নবী ও রাসুল

মহানবীর সত্যবাদিতা : কাফিরদের স্বীকারোক্তি

By lazy-coder

February 05, 2014

নবী-রাসুলগণ আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের মনোনীত বিশেষ কাফেলা। আল্লাহ তা‘আলা তাদের মধ্যে উত্তম গুণাবলীর সমাবেশ ঘটিযে় তাদের মানবজাতির সামনে আদর্শ হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। নবী-রাসূলগণকে আল্লাহ প্রদত্ত উত্তম গুণাবলীর মধ্যে সবচেযে় গুরুত্বপূর্ণ হলো আস-সিদক তথা সততা-সত্যবাদিতা। সকল নবী রাসূলগণ এ মৌলিক চরিত্রে চরিত্রবান ছিলেন। মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ ক্ষেত্রে সর্বোত্তমভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত ছিলেন। তাঁর সত্যবাদিতা ছিল সর্বজনবিদিত। শত্রু-মিত্র নির্বিশেষে সকলেই তাঁকে সত্যবাদী হিসেবে স্বীকার করতে বাধ্য হযে়ছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জন্মের পর থেকে তাঁর শৈশব-কৈশোর, যৌবন কিংবা বার্ধক্যে কোনোদিন কখনো কোনো মিথ্যা কথা বলেননি। বরং চরম বিপদের সময়ও তিনি সর্বদা সত্য কথা বলতেন। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সত্যবাদিতার বিষয় এতই সুপ্রসিদ্ধ যে, জাহিলিয়াতের যুগে মানুষ একে অন্যকে যেখানে সামান্যতমও বিশ্বাস করত না সেখানে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ‘আল-আমীন’, ‘আস-সাদিক’ উপাধিতে ভূষিত হযে়ছিলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বীয় সত্যবাদিতার বলে নবুওয়াত প্রকাশের পূর্বে আরবের বিভিন্ন বিচার-ফয়সালার দাযি়ত্ব প্রাপ্ত হযে়ছিলেন। এমনকি কুরাইশগণ কর্তৃক কা’বা ঘর নির্মানের পর হাজরে আসওয়াদ প্রতিস্থাপনকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট বিরোধের সমাধান তিনিই করেছিলেন। হাজরে আসওয়াদ যথাস্থানে প্রতিস্থাপন নিযে় যখন বিভিন্ন আরবের গোত্রের মধ্যে বিরোধ বাধে এবং ব্যাপক উত্তেজনা সৃষ্টি হয় তখন সিদ্ধান্ত গৃহীত হযে়ছিল যে, আগামীকাল সর্বপ্রথম যে ব্যক্তি কা’বা ঘরে প্রবেশ করবে তার ফয়সালা সকলে মেনে নিবে। পরদিন দেখা গেল কা’বাগৃহের প্রথম প্রবেশকারী হলেন আরবের ‘আল আমীন’ হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। তারা তাদের ‘আল আমীন’ মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে সর্বপ্রথম কা’বাগৃহে প্রবেশ করতে দেখে বলে উঠছিলো-এই যে আল আমীন! তিনি আমাদের মধ্যে যে ফয়সালা করবেন আমরা তাই মেনে নেব। (তাবাকাতে ইবনে সাদ) নবুওয়াত প্রকাশের পর মক্কার কাফির মুশরিকরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উপর ঈমান না আনলেও তাঁর সত্যবাদিতার বিষযে় তারা সম্পূর্ণ আস্থাশীল ছিল। তাদের মধ্যে যারা পূর্ব থেকেই তাঁর সম্বন্ধে জানত তারা তাঁকে কখনো মিথ্যবাদী বলেনি। তিনি যখন ইসলামের দাওয়াত দেন তখন তারা মনে করেছিল হয়তো তাঁর বুদ্ধিবিভ্রম ঘটেছে কিংবা কবিত্বভাব ফুটে উঠেছে। এ কারণে তাঁকে তারা ‘মাজনুন’ বলে আখ্যাযি়ত করল, কিন্তু মিথ্যাবাদী বলেনি। যখন আল-কুরআনের আয়াত ‘আপনার নিকটাত্মীয়দের ভয় প্রদর্শন করুন’ অবতীর্ণ হলো তখন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কাবাসীকে সাফা পাহাডে়র পাদদেশে জমাযে়ত করে বললেন- ‘যদি আমি বলি এ পাহাডে়র পাদদেশে একদল আশ্বরোহী সৈন্য তোমাদের উপর হামলা করার জন্য ওঁৎ পেতে বসে আছে তাহলে তোমরা কি তা বিশ্বাস করবে?’ সবাই জবাব দিল ‘হ্যাঁ, কেননা, আমরা তোমাকে কখনো মিথ্যা বলতে শুনিনি’। (বুখারী শরীফ) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আনীত দীন ইসলামকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার জন্য কাফির কুরায়শরা সমযে় সমযে় নানাবিধ চেষ্টা করলেও কেউ তাকে মিথ্যাবাদী বলার দুঃসাহস দেখায়নি। ইসলাম গ্রহণের আগে আবূ সুফিয়ান যখন মুসলমানদের ঘোর শত্রু ছিলেন তখনও তিনি রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াসের সামনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সত্যবাদিতার সাক্ষী দিযে়ছিলেন। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, আবূ সুফিয়ান ইবনে হারব তাকে বলেছেন, বাদশাহ হিরাকল (হিরাক্লিয়াস) একবার তার নিকট লোক পাঠালেন। তিনি তখন ব্যবসা উপলক্ষ্যে কুরায়শ কাফেলার সাথে সিরিয়ায় ছিলেন। সে সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবূ সুফিয়ান ও কুরায়শদের সাথে নির্দিষ্ট সমযে়র জন্য সন্ধিবদ্ধ ছিলেন। আবূ সুফিয়ান তার সঙ্গীদেরসহ হিরাক্লিয়াস-এর দরবারে আসলেন। বাদশাহ হিরাকল (হিরাক্লিয়াস) তখন জেরুজালেমে অবস্থান করছিলেন। তিনি আবূ সুফিয়ান ও তার সাথীদের স্বীয় দরবারে ডাকলেন। সাথে একজন দোভাষীকেও ডাকলেন। এ সময় রোমের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ তার পাশে উপবিষ্ট ছিলেন। বাদশাহ কুরায়শ কাফেলাকে জিজ্ঞাসা করলেন, যে ব্যক্তি নবী বলে দাবি করেন, তোমাদের মধ্যে বংশের দিক দিযে় তার সবচেযে় নিকটাত্মীয় কে? আবূ সুফিয়ান বললেন, বংশের দিক দিযে় আমিই তার নিকটাত্মীয়। এরপর বাদশাহ আবূ সুফিয়ানকে তার নিকটে নিযে় আসতে এবং সঙ্গীদের পেছনে বসিযে় দিতে বললেন। এরপর দোভাষীকে বললেন, তাদের (সঙ্গীদের) বলে দাও, আমি তার কাছে (আবু সুফিয়ানের কাছে) সে ব্যক্তি সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞেস করব, সে যদি আমার কাছে মিথ্যা বলে তবে সাথে সাথে তোমরা তাকে মিথ্যাবাদী বলে প্রকাশ করবে। আবূ সুফিয়ান বলেন, আল্লাহর কসম! তারা আমাকে মিথ্যাবাদী বলে প্রচার করবে এ লজ্জা যদি আমার না থাকত, তবে অবশ্যই আমি তাঁর সম্পর্কে মিথ্যা বলতাম। অতঃপর বাদশাহ তাঁর সম্পর্কে আমাকে প্রশ্ন করেন – ‘তোমাদের মধ্যে তার বংশমর্যাদা কেমন?’ আমি বললাম- ‘তিনি আমাদের মধ্যে অতি সম্ভ্রান্ত বংশের।’ তিনি বললেন- ‘তোমাদের মধ্যে কি কেউ ইতোপূর্বে নবুওয়াতের দাবী করেছে?’ আমি বললাম- ‘না ।’ তিনি বললেন- ‘তার বাপ-দাদাদের মধ্যে কেউ কি বাদশাহ ছিলেন?’ আমি বললাম-‘না।’ তিনি বললেন- ‘সম্ভ্রান্ত লোকেরা তার অনুসরণ করে, না সাধারণ লোকেরা?’ আমি বললাম- ‘সাধারণ লোকেরা।’ তিনি বললেন- ‘তারা সংখ্যায় বাড়ছে, না কমছে?’ আমি বললাম-‘তারা বেডে়ই চলছে।’ তিনি বললেন- ‘তার দীন গ্রহণ করার পর কেউ কি অসন্তুষ্ট হযে় তা পরিত্যাগ করেছে?’ আমি বললাম-‘না,’ তিনি বললেন- ‘নবুওয়াতের দাবির আগে তোমরা কখনও কি তাকে মিথ্যার দাযে় অভিযুক্ত করেছো?’ আমি বললাম- ‘না।’ (বুখারী) দেখুন, তখনকার ইসলামের প্রচণ্ড বিরোধী আবূ সুফিয়ান ইবন হারব-এর স্বীকারোক্তিমূলক বক্তব্য। এ বক্তব্যে তিনি রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে মিথ্যাবাদী বলতে পারেননি। এমনকি তিনি স্বীকার করেছেন নবুওয়াতের আগেও তাঁকে তারা মিথ্যার দাযে় অভিযুক্ত করেননি। আমৃত্যু ইসলামের ঘোরতর শত্রু ছিল আবূ জাহল। একদিন সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দরবারে উপস্থিত হযে় তাঁর সাথে মুসাফাহা করল। এতে মানুষেরা বলতে লাগল, কি হলো, তুমি মুহাম্মদের সাথে মুসাফাহা করলে? তখন সে বলল, আল্লাহর শপথ! আমি জানি, সে সত্য নবী। কিন্তু কি করব? আমরা যে আবদে মনাফ এর সন্তানদের মধ্যে নেতৃস্থানীয়। অর্থাৎ আমাদের নেতৃত্বের কারণে আমরা তাকে নবী বলে স্বীকার করতে পারছি না (বুখারী) কাফির-মুশরিকরা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে সব সময় সত্যবাদী বলে বিশ্বাস করতো। তবে তারা বাপ-দাদার ধর্ম ছেডে় তাঁর আনীত দীনকে গ্রহণ করতে পারেনি। আবূ জাহলের মত কাফির পর্যন্ত বলত হে মুহাম্মদ! আমি তোমাকে মিথ্যাবাদী বলতে পারি না তবে তুমি যা বলছো এগুলো আমি সঠিক বলে মেনে নিতে পারছি না। তখন আল্লাহ তাআলা আয়াত নাযিল করেছিলেন-[হে নবী!] তারা [কাফিররা] আপনাকে মিথ্যবাদী বলছে না বরং এ যালিমরা আল্লাহর নিদর্শনাবলীকে অস্বীকার করছে। (সূরা আল আনআম, আয়াত ৩৩)

Comments

comments