আন্তর্জাতিক

মায়ানমারে লাশের গন্ধ : মানবতা ভূলুণ্ঠিত

By mumin

December 08, 2016

মায়ানমার পরিচিতি: দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া মহাদেশে অবস্থিত, বাংলাদেশের পূর্ব সীমান্তে ছোট্ট একটি (নাফ) নদী দ্বারা পৃথককৃত প্রতিবেশী দেশ মায়ানমার। ২ লক্ষ ৬১ হাজার ৯৭০ বর্গমাইলের এ দেশটির জনসংখ্যা ৬ কোটির বেশী। এ দেশের অধিবাসী ১৪০টি জাতি-গোষ্ঠীর মধ্যে মুসলমানরা দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় জনগোষ্ঠী। ৮০ লাখের অধিক মুসলিম এখানে বসবাস করে। শত শত বছর ধরে মুসলিমরা ‘আরাকান’ রাজ্যে বসবাস করে আসছিল। ছড়িয়ে ছিটিয়ে মায়ানমারের বিভিন্ন জায়গায় মুসলমানদের বসতি থাকলেও ‘আরাকান’ ছিল মুসলিম অধ্যুষিত একচ্ছত্র- স্বাধীন ও নিরাপদ আবাসস্থল। আরাকানের নাম পাল্টিয়ে রাখাইন প্রদেশকরণ: মায়ানমারের পশ্চিম দিকে নাফ নদী ও সাগরের উপকূল ঘেষে, বিস্তীর্ণ পাহাড়ের পাদদেশে, ২০ হাজার বর্গমাইলের এক উর্বর ভূমি আরাকান। বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্ব দিকে এ ভূখণ্ডটি একেবারে দেখা যায়। ভারত ও বাংলাদেশের উভয় সীমান্তে অবস্থানের কারণে এ আরাকান ব্যবসায়-বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও এক গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান দখল করে আছে। আমরা জানি যে, ব্রিটিশদের থেকে ১৮২৪ সালে মায়ানমার স্বাধীনতা লাভ করে। ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসনামলেও সামাজিক, সাংস্কৃতিক বা অর্থনৈতিকভাবে মুসলিম অধ্যুষিত আরাকান কখনো মায়ানমারের অংশ ছিল না। ১৮২৪ সালে ব্রিটিশ-বার্মা যুদ্ধে আরাকান ‘ব্রিটিশ ভারতের’ অন্তর্ভুক্ত ছিল। আরো পিছন থেকে বলতে গেলে ১৭৮৪ সালের আগ পর্যন্ত আরাকান ছিল স্বাধীন একটি রাষ্ট্র। পরবর্তীতে তা মায়ানমারের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১৯৪০ সালে মায়ানমার স্বাধীনতা লাভের পর ব্রিটেন আরাকানের সার্বভৌমত্ব রেঙ্গুনের কাছে ন্যস্ত করে। এর মধ্যে ১৯৪৮ সালে মায়ানমার আরাকানকে স্বায়ত্বশাসনের ভার অর্পণ করেছিল। কিন্তু ১৯৬২ সালে এক ডিক্রি বলে জেনারেল নে উইনের নেতৃত্বাধীন সামরিক জান্তা-সরকার আরাকানের স্বায়ত্তশাসনের ক্ষমতা প্রত্যাহার করে নেয়। স্বায়ত্তশাসন কেড়ে নেয়ার এ প্রক্রিয়ায় এক কালের মুসলিম স্বাধীন রাজ্য ধীরে ধীরে হয়ে যায় মায়ানমারের একটি প্রদেশ। মানচিত্র থেকে আরাকান নামটি তারা মুছে ফেলে। ১৯৮৯ সালে এর নাম হয় রাখাইন প্রদেশ। এ সময়ই বার্মার নামও বদল করে রাখা হয় মায়ানমার। যা হোক, জেনারেল নে উইন শুধু স্বায়ত্তশাসন কেড়ে নিয়েই ক্ষান্ত ছিল না, মুসলমানদেরকে বহিরাগত হিসেবে আখ্যায়িত করেছিল। মুসলমানদেরকে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত করেই ক্ষান্ত হয়নি, তাদের উপর অত্যাচার ও নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছিল। যাতে মুসলমানরা এই উর্বর গুরুত্বপূর্ণ ভূখণ্ডটি ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়- নির্যাতনের মাত্রা সে পর্যন্তই উন্নীত করেছিল সে। আজ মায়ানমারের মুসলমানদের ঘর-বাড়ি, ক্ষেত- খামার এমনকি মুসলমানদেরকে পুড়িয়ে মারার যে নিধন-যজ্ঞ চলছে, নির্বিচারে যে হত্যা-যজ্ঞ চালানো হচ্ছে- তা মুসলমানদের নির্মূল করার সেই পুরাতন ধারাবাহিকতা।

মায়ানমার বা আরাকানের অতীত-বর্তমান: মুসলমানদের অতীত অবস্থা: হাজার বছর আগে মুসলিমরাই মায়ানমার (বার্মা) শাসন করতো। পরবর্তীতে তারা হয়ে ওঠে রাজ্য-হারা, অত্যাচারিত ও নির্যাতিত। তাদের এ অধপতন শুরু হয় ১৭৮৪ সালে বার্মার আরাকান দখল করে নেয়ার পর থেকে। ১৮১৫ সালে আরাকানের স্বাধীনতাকামী তথা বার্মার চোখে বিদ্রোহী নেতা ‘সিনপিয়া’র মৃত্যুর দুইশ’ বছর ধরে আজো রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যার সুরাহা হয়নি। সেখানে মুসলিমরা এখন শরণার্থী, তারা অবৌদ্ধ, অবর্মী। শুধু তাই নয়, ব্রিটিশ শাসনামলে বার্মায় এসে বসতি স্থাপনকারী ‘অবৈধ বাঙালী অভিবাসী’ হিসেবে আজ তারা তালিকাভুক্ত। এককালের শাসক গোষ্ঠী মুসলমান ঈমান, আমল ও ঐক্যচ্যুত হয়ে আজ তারা দেশে দেশে কাফির- মুশরিকদের নির্যাতনের খেলনা-বস্তু। কাজী নজরুলের ভাষায়- তল্ওয়ার শুরু যার স্বাধীনতা শিক্ষার! যারা ছিল দুর্দম আজ তারা দিকাদর! আনোয়ার! ধিক্কার! বিশ্বের অসভ্যদের শিক্ষা দিতে দুর্দান্ত জাতি ছিল, তারা আজ রিক্ত, বিরক্ত, নিপীড়িত, নির্যাতিত। বার্মা থেকে মুসলমানদের বহিষ্কার করার লক্ষ্যে ১৯৭৮ সালে এক অপারেশন পরিচালনা করা হয়। ১৯৯১ সালে রোহিঙ্গা জাতি গোষ্ঠীকে বহিষ্কারের চেষ্টায় পুনরায় ‘অপারেশন পাই থায়া’ বা পরিষ্কার ও সুন্দর জাতি অপারেশন নামে দ্বিতীয় অভিযান শুরু করে। ২ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা এ সময় পালিয়ে বাংলাদেশে আসে। ২০১২ সালে আবার রাখাইন বৌদ্ধরা রোহিঙ্গা মুসলমানদের নির্মূলে দাঙ্গা শুরু করে। এতে এক হাজার মুসলমানকে হত্যা করা হয়। ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে মায়ানমার সরকারের স্বীকৃত ১৩৫ টি জাতি গোষ্ঠীর দেশের বৈধ নাগরিক রাখাইন সম্প্রদায়। সেই রাখাইন প্রদেশে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের উপর তুচ্ছ ঘটনায় হামলা চালায় বৌদ্ধ ভিক্ষুরা। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস। আরাকানের এক সময়ের মুসলিম রাজশক্তির রোহিঙ্গারা এখন শরণার্থী। মুসলমানদের বর্তমান অবস্থা: ইতিহাসের সবচেয়ে কঠিন অবস্থা পার করছে এখন মায়ানমারের মুসলমান। বিজ্ঞান-প্রযুক্তির কল্যাণে বিশ্ব এখন একটি গ্রামের মত (Global village)। উন্নতির এ যুগে পৃথিবীর যে কোন প্রান্তের যে কোনো খবর নিমিষেই ছড়িয়ে যায় অন্য প্রান্তরে। কিন্তু মুসলিম নির্যাতনের যত খবর তা মিডিয়ার প্রায় অগোচরেই রয়ে যায় বরাবর। গত অক্টোবর মাসে রোহিঙ্গাদের গ্রামে অগ্নি সংযোগ করা হয়। অতঃপর ৯ নভেম্বর মায়ানমারের সেনা বাহিনী অভিযানের নামে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর শুরু করে আক্রমণ। শত শত মুসলিম অধ্যুষিত গ্রাম জ্বালিয়ে পুড়িয়ে পয়মাল করে দেয়া হয়েছে। রোহিঙ্গা মুসলমানদের রক্তে ভিজে গেছে রাখাইন রাজ্যের মাটি। নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছে সাড়ে তিনশ’ নারী-শিশু-পুরুষ। ঘরছাড়া হয়ে পালিয়ে গেছে এক লাখ ষাট হাজার মুসলিম। যতটুকু পেপার পত্রিকায় পাওয়া যায়, এটাই যে সঠিক সংখ্যা এমনটি নয়। হত্যা ও ঘরছাড়া করা মানুষের সঠিক পরিসংখ্যান জানা যাবে না। কারণ আক্রমণ শুরু করা থেকে সেখানে কোন সংবাদকর্মী বা মিডিয়ার কাউকে প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। তথাকথিত ‘শান্তির রাণী’ শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়া ‘অং সাং সুচি’ র নেতৃত্বাধীন সরকারের সেনাবাহিনী মুসলমানদের উপর নির্যাতন তো চালাচ্ছেই। রাখাইন রাজ্যের মংডুর উত্তরাঞ্চলীয় একটি গ্রামে ১৩ নভেম্বর ৯ জন মুসলমানকে জীবন্ত পুড়িয়ে মেরে ফেলে দেশটির সেনাবাহিনী। আরাকান রোহিঙ্গা ন্যাশনাল অর্গানাইজেশনের চেয়ারম্যান নূরুল ইসলাম এ নির্যাতনকে নরকের সাথে তুলনা করে বলেছেন, সেখানে দেড় মাস ধরে এরূপ গণহত্যা ও নির্যাতন চলছে। বিবিসির দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছেন, সেখানে এমন নির্যাতন চলছে- যা ভাষায় বর্ণনা করা যাবে না। সাড়ে তিন হাজারের বেশি বাড়ি ঘর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। তিরিশ হাজারেরও বেশি মানুষ ঘরবাড়ি হারা হয়েছে, ধর্ষণের শিকার হচ্ছে মুসলিম নারীরা। অবশেষে হত্যাই তাদের চূড়ান্ত ভাগ্য। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা উত্তর আরাকানের মংডু টাউনশীপে। সেনাবাহিনী পাড়ায় পাড়ায় গিয়ে তল্লাশী চালাচ্ছে। মুসলমানদেরকে গুলি করে হত্যা করছে। ভীত সন্ত্রস্ত এলাকাবাসী যখন বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে, তখন হেলিকাপ্টারে গানশিপ থেকে গুলিবর্ষণ করে তাদেরকে হত্যা করা হচ্ছে। এরূপ হত্যা ও নির্মূল অপারেশন যদি অন্য কোন জাতির উপর চালানো হতো, তাহলে সারা বিশ্বে এ নিয়ে ঝড় বয়ে যেতো মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগে। কিন্তু এখন কোন মানবাধিকার লংঘন হচ্ছে না। কারণ এরা মুসলমান। এরাতো মানুষ নয়। মুসলমানদের সমূলে বিনাশ করতে পারলেই বরং মানবাধিকার কায়েম হয়! অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, পৃথিবীতে মুসলমানদের কেউ নেই। বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা বনে-জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছে। পলায়নরত রোহিঙ্গাকে গুলি করে মারছে সেনাবাহিনী। সাগরে ভাসছে রোহিঙ্গা মুসলমান। বর্বরতার হাত থেকে একটু প্রাণে বাঁচতে বাংলাদেশে প্রবেশের ব্যর্থ চেষ্টা করে বিতাড়িত হয়ে আবার ফিরে গেছে সাগর জলে অজানার উদ্দেশ্যে। মায়ানমারের মুসলমানদের বীভৎস চিত্র সারা বিশ্বে কোন ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া যেন সৃষ্টি করছে না। মুসলিম নেতৃবৃন্দ যেন এ খবর জানেনই না। সকলের এ নীরব ভূমিকা ও অদ্ভূত আচরণের কারণ কী? মায়ানমারের মুসলিমদের পাশে না দাঁড়ানোর মানে হচ্ছে- এরূপ যে কোন রাষ্ট্রেই মুসলমানদেরকে নির্বিচারে নির্মূল অভিযান চালানোর মৌন অনুমতি দিয়ে দেয়া। গত ২৬ নভেম্বর ’১৬ তারিখের দৈনিক ইনকিলাব এর প্রথম পাতায় দেখলাম অনেক রোহিঙ্গা মুসলমান বিপুল টাকার বিনিময়ে দালালের মাধ্যমে কোন রকম প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশের বন জঙ্গলের সীমানায় এসে আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশী দস্যুরা সেখানে তাদের উপর চালিয়েছে লুটতরাজ! মহিলাদের কাছে যার যা সোনা গহনা পেয়েছে, সব লুট করে নিয়ে এসেছে। যুবতী মেয়েদের ধর্ষণ শেষে হত্যা করেছে এই দেশের মানুষই। তারা কি মুসলমান না কি অন্য কেউ। কারা এসব জঘন্য কাজ করতে পারে? জানিনা, আজ মুসলমানের শত্রু কি অমুসলিমরা শুধু, নাকি মুসলমানও। বিশ্ব বাজারে আজ পরিসংখ্যানে যত মুসলিম পাওয়া যায়, অতীতে কখনোই সংখ্যায় এত মুসলমান ছিল না। শহরের কোরবানীর গুরুর হাটে যত মুসলমান দেখা যায়, ঐ হাটে-ই মসজিদে কিন্তু অত মুসলমান দেখা যায় না। হোক সেটা মাগরিবের নামাজ বা জুমার নামাজ। যেটা জামাত ছাড়া আদায় করার কোন বিকল্প ব্যবস্থা নেই। অর্থাৎ-ভাল ধারণা রেখে আপনি বলবেন যে, এরা হয়তো একেকজনে আলাদা আলাদা জুমার নামাজ পড়ে নিয়েছে বা নিবে। কুরবানীর পশুর হাটেই দেখবেন জুমার নামাজের ইকামত আরম্ভ হয়েছে কিন্তু হাটের মধ্যে ভীড় সামান্যও কমেনি। এরা সবাই মুসলমান। ইবরাহীম আ. এর মত পরীক্ষা দিতে দিতে এখন পুত্রকে কুরবানী করার মত কঠিন ও ফাইনাল পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছে। তাই হাজার হাজার মুসলমান জুমা বা মাগরিবের নামাজ বাদ দিয়ে গরু কেনা বেচা করছে। এ সময় নামাজে দু’ এক কাতার লোক বাড়তে পারে হয়তো কিন্ত হাটের সব মুসলমানকে যদি মাগরিব পড়তে হয়, তাহলে প্রতিটি মসজিদে অন্তত ৫/৬ বার কিংবা তারও অধিকবার জামাত অনুষ্ঠিত করেও শেষ করা যাবেনা- এতে সন্দেহ নেই। আপনার সন্দেহ থাকলে একটা কাজ করতে পারেন। হাটের সব প্রবেশ পথ বন্ধ করে দিয়ে মসজিদে ঘোষণা দেন যে, এখন যারা হাটে উপস্থিত সবাইকে পেট ভরে বিরানি খাওয়ানো হবে। দেখেন সবাইকে মসজিদে বসে খাওয়াতে গেলে কতগুলি বৈঠক লাগে। ঠিক ততগুলো বৈঠক (জামাত) লাগবে মাগরিব সবাই পড়লে। আজ মনে প্রশ্ন জাগে, বিশ্বের এত মুসলমান কি শুধু গরু খাবার জন্য? আমাদের আর কোন দায়িত্ব, চেতনা, কাণ্ডজ্ঞান নেই? দেশে দেশে মুসলিম হত্যা-যজ্ঞের দৃশ্য দেখে নীরব থাকার দায়িত্ব আমাদেরকে কে দিল? বিশ্বের মুসলিম নেতৃবৃন্দ কি কানে শুনে না মুসলমানদের হাহাকার? তারা কি চোখে দেখেনা মুসলমানদের লাশ ও কান্না? তাদের নাকে কি প্রবেশ করে না মুসলমানের লাশের গন্ধ?

Comments

comments