই। নয় আবেদ আলীর স্বাস্থ্য খারাপ যাচ্ছিল দৈনন্দিন। তাই তার মনে হলো, এবার গ্রামের বাডি়তে ফেরা যাক। নূরবানু শহর পরিবেশে থাকাটা পছন্দ করেন। কিন্তু আবেদ আলীর ইচ্ছাক্রমে তাকেও শেষ পর্যন্ত মত পরিবর্তন করতে হলো। আবেদ আলী সস্ত্রীক গ্রামে ফিরলেন। বহুকাল চাকরীর কারণে শাহেদ আলীর সংগে দেখা-সাক্ষাৎ কম হযে়ছে। গ্রামে ফেরায় রোজই দু’বন্ধুর কথা-বার্তা হয়। আবেদ আলী প্রথম সাক্ষাতের দিনেই বলে : শাহেদ তোমার বরাত ভালো। বুডে়াবয়সেও দেহটা দেখছি খুব মজবুত আছে। শাহেদ আলী বললেন : আল্লাহর রহমতে তেমন কোনো রোগ-বালা নেই। তোমার শরীটা দেখছি খুব ভেঙ্গে গেছে। আবেদ আলী বললেন : শরীর নিযে় দারুণ কষ্টে আছি। তাই শহর ছেডে় গ্রামে এলাম। দেখি গ্রামের আবহাওয়ায় একটু ভালো থাকতে পারি কি না। শুনেছি তুমি নাকি সস্ত্রীক হজ্জ করে এসেছো। শাহেদ আলী বলেন : হ্যাঁ, নসিবে ছিল, তাই হযে়ছে। তুমি কেন হজ্জ করলে না? টাকাতো কামিযে়ছো কম নয়। আবেদ আলী বললেন : এক সময়তো টাকা কামাইযে়র নেশায় ছিলাম। হজ্বের কথা মাথায় আসেনি। এখন মনে হচ্ছে টাকায় সুখ হয় না। শাহেদ আলী বললেন : এটা যদি আগে বুঝতে, তাহলে শুধু টাকার পেছনে ছুটতে না। পরকালের জন্য কামাইযে়র কথাও ভাবতে। আবেদ আলী বললেন : বুঝতো সবারই আসে এক সময়। (চলবে)

Comments

comments