হঠাৎ কেউ এসে যখন বায়না ধরে ‘জামী ভাই, আমাকে কবিতা লেখার নিয়মগুলো শিখিয়ে দিন তো’, সত্যি তখন নিজেকে বিপদগ্রস্ত মনে হয়। কারণ কবিতা লেখার জন্য যারা নিয়মের অপেক্ষা করে, তাদের ভেতরে সাধারণত কবিতা থাকে না। কবিতা এক শক্তি; কবির ভেতর থেকে প্রথমে এই শক্তি কাগজে লাফিযে় পডে়, তারপর আশ্রয় খোঁজে, অতঃপর সে নিজেকে গুছিযে় নিতে উদ্যত হয়। তখনই আসে নিয়ম-অনিয়মের প্রশ্ন। সাহিত্যের সব শাখার ব্যাপারেই মনে হয় এ কথা সত্য। কিন্তু এই ধারাবাহিকতা ভঙ্গ করে নিয়মের প্রশ্নই যখন প্রথমে এসে যায়, সেটা হয় লেখালেখির ক্ষেত্রে বড় রকমের অনিয়ম। এখন প্রশ্নকারীকে তো এটা বলা যাবে না ‘তুমি অনিয়ম করেছ’; তাছাড়া সবার অবস্থা এক রকম নয়, হতে পারে সকলের অগোচরে পঙ্ক্তিতে-পঙ্ক্তিতে তার ডাযে়রির পাতাগুলো ভারী হযে় আছে কারুর উন্মোচনের অপেক্ষায়; এমতাবস্থায় তার আত্মপ্রকাশের ব্যাগ্রতাকে প্রশ্রয় না দিয়ে থামিয়ে দেয়ার চেষ্টা কি সমর্থনযোগ্য? অনেকে অবশ্য বলেন, ‘ঘাটে-বাটে যার-তার কাব্যবিলাস দিযে় এ-জাতির হবেটা কি? মাযে়র উদর থেকে কাব্যপ্রতিভা নিযে় এল না, গাযে়র জোরে এখন সে কবি!’ আমি নিজেও অর্থহীন কাব্যবিলাসের পক্ষে নই; কিন্তু নতুন-কাঁচাদের এই আবেগের কোন অর্থ আছে কি-না, একটু বিচার করে দেখা উচিত। হতাশার বাণী সবাই শোনাতে পারে; আশার আলো খুঁজে বার করতে পারেন ক’জন? একজন প্রতিশ্রুতিশীল কবির দায়বদ্ধতা এখানেই। আমি শব্দসাধক কবির কথা বলছি না, কাব্য ও সুন্দরের সাধক যে কবি, তার কথাই বলছি। অনেক পঙ্ক্তি-লেখককে দেখেছি, নিজের কবিতার শব্দে-শব্দে তিনি নেচে ওঠেন; অন্যের কবিতা যত ভাল হোক, তা নিযে় তার বিশেষ কৌতুহল বা আবেগ থাকে না। বাধ্য হলেই কেবল অন্যের কবিতা মূল্যায়ন করেন। আবার অনেক কবিতা-লেখক আছেন, যারা অন্ত্যমিল-সম্বলিত কবিতার ব্যাপারে নিরাসক্ত বা বিরক্ত। পরে খোঁজ নিযে় দেখেছি, অন্তমিল সৃষ্টিতে তিনি তারা পুরোপুরি অক্ষম। আধুনিক কবিতা বলতেই তারা বোঝেন গদ্যকবিতাকে। জানতে চেযে়ছি, আধুনিক কবিতার বৈশিষ্ট্য কি? প্যাঁচাপেঁচি করে যা বলেছেন, তাতে অস্পষ্টতা আর দুর্বোধ্যতা ছাড়া কিছু পাওয়া যায়নি। কাজেই নবীনদের আবেগকে মূল্য দিযে় এগিযে় নেয়ার, এমনকি দুটো পরামর্শ দিযে় সহযোগিতা করার মত যোগ্য, দরদী ও দাযি়ত্ববোধ-সম্পন্ন লোকের বড়ই অভাব। আমি বলি না, আমার এই প্রবন্ধটি পড়লে রাতারাতি সে অভাব ঘুচে যাবে। তাছাড়া বয়স এবং যোগ্যতা সব মিলিযে় এ দাযি়ত্ব আমাকে মানায়ও না। তবুও কিছুটা আন্তরিকতা ব্যয় করা যেতে পারে। একজন লেখকের চলার পথে কি কি দরকার হয়? জর্জ বার্নার্ড শ’-এর মতে, পঁচিশ ভাগ থাকতে হয় প্রতিভা বা মগজের ক্ষমতা, পঁচিশ ভাগ সাধনা আর বাকি পঞ্চাশ ভাগ পাঠকের উৎসাহ। এই তিনটি জিনিসেরও আগে থাকতে হয় আত্মপ্রকাশ তথা নিজের চিন্তা-চেতনাকে প্রকাশ, প্রচার, প্রসার ও প্রতিষ্ঠা করার ব্যাকুলতা। আত্মপ্রকাশের বাসনা না থাকলে কেউ লেখক হতে পারবে না। অতএব, লেখাটি লিখে প্রকাশ করার ব্যবস্থা নিতে হবে। সংশোধনের দরকার হলে যোগ্য কাউকে দিযে় লেখাটিকে শুধরে নেয়া যেতে পারে। বারবার পডে় নিজের কানকে শোনানো যেতে পারে। অরুচিকর শব্দ, অপাঙ্ক্তেয় বাক্য এবং পঠনের জটিলতা দূর করে লেখাটিকে সুখপাঠ্য, শ্রুতিমধুর ও আকর্ষণীয় করে তুলতে হবে। চিন্তা করে দেখতে হবে, লেখাটিতে পাঠকদের পাওয়ার কিছু আছে কি না। লেখার সময় খেয়াল রাখা উচিত আমি লেখাটি যাদের জন্য লিখি, তাদের উপযোগী শব্দ, বাক্য, বক্তব্য, উপমা এবং উপস্থাপনা হযে়ছে কি? ২. হযে় থাকলে এবার পত্রিকার অফিসে পাঠান। ছাপা না হলে ঘাবড়াবেন না। ওর চেযে়ও সুন্দর একটা লেখা পাঠানোর চেষ্টা করুন। আর খেয়াল রাখুন, যে পত্রিকার যে-কলামে লেখাটি পাঠিযে়ছেন, লেখাটি তার মেজাযমত হযে়ছে তো? ৩. দু’/ তিনটি লেখা ছাপা হলেই নিজেকে লেখক ভাববেন না। মনে রাখবেন, দু’-পাঁচটা লেখা ছাপা হওয়া আর লেখক হওয়া এক কথা নয়। জাতির জন্য, পৃথিবীর জন্য এবং সর্বোপরি পৃথিবীবাসীর জন্য যারা জীবন বাজি রেখে প্রতিটি দিন লিখে যায় এবং ভেবে যায়, তারাই লেখক। তাছাড়া জর্জ বার্নার্ড শ’ যে পঞ্চাশ ভাগ উৎসাহের কথা বলেছেন, তা কিন্তু ব্যাপকহারে লেখাপ্রকাশ ছাড়া পাওয়া সম্ভব নয়। ৪. অবিরাম ঘাঁটাঘাঁটি করুন, সাধনা করুন। নিবিড় এবং গভীর অধ্যয়ন ছাড়া কলমে খুব ভাল কিছু আসতে পারে না। প্রতিভা ও চিন্তার নিজস্ব রসদ এক সময় ফুরিযে় যাবেই। ইতিহাস খুঁটে-খুঁটে দেখুন, ওর আলোকে জাতিকে বোঝান, জাতি বুঝবে। ইতিহাস-ঐতিহ্য দিযে় আঘাত করলে জাতির ঘুম যত সহজে ভাঙে, চেতনা যত সহজে ফিরে আসে, অন্য কিছুতেই তেমনটা ঘটে না। আপনি ইতিহাসের তথ্যটি জানেন না, চলমান পৃথিবীর ঘটমান তথ্য সম্বন্ধে বেখবর, তাহলে তথ্য ঘেঁটে তত্ত্ব বের করবেন কিভাবে? ৫. আপনার তথ্য এবং তত্ত্বটিকে সুন্দর উপস্থাপনা, সহজ ভাষা, আকর্ষণীয় শব্দ, পাঠকঘনিষ্ঠ ধারালো যুক্তি এবং সহজবোধ্য উদাহরণ দিযে় পেশ করুন। আপনার চরম শত্রুও দেখবেন পরম আগ্রহ নিযে় আপনাকে পাঠ করবে। ৬. যাকে দিযে় আপনি হতাশা পান, সে যে-ই হোক তাকে এডি়যে় চলুন। ৭. সাহিত্যের আড্ডায় যান। কবিতার ভাষা দিযে়, কবিতার ছন্দ দিযে় মানুষের আপন হযে় উঠুন। সাধ্য থাকলে নিজেই সাহিত্যচর্চার নতুন নতুন ক্ষেত্র আবিষ্কার করুন। আপনার সামনে যত আযে়াজন আসে, পারলে প্রতিটিতে নিজেকে উপস্থিত করুন। আপনার পাঠক, ভক্ত শুভার্থী ও গুণগ্রাহীর সংখ্যা বাড়বে এবং আপনার বই বের হলে চলবে। মনে রাখবেন, বইযে়র ক্রেতা না পেলে আপনি যত বড় লেখকই হোন, লেখকসত্তা হিসেবে বেঁচে থাকা আপনার জন্য মুশকিল হবে। ৮. কেউ আপনাকে বুদ্ধি-পরামর্শ অথবা স্বতঃস্ফূর্ত সহযোগিতা দিযে় এগিযে় নেবে এমন আশা করবেন না। পৃথিবীতে অমন মানুষ দুর্লভ। সুতরাং সমস্ত প্রতিকূলতা এবং অসহযোগের মোকাবেলা করে আপন পাযে় দাঁড়ান। নিজের লেখনীশক্তিকে তুলে ধরুন সব বয়সের পাঠকের সামনে। ৯. লেখার ভেতরে নতুন কিছু, আনকমন কিছু পরিবেশন করুন। আপনার বক্তব্যটা কিভাবে উপস্থাপন করলে চমৎকারিত্ব সৃষ্টি হবে, লেখার আগে সে-বিষযে় ভেবে নিন। ১০. লেখার বন্ধন সুন্দর হল কি না, খেয়াল করুন। লেখাটি পড়তে গিযে় যেন হোঁচট খেতে না হয়। পাঠক এক প্যারা থেকে অন্য প্যারায় চলে যেতে অর্থ বা ভাবের কোন অসামঞ্জস্য যেন অনুভব না করেন। পড়ার সময় পরবর্তী বাক্য যেন পাঠককে চুম্বকের মত টানতে থাকে। এই টানাটনির ভেতর দিযে়ই এক ধরনের গতির সৃষ্টি হয়, যে গতিশীলতা সাহিত্যকে সার্থক করে তোলে। পাঠকের নিশ্চল অন্তরকে সচল করতে গতিশীল ভাষার ভূমিকা অব্যর্থ ঔষধের কাজ করে। ১১. লেখক হওয়ার যত প্রেসক্রিপশনই করা হোক, সবচেযে় সুন্দর চিকিৎসা হচ্ছে অধ্যয়ন। অধ্যয়ন, অধ্যয়ন এবং অধ্যয়ন। সাধনা, সাধনা এবং সাধনা। ‘মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পাতন। ’ আপনি মানুষকে জ্ঞান দিতে চান? উপলব্ধি দিতে চান? চৈতন্য দিতে চান? শেখাতে চান? মনে রাখবেন, সেজন্যে আপনাকে প্রথমে শিখতে হবে, উপলব্ধি করতে হবে, আত্মসচেতন হতে হবে। তারপরে সচেতন করতে পারবেন। কিন্তু এগুলোর একটিও কি অধ্যয়নকে বাদ দিযে় চলবে? আপনি লোকমান হেকীমকে পাচ্ছেন না, তাঁর হেকমত কার কাছ থেকে শিখবেন? সক্রেটিসকে কে এসে আপনার সামনে তুলে ধরবে? মিশরীয়-ব্যাবিলনীয় সভ্যতার জ্ঞান আপনাকে কে দেবে? নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুশিক্ষা আপনি কোত্থেকে লাভ করবেন? আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব কোথায় পাবেন? গাযালীর (রহ.) দর্শনজগতে কি করে হাঁটবেন? ইসলামের জবাব ‘পড়। পড় এবং তোমার প্রভু মহামহিম, যিনি কলমের মাধ্যমে শিখিযে়ছেন। ’ দোলনা থেকে কবর অবধি শিক্ষাকে ইসলাম পরমভাবে উৎসাহিত করেছে। মনীষী বলেছেন, ‘জীবনে তিনটি জিনিস দরকার : বই, বই এবং বই’। আরেক মনীষী বলেছেন, ‘প্রতিভা বলতে আমি কিছু বুঝি না। আমি বুঝি অধ্যবসায়’। শিক্ষাগুরুর শেখানোর একটা গণ্ডি আছে, সীমাবদ্ধতা আছে। সীমাবদ্ধতা আছে সুযোগেরও। তাই বলে শিক্ষার্থীর শিক্ষা থেমে থাকতে পারে না। জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে তার অধ্যয়ন চলতে থাকবে বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর, সবার আমি ছাত্র/ শিখছি এসব কৌতুহলে নেই দ্বিধা-লেশ মাত্র। সুনির্মল বসু এই কৌতুহল না থাকলে মানুষ কোনদিন বড় হতে পারে না। বলা হযে়ছে, ‘সুশিক্ষিত ব্যক্তিমাত্রই স্বশিক্ষিত’ প্রমথ চৌধুরী। আর সাহিত্যের ব্যাপারে তো স্বীকৃত সত্য, সাহিত্যের শিক্ষক হয় না; সাধনা বা স্বশিক্ষাই এখানে প্রধান সমাধান। সুতরাং কবিতা লিখতে চান তো কবিতা পড়–ন, ব্যাপকভাবে পড়ুন। ছন্দ-অলংকারের ব্যাকরণ খুব জরুরি না; জরুরি হচ্ছে প্রখর উপলব্ধিশক্তি এবং গভীর অধ্যয়ন। সময়কে অধ্যয়ন করুন। এই সমযে় কারা ভাল লিখছেন, কার লেখা কতটা ভাল, সে সংক্রান্ত ধারণা আপনার থাকতে হবে। ভাল কবিরা কবিতায় একটা চমৎকার কথা কিভাবে লিখলেন, হৃদয়কাড়া একটি উপমা কখন ব্যবহার করলেন, কি কারণে পঙ্ক্তি বা উপমাটি কালজয়ী হল, চিন্তাশক্তি ব্যয় করে এসব আত্মস্থ করুন। কবিতাটি লিখতে গিযে় কি দিযে় শুরু করা হযে়ছে এবং কিভাবে শেষ করা হল, তা মাথায় নিন। এবার চেষ্টা করে দেখুন, আপনিও পারেন কি না। গল্প-প্রবন্ধের ব্যাপারেও একই কথা যা লিখবেন, সে ধরনের লেখা পড়ুন, নিবিড়ভাবে পড়–ন। অবশেষে বলতে চাই, সাহিত্যরচনা পরোপকার এবং সামাজিক দাযি়ত্ববোধ থেকে এলেও আগ্রহ এবং আনন্দবোধই লেখকের চালিকাশক্তি। আঠার মত লেগে না থাকলে সাহিত্য তার লেখককে খুব কিছু দেবে না। অতএব, পরিকল্পিত পরিশ্রম আর অবিরাম খাটুনি দিতে যারা স্বেচ্ছায়-সানন্দে রাজি, তারাই আগামী দিনের লেখক। বাদ বাকি সবাই ঝরে পড়বে।
Comments
comments