আউলিয়ায়ে কেরাম

মাওলানা মুহিউদ্দীন খান (র.) সিরাত সাহিত্যে তাঁর অনন্য অবদান ও সুনিপুন রচনাশৈলী

By mumin

August 25, 2016

‘সিরাত’ আরবি শব্দটি দ্বারা সাধারণভাবে জীবন-চরিত্র বা জীবনাদর্শ বোঝানো হলেও বিশেষভাবে বোঝায় মহানবি (স.) এর জীবন ও আদর্শ। সত্যি বলতে কি, বাংলা সাহিত্য জগতে এ শব্দটি যথেষ্ট পরিচিত নয়। মাওলানা মুহিউদ্দীন খানের ইসলামের সেবায় বহুমুখী অবদানের মধ্যে সিরাত চর্চাই সর্বাগ্রে। সিরাত প্রতিষ্ঠাকে তার জীবনের সর্বোচ্চ আরাধ্য বিষয়ই বলা যায়। তিনি এটিকে শিল্পের রূপ দিয়েছেন। এ বিষয়ে তার যত কর্ম ও স্বপ্ন, তাতে এটিকে বলতে হবে সিরাত আন্দোলন। তাঁর আগেও এ বিষয়ে বাংলা ভাষায় অনবদ্য কিছু কাজ হয়েছে। কাজী নজরুলের না’তমালা, গোলাম মোস্তফার ‘বিশ্বনবী’, মুন্সী মেহেরুল্লাহর কাসীদা, আকরাম খাঁর ‘মোস্তফা চরিত্র’সহ অনেক কাজ ইতিহাসে উত্তীর্ণ। এছাড়া রুহুল আমীন খান-এর মতো আরও অনেকে সিরাত বিষয়ক গীতি ও কবিতা যা রচনা করেছেন, তার অনেকাংশই ‘সিরাত-সম্পদ’ হবে হয়ত। সত্যেন্দ্রনাথ, ফররুখ আহমদ, সুফিয়া কামাল, আল মাহমুদের মতো কবিগণও কমবেশি এ আন্দোলনে শরিক হয়েছেন। কিন্তু রচনার উৎকর্ষ, সংখ্যার ব্যাপকতা ও আবেদনের গভীরতায় মাওলানা মুহিউদ্দীন খান এ বিষয়ে আকাশ ভরা তারার মাঝে অদ্বিতীয় চন্দ্রের মতো। মহানবি (স.)-এর প্রতি অতি উচ্চমাত্রার ভক্তি ও দরদ না থাকলে তাঁর দ্বারা এসব সম্ভব হতো না। তিনি বায়তুল মোকাররমে সিরাত মজলিশ করতেন। অতি সমাদৃত তার যে মাসিক পত্রিকাটি প্রকাশ করে আসছেন, তার নাম রেখেছেন-‘মদীনা’। মদীনার মালিকের প্রতি ‘পাগল’ না হলে এ নাম তিনি রাখতেন না। এ নামের কারণে এ দেশের বাজারে খুব যে কাট্তি হবে, তা মনে করার তেমন যুক্তি ছিল না। আজও মদীনার সিরাত সংখ্যাগুলো তার সিরাত আন্দোলনের সাক্ষী। এমনকি পরবর্তীকালে অনেক মাসিকই বিশেষ সিরাত সংখ্যা বের করেছে। অর্থাৎ সিরাত সংখ্যা একটি উৎসব হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তিনি মদীনার দুর্লভ ছবি সংগ্রহ করে ‘সিরাত এলবাম’ ছাপিয়েছেন। সিরাত বিষয়ে তার রচিত এবং বেশিরভাগ অনুদিত বইগুলোর নামকরণে প্রিয় নবির মহব্বতেরই সুগদ্ধি ছড়ায়। অসংখ্য পাঠক সাক্ষী; যারা তার বই কিনে রাসূল (স.) কে স্বপ্নে দেখেছেন কিংবা স্বপ্নে রাসূল (স.) কর্তৃক নির্দেশিত হয়েই তার বই কিনতে এসেছেন। এখন বুঝতে হবে আল্লাহ ও রাসূলের কাছে তাঁর অবস্থান কী এবং মানুষের কাছে তাঁর মূল্যায়ন কেমন। কেন তাঁর এতো মাকবুলিয়াত? কী আছে তাঁর বইয়ে? কেন পাঠকের এতে আস্থা? এসব প্রশ্নের জবাব পেতে তাঁর অন্তত : একটি বই হলেও পড়ে দেখতে হবে। তাঁর রচনা ও অনুবাদের সংখ্যা তিনশ’র বেশি। তবে কোনটি বেশি উৎকৃষ্ট আর কোনটি কম, তার পার্থক্য করাও সাদা চোখে সম্ভব নয়। অর্থাৎ, আমার মতে, ইশকে নববীর নূরের রৌশনীতে তার প্রতিটি বইই জ্বলজ্বলে। স্বপ্নযোগে রাসূলুল্লাহ (স.) শাওয়াহেদুন নবুওয়াত, খাসায়েসুল কুবরা ইত্যাদি বইগুলো সিরাত সাহিত্যের দালীলিক স্তম্ভ হয়ে থাকবে। তবে তার ‘মাআরেফুল কুরআন’ এর অনুবাদই আমার মতে, সিরাতের শ্রেষ্ঠ কর্ম। এই তাফসীরটি এতটাই আধুনিক অথচ আধ্যাত্মিক রসাভিষিক্ত, এত বেশি সামগ্রিক অথচ সংক্ষেপিত এবং এতটাই সুলভ ও সহজবোধ্য যে, এটি আলেম শ্রেণি শুধু নয়; বরং সাধারণ শিক্ষিত গণমানুষের পাঠ্যে পরিণত হয়েছে। হজরত আয়েশা (রা.) এর সূত্রানুসারেই আমি এটিকে সিরাতকর্ম বলছি। তাঁর মতে, কুরআনই রাসূলের চরিত্র। এ সমাজে সাধারণত : ইসলামী ব্যক্তিত্বকে সাহিত্যিক বলা হয় না। যদি একটু মুখ খুলে বলি, ‘কাঠপেন্সিল’ বা ‘রঙপেন্সিল’ লিখে হুমায়ুন আহমেদের যেমন গুরুত্ব বা সুনাম, ‘জীবনের খেলা ঘরে’ লিখে মুহিউদ্দীন খানের তেমন সাড়া দৃশ্যমান নয়। সাহিত্য বিশারদ আব্দুল করীম এর আশংকাই সত্য-‘আমাদের সমাজে এমনও লোক রয়েছে, যারা মনে করে, ইসলাম নিয়ে সাহিত্য রচনা সম্ভব নয়।’ যথাযথ স্বীকৃতি না দেয়ার এই যে রোগ, কবে কীভাবে তা নিরাময় হবে জানি না। মুহিউদ্দীন খানের রচনার অলংকারের কারণেই তা সাহিত্য। তার রচনা কিংবা অনুবাদ দু’টোই ছিল সহজবোধ্য। অনেকের ধারণা, কুরআন এতটাই ভারি যে, তার অনুবাদে ও ভারি ভারি শব্দ ব্যবহার করতে হবে। অথচ এই ভারি পর্বত-কাঁপানো কুরআন আল্লাহপাক মানুষকে বুঝে ও চিন্তা করে আমল করার জন্যই নাজিল করেছেন, সেজন্যই তা সহজবোধ্য ভাষায় অনুবাদ ও ব্যাখ্যা করা উচিত বৈ কি! তর্কটা আসলে ভারি আর সহজ নিয়ে নয়; বরং মানানসই হতে হবে। এই মানানসই শব্দ চয়নে খান সাহেবের পরিপক্ক হাত ছিল। এরূপ মানানসই করার জন্য প্রয়োজনে শাব্দিক অর্থ না নিয়ে ভাবার্থ ব্যবহার করতেও তার সংকোচ ছিল না। যেমন ধরুন-আয যাহরাতু শব্দটির আভিধানিক অর্থ ফুলসমূহ। আল্লামা আব্দুর রহমান আল-কাশগরীর এই নামে একটি আরবি কাব্য ছিল, খান সাহেব তার অনুবাদ করলেন ফুলের মেলা। নিশ্চয় এখানে ‘মেলা’ ব্যবহার করে যে দৃশ্য পাঠকের চোখে হাজির করা যায় ‘ফুলসমূহ’ বললে তা হয় না। এটুকুই শিল্পের সার্থকতা। তাঁর একটি বইয়ের নাম ‘হৃদয়তীর্থ মদীনার পথে’। প্রশ্ন উঠেছিল, হিন্দুবাদী শব্দ ‘তীর্থ’ নিলেন কেন? তার সহজ উত্তর ছিল এরকম যে, এখানে তীর্থ বললে যে আবেগ সৃষ্টি হয়, ‘হৃদয়খানা’ বললে তা হয় না। অতএব, জল নাকি পানি, নেমক নাকি লবন-এ নিয়ে তার সিদ্ধান্ত ছিল, শিরক হতে পারে এমন শব্দ বাদ দিয়ে অন্যসব কমন শব্দসম্পদ আমরা হিন্দুদের ছেড়ে দিব না। ধরুন, জলবায়ুর স্থানে পানিবায়ু আর নেমকহারাম এর জায়গায় লবন হারাম বললে তাতে শিল্প থাকবে না। অন্তর নিংড়ে দোয়া বেরিয়ে আসে এই মহামনীষীর জন্য, যার এই সিরাত আন্দোলন না হলে কোনোদিন আমাদের রাত পোহাতো না। পিলখানা ১৮.০৭.১৬

Comments

comments