ইসলাম

শবে বরাত

By mumin

April 09, 2020

শব মানে রাত। আর বরাত হলো ভাগ্য। তাহলে শবে বরাত বলতে ভাগ্যের রাত। ১৪ই শা’বান দিবাগত রাত বা ১৫ শা’বানই হলো এই রাত। মুমীনের জন্য এ দিনটি অসীম নেআমতস্বরূপ। সওয়াব অর্জনের ও রহমতপ্রাপ্তির বড় একটি মাধ্যম এই রাত, এতে সন্দেহ করার কোন অবকাশই ইসলাম রাখছে না। কারণ কুরআন কারীমের আয়াতে এ রাতের কথা এসেছে। আর কতগুলো হাদীসে নববী তো আছেই আছে। কুরআনে এ রাতকে বলা হয়েছে লাইলাতুল বারাআত। তাহলে বুঝতে পারলাম-

লাইলাতুল বারাআত হলো আরবী নাম, যার ফারসীতে শবে বরাত হয়। যেমন আরবীতে সালাত, সিয়াম/সওম, মুরশীদ/শাইখ, যার ফারসীতে যথাক্রমে নামাজ, রোজা, পীর।অতএব, একজন আক্বলমান্দের এ কথা বলা কোনভাবেই ঠিক হবে না যে, শবে বরাত, নামাজ, রোজা, পীর ইত্যাদি শব্দগুলো বিদআতী শব্দ কিংবা এগুলোর কোন ভিত্তি নেই শরীয়তে দ্বীনে।সুতরাং শবে বরাত, পীর, নামাজ, রোজা অবশ্যই ইসলামে আছে। সরাসরি নসের মাধ্যমেই সবকিছু মুদাল্লাল ও মুছবাত, যদি ব্যক্তির হৃদয় আক্বল ও জ্ঞানের রোশনীতে আলোকিত থাকে।

যাহোক, আবার শবে বরাত কড়া নেড়েছে আমাদের দ্বারে। আমরা কি সচেতন? দ্বীনের গুরুত্বপূর্ণ হুজ্জত কতটুকু গুরুত্ব পাচ্ছে আমার কাছে? আদৌ কি মূল্যায়ন করছি বা মূল্যায়ন করার মানসিকতা তৈরী হয়েছে? এ রাতের যে অপরিসীম ফজিলত, তা কি জানতে চেয়েছি? কারো কাছে জানতেও চেয়েছি? আমরা মুখে মুখে কত শতবার বলি, ”শবে বরাত আসছে শবে বরাত আসছে”, কিন্তু অন্তর কি কিছু বলে আমাকে? না বললে কিসের এই মুখে মুখে বুলি আওড়ানো? আমি যদি প্রিয় নবীজিকে ভালোবাসতে চাই, এটাকে উছিলাকে করে হলেও ভালোবাসার অর্থকে প্রকৃতভানে সার্থক করতে হবে। সুতরাং আমাদের সচেতন হতে হবে। মনভুলা না হওয়া চাই। এজন্য এই ফেতনা ও বিলাসিতার যুগে শায়খ বা বুযুর্গ ব্যক্তির সোহবতকে এখতিয়ার করতেই হবে, করতেই হবে।

এরপর আসুন জেনে নিই শবে বরাতের কিছু ফজীলত ও করণীয় কিছু সংক্ষেপ বিবরণ। আল্লাহ তাআলার দয়া ও কবুলিয়াত যেন আমাদের ছায়া হয়।

হযরত মুআয ইবনে জাবাল রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন ‘অর্ধ শাবানের রাতে আল্লাহ সৃষ্টির প্রতি দৃষ্টিপাত করেন। অতপর শিরককারী ও বিদ্বেষপোষণকারী ছাড়া তার সমগ্র সৃষ্টিকে ক্ষমা করে দেন।’

আরো একাধিক হাদীসে এ বিষয়টি এসেছে। যেগুলোর সনদ ‘হাসান লিযাতিহী বা হাসান লিগায়রিহী।’ যথা মুসনাদে আহমদের এবং মুসনাদুল বাযযারেরর কিছু হাদিস।

এছাড়া এ রাতের আমল সম্পর্কে ‘শুআবুল ঈমান’বায়হাকীর নিম্নোক্ত হাদীসটি লক্ষণীয়।

হযরত আলা ইবনুল হারিছ রাহ. থেকে বর্ণিত, হযরত আয়েশা রা. বলেন, একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাতে নামাযে দাঁড়ান এবং এত দীর্ঘ সেজদা করেন যে, আমার ধারণা হল তিনি হয়তো মৃত্যু বরণ করেছেন। আমি  তখন উঠে তার বৃদ্ধাঙ্গুলি নাড়া দিলাম। তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুলি নড়ল। যখন তিনি সেজদা থেকে উঠলেন এবং নামায শেষ করলেন তখন আমাকে লক্ষ করে বললেন, হে আয়েশা, অথবা বলেছেন, ও হুমায়রা, তোমার কি এই আশংকা হয়েছে যে, আল্লাহর রাসূল তোমার হক নষ্ট করবেন? আমি উত্তরে বললাম, না, ইয়া রাসূলুল্লাহ। আপনার দীর্ঘ সেজদা থেকে আমার আশংকা হয়েছিল, আপনি মৃত্যুবরণ করেছেন কিনা। নবীজী জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি জান এটা কোন রাত? আমি বললাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ভালো জানেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন ইরশাদ করলেন-‘এটা হল অর্ধ-শাবানের রাত। (শাবানের চৌদ্দ তারিখের দিবাগত রাত।) আল্লাহ তাআলা অর্ধ-শাবানের রাতে তাঁর বান্দার প্রতি মনোযোগ দেন এবং ক্ষমা প্রার্থনাকারীদের ক্ষমা করেন এবং অনুগ্রহপ্রার্থীদের প্রতি অনুগ্রহ করেন আর বিদ্বেষ পোষণকারীদের ছেড়ে দেন তাদের অবস্থাতেই।’-শুআবুল ঈমান, বায়হাকী ৩/৩৮২-৩৮৩ (ইমাম বাইহাকী রাহ. এই হাদীসটি বর্ণনার পর এর সনদের ব্যাপারে বলেছেন- এই হাদিসটি মুরসাল জায়্যিদ।)

বিভিন্ন সহীহ হাদীসে বর্নিত আছে, নবী সা. এ মাসে বেশি বেশি নফল রোযা পালন করতেন। শাবান মাসের রোযা ছিলো তাঁর কাছে সবচেয়ে প্রিয়। এ মাসের প্রথম থেকে ১৫ তারিখ পর্যন্ত এবং কখনো কখনো প্রায় পুরো শাবান মাসই তিনি নফল সিয়াম পালন করতেন। এ বিষয়ে তাকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “এ মাসে রাব্বুল আলামীনের কাছে মানুষের কর্ম উঠানো হয়। আর আমি ভালবাসি যে, আমার রোযা রাখা অবস্থায় আমার আমল উঠানো হোক।” (নাসায়ী)

উক্ত হাদিসগুলোর ভিতরে কিছু ফাজায়েলের বর্ণনা এসে গেছে। যার মাধ্যমে স্পষ্টতই আমরা বুঝতে পারছি যে, কেন এতো গুরুত্বপূর্ণ এই শবে বরাত। তবে অবশ্যই আরো অনেক হাদিস বিদ্যমান।

এ রাতে আমাদের কাজই হলো, বেশি রাবাত সংখ্যক নামাজ পড়া, নামাজের আরকান বিশেষত সেজদাগুলো দীর্ঘ করা, মুনাজাতে মশগুল থাকা, কৃত গুনাহের জন্য ক্ষমা চাওয়া, জীবনের বাকি সময়গুলো সুন্দরভাবে কাটানোর প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করা, কবর জিয়ারত করা। এককথায় সারাটি রাত ইবাদতে কাটিয়ে দেওয়া। এটা তো উপরোক্ত দ্বারাই বুঝা যাচ্ছে। কি কি ইবাদত করতে হবে, এভাবে নির্দিষ্ট করে শরীয়ত আমাদেরকে সীমাবদ্ধ করেনি, বরং এর মধ্যে শামিল হয়ে যাচ্ছে তাহাজ্জুদ, সালাতুত তাসবীহ, দরুদ ও সালাম পাঠ, কুরআন তেলাওয়াত, জিকির, পরেরদিন রোবযা রাখা প্রভৃতি।

তবে কখনোই এই চিন্তা করা যাবে না যে, উপরের সবগুলো আমল আমার করতেই হবে, এগুলো শবে বরাতের আবশ্যক আমল, হালুয়া রুটি বানাতেই হবে; কোনটা বাদ দিলে শবে বরাত পালন করা হবে না। এই ধারণা ভুল। যেটা পারবো, সেটা অন্তর তৃপ্ত হওয়ার মতো করেই করবো, যত বেশি পারি, করবো। যত দীর্ঘ সময় ধরে পারি, করবো। হালুয়া রুটি বানাবো, খাবো, গরীবদের দেবো। বিশেষদিনে তারাও আনন্দ পাক। কিন্তু শবে বরাতের নির্দিষ্ট আমল, এটা ভাবা যাবে না। তবে আমাদের দেশে বাঙালী সংস্তৃতিও বলা চলে এটাকে।

যাহোক, মূল কথা হলো, এ রাতটাই ইবাদতের। বিশেষভাবে ক্ষমা চাওয়ার ও ক্ষমা পাওয়ার এটি অন্যতম রাত। তবে সকল ইবাদতই এ রাতের উছিলায় বিশেষ মর্যাদা পাবে।